সুন্দরী প্রতিযোগিতা চায় মেয়েদের কর্পোরেট যৌনদাসী বানাতে
ব্বার হোসেন
সুন্দরী প্রতিযোগিতা চায় মেয়েদের কর্পোরেট যৌনদাসী বানাতে
এ কেমন প্রতিযোগিতা, যার বিভিন্ন ইভেন্টে শরীরের মাপ দিতে হয়, তাও সে মাপ আবার পুরুষদের নির্ধারিত মাপের ছকেই। স্তনকে বাধ্য করতে হবে ৩৬ ইঞ্চি থাকতে, কোমর হতে হবে ২৬ ইঞ্চি, নিতম্বকেও বেপরোয়া হলে চলবে না, ঠিক ৩৬ ইঞ্চিই চাই তোমার। সভ্যতার এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে, বস্ত্র সভ্যতার এতকাল পেরিয়ে, মঞ্চে হাঁটতে হবে আধ নেংটো হয়ে। ফটোস্যুটের জন্য পোজ দিতে হবে, তাও অর্ধ-উলঙ্গ হয়েই। ব্রা-পেন্টি পরে। দুনিয়াজুড়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় এমনটাই রীতি, যা পুরুষেরা তৈরি করেছে।
আমার ত্বক উজ্জ্বল, চোখ বাদামী, ঠোঁট আকর্ষণীয়- নিজের সম্পর্কে লোকের মুখে এমন মন্তব্য শুনে আমি অভ্যস্থ অনেককাল। নারী-পুরুষ অনেকেই আমার চেহারাও শারীরিক গঠনের সৌন্দর্যে আকর্ষণবোধ করেন, প্রশংসা করেন। এই সৌন্দর্যে আমার কোনো হাত নেই, ভূমিকা নেই। প্রকৃতিপ্রদত্ত। প্রকৃতি একেক মানুষকে একেক রকম করে তৈরি করেছে। এই যে বৈচিত্র্য, এটাই সৌন্দর্য। আমি তো মনে করি, প্রতিটি মানুষই সুন্দর। স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি। এই সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিযোগিতায় কী আছে? যাতে আমার কোনো অর্জন নেই, ভূমিকা নেই, তা কেন হতে যাবে প্রতিযোগিতার বিষয়।
‘আমি চাই মেয়েরা আসুক, মঞ্চে দাঁড়াক, জীবনের মঞ্চে, তবে তা কাপড় খুলে নয়- কাপড় পরে, সম্মান নিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, মানুষের মত।’
মানুষ নিজে চর্চার মধ্যে দিয়ে যা অর্জন করে, জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতিতা তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হতে পারে, এমনটাই হওয়া উচিত সভ্য দুনিয়ায়।
আমি সবসময় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, সুন্দরী প্রতিযোগিতার ঘোর বিরোধী। আমি কোর্ট প্যান্ট পরা একটি মানুষ। হঠাৎ করে আমাকে যদি শরীরের প্রায় সব কাপড় খুলে, শুধু ‘আন্ডারওয়ার’ পরে লোকের সামনে, আলো ঝলমলে মঞ্চে হাঁটতে হয়, নিজেকে আকর্ষণীয় প্রমাণ করতে, কখনও কখনও যেই আন্ডারওয়ারকে যদি আবার ডানে বামে, উপরে নিচে নামিয়ে ছবি তুলতে হয়, ভাবা যায় ব্যাপারটা কী ভয়ঙ্কর! পণ্য সভ্যতার বিকট থাবা থেকে মুক্তি নেই মানুষের। পণ্য মানুষকেও পণ্য করে তোলে তার স্বার্থে। বিক্রি হতে হবে প্রসাধন সামগ্রী। সাবান, শ্যাম্পু, লোমনাশক ক্রিম। সে সব বিক্রি করতে নারীকেও পণ্য করে তোলা হচ্ছে দুনিয়াব্যাপী। নির্ধারিত মাপ দিয়ে দেয়া হচ্ছে মেয়েদের জন্য। স্তনের মাপ, নিতম্বের মাপ।
নির্দিষ্ট ছাচে পড়লেই তুমি সুন্দরী। বিশ্ব সুন্দরী। বোকা বুদ্বু মেয়েরাও ছুটে ‘সেই ফিগার’ গড়ে তুলতে। ‘জিরো ফিগার’ চাই। যে করেই হোক, মাপে আসতে হবে ফিগারকে। প্রয়োজনে ডায়েটিং করো, না খেয়ে থাক। ইউরোপেও যে কত মেয়ে না খেয়ে ‘এনিমিয়া’, ‘বুলিমিয়ার’ মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। পশ্চিমে গত কয়েক বছরে বেশ ক’জন মডেল ওভার ডায়েটিংয়ে মারাও গেছেন। মেয়েরা ছুটছে পার্লারে, জিমে। পার্লার থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েগুলোকে দেখতে মনে হবে, সবাই একই ছাচে গড়া। সুন্দরী প্রতিযোগিতার ‘গ্রুমিং সেশনের’ মেয়েদের মতো, গ্রুমিং শেষে সবাই একই রকমভাবে হাঁটে, বসে, কথা বলে, মনে হয় ‘পাপেট’ এই মেয়েরা সবাই।
মিডিয়া সুন্দরী প্রতিযোগিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও প্রচারে বিভোর সবসময়ই। মিডিয়া ভীষণ নারীবান্ধব, মানবিক সবসময় এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বাণিজ্যিক মিডিয়ার প্রভু পুঁজি। ফলে সে যাকে বিকোতে পারে, যা বিকোনো যায়, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে স্বাভাবিক। পণ্য হিসেবে, নারীর চেয়ে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা আর কোন পণ্যের নিশ্চয়তা আছে? ফলে বাণিজ্যিক মিডিয়া মেধাবী, প্রতিভাবান মেয়েদের চেয়ে অমেধাবী, অপ্রতিভাবানদেরই খোঁজে বেশি। ফলে শুধুমাত্র খোলামেলা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে নায়লা নাইম তারকা হয়। মিডিয়ায় ‘সাহসী মেয়ে’ বলে একটি টার্ম চালু রয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, শরীরসর্বস্ব, গা খোলা মেয়েদের সাহসী বলে সমর্থন জোগাতে।
দাঁত উঁচু, লিকলিকে, স্তনহীন এমন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করলেও তার চেয়ে মেধাশূন্য গা খোলা, ভরাট শরীরের মেয়েদেরই মিডিয়া প্রচার দেয়, দু’দিনেই তারকা বানাতে অস্থির হয়ে ওঠে। আর এই মেয়েরাও খোলামেলা হয়ে, অর্ধ নেংটো হয়ে পোজ দিয়ে, ছবি তুলে নিজেকে ‘কথাকথিত তারকা’ ভেবে এক ধরনের মিথ্যা আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। পর্ন তারকাদেরও যেমন ‘তারকা’ বলে ধারণা দেয়া হয়, নেহাত বাণিজ্যিক কারণে। তারাও যেমন কে কত বেশি যৌন হেনস্থা, যৌন নির্যাতিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে, সেই নিরিখে ‘বড় তারকা’ ভাবে নিজেকে, এই মেয়েরাও তেমনি নিজেকে মূল্যবান ভাবতে থাকে, পুরুষতান্ত্রিকতার ফাঁদে পড়ে।
একটি বারের জন্যও সে ভাবে না, মানুষের মূল্য আসলে কিসে? সে যে একটি যৌনবস্তু হয়ে উঠছে, ভোগ্য বস্তু হয়ে উঠছে, তাতে তার কোনো ভাবাবেগ নেই। প্রতিটি সুন্দরী প্রতিযোগিতা, আয়োজন, আয়োজক কোন না কোন নারী বাণিজ্যের নেটওয়ার্কেও সঙ্গে যুক্ত, এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। পণ্য হতে আসা, কাপড় খুলতে আসা, পতিতা হতে আসা মেয়েদের পুরুষতন্ত্র চিরকালই বুঝিয়েছে- ‘এটা তোমার স্বাধীনতা, এটা নারী স্বাধীনতা, তুমি অনেক বেশি স্বাধীন, তুমি চাইলেই খুলতে পারো, ছুতে পার, শুতে পারো যে কারও সঙ্গে।
স্বাধীনতা ও নারীবাদের অসম্ভব ভুল ব্যাখ্যা এই মেয়েদের মস্তিষ্কের নিউরনে বিল্ট-ইন করে দেয়া হয়েছে নেহাত বাণিজ্যিক স্বার্থে। অথচ নারীবাদ, মানবতাবাদ ও নৈতিকতাবাদ সেটাই, যেটা নারীকে পুরুষতন্ত্রের বাণিজ্যিক চাহিদার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে শেখাবে, আমি নারী, আমি স্বাধীন, আমি সম্পূর্ণ মানুষ। চাইলেই আমি খুলতে বাধ্য নই, আমি বাধ্য নই যাকে তাকে ছুঁতে, যার তার সঙ্গে শুতে। দানবীয় পুঁজির হাতে বন্দি সবাই- মানুষ, মানবিকতা, যৌনতা। তাই প্রাচীন যৌনদাসীর বদলে, আধুনিক চকচকে কর্পোরেট যৌনদাসীই বানাতে চায় কর্পোরেট পুঁজি। নাম দেয় বিউটি হান্ট, ফান্ট নানা কিছু। ভেতরে বাণিজ্য, বাইরে সৌন্দর্য। যৌনবাণিজ্যেই যদি শেষাবধি লক্ষ্য উদ্দেশ্য না হবে তবে ‘ভার্জিনিটি’ই বা খোঁজা কেন?
অসহায়, নির্বুদ্ধিমান মেয়েরা পুঁজি আর পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পড়ে এই সব তথাকথিত প্রতিযোগিতার মঞ্চে এসে দাঁড়ায়।
আমি চাই মেয়েরা আসুক, মঞ্চে দাঁড়াক, জীবনের মঞ্চে, তবে তা কাপড় খুলে নয়- কাপড় পরে, সম্মান নিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, মানুষের মত।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।