মালয় মুভির ভাইরাল সিন এবং ভারতে মুসলিম মোপলা জাতির ইতিহাস
মালয় মুভির ভাইরাল সিন এবং ভারতে মুসলিম মোপলা জাতির ইতিহাস

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরববাসী শুধু বর্বর, কলহপ্রিয় ও রক্তপিপাসু জাতিই ছিল না। বরঞ্চ তাদের মধ্যে যারা ছিল অভিজাত ও বিত্তশালী, তারা জীবিকার্জনের জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। মরুময় দেশে জীবন ধারণের জন্যে খাদ্য এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আবহমান কাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হতো। যে বণিক দল হযরত ইউসূফকে আলাইহিস সালাম কূপ থেকে উদ্ধার করে মিশরের জনৈক অভিজাত রাজকর্মচারীর কাছে বিক্রয় করে, তারা ছিল আরববাসী। অতএব আরববাসীদের ব্যবসায় পেশা ছিল অত্যন্ত প্রাচীন এবং বিস্তৃত ছিল দেশ-দেশান্তর পর্যন্ত।

স্থলপথ পানিপথ উভয় পথেই আরবগণ তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতো। উটের সাহায্যে স্থলপথে এবং নৌযানের সাহায্যে তারা বাণিজ্য কেরার লক্ষ্য দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ করতো। প্রাক ইসলামী যুগেই তারা একদিকে সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া এবং অপরদিকে সসুদূর প্রাচ্য চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসায় ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিল। আরব থেকে সুদূর চীনের মাঝপথে তাদের কয়েকটি সমুদ্রতীরবর্তী একটি জেলা। ভৌগোলিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ উপদ্বীপটিকে মালাবার নামে অভিহিত করা হয়। আরব ভৌগোলিকগণের অনুলিখনে একে মালিবার বলা হয়েছে।


মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেনঃ
“আধুনিক গ্রীকদের মলি (MALI) শব্দে বর্তমান মালাবার নামের উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ ‘মালাবার’ নাম আরববাসী কর্তৃক প্রদত্ত হয় –বিশ্বকোষ সম্পাদকের এই সিদ্ধান্তটা খুবই সংগত। আমাদের মতে মালাবার, আরবী ভাষার শব্দ –মলয়+আবার= মালাবার। আরবী অনুলিখনে মলয়+আবার। মলয় মূলতঃ একটি পর্বতের নাম, আবার অর্থ কুগপুঞ্জ, পানিয়াশয়। আরবরা এদেশকে মা’বারও বলিয়া থাকেন। উহার অর্থ, অতিক্রম করিয়া যাওয়ার স্থল, পারঘাট। আজাকালকার ভূগোলে পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট। যেহেতু আরব বণিক ও নাবিকরা এই ঘাট দুইটি পার হইয়া মাদ্রাজে ও হেজাজ প্রদেশে যাতায়াত করিতেন, এবং মিশর হইতে চীনদেশে ও পথিপার্শ্বস্থ অন্যান্য নগরে বন্দরে যাতায়াত করিতেন। এই নাম দুইটি হইতে ইহাও জানা যাইতেছে, এই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয় অতি পুরাতন এবং সম্বন্ধ ছিল অতি ঘনিষ্ঠ”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস, পৃঃ ৪৭-৪৮)।

হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ায় আগমনের বহুকাল পূর্বে বহুসংখ্যক আরব বণিক এদেশে (মালাবারে) আগমন করেছিলেন। তারা হরহামেশা এ পথ দিয়ে অর্থাৎ মালাবাদের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীন দেশে যাতায়াত করতেন। এভাবে বাংলার চট্টগ্রাম এবং তৎকালীন আসামের সিলেটও তাদের যাতায়াতের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এর থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাক ইসলামী যুগেই মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেট প্রভৃতি স্থানে আরবদের বসতি গড়ে উঠেছিল।


খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের মক্কা নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং চল্লিশ বৎসর বয়সে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে দ্বীন ইসলামের প্রচার কার্য শুরু করেন। তাঁর প্রচার আন্দোলন ছিল অত্যন্ত বিপ্লবাত্মক। এ বিপ্লবের ঢেউ আরব বণিকদের মাধ্যমে মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেট ও চীনদেশেও –যে পৌঁছেছিল, তা না বল্লেও চলে। মালাবারের আরববাসীগণ খুব সম্ভব হিজরী সনের প্রারম্ভেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এটাও এক ঐতিহাসিক সত্য যে, সপ্তম শতক পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়েছিল আরব বণিকদের দ্বারাই।

মালাবারে যেসব আরব মুহাজির ইসলাম গ্রহণ করার পর স্থায়ীভাবে বসবাস করে তারা মোপলা নামে পরিচিত। ছোটো বড়ো নৌকার সাহায্যে মাছ ধরা এবং মাল ও যাত্রী বহন করা ছিল তাদের জীবিকার্জনের প্রধান পেশা। অনেক সময়ে তাদেরকে জীবিকার্জন ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের জণ্য ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আরব দেশে যাতায়াত করতে হতো। এভাবেই তারা ইসলামের বিপ্লবী দাওয়াতের সংস্পর্শে এসেছিল।

তারা ছিল অত্যন্ত কর্মঠ ও অধ্যাবসায়ী। সুন্দর ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল তারা। সাহসিকতায় এরা চিরপ্রসিদ্ধ। এর দাড়ি রাখে এবং মাথায় টুপি পরিধান করে, এদের মধ্যে অনেকেই ধীবর জাতীয় এবং ধীবরদের মধ্যে ইসলামের বাণী প্রচার করা ছিল এদের প্রধান কাজ।

মালাবারের অনারব অধিবাসীদের মধ্যেও ধীরে ধীরে ইসলামের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সেকালে ভারতে বৌদ্ধ এবং জৈন মতাবলম্বীদের উপরে হিন্দু ব্রাক্ষণ্যবাদের নিষ্ঠুর ও অমানুষিক নির্যাতন চলছিল। এসব নির্যাতন উৎপীড়নের মুখে মুসলমান সাধুপুরুষের সাহচর্য ও সান্নিধ্য তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে।

মালাবারের অনারব অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের দ্রুত বিস্তার লাভের প্রধান কারণ মালাবারের স্থানীয় রাজার ইসলাম গ্রহণ। মালাবার-রাজের ইসলাম গ্রহণের চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণিত আছে।

মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর পূর্ব বর্ণিত গ্রন্থে বলেনঃ
হিন্দু সমাজের প্রাচীন শাস্ত্রে ও সাহিত্যে মালাবার সম্বন্ধে কিছু কিছু উল্লেখ দেখা যায়। বিশ্বকোষের সম্পাদক মহাশয় তাহার অনেকগুলি উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেগুলির অধিকাংশই মহাভারত ও পুরাণাদি পুস্তক হইতে উদ্ধৃত পরশুরামের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে মহাভারত ও পুরাণাদি পুস্তক হইতে উদ্ধৃত পরশুরামের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে কতকগুলি উদ্ভট উপকথা ছাড়া আর কিছুই নহে। তবে এই কোষকার নিজে মালাবারের হিন্দুরাজা সম্বন্ধে একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিতেছেনঃ পুরাবৃত্ত পাছে জানা যায় যে, চেরর রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল পেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ অভিলাষে মক্কা গমন করেন –(বিশ্বকোষ-১৪:২৩৪)।

শেখ যয়নুদ্দিন কৃত তোহফাতুল মুজাহেদীন পুস্তকেও একজন রাজার মক্কা গমন, তাঁহার হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেদমতে উপস্থিত হওয়া এবং স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। তাহার এই বর্ণতা হইতে জানা যাইতেছে যে, মালাবারের রাজা-যে মক্কায় সফর করিয়াছিলেন এবং হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেদমতে উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট ইসলামের বয়আত গ্রহণ করিয়াছিলেন, স্থানীয় মুসলমানদিগের মধ্যে ইহাই মশহুর ছিল”।


মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর উক্ত গ্রন্থে আরও মন্তব্য করেনঃ
“স্থানকালাদির খুঁটিনাটি বিষয়ে মতভেদ থাকিলেও এবং সেগুলিকে অবিশ্বাস্য বলিয়া গৃহীত হইলেও রাজার মক্কায় যাওয়ার, হযরতের খেদমতে উপস্থিত হওয়ার এবং কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করার পর দেশে ফিরিয়া আসার জন্য সফর করার

বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার কোন কারণ নাই। মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে একটা দেশের সমস্ত অধিবাসী আবমান কাল হইতে যে ঐতিহ্যকে সমবেতভাবে বহন করিয়া আসিতেছে তাহাকে অনৈতিহাসিক ও ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কোনও মতে বিবেচিত হইতে পারে না। এই প্রসংগে বিশেষভাবে বিবেচ্য হইতেছে বিশ্বকোষের বিবরণটি।

কোষকার বলিতেছেনঃ ‘পুরাবৃত্ত পাছে জানা যায় যে, চেরার (মালাবার) রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল পেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণাবিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করেন’। সুতরাং মালাবার রাজ্যের রাজার স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সিংহাসন ত্যাগ করা এবং হযরতের নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করার বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া আদৌ সংগত হইতে পারে না”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)

মালাবারের আরব মুহাজিরগণের এবং স্থানীয় রাজার ইসলাম গ্রহণের পর স্থানীয় মালাবারবাসীগণও ইসলাম আকৃষ্ট হয় এবং তারা দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হয়। তারপর মালাবরে পরপর দশটি মসজিদ নির্মিত হয়। প্রথম মসজিদ পেরুমলের রাজধানী কর্ণক্রোর (কোড়ঙ্গনূর) বা ক্রাঙ্গানুরে নির্মাণ করেন মালেক ইবনে দীরান। এভাবে ত্রিবাংকোরের অন্তর্গত কুর্কবে, মঈলোর নগরে, ধর্মপত্তন নগরে, চালিয়াম নগরে, সুরুকুন্ডপুরমে, পন্থারিণীতে এবং কঞ্জরকোটে মসজিদ নির্মিত হয়।

“বিশ্বকোষ প্রণেতা বলেনঃ মসজিদ প্রতিষ্ঠার সংগে সংগেই যে এদেশে মুসলমান প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নেই। এই সকল মসজিদের ব্যয়ভার বহনের জন্য অনেক সম্পত্তিও প্রদত্ত হইয়াছিল। ঐ সময়ে উপকূলবাসী

মুসলমানগণের এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত দেশীয় অধিবাসীদিগের সংখ্যায় পরিবৃদ্ধি হইয়াছিল। ক্রমে তাহারা রাজ্য-মধ্যে প্রভাব সম্পন্ন হইয়া উঠে”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)

উপরের আলোচনায় এ সত্য প্রকট হয়ে যায় , খৃষ্টীয় সপ্তম শতকেই ভারতের মালাবার মুসলমানদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। তাদের ছিল না কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।

মালাবারের পরেই মুসলিম আরব মুহাজিরদের বাণিজ্য পথের অন্যান্য মনযিল চট্টগ্রাম ও সিলেটের কথা আসে। মালাবারে আরব মুহাজিরদের স্থায়ী বসবাসের পর তাদের অল্পবিস্তর বসতি গড়ে উছে। এটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মালাবারে যেমন প্রথম হিজরী শতকেই ইসলাম দানা বেধেঁছিল, চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার কি সমসাময়িক কালেই হয়েছিল, না তার অনেক পরে। এ সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবেশন করা সম্ভবপর নয়। তবে খৃষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকে আরবের মুসলমান বণিকদের চট্টগ্রামের সাথে যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে।

ডক্টর আবদুল করিম তাঁর ‘চট্টগ্রামের সংগে আরবীয় মুসলমান বণিকদের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তকালে চট্টগ্রামে আরব ব্যবসায়ীদের আনা-গোনার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব বণিককেরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্যগঠন না করলেও আরবদের যোগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে তাদের প্রভাব এখনও পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহারও আরবী ভাষার প্রভাবের ফল। অনেক চট্টগ্রামী পরিবার আরব বংশদ্ভুত বলে দাবী করে। চট্ট্রগামী লোকের মুখাবয়ব আরবদের অনুরূপ বলেও অনেকে মনে করেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা যেমন, আলকরণ, সুলুক বহর, (সুলুক-উল-বহর), বাকালিয়া ইত্যাদি এখনও আরবী নাম বহন করেন। আগেই বলা হয়েছে যে, কো কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, আরবী শব্দ শৎ ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, চট্টগ্রাম পৃঃ-১)।
ভারতবর্ষে অস্ত্রবলে নয়,ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলাম কবুল করেছেন
ভারতবর্ষে অস্ত্রবলে নয়,ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলাম কবুল করেছেন

ইংরেজরা গোটা ভারতবর্ষ শাসন করার জন্য যে ডিভাইড & রুল পলিসি গ্রহণ করে তার একটা প্রধান অঙ্গ হল ইতিহাস বিকৃতি। “এক হাতে অস্ত্র ও অপর হাতে কুরআন” নামক এই অপবাদ ইতিহাস বিকৃতি থেকে জন্ম নেওয়া একটা বিষাক্ত ফল, যার মারাত্মক বিষে গোটা ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে প্রমাণ করা হবে যে এই অপবাদটি একেবারেই মিথ্যা।

ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মের আগমন ও বিস্তারঃ
ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –
“ আমরা দেখেছি যে মালাবার উপকূলে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির আগে থেকেই আরব বণিকদের বসতি গড়ে উঠেছিল, বাণিজ্যের সমৃব্ধির জন্য শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা তারা বিশেষ জরুরি মনে করত এবং দেশের ভারতীয় শাসকদের এ ব্যাপারে সাহায্য করত। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আরব বণিকদের অসদ্ভাবের কোনও সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় যে নিতান্ত বাস্তব কারণেই উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিল। পরে এই আরবরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তখন থেকে তারা পরিচিত হয় মুসলমান বলে।“ [ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ৯]
উপরের লেখা থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে মুসলিমদের সঙ্গে স্থানীয় অন্য ধর্মের মানুষের সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিল।
সে আরও লেখে–
“ আরব বণিকরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং সেই ইসলামকে কেরালায় নিয়ে আসে, কেরালাস্থিত তাদের পরিবারবর্গের মধ্যে ইসলাম প্রচার করে তখন এ বণিকদের স্থানীয় কর্মচারীরাও, যাদের একটা বড় অংশ বণিকদের জন্য কায়িক শ্রম করত, ইসলামের আদর্শ ও বক্তব্য সম্বন্ধে জানতে পারে। তারা জানতে পারে এমন এক শাস্ত্রের কথা, যাতে বলা হয়েছে – মানুষকে আলাদা আলাদা জাতিতে জন্ম দেওয়া হয়েছে বটে কিন্তু জন্ম দিয়ে নয়, মানুষের বিচার হয় তার স্বভাব-চরিত্র দিয়ে। বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত কেরলের জনসাধারণ ইসলাম ধর্মের মধ্যে মানুষ হিসাবে বাঁচার ডাক শুনতে পেল।“

লেখকের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে বর্ণভেদ প্রথার ছোবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ইসলাম ধর্মকে বেছে নিয়েছিল।

সুরজিৎ দাশগুপ্ত অপর এক জায়গাতে লিখেছে –
“ ব্রাহ্মন্য ধর্মের ব্যবহারিক দিকগুলোর চাপে কেরালার জনসাধারণ যখন মানুষ হিসাবে নিজেদের পরিচয় ভুলতে বসেছে তখন ইসলাম ধর্মের আগমন ও আহ্বান। এই আহ্বানে তারা প্রচণ্ড সাড়া দিল এবং ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল। ‘তুহফাতুল মুজাহিদিন’ এর লেখক জৈনুদ্দিন লিখেছেন, ‘যদি কোন হিন্দু মুসলমান হতো তাহলে অন্যেরা তাকে এই (নিম্নবর্ণে জন্মের) কারণে ঘৃণা করত না, অন্য মুসলিমদের সঙ্গে যে রকম বন্ধুত্ব নিয়ে মিশত, তার সঙ্গেও সেই ভাবে মিশত।‘ মানুষের মূল্য পাবে, সমাজে মানুষের মত ব্যবহার পাবে – এটা ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রধান কারণ।“[ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১২৭]

উপরের লেখা থেকে এটা বোঝা গেল যে নিপীড়িত মানুষকে সন্মান ও মর্যাদা দিয়েছিল ইসলাম ধর্ম, যার কারণে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।


দাশগুপ্ত আরও লিখেছে–“ আগেই বলা হয়েছে যে নিম্ন বর্ণের লোকেদের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হতো। এককালে কেরালাতে অমুকের স্ত্রী বা মেয়ে ইসলাম নিয়েছে বলার দরকারই হতো না, তার বদলে শুধু ‘কুপপায়ামিডুক’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো – কুপপায়ামিডুক শব্দটির অর্থ হল ‘গায়ে জামা চড়িয়েছে’। অপমান-সুচক বা হীনতা-দ্যোতক এ রকম বহু আচার প্রথা ইসলামের প্রভাবে কেরালায় সমাজ থেকে দূরীভূত হয়। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের ফলে দাস প্রথাও বহুল পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত হয়।“ “[ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১৩০]

এখান থেকে আমরা জানতে পারলাম যে মহিলাদের প্রকৃত সন্মান দিয়েছিল ইসলাম ধর্ম, যার কারণে মানুষ ইসলাম ধর্মকে আপন করে নেয়।

দক্ষিণ ভারতে ইসলাম ধর্মের বিস্তারঃ
কেরল ও মালাবার অঞ্চলে বাণিজ্যিক কারণে মুসলমান জাতি সেখানে বসতি স্থাপন করে এবং তারা স্থানীয় অন্য জাতির মানুষের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে থাকে। এই মুসলিম জাতিকে “ মোপলা” বলা হয়। এই অঞ্চলের ব্যবসার চাবিকাঠি ছিল এই মোপলা মুসলিমদের হাতে। ইতিহাসে কোথাও কোথাও এদেরকে মহাপিলাহ, মোইপিলাহ, মোপলাহ ইত্যাদিও নামে অভিহিত করা হয়েছে। মোপলা মুসলিমরা অত্যন্ত সাহসী, সৎ এবং কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন, তাই হিন্দু রাজারা তাদেরকে সৈন্য হিসাবে বাহিনীতে রাখতেন। ব্যবসা ছাড়াও বিশ্বাসভাজন এবং সুদক্ষ সৈন্য হিসাবেও মোপলা মুসলিমরা বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

কালিকটের রাজবংশকে জামোরিন বলা হত এবং জামোরিন রাজবংশের শক্তির উৎস ছিল মোপলা মুসলিমরা। এছাড়া মালাবারের প্রত্যেক হিন্দুরাজা মোপলাদের সৈন্য, দেহরক্ষী অথবা পরামর্শদাতা হিসাবে রাখত এবং ছেলের মতো ভালবাসত। মহাপিলাহ মানে বিখ্যাত পুত্র বা বড় ছেলে।

এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –
“তেমনই মালাবারের রাজারাও ইসলাম ধর্মাবলম্বী দুর্দান্ত জওয়ানদের পুষত এবং আপন আপন রাজ্যে তাদের বসবাসের সুবন্দোবস্ত কর দিত। বড় ছেলের মত এদেরকে খাতির করা হতো বলে এদেরকে মইপিলাহ বা মহাপিলাহ বলা হতো।“ [ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১৩২]

মোপলাদের চারিত্রিক গুণাবলী দেখে মালাবারের অনেক হিন্দু রাজা ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –

“এখানকার কোন কোন রাজবংশ ইসলাম ধর্মের আদর্শে প্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং (তারা) ইসলামের প্রচারে উদ্যোগী হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য ভারতবর্ষের অন্য কোনখানের ইতিহাসে দেখা যায় না। বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত নিম্নবর্ণের লোকেরা মানুষের মর্যাদা পাওয়ার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছে।“[ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১১৩]

সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে পরিস্কার হল যে দক্ষিণ ভারতে মোপলা মুসলিমরা তাদের বীরত্ব ও চরিত্র মাধুর্য দিয়ে সমাজে সন্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে নয়।

বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিস্তারঃ
ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –“আপন সমাজকে সুসংহত করার জন্য হিন্দু নেতারা অনুশাসনাদিকে যতই সংকুচিত করতে থাকলেন ততই তাদের হাত থেকে পরিত্রানের জন্যে একদল, যাদেরকে বলা হয় নির্যাতিত হিন্দু তারা আরও বেশী করে ইসলামের কাছে আশ্রয়প্রার্থী হলো।“[ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ৫৪]

ব্রাহ্মণ্যশক্তি ভারতের বৌদ্ধদের প্রতি এত বেশী অত্যাচার করত তা ভাষায় অবর্ণনীয়। অত্যাচার যখন সহ্যসীমা অতিক্রম করে তখন বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধরা মাথা মুণ্ডন বা নেড়া করতেন, তাই বৌদ্ধদের বলা হত “নেড়ে”। এখনও অনেক অশিক্ষিত ও মূর্খ লোকেরা মুসলমানদের বিদ্রূপ করে “নেড়ে” বলে থাকে। এই “নেড়ে” কথাটি যতদিন থাকবে ততদিন বৌদ্ধদের উপর ভারতীয় হিন্দুদের অত্যাচারের কাহিনী জীবন্ত থাকবে।


শুধুমাত্র বৌদ্ধরা নয়, ভারতের আরেক বিরাট জনজাতি জৈন সম্প্রদায়ও হয় ভারতীয় হিন্দুদের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন; তাদের মধ্যে অনেকে মুসলমান হয়ে নিস্তার পেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –
“বাংলার বৌদ্ধদের মতো দক্ষিণ ভারতের জৈনরাও রক্ষণশীল শৈব হিন্দুদের হাতে নিপীড়িত হয় এবং একদিনে আট হাজার জৈনকে শূলে হত্যা করার কথা তামিল পুরাণেই উল্লিখিত হয়েছে। স্পষ্টতই এই সময়টাতে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম পরধর্মসহিষ্ণুতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল।“[ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ৫৫]

ব্রাহ্মণ্যবাদ এতোই চরম সীমায় পৌঁছেছিল যে ব্রাহ্মণ্যদের দ্বারা যেটাই ঘোষিত হত সেটাই ইশ্বরবাক্য বলে মেনে নিতে হত সমাজকে; বিরোধিতা বা সমালোচনা করার মত কোন জায়গা ছিল বলে মনে হয় না।

ঐতিহাসিক শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছে –“শারদীয় দুর্গাপূজায় বিজয়া দশমীর দিন শাবরোৎসব নামে একপ্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হইত। শবর জাতির ন্যায় কেবলমাত্র বৃক্ষপত্র পরিধান করিয়া এবং সাড়া গায়ে কাদা মাখিয়া ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে লোকেরা অশ্লীল গান গাহিত এবং তদনুরূপ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গী করিত। জীমূতবাহন ‘কাল-বিবেক গ্রন্থে’ যে ভাষায় এই নৃত্যগীতের বর্ণনা করিয়াছেন বর্তমান কালের রুচি অনুসারে তাহার উল্লেখ বা ইঙ্গিত করাও অসম্ভব। অথচ তিনিই লিখিয়াছেন, যে ইহা না করিবে ভগবতী ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে নিদারুন শাপ দিবেন। বৃহদ্ধর্মপুরাণে কতিপয় অশ্লীল শব্দ সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে যে ইহা অপরের সম্মুখে উচ্চারণ করা কর্তব্য নহে, কিন্তু আশ্বিন মাসে মহাপূজার দিনে ইহা উচ্চারণ করিবে – তবে মাতা, ভগিনী এবং শক্তিমন্ত্রে অদীক্ষিতার সম্মুখে নহে। ইহার স্বপক্ষে এই পুরাণে যে যুক্তি দেওয়া হইয়াছে, শ্লীলতা বজায় রাখিয়া তাহার উল্লেখ করা যায় না।“ [বাংলাদেশের ইতিহাস – পৃষ্ঠা ১৮৯]

রমেশচন্দ্র মজুমদার আরও লিখেছে-
“সে যুগের স্মার্ত পণ্ডিতগণ প্রামাণিক গ্রন্থে অকুণ্ঠিত চিত্তে লিখিয়াছেন শূদ্রাকে বিবাহ করা অসঙ্গত কিন্তু তাহার সহিত অবৈধ সহবাস করা তাদৃশ নিন্দনীয় নয়।“[বাংলাদেশের ইতিহাস – পৃষ্ঠা ১৯৩]
সে আরও লিখেছে –
“কঠোর জাতিভেদ প্রথা তখন ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য জাতির মধ্যে একটি সুদৃঢ় ব্যবধানের সৃষ্টি করিয়াছিল।“

ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির এই প্রভাব প্রতিপত্তির সম্পর্কে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –
“পরে সেন রাজাদের আমলে প্রচণ্ড আগ্রহে ও প্রচারের জন্য উৎসর্গিত প্রাণের উদ্দীপনায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে বাঙালী সমাজে মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণদের প্রভাব এত বেশী বেড়ে যায় যে তা অচিরে অত্যাচার হয়ে দাঁড়ায়।“[ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ৯৮]

সেন রাজাদের আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির প্রভাব প্রতিপত্তির সম্পর্কে জানতে হলে কুলীন ব্রাহ্মণদের আচার ব্যবহার সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে যা সবাইকে অবাক করে দেবে।

ঐতিহাসিক অধ্যাপক বিনয় ঘোষ লিখেছে –
“ কুলীন ব্রাহ্মণ হিসাবও রাখতেন না তারা ক’টি মেয়েকে বিবাহ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য একটি ছোট খাতায় বিয়ের ও বিয়ের পাওয়া যৌতুকের তালিকা লিখে নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্বশুরালয়ে গেলে শ্বশুররা তাদেরকে কি কি জিনিষ দিতেন তারও একটা তালিকা রাখতেন।“ [ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – পৃষ্ঠা ১২০]

সে আরও লিখেছে – “কুলীন জামাতারা যখনই শ্বশুরগৃহ যান তখনই তাদের সন্মানার্থে শ্বশুরকে কিছু অর্থ বা কোনও উপহার দিতে হয়।এই প্রথার ফলে বিবাহ বেশ লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছে।
একটি ব্রাহ্মনের যদি ত্রিশটি স্ত্রী থাকে তবে প্রতিমাসে কয়েকদিনের জন্য শ্বশুরালয়ে গিয়ে থাকলেই ভাল খেয়ে ও উপহার পেয়ে এবং জীবিকা অর্জনের কোন চেষ্টা না করে তারা সারা বৎসর কেটে যেতে পারে। বহুবিবাহ প্রথার ফলে কুলীন ব্রাহ্মণরা এক নিষ্কর্মা, পরভুক শ্রেণী হয়ে উঠেছে এবং বিবাহের মত একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে নীতিহীনতার উৎস করে তুলেছে।“

সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে ব্রাহ্মন্যবাদী শক্তির চরম অত্যাচারের ফলে মানুষের মনে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিতৃষ্ণা এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি আকর্ষণ জন্ম নেয়। তবে এছাড়া আরও একটি কারণ ছিল, সেটা হল মুসলিম রাজাদের অনুগ্রহ লাভ করা। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –
“ইংরেজ আমলে বিশেষত উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাজানুগ্রহ লাভের আশায় যেমন ইংরাজী শেখার হিড়িক পড়ে যায় তেমনিমধ্যযুগের বাংলাতে বিশেষত পশ্চিম বাংলায় একই কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্যও জনসাধারণের মনে প্রবল উৎসাহ সঞ্চারিত হয় বলে মনে সন্দেহ জাগে। শাসন ক্ষমতার অধিকারী মুসলমানরাও বাংলার জনসাধারণের এই উৎসাহের সদ্ব্যবহারে কোনরূপ ত্রুটি রাখেনি এবং সত্যি সত্যি ধর্মান্তরিতরা বহু ক্ষেত্রেই উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অপেক্ষা শাসন ব্যবস্থায় উচ্চতর পদ লাভ করেছে।“ [ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১০২]

নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যায় ইসলাম ধর্ম বাংলা তথা ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ এসেছিল, অভিশাপ হিসাবে নয়। তাই শ্রী সুরজিৎ দাশগুপ্ত স্পষ্ট করে বলেছে যে –
“সামগ্রিক বিচারে মানতে হবে যে, ইসলাম স্বাতন্ত্রে গৌরবান্বিত বাংলার জনসাধারণকে অজ্ঞাতপূর্ব মুক্তির স্বাদ দিল। বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণীর তথা শ্রমজীবি জনসাধারণকে দিল ব্রাহ্মণ্য নির্যাতন ও কঠোর অনুশাসনাদির থেকে মুক্তি, প্রতি পদে সামাজিক অপমানের থেকে মুক্তি, পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গের সমুদ্রস্পৃহ জনসাধারণকে দিল ভৌগোলিক বিধি–নিষেধের বন্দীদশা থেকে মুক্তি, বহু আয়াসসাধ্য সংস্কৃত ভাষার বন্ধন কেটে জনসাধারণকে দিল মাতৃভাষাতে আত্মপ্রকাশের অধিকার।“ [ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১০২]

দীর্ঘকাল মুসলমান শাসনে ভারতে হিন্দু ধর্মও ধ্বংস হয়নি, হিন্দু জাতিও ধ্বংস হয় নি। কিন্তু প্রচলিত ইতিহাসে যা ঘটানো হয়েছে তা ঘটনা নয় রটনা, ইতিহাস নয় বরং বিকৃত ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –

“দীর্ঘকাল মুসলিম শাসনের অধীনে থাকা সত্বেও ভারতবর্ষের অধিকাংশ অধিবাসী, এমনকি মুসলমান শক্তির প্রধান কেন্দ্রগুলির অধিবাসীও হিন্দু থেকে যায়, কিন্তু ইউরোপে পেগান ধর্মের বিরুদ্ধে এমন সর্বব্যাপী অভিযান চালানো হয় যে পেগান ধর্মাবলম্বী ইউরোপিয়ানদের চিহ্নমাত্র রাখা হয় নি। মুসলমানরা যদি সত্যিই এক হাতে অস্ত্র নিয়ে ধর্ম প্রচারের অভিযানে নামতো তাহলে ইউরোপের মত ভারতবর্ষেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চিহ্নমাত্র থাকত না।“ [ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১৬]
স্বামী বিবেকানন্দ তার “প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য” বইতে লিখেছে – “‘দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায় আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সে-সব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান।“

ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল সুফী-আউলিয়াদের ভূমিকা, যা প্রত্যেক ঐতিহাসিকরা অল্পবিস্তর স্বীকার করে গেছেন। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন যে – “ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রচার এসব সাধু-সন্ত পীর-ফকীরদের মাধ্যমেই হয়েছে, অর্থাৎ আমীর-ওমরাহ রাজা-বাদশাহের চাইতে ধার্মিক মুসলিমরাই ইসলামের ব্যাপক প্রচার অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন।“[ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ১৬; লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত]

সেই যুগে আজমীরের হজরত খাজা মুয়ীনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর হাতে এক কোটিরও বেশী মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
এখানে অসংখ্য সূফীদের ভিতর থেকে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হল –
১) হজরত খাজা মুয়ীনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
২) হজরত বাবা ফরীদুদ্দীন শকরগঞ্জ রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৩) হজরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৪) হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৫) হজরত নাসীরুদ্দীন চিরাগ দেহলবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৬) হজরত আহমাদ ফারুকী সিরহিন্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৭) হজরত সৈয়দ আহমদ বেরেলবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৮) হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৯) হজরত আবুবকর সিদ্দীকী ফুরফুরাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
১০) হজরত মুহম্মদ রুহুল আমীন বশীরহাটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
১১) হজরত কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
১২) হজরত শাহ জালাল সিলেটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
১৩) হজরত নূর কুতুবুল আলম রহমাতুল্লাহি আলাইহি
১৪) হজরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি

ঐতিহাসিক শ্রী সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছে –
“মামলুকদের শাসনকাল ত্রয়োদশ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই মুসলিম সাধকরা ভারতবর্ষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কশূন্য জনসাধারণের জীবনে উপনীত হয়েছিলেন এবং তার ফলে ভারতীয় জনসাধারণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলামকে গ্রহণ করেছিল নিতান্তই আধ্যাত্মিক আকর্ষণে।“ [ ভারতবর্ষ ও ইসলাম – পৃষ্ঠা ৪৯]
মুসলমানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেই বৃটিশ দালাল হিন্দু জমিদার গোষ্ঠির সৃষ্টি

মুসলমানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেই বৃটিশ দালাল হিন্দু জমিদার 
গোষ্ঠির সৃষ্টি
লাখেরাজ আরবি শব্দ, অর্থ নিষ্কর। মুগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি অথবা কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি। মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক এ অঞ্চলের মুসলিম ছূফী-দরবেশ ও আলিম-উলামাগণকে মুসলিম শাসকদের তরফ থেকে লাখেরাজ সম্পত্তি দেয়া হতো। যাতে উনারা উক্ত ভুমি ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে দ্বীন ইসলাম প্রচার-প্রসার করতে পারেন।
আবহমান কাল থেকে ভারতের মুসলমান শাসকগণ জনগণের শিক্ষা বিস্তারকল্পে মুসলিম মনীষীদেরকে জায়গীর, তমঘা, আয়মা, মদদে-মায়াশ প্রভৃতি নামে লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি দান করতেন। বুকাননের মতে “একমাত্র বিহার ও পাটনা জেলার একুশ প্রকারের লাখেরাজ ভূমি দান করা হয়েছিল বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে”।
“বহুদিন থেকে ভারতবর্ষের শাসনকর্তাগণ সাধারণ মানুষের বিদ্যাশিক্ষার জন্য লাখেরাজ জমি মঞ্জুর করতেন। মসজিদ, মাজার ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের জন্য ভূমি মঞ্জুর করা হতো। এছাড়াও তাঁরা নানা প্রকার বৃত্তি ভোগ করতো।শুধু মুসলমান উনাদের জন্যই এসময় পনের প্রকারের আয়কর মওকুফের মঞ্জুরী ছিল, তিন প্রকারের ছিল হিন্দুরের” (ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ব্রিটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, উদৃতি, এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃঃ ৭৭-৭৮)
“১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম হিসাব করে বের করে যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য এক ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখে” (কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এম আর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮)।
মুসলমান উনাদের শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত জমি-সম্পত্তির (ওয়াকফ) উপর ব্রিটিশ আর হিন্দুদের শকুনি দৃষ্টি পতিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতেই ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ছূফী-দরবেশ, আলিম-উলামা উনাদের নিকট থেকে এসব লাখেরাজ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়।
১৮২৯ সালে বাজেয়াফত হলো লাখোরাজ সম্পত্তি। এই সব নিষ্কর জমির আয়ে পরিচালিত মুসলমান উনাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো। ইংরেজ আমলে নানান অজুহাত এসব লাখেরাজদারকে তাদের মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। মুসলিম উচ্চশ্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হ’য়ে যায়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন দ্বারা মুসলমান উনাদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেল।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণী হলো হিন্দু এবং জমির একচ্ছত্র মালিক। জমির মুল মালিক মুসলমান কৃষককুল হলেন হিন্দু জমিদারদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল।

উপরে বর্নিত ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে যে ব্রিটিশরা মুসলমান উনাদের লাখেরাজ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের দিয়ে দিয়েছে । যার ফলে ফকিরনি হিন্দুরা হয়েছে জমিদার আর মুসলমান হয়েছে গরীব।
সারা বাংলাদেশে অর্পিত বা দেবোত্তর সম্পত্তির দোহাই দিয়ে লক্ষ লক্ষ একর মুসলমান উনাদের সম্পত্তি দখল করার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে উগ্র হিন্দুরা। অথচ ইতিহাস সাক্ষী ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান উনাদের লাখেরাজ সম্পত্তি দখল করে রাতারাতি কথিত জমিদার বনে যায় হিন্দুরা। যে জায়গা আজও মুসলমান ফেরত পায়নি।
বাংলাদেশের মুসলমানদের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। এই বাংলার প্রায় সব জমির মালিক এক সময় মুসলমানরাই ছিলো। এসব জমির মালিক মূলত মুসলমানরা। এসব লা-খেরাজ জমি এখনো যেসব মুসলমানদের দখলে দখলে রয়েছে; তাদের উচ্ছেদ করে দেবোত্তর সম্পত্তির নামে হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এটা কিভাবে বৈধ হতে পারে? কারো সাম্প্রদায়িক নির্দেশে এসব লা-খেরাজ জমি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ কোনো মুসলমান মেনে নিবে না। ‘দেবোত্তর সম্পত্তি আইন’ এর নামে ব্রিটিশ বেনিয়াদের মতো নতুন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বন্ধ করতে হবে। দেবোত্তর সম্পত্তির নামে মুসলমান উনাদের লা-খেরাজ সম্পত্তি মুসলমান উনাদের ফেরত দিতে হবে।

মুসলমানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেই বৃটিশ দালাল হিন্দু জমিদার গোষ্ঠির সৃষ্টি
মুসলমানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেই বৃটিশ দালাল হিন্দু জমিদার গোষ্ঠির সৃষ্টি

লাখেরাজ আরবি শব্দ, অর্থ নিষ্কর। মুগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি অথবা কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি। মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক এ অঞ্চলের মুসলিম ছূফী-দরবেশ ও আলিম-উলামাগণকে মুসলিম শাসকদের তরফ থেকে লাখেরাজ সম্পত্তি দেয়া হতো। যাতে উনারা উক্ত ভুমি ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে দ্বীন ইসলাম প্রচার-প্রসার করতে পারেন।

আবহমান কাল থেকে ভারতের মুসলমান শাসকগণ জনগণের শিক্ষা বিস্তারকল্পে মুসলিম মনীষীদেরকে জায়গীর, তমঘা, আয়মা, মদদে-মায়াশ প্রভৃতি নামে লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি দান করতেন। বুকাননের মতে “একমাত্র বিহার ও পাটনা জেলার একুশ প্রকারের লাখেরাজ ভূমি দান করা হয়েছিল বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে”।
“বহুদিন থেকে ভারতবর্ষের শাসনকর্তাগণ সাধারণ মানুষের বিদ্যাশিক্ষার জন্য লাখেরাজ জমি মঞ্জুর করতেন। মসজিদ, মাজার ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের জন্য ভূমি মঞ্জুর করা হতো। এছাড়াও তাঁরা নানা প্রকার বৃত্তি ভোগ করতো।শুধু মুসলমান উনাদের জন্যই এসময় পনের প্রকারের আয়কর মওকুফের মঞ্জুরী ছিল, তিন প্রকারের ছিল হিন্দুরের” (ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ব্রিটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, উদৃতি, এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃঃ ৭৭-৭৮)

“১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম হিসাব করে বের করে যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য এক ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখে” (কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এম আর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮)।

মুসলমান উনাদের শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত জমি-সম্পত্তির (ওয়াকফ) উপর ব্রিটিশ আর হিন্দুদের শকুনি দৃষ্টি পতিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতেই ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ছূফী-দরবেশ, আলিম-উলামা উনাদের নিকট থেকে এসব লাখেরাজ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়।

১৮২৯ সালে বাজেয়াফত হলো লাখোরাজ সম্পত্তি। এই সব নিষ্কর জমির আয়ে পরিচালিত মুসলমান উনাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো। ইংরেজ আমলে নানান অজুহাত এসব লাখেরাজদারকে তাদের মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। মুসলিম উচ্চশ্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হ’য়ে যায়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন দ্বারা মুসলমান উনাদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেল।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণী হলো হিন্দু এবং জমির একচ্ছত্র মালিক। জমির মুল মালিক মুসলমান কৃষককুল হলেন হিন্দু জমিদারদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল।

উপরে বর্নিত ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে যে ব্রিটিশরা মুসলমান উনাদের লাখেরাজ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের দিয়ে দিয়েছে । যার ফলে ফকিরনি হিন্দুরা হয়েছে জমিদার আর মুসলমান হয়েছে গরীব।

সারা বাংলাদেশে অর্পিত বা দেবোত্তর সম্পত্তির দোহাই দিয়ে লক্ষ লক্ষ একর মুসলমান উনাদের সম্পত্তি দখল করার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে উগ্র হিন্দুরা। অথচ ইতিহাস সাক্ষী ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান উনাদের লাখেরাজ সম্পত্তি দখল করে রাতারাতি কথিত জমিদার বনে যায় হিন্দুরা। যে জায়গা আজও মুসলমান ফেরত পায়নি।


বাংলাদেশের মুসলমানদের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। এই বাংলার প্রায় সব জমির মালিক এক সময় মুসলমানরাই ছিলো। এসব জমির মালিক মূলত মুসলমানরা। এসব লা-খেরাজ জমি এখনো যেসব মুসলমানদের দখলে দখলে রয়েছে; তাদের উচ্ছেদ করে দেবোত্তর সম্পত্তির নামে হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এটা কিভাবে বৈধ হতে পারে? কারো সাম্প্রদায়িক নির্দেশে এসব লা-খেরাজ জমি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ কোনো মুসলমান মেনে নিবে না। ‘দেবোত্তর সম্পত্তি আইন’ এর নামে ব্রিটিশ বেনিয়াদের মতো নতুন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বন্ধ করতে হবে। দেবোত্তর সম্পত্তির নামে মুসলমান উনাদের লা-খেরাজ সম্পত্তি মুসলমান উনাদের ফেরত দিতে হবে।