প্যাটেন্ট আগ্রাসনের কবলে বাংলাদেশ

Image result for প্যাটেন্ট আগ্রাসন
প্যাটেন্ট কী জিনিস?
ধরা যাক, একজন বিজ্ঞানী একটা কিছু আবিষ্কার করলেন। এখন তাহলে সেই আবিষ্কার করা জিনিসটি বাজারে বিক্রি করে বেশ একটা ব্যবসা জমিয়ে তোলা সম্ভব। এখন তাঁর অনুমতি ছাড়াই আরেকজন সেই আবিষ্কার করা জিনিসটি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভালো হবে না।
এই ব্যাপারটা বন্ধ করার রাস্তাই হলো প্যাটেন্ট কেউ কিছু আবিষ্কার করলে সেটা চটজলদি নিজের নামে প্যাটেন্ট করে ফেলতে হবে। তাহলে চাইলেই যে কেউ আর সেটা বানিয়ে বিক্রি করতে পারবে না। যদি করেও, মামলা ঠুকে এর একটা বিহিত করা যাবে।
তাহলে যেটা দাঁড়াল, প্যাটেন্ট হলো এক ধরনের অধিকার। কেউ কোনো কিছু আবিষ্কার করলে রাষ্ট্রকে জানাবে, এটা তাঁর আবিষ্কার। রাষ্ট্র মেনে নেবে, এটা বানানোর অধিকার শুধু তাঁর। বিনিময়ে রাষ্ট্রও তাঁকে কিছু শর্ত দিয়ে দেয়। যেমনএই অধিকারটা আজীবনের জন্য নয়, বরং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পাওয়া যাবে। সাধারণভাবে মেয়াদটা ২০ বছরের মতো হয়। আবিষ্কার করা জিনিসটার ধরন-ধারণ অনুযায়ী এই মেয়াদ কমবেশিও হয়। সাধারণত প্যাটেন্ট করতে গেলে আরো একটা শর্ত দেওয়া হয়, আবিষ্কারের বিষয়টা প্রকাশ্যে জানাতে হয়।
আগে এই প্যাটেন্টের বিষয়টা রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন ছিল। মানে, চাইলে কোনো রাষ্ট্র এই অধিকার না-ও দিতে পারত। আবার কোনো রাষ্ট্র চাইলে প্যাটেন্টের বিপরীতে যা ইচ্ছা শর্তও জুড়ে দিতে পারত। পরে বিশ্ব শ্রম সংস্থা এই নিয়ে একটা চুক্তি করল। সেই চুক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটির সব সদস্য রাষ্ট্রকে প্যাটেন্টের অধিকার দিতে হবে।
এই প্যাটেন্ট শব্দটা এসেছে লাতিন শব্দ patere থেকে, যার অর্থ খুলে রাখা। পৃথিবীতে প্রথম প্যাটেন্টের ধারণা চালু হয় প্রাচীন গ্রিসের শহর সাইবেরিসে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে। এখনকার হিসেবে সেটা ইতালির দক্ষিণ অংশে পড়বে। সেটি অবশ্য এখনকার প্যাটেন্ট ব্যবস্থার মতো ছিল না। এখনকার মতো প্যাটেন্ট, মানে আধুনিক প্যাটেন্ট প্রথম চালু হয় ভেনিসে, ১৪৭৪ সালে।
তবে বেশিরভাগ দেশ ভেনিসের এই প্যাটেন্ট ব্যবস্থা অনুসরণ করে না। ব্রিটেনে ১৬২৪ সালের ২৫ মে একটি বিধিমালা পাস হয় Statute of Monopolies নামে। পরে এটাকেই ওরা প্যাটেন্ট আইনে রূপান্তরিত করে। বেশির ভাগ দেশই এই বিধিমালা অনুসরণ করেই প্যাটেন্ট আইন তৈরি করেছে।

প্যাটেন্ট সম্পদ লুন্ঠনের হাতিয়ার
নতুন প্রযুক্তি মাত্রই নতুন সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যম তা নয় বরং এই প্রযুক্তি সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যাবহার করা হতে পারে যদি এই প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত হয় আইনি আধিপত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের দেশিয় পেটেন্ট আইন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার আইনের ভিত্তিতে প্রযুক্তি এখন হেজিমনিক দেশগুলো কর্তৃক অনুন্নত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদরাজি লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
গত দুই দশক ধরেই পশ্চিমা বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেমন মনসেন্টো, ইউনিলিভার, ডুপন্ট তৃতীয় বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জ্ঞান, প্রাণ বৈচিত্র্য তথা জেনেটিক সম্পদকে অবৈধভাবে পেটেন্ট করে নিয়ে এসবের উপর তাদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ ধরনের পেটেন্ট আগ্রাসনের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩ (খ)  ধারা।
ট্রিপস চুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক বিভিন্ন প্রকারের পণ্য ও প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণ এর সম্ভাবনা অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই চুক্তি এমনকি গ্লোবাল কর্পোরেশন কর্তৃক জেনেটিক সম্পদ যেমন বীজ জার্মপ্লাজম প্যাটেন্টের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ফলে কৃষকগণ তাদের উদ্ভাবিত বীজের মালিকানা হারাচ্ছে। ট্রিপস চুক্তি অনুসারে জিনের প্যাটেন্ট দাবি করতে পারবে শুধু সরকার ও কর্পোরেশন কৃষকগণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই প্যাটেন্ট দাবি করতে পারবে না এবং এই চুক্তিতে ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জ্ঞানের উপর কৃষক ও কমিউনিটির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অধিকারের স্বীকৃতিও নাই (গ্রিনফিল্ড, ১৯৯৯)

মার্কিন বহুজাতিক এগ্রো-কেমিক্যাল কর্পোরেশন মনসেন্টো, ইউনিলিভার ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে শস্য বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তোলে বিশাল শস্য বীজ ব্যাঙ্ক এরপর উক্ত শস্যের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করে যে জিনটি শস্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী তা সনাক্ত করে। লোকায়ত কৃষকদের বীজের সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ক্রসিং (Natural combination) এর ফলে যে জিনের উদ্ভব তাকেই ল্যাবরেটরিতে সনাক্ত করে বহুজাতিক কোম্পানি তার মৌলিক উদ্ভাবনা বলে চালিয়ে দেয় এবং ঐ শস্য বীজের পেটেণ্ট করে নেয়। কোম্পানি পরবর্তীতে জেনেটিক রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সমস্ত উদ্ভিদ, বীজ ও উদ্ভিদজাত সব পণ্যের উপর তার মালিকানা নিয়ে নেয়।
কৃষিজ উদ্ভিদের যে বৈচিত্র্য, বিভিন্ন জাতের ও বৈশিষ্ট্যের যে সমাহার তা কিন্তু কৃষকদের বীজের সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন ও নবায়নযোগ্য ব্যাবহারেরই ফল। কোম্পানি কৃষকদের পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতালব্ধ এই উৎপাদন প্রণালীকেই নিজস্ব উদ্ভাবন বলে দাবী করে শুধু মাত্র অর্থ ও প্রযুক্তির জোরে। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের কৃষক ও জনসাধারণের উৎপাদন প্রণালী উদ্ভূত বিভিন্ন শস্য বীজের জাত চলে যায় বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানায়। এভাবে প্রাণ ও উদ্ভিদের পেটেন্ট হচ্ছে হাজার বছরের উন্নয়নশীল দেশের জ্ঞানের নীরব চৌর্যবৃত্তি।
উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৫ সালে মার্কিন কৃষি বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশের ওষধি গাছ নিম হতে প্রাপ্ত ছত্রাক বিরোধী ওষুধের পেটেন্ট, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাসমতি চালের উপর যুক্তরাষ্ট্রের রাইসটেক কোম্পানির মালিকানা দাবী এবং টেকনোমতি নামে বাজারজাতকরণ ইত্যাদি। এছাড়াও গাছের বিশেষ উপাদান যেমন প্রোটিন বা লিপিড এবং এসব উপাদান সমৃদ্ধ সমস্ত জেনেটিক সম্পদ, হাইব্রিড ব্রিডিং প্রণালীর সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্ত বীজ ও উদ্ভিদ, টিস্যু কালচার প্রযুক্তির প্রয়োগে উদ্ভূত উদ্ভিদের জেনেটিক বস্তু, বাহ্যিক জিনকে (external gene) বিদ্যমান প্রজাতিতে প্রযুক্ত করে নতুন জিন বহনকারী সকল উদ্ভিদ এবং বীজকে নিজের বলে দাবি করে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ডুপন্ট এবং পাইওনিয়ার এসব জৈবিক সম্পদের উপর পেটেন্টের আবেদন করে রেখেছে।
পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক প্রাণবৈচিত্র্যে  সমৃদ্ধ দেশগুলোর জেনেটিক সম্পদরাজির এই লুণ্ঠনকে আমাদের মত দেশের কর্মকর্তাগণ যে মেনে নিচ্ছেনতার পেছনে কাজ করে কালচারাল ইম্পারিয়ালিজম।
জেনেটিক ইঞ্জিরিয়ারিং/ জিএম প্রযুক্তি মাত্রই মানব কল্যাণ সাধন করবে এই অন্ধ ধারনার কারনে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো জিএমর মাধ্যমে  সহজেই বায়োপাইরেসির মধ্য দিয়ে  আমাদের মত দেশের শস্য বীজের মালিকানা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। বহুজাতিক এগ্রো কামিক্যাল কর্পোরেশনগুলো অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে জিএম টেকনোলোজি গ্রহণ করার কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে সহজেই প্যাটেন্ট আগ্রাসনের মাধ্যমে কৃষি বীজের ওপর কোম্পানির মনোপলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাথে রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পর্ক মানে মালিকানার সম্পর্ককে বাদ দিয়ে যারা বিবেচনা করেন তারা নিজের অজান্তেই বহুজাতিক কোম্পানির কাছে স্বদেশের সম্পদের মালিকানা তুলে দেয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। জিএম দিয়ে পেটেন্ট আগ্রাসন চালিয়ে কোম্পানি যখন বায়োপাইরেসি করে আর এর মাধ্যমে আমাদের হাজার হাজার বছরের শস্যবীজের মালিকানা দাবি করে, তখন তাকে আর নির্মোহ বিজ্ঞান বলা যায় না এটা করপোরেটের হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করে।

প্যাটেন্ট আগ্রাসনে কি ক্ষতি হবে ?
১।  নিজেদের লোকায়ত জ্ঞান ও সম্পদের মালিকানা হাতছাড়াঃ
প্যাটেন্ট আগ্রাসনের মাধ্যমে লোকায়ত জনগোষ্ঠী নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের ও লোকায়ত জ্ঞানের মালিকানা হারায়।
২। খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন এবং খাদ্যের  জন্য কর্পোরেটদের উপর নির্ভরশীলতাঃ
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তি এবং এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার পুরাপুরি  বাস্তবায়িত হলে  দরিদ্র দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ কৃষক এর জীবন জীবিকা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের কর্পোরেট মনোপলি এবং মনোকালচারের কারনে  এসব দেশের প্রাণ বৈচিত্র্য বিশেষ করে শস্য বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
বহুজাতিক কোম্পানির মনোপলি বিজনেস শস্য বীজের বৈচিত্র্যকে ধংস করে দিচ্ছে। আগে সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ কৃষক নিজদের শস্য বীজ নিজেরাই সংগ্রহ, সঞ্চয়, পুনরুৎপাদন  করত কিন্তু বর্তমানে মেধাস্বত্ব আইনের সুযোগ নিয়ে এসব বীজের  মালিকানা বৃহৎ এগ্রো কর্পোরেশন নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসায় কৃষকদের চড়া দামে পেটেন্টেড  বীজ কিনে নিতে হচ্ছে। আবার বীজ ইঞ্জিনিয়ারিং ও বীজ মোডিফিকেশনের মাধ্যমে  বীজের প্যাটেন্ট নিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, ফলে সারা দুনিয়ার কৃষিতে চালু হয়েছে বীজ আগ্রাসন।

বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক এভাবে পেটেন্ট আগ্রাসনের ফলে পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন শুরু হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
প্রথমত, বায়োপাইরেসির ফলে লোকায়ত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং জেনেটিক সম্পদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এসব উদ্ভিদ এবং শস্য বীজের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উৎপাদনের উপর বিধিনিষেধের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো খাদ্য শস্যের উপর গবেষণা করতে পারবে না এবং খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট কর্পোরেশনের হাতে। স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্যবীজ, উদ্ভিদ এবং ওষধি গাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকদের নিজেদের জমিতে/খামারে বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যাবহার এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত হবে পেটেন্ট আইনের কারনে। ফলে পেটেন্টেড শস্য বীজ ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ উৎপাদনের জন্য হয় বহুজাতিক কোম্পানিকে রয়্যালিটি দিতে হবে অথবা আমাদেরই উৎপাদন প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত এসব দ্রব্যাদি উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য করা হবে। ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে কৃষিজ পণ্য ও খাদ্য দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে, হুমকির মুখে পড়বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। আর এসব পেটেন্টেড পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা অর্জন করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো
৩। কালচারাল ক্ষতিঃ
এশিয়া ও আফ্রিকার জনপদের ট্র্যাডিশনাল কৃষি পদ্ধতির সাথে যুগপৎভাবে মিশে আছে এসব দেশের কৃষ্টি-কালচার-জীবনযাপনের বৈচিত্র্য। কৃষিতে কর্পোরেট আগ্রাসন তথা বায়োকলোনিয়ালিজম এই বৈচিত্র্যকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে এগ্রিবিজনেসের মাধ্যমে।
কর্পোরেট এগ্রিবিজনেস কৃষির সাথে যে সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের সম্পর্ক তা অস্বীকার করে এবং দুনিয়ার খাদ্য সমস্যা দূর করার নাম করে বীজ পেটেন্টিং এর মাধ্যমে চালু করে মনোকালচার ( বিচিত্র খাদ্য শস্যের বদলে কোম্পানি তার বাণিজ্যিক স্বার্থে হাতে গোনা কিছু শস্য উৎপাদনে বাধ্য করে) যা কৃষির প্রাণবৈচিত্র্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদন কৃষকদের কাছে শুধু ভোগের বিষয় নয় এর সাথে কালচারের অনুষঙ্গ রয়েছে কিন্তু  বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক প্রাণ ও প্রতিবেশের বাণিজ্যিকীকরন ও পণ্যকরণ লোকালয় ভিত্তিক কৃষির প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
বহুজাতিক কোম্পানির মনোপলি বিজনেস শস্য বীজের বৈচিত্র্যকে ধংস করে দিচ্ছে। আগে সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ কৃষক নিজদের শস্য বীজ নিজেরাই সংগ্রহ, সঞ্চয়, পুনরুৎপাদন  করত কিন্তু বর্তমানে মেধাস্বত্ব আইনের সুযোগ নিয়ে এসব বীজের  মালিকানা বৃহৎ এগ্রো কর্পোরেশন নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসায় কৃষকদের চড়া দামে পেটেন্টেড  বীজ কিনে নিতে হচ্ছে। আবার বীজ ইঞ্জিনিয়ারিং ও বীজ মোডিফিকেশনের মাধ্যমে  বীজের প্যাটেন্ট নিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, ফলে সারা দুনিয়ার কৃষিতে চালু হয়েছে বীজ আগ্রাসন।

বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক এভাবে পেটেন্ট আগ্রাসনের ফলে পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন শুরু হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। প্রথমত, বায়োপাইরেসির ফলে লোকায়ত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং জেনেটিক সম্পদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এসব উদ্ভিদ এবং শস্য বীজের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উৎপাদনের উপর বিধিনিষেধের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো খাদ্য শস্যের উপর গবেষণা করতে পারবে না এবং খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট কর্পোরেশনের হাতে। স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্যবীজ, উদ্ভিদ এবং ওষধি গাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকদের নিজেদের জমিতে/খামারে বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যাবহার এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত হবে পেটেন্ট আইনের কারনে। ফলে পেটেন্টেড শস্য বীজ ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ উৎপাদনের জন্য হয় বহুজাতিক কোম্পানিকে রয়্যালিটি দিতে হবে অথবা আমাদেরই উৎপাদন প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত এসব দ্রব্যাদি উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য করা হবে। ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে কৃষিজ পণ্য ও খাদ্য দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে, হুমকির মুখে পড়বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। আর এসব পেটেন্টেড পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা অর্জন করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো
প্রাণ-উপনিবেশীকরণ প্রতিরোধে
নিওলিবারেল বিশ্বায়ন এখন লোকাল কমিউনিটির বায়োলজিকাল ও কালাচারাল ডাইভার্সিটি, ইকোসিস্টেম, মূল্যবোধ এবং জ্ঞান কাঠামোকে ধংস করতে উদ্যত। ফলে স্থানীয় জনপদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও জীবন জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। অবিলম্বে তাই অনুন্নত দেশগুলোর ট্র্যাডিশনাল বীজ, হারবাল মেডিসিন, জ্ঞানকাঠামো এবং প্রাণবৈচিত্র্যের এই লুণ্ঠন ও প্যাটেন্টকরণ বন্ধ করতে হবে। প্রাণের ( উদ্ভিদ, প্রাণী, জিন) পেটেন্টকরণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পূর্ণ অবৈধ। ট্রিপস চুক্তি আবশ্যকীয় মেডিসিন ও অন্যান্য সেবার প্রাপ্যতা থেকে গণমানুষকে বঞ্চিত করবে এবং এসব জীবন রক্ষাকারী খাদ্য ও ওষুধের দখল, প্রাণবৈচিত্র্য, জেনেটিক সম্পদ ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের মালিকানা বহুজাতিকের কাছে চলে যাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রাণের উপর প্যাটেন্টকরণ অথবা অন্যান্য বায়োলজিক্যাল সম্পদের উপর মেধাসত্ত আইন কার্যকর করা অবৈধ করা উচিত। জিন বৈচিত্র্য প্রাইভেত প্রোপার্টি হতে পারে না এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের বায়োপাইরেসি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য   সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা এবং তার সুরক্ষা দেয়া আবশ্যক। কৃষক সমাজের টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনাকে বজায় রাখার স্বার্থেই আন্তর্জাতিক ট্রেড নীতির আধিপত্য থেকে কৃষি খাতকে সুরক্ষা দিতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে কৃষকদের জীবন জীবিকা এবং গণমানুষের লোকাল অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করা যাবে না। খাদ্যের সহজ প্রাপ্যতার মৌলিক  অধিকার তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন লোকাল জনগণের খাদ্য    সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভবপর হয়। এর মানে কর্পোরেট নয় বরং কৃষক ও স্থানীয় জনতাই তাদের নিজস্ব খাদ্যনীতি এবং কৃষি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে এবং লোকায়ত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনাকে বজায় রাখা হবে যার মাধ্যমে এসব জনপদের ঐতিহ্যবাহী কালচার, জ্ঞানকাণ্ড ও বৈচিত্র্যও সুরক্ষিত হবে

প্যাটেন্ট আগ্রাসনের কবলে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং কৃষিজ পণ্যের উপর একের পর এক মেধাস্বত্ব অধিকার তথা মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা থেকে বাংলাদেশের  ফজলি আম ও  জামদানি শাড়ির  মালিকানা স্বত্ব নিয়ে নিয়েছে ভারত।
ওষধি গাছ নিমের স্বত্ব নিয়ে গেছে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে ভারত।
বাসমতির স্বত্ব নিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথাকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ভারত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাছে এর মালিকানা স্বত্বও দাবি করে রেখেছে জিএম প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব বেগুনের নয়টি জাতকে জেনেটিকালি পরিবর্তিত করে এসব বীজের মালিকানাও নিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মনসান্তো কোম্পানি।
এভাবে একের পর এক আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পণ্য, ওষধি গাছ এবং কৃষিজ শস্যের মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং এসব পণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং হারবাল ওষুধ বিজ্ঞানকে বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্ট আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে হলে দরকার আমাদের লোকায়ত জ্ঞানের সংরক্ষন এবং রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য একদিকে সরকার এবং সচেতন মহলকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারা অনুযায়ী প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে।
বর্তমানে দক্ষিন আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ১১৮টি সংগঠন সব ধরনের প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্ট বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্টের বিপক্ষে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (মেক্সিকো, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া) কৃষক ও আদিবাসীদের বিভিন্ন ফেডারেশন যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে তার সাথে এদেশের কৃষক ও জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। সরকারকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অন্যায্য মেধাস্বত্ব অধিকার আইন বাতিলের জন্য কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে হবে।

কৃষিতে  অর্থনীতিতে কর্পোরেট আগ্রাসন


Image result for কৃষি কর্পোরেট      কৃষিতে বহুজাতিকের আধিপত্যের সূচনা

কৃষিতে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের সূচনা হয় ষাটের দশকে। এ সময় ফোর্ড ফাউন্ডেশন, রকফেলার ফাউন্ডেশন, ও ইউএস এইডের টাকায় গঠিত কনসালটেটিভ গ্রুপ ফর ইনটিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল রিসার্চ(C.G.I.A.R)সারা পৃথিবী জুড়ে সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচী হাজির করে। এই কর্মসূচী অনুসারে ভারতে তথাকথিত হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটি (HYB)বা উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ শুরু হয়। এই উচ্চফলনশীলগুলি হলো রাসায়নিক সারে সংবেদনশীল খর্বাকৃতির গাছ। এদের দেহের গড়ন সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে মূল থেকে শোষিত ও সালোকসংশ্লেষের ফলে উৎপন্ন পুষ্টির অর্ধেকই ধানের দানার পুষ্টি বাড়ানোর কাজে ব্যবহার হয়। এ সমস্ত খর্বাকৃতির ধানগাছ তৈরি হয়েছিলো তাইওয়ানের ডিজিওগেন নামক একটি জাতের সাথে দেশি ধানের সংকরায়নের মাধ্যমে।
সবুজ বিপ্লবের ফলে ঐরকম কয়েকটি উচ্চফলনশীল ধান সমগ্র দেশ জুড়ে চাষ করা শুরু হয়ে গেলো। ফলে ভারতে যে হাজার হাজার দেশি জাতের ধান চাষ হতো, তা ক্রমশই বন্ধ হয়ে গেলো। এক্ষেত্রে ধানের বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সাধারণত এক বছরের বেশি না থাকায় এবং কৃষক পরপর কয়েক বছর নিজেদের স্থানীয় জাতের ধান চাষ না করায় তাদের বীজধান নষ্ট হয়ে গেলো। উল্লেখ্য, এসময় চাষীরা উচ্চফলনশীল ধান চাষ করেছিলো মূলত তিনটি কারণে
১.ঠিকমতো সার, পানি, কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারলে এর ফলন বেশি।
২.চাষীকে দিয়ে উচ্চফলনশীল চাষ করানোর জন্য প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে চাপ দেওয়া হয়েছিলো। ৩.চাষীকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো এবং সারে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিলো।

আর পুরো মহাদেশব্যাপি যখন কথিত সবুজ বিপ্লব সম্পূর্ণ হচ্ছিলো এবং উচ্চফলনশীলের ব্যাপক চাষাবাদের ফলে যখন দেশি জাতগুলি বিলুপ্ত হতে শুরু করে, তখন ১৯৭৪ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং রকফেলার ফাউনডেশন গঠন করে ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড অব প্লান্ট জেনেটিক রিসোর্স বা IBPGRএ সংগঠন দুটি ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (FAO)এর সমগ্র পরিকাঠামো ব্যবহার করে সারা পৃথিবী থেকে (প্রধানত তৃতীয় বিশ্ব থেকে) আর্থিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন উদ্ভিদের হাজার হাজার প্রজাতি বা ভ্যারাইটির জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করতে শুরু করে। IBPGRবেশ কিছু সংস্থার মাধ্যমে এই সংগ্রহের কাজটি সম্পূর্ণ করে। এ সমস্ত সংস্থাগুলির উপর তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশের সরকারের কোনপ্রকার নিয়ন্ত্রণ ছিলো না।

বর্তমান পৃথিবীতে সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের এক চতুর্থাংশই উক্ত IBPGR-এর কাছে রক্ষিত আছে। এবং সংগ্রহ করার সময় তারা যে কথা বলেছিলো, সংগৃহীত উদ্ভিদের একটি সেট যে দেশ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে সেই দেশেই থাকবে,সংগ্রহ এবং প্রয়োজন শেষে চুড়ান্ত বৈঈমানির নজির সৃষ্টি করে উক্ত চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্বব্যাপী কথিত সবুজ বিপ্লবের প্রবক্তারা! উল্লেখ্য যে সবুজ বিপ্লবের আগে শুধুমাত্র ভারতেই ছিলো, বেয়াল্লিশ হাজার ধানের জাত। বর্তমানে যা দুই হাজারেরও কম। আর অবলুপ্ত ওসব ধানের জাতগুলোই আছে এখন শুধুমাত্র IBPGR-এর সংগ্রহে।

এক্ষেত্রে গত একশো বছরে যেসব প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ, শস্য বীজ, প্রজাতি বহুজাতিকরা জোচ্চুরি ও কৌশল খাটিয়ে স্থানীয় ভান্ডার থেকে অবলুপ্ত করিয়েছে এবং নিজেদের করায়ত্ত্ব করেছে সেসবই এখন আবার উচ্ছমূল্যে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসছে।

কৃষক এখন বহুজাতিক কোম্পানি ও বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রায় এবং গত বিশত্রিশ বছর ধরে কথিত উচ্চফলনশীল ফসল চাষাবাদের নামে কৃষি জমিতে ব্যাপক মাত্রায় রাসায়ানিক সার ব্যাবহারের ফলে জমির উর্বরতা হারিয়েছে। বা রাসায়ানিক সার জমিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটিশিয়ামের যোগান দিলেও জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, বোরন, তামা, মলিবডেনাম, লোহা প্রভৃতির যোগান দিতে পারেনা। তাই এই অনু খাদ্যগুলি জমি থেকে স্থায়ীভাবে অপসারিত হয়েছে!
এমতাবস্থায় বহুজাতিকরা বাজারজাত করতে শুরু করে অনুখাদ্য সার! আবার জৈবসার ব্যবহার না করায় জমির যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে বহুজাতিকরা বাজারে ছেড়েছে তাদের পেটেন্টকৃত জৈব সার ও জীবানু সার! অন্যদিকে রোগপোকার উপদ্রব বাড়লে অতি উচ্চফলনশীল জাতও অতিনিন্ম ফলন দিতে শুরু করে। আবার ঘুরে ফিরে কিছুদিন পরপর পোকামাকড়রাও শক্তিশালী এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে, তখন আবার প্রয়োজন হয় ধানের জাত পাল্টানোর বা অবলুপ্ত ভ্যারাইটিগুলোর সমন্বয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন। যা আদিকাল থেকেই কৃষক করে আসছিলো প্রতিবছর।
কিন্তু কৃষক চাইলে এখন আর স্থানীয় বীজে ফিরতে পারবেনা, কারণ তার কাছে থাকা বীজ ধান অথবা ফসলের বীজ ততদিনে নষ্ট হয়ে গেছে বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, যা শুধু রক্ষিত আছে কুখ্যাত জোচ্চোর সংস্থা IBPGR-এর কাছে। যেহেতু কোন ফসলের বীজেরই অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা থাকেনা দুচার বছর পর, তাই থাকেনি কৃষকের ভাণ্ডারের বীজও! আর এভাবেই সুযোগ, চাহিদা আর বীজের বাজার সৃষ্টি করে বহুজাতিক কোম্পানিরা শুরু করেছে কথিত উচ্চফলনশীল, কথিত প্রতঙ্গ প্রতিরোধী জাত, এবং প্রতঙ্গ বিনাশী কীটনাশক ও অনু খাদ্য বা জৈব সারের ব্যবসা।

সর্বনাশী কর্পোরেট কৃষি নয়, চাই পরিবেশসম্মত কৃষি

ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে ১ কোটি ৪০ লক্ষ কৃষক আছে, আর যুক্তরাষ্ট্রে আছে মাত্র ২০ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার মাত্র ২% কৃষক আছে। অথচ ১০০ বছর আগে ছিল ৭০ থেকে ৮০% বাংলাদেশে ৫০% জনগণ সরাসরি কৃষি কাজের সাথে যুক্ত, তার মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র কৃষক ও বর্গা চাষী। ২৫ কোটি মানুষের দেশের তাহলে অন্তত ১২.৫০ কোটি মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই ইওরোপ-আমেরিকার কৃষি নীতি যা হবে, শুধু সংখ্যার দিক বিচার করলেও বাংলাদেশের কৃষি একই নীতিতে চলতে পারে না। উন্নত দেশের কৃষি পদ্ধতি এখানে চালানোর অর্থ হচ্ছে এখানকার কৃষকদের শেষ করে দেয়া।
গত শতাব্দীর ষাটের মাঝামাঝি সময়ে এদেশে আধুনিক কৃষির প্রবর্তন কৃষকের পক্ষে যায়নি। যদিও উচ্চ ফলনশীল বীজের কারণে কিংবা সার দেয়ার কারণে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এর ফলে পরবর্তীকালে অনেক ক্ষতি হয়েছে, যেমন কৃষকের সংখ্যা কমে যাওয়া, পরিবেশ নষ্ট হওয়া, খাদ্যের বৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, এবং নির্বিচারে কীটনাশকের ব্যবহার, মাটির তলার সেচের পানি ব্যবহার এবং সার ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়াজাত করার কারণে পুষ্টি ঘাটতি ও নানা রোগের সৃষ্টি হওয়া। বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে আধুনিক কৃষির কারণে এই ক্ষতি হয়েছে।
উচ্চ ফলনশীলের পর এসেছে আরো বেশী কীটনাশক নির্ভর এবং বীজ ব্যবসায়ী ও কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত হাইব্রীড বীজের। যার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফসলের চাষ বেড়েছে। কৃষক বাণিজ্যের স্বার্থে বিপুল পরিমানে কীটনাশক ব্যবহার করছে, বাজারের প্রয়োজনে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে কাঁচা অবস্থা থেকে পাকানো, স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর কৃত্রিম রং দেয়ার মতো কাজ বেড়ে গেছে। কৃষি পণ্য, বিশেষ করে খাদ্য শস্যের আবাদ ব্যাপকভাবে বাড়লেও হয়ে গেছে বিষাক্ত।

খাদ্য উৎপাদন হয় কৃষকের মাঠে, প্রকৃতির সাথে মিল রেখে। এখানে পোকা লাগতে পারে, ফসলের আকৃতি ও রং ভিন্ন হতে পারে। সব বেগুন, টমেটো, মরিচ এক রকম হবে না, সবগুলোর স্বাদও এক হবে না। কিন্তু আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষি এসে সে ধারণা পালটে দিয়েছে।

একটি জরীপে দেখা গেছে ঢাকা শহরের রিক্সা ওয়ালাদের মধ্যে ৬৭% আগে কৃষি কাজ করতেন। কেউ কেউ মৌসুমী কৃষি কাজ করে আবার ঢাকায় কিংবা যে কোন শহরে রিক্সা চালান, বা দিন মজুর খাটেন। ফলে কৃষি কাজ প্রধান পেশা হিশেবে কমে যাচ্ছে। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১২ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ২০১১ সালে Population and Housing Census, 2011: Socio-Economic and Demographic Report প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে পেশা হিশেবে কৃষি কাজ বা কৃষক বলে কিছু নেই, আছে Skilled Agriculture/Forestry and Fisheries Workersপ্রায় ৩০.১% মানুষ এই কাজে নিয়োজিত এবং অন্যান্য সব ধরণের কাজের চেয়ে এটাই সবচেয়ে বেশী। কিন্তু ২০০৪ সালেও এর পরিমান ছিল ৪৯.৫% এটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
বর্তমানে কৃষক হিশেবে যারা আছেন তাদের দুরাবস্থা দেখেই ভবিষ্যত প্রজন্ম এই কাজে আসছে না, এমন কি কৃষকরা নিজেদের সন্তানদের কৃষি থেকে দূরে রাখছেন।
সবুজ বিপ্লব মানে সার-কীটনাশকের ব্যবহার এবং তার ফলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি এখন বিশ্ব ব্যাংক, জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ অনেকেই স্বীকার করে। ইংরেজীতে Green Revolution কে Grey Revolution হিশেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ব্যাপক পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের কারণে কেঁচো থেকে শুরু করে প্রজাপতি, মৌমাছিসহ ছোট, বড় প্রাণী ও জীব-অনুজীব ধ্বংস হয়েছে, মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়েছে, পানি বিষাক্ত হয়েছে, তাই সবুজ বিপ্লব আর সবুজ থাকেনি। সবুজ বিপ্লবের সময় থেকেই শুরু হয়েছে কৃষকের সংখ্যা কমে যাওয়ার ঘটনা, কিন্তু তারপর বাজারে কীটনাশক ও রাসায়নিক কোম্পানির নেতৃত্বে এসেছে হাইব্রিড বীজ, তখন কৃষকের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে।
সবুজ বিপ্লবে সরকারের মাধ্যমে, হাইব্রিড বীজ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি এখন কৃষি চলে যাচ্ছে বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি জেনেটিকালী মডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমও প্রবর্তনের মধ্যেমে। এখন বিশ্বে যেসব বড় বড় কোম্পানি কৃষির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী তারা এখন এমন বীজ প্রবর্তন করতে চায় যার মালিকানাসহ নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির থাকবে। তারা বলছে We, the corporations, own the seeds. You, the farmer, cannot save or replant them by law; you must buy new seeds every year from us, the corporations. [Ref: GMOs - who will feed us and what will they feed us? Nana Ama Amamoo 2013-09-26, Issue 647 http://pambazuka.org/en/category/features/89001] আমরা, কর্পোরেশানরা, বীজের মালিক। তুমি, কৃষক, আইনগতভাবে বীজ রক্ষা বা পুণউৎর্পাদন করতে পারবে না; তোমাকে প্রতিবছর নতুন বীজ কিনতে হবে আমাদের (কর্পোরাশানের) কাছ থেকে এই কর্তৃত্বকারী কোম্পানীর সংখ্যা খুব বেশী নয়।

মাত্র ১০টি বহুজাতিক কোম্পানি বিশ্বের ৭৩% জিএম বীজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এই দশটির মধ্যে মাত্র ৩টি কোম্পানি মনসান্তো, সিনজেন্তা ও ডু-পন্ট ৫৩% বাজার দখল করে আছে। তবে এই তিন মোড়লের মধ্যে মনসান্তো একাই ২৩% বাজার দখলে রেখেছে। [Who Owns Nature, Corporate Power and the Final Frontier in the commodification of life, ETC group, 2008] এরাই আবার কীটনাশকের বাজারে ৯৫% দখল করে আছে। অর্থাৎ বীজের বাজার ও কীটনাশকের বাজার একই কোম্পানির হাতে রয়েছে।

প্রচুর সুর্যালোক, উত্তরে হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃষ্টিপাত এবং  বিশাল তিন নদির মোহানায় জেগে ওঠা বদ্বীপ  বাংলাদেশের জমি অতি উর্বর। এই দেশ কৃষি ফসলের দেশ, যাকে বলে সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা বাংলাদেশ। অথচ এই কৃষিকে ক্রমাগতভাবে কৃষকের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে।
এই দেশে কোন প্রয়োজন ছাড়াই জিএম ফসলের প্রবর্তন করছে। এবং খুব গর্বের সাথে ঘোষনা দেওয়া হচ্ছে যে বাংলাদেশ জিএম ফসল উৎপাদনকারি ২৮টি দেশের সাথে যোগ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে আমরা আমাদের প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র্য বিকৃতি ঘটাচ্ছি, এবং এটা খুব আনন্দের বিষয়! এই ঘোষনা এসেছিল ২০১৩ সালে প্রথম জিএম খাদ্য ফসল বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের চাষের অনুমোদন দেয়ার সময়। দেশে কৃষক সংগঠন ও পরিবেশ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে, কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।
বিশ্বের পরিবেশবাদী সংগঠন এবং স্বাধীন বিজ্ঞানীরাও প্রধান মন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও পরিবেশ ও বন মন্ত্রীর কাছে সরাসরি চিঠি লিখেছেন এই অনুমোদন না দেয়ার জন্যে। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ২০ জন কৃষককে বিটি বেগুনের চারা দেয়া হয়, কিন্তু চাষ করে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা লাগবে না বলে এই প্রযুক্তি দেয়া হলেও বেগুন গাছের পাতায়, ডগায় এমনকি ফলেও পোকা লেগেছে। বিটি বেগুনের ব্যর্থ অভিজ্ঞতার পরও আরো পাঁচটি বিটি ফসলের অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটি (এনসিবি) (বণিক বার্তা ১৪ জানুয়ারি, ২০১৫) এর মধ্যে দুটি ধানের জাত, দুটি আলুর এবং একটি তুলার জাত রয়েছে। এই তথ্য থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশকে দুর্বল আইনী ব্যবস্থা, অগণতান্ত্রিক ও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছে। কারণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এতো সহজে আর কোন দেশে অনুমোদন নিতে পারবে না।
কারণ এখানে যারা পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছে তাদের কথা না শুনলেও কোন জবাবদিহি করতে হয় না। এখানে শিক্ষিত মানুষ জিএম প্রযুক্তিকে বিজ্ঞানের অবদান বলে খুব স্বাগত জানায় যদিও যারা বিরোধিতা করছে তারাও বিজ্ঞানের পক্ষে। বোঝা দরকার যে কর্পোরেশান নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জন্যে নয়, তাদের মুনাফার জন্যে প্রবর্তন করা হয়।

দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার এমন আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের ও পরিবেশের ক্ষতি করছে এবং কৃষক হাত থেকে কৃষি বীজ কেড়ে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করিয়ে দিচ্ছে।

খাদ্য রাজনীতি ও কৃষিতে কর্পোরেট মনোপলি
প্রাণবৈচিত্র্য, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব, শস্য বীজ থেকে শুরু করে জিন পর্যন্ত বেদখল হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট আগ্রাসনে। প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলো কর্তৃক অনুন্নত কিন্তু জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশগুলোর হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জেনেটিক সম্পদ ও লোকায়ত জ্ঞানকাঠামোর এই লুণ্ঠনকেই বায়োকলোনিয়ালিজম  বলা হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদ/ জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও দক্ষিনের এই দেশগুলোর মালিকানা হারানোর পেছনে দায়ি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো। মুক্ত বাজার অর্থনীতির আড়ালে ডব্লিউটিও মূলত বিশ্বব্যাপী এমন এক একমাত্রিক বাণিজ্য নীতি চালু করতে চায় যা তথাকথিত ট্রেড বাধাসমুহ দূর করে গ্লোবাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। ডব্লিউটিওর গ্যাটস ( জেনেরাল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস) দুর্বল রাষ্ট্রসমূহকে গ্লোবাল কর্পোরেট বাণিজ্য নীতির অধীনে নিয়ে আসতে চায়। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্য সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় বাধাসমুহ দূর করে এসব দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে সেবা খাতকে বৃহৎ কর্পোরেশনের বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া।
ডব্লিউটিওর এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার (AoA) কৃষিতে উদারীকরণের নামে অনুন্নত দেশগুলোর কৃষি ব্যবস্থার উপর বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দরজা খুলে দিচ্ছে। এওএ অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড এবং নন হাইব্রিড জিএম (জেনেটিক্যালি মোডিফাইড)  শস্য চাষ করতে বাধ্য করছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী লোকাল জাতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানাধীন জিএম শস্যজাত।
কাজেই প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি উৎপাদনের পরিকল্পনা নয়, কৃষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পরিবেশ নির্ভর কৃষিকে মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে। কোম্পানির মুনাফার জন্যে নয়, মানুষের পুষ্টি, সুস্থ থাকা এবং জীবন-জীবিকা চালানো সব চিন্তা করতে হবে।