বৃটিশ উপনিবেশ শাসনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
Related imageবৃটিশ উপনিবেশ শাসনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
আগেরকার সাম্রাজ্যগুলোর ন্যায় বৃটিশরা হঠাৎ আক্রমণ করে ভারত দখল করেছে এমন নয়।শাসন ক্ষমতা নেয়ার বহু আগে থেকেই তারা এই অঞ্চলে ব্যবসা করে আসছিল।ফলে ১৭০২ সালে দেখা প্রথম মিশনারি স্কুল স্থাপিত হয় কলকাতায়।১৯৫৭ সালে পট পরিবর্তনের পরও ইংরেজরা সরাসরি শাসন চালায়নি।তবে পর পর কয়েকটি বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করার পর বাঙ্গালীরা বুঝতে সক্ষম হয় ইংরেজদের উপস্থিতি।বাংলা দিয়ে বৃটিশ শাসনের শুরু হওয়ার ফলে প্রায় ২০০ বছর আমাদেরকে উপনিবেশের যাঁতাকলে থাকতে হয়।অথচ দিল্লি কেন্দ্রিক উত্তর ভারতের মুসলমানদের থাকতে হয়েছে মাত্র ৯০ বছর।ফলে দুই অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের প্রভাবে রয়েছে ভিন্নতা।
বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং ১৭৮০ সালে কলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যা শুরুতেই ফিরাংগী মহলের দারস-ই-নিজামী কারিকুলার গ্রহন করে।সেটা ১৭৯০ সাল পর্যন্ত চলে।১৭৯২ সালে আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের পদচ্যুতির মাধ্যমে কারিকুলামে প্রথম পরিবর্তন আনা হয়। ১৮২৪ সালে আলীয়া মাদ্রাসায় ইংরেজি চালু করার সীদ্ধান্ত হয়,যা বাস্তবায়িত হয় ১৮২৬ সাল থেকে এবং ১৮৫১ সাল পর্যন্ত চলে(Ali Riaz, 2010)।
মনে রাখা ভাল, আলীয়া মাদ্রাসা যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন শাসন ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে।আইনত তাঁদের কোন স্কুল, কলেজ করার কথা ছিলনা।কিন্তু প্রশাসন চালাতে প্রয়োজনীয় লোক তৈরির জন্যই তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে থাকে।আলীয়া আলীয়া মাদ্রাসাও সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়।মোহামেডান আইন অনুসারে মুসলিমদের পারিবারিক, বিবাহ, ওয়ারিস সম্পত্তি ইত্যাদি বিষয়ে দেখভালের জন্যই আলীয়া প্রতিষ্ঠিত হয়।
মিশনারিদের উদ্যেগে ১৭৯১ সালে বেনারসে সংস্কৃত কলেজ এবং ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্টিত হয়। এরই মধ্যে চার্লস গ্র্যান্ট ১৭৯২ সালে শাসিতের অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন।যেখানে ‘downward filtration’ থিওরি গ্রহণ করার প্রস্তাবনা ছিল যা ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে।এই থিওরির মানে হচ্ছে মুসলিমদের স্থলে হিন্দুদের প্রাধান্য দেয়া (প্রাগুক্ত)।

হিন্দুদের সহযোগিতায় ইংরেজ শাসনের গোঁড়াপত্তন হওয়ার পর থেকেই ব্রাহ্মণ হিন্দুরা শাসকগোষ্ঠীর আনুকুল্য পেয়ে আসছিল।( (আরো পড়ূনঃ মহাজন হিন্দুদের সহযোগিতায় ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন) )। একই সাথে মুসলিমরা যেহেতু বৃটিশ শাসন মেনে নিতে পারেনি শুরু থেকে,সেহেতু শাসনের সুবিধার্থেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পলিসি ছিল হিন্দুদের সামাজিক ভিত্তি সুদৃঢ় করা।যার ফলে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দিয়ে নতুন এক জমিদারি শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। (আরো জানতে পড়ুনঃ জমিদারি শোষণের স্মৃতি ও চিরস্থায়ী যন্ত্রণার বন্দোবস্ত এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তঃ বাঙালি মুসলমানদের দু:সময়ের চাঞ্চল্যকর ইতিহাস)
তৎকালীন ভারত সরকারে একজন ইংরেজ সদস্য চার্লস মেটকাফ ব্রিটিশদের এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সম্পর্কে ১৮২০ সালে মন্তব্য করেছিল যে,
“এ নীতি হচ্ছে অন্যায় অবিচারের চূড়ান্ত; কোনো দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠীর হিন্দু বাবুদের হাতে তুলে দেয়া হলো যারা নানা দুর্নীতি ও উৎকোচের আশ্রয় নিয়ে দেশের ধনসম্পত্তি চুষে খেতে চায়।” (এম আর আখতার মুকুল, ১৯৮৭,পৃষ্ঠা ৭৯)।
অন্যদিকে হিন্দুদেরকে ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বেনিয়া প্রশাসন ১৮১৭ সালে ‘হিন্দু কলেজ’ এবং ১৮২৪ সালে কলকাতায় ‘সংস্কৃত কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করে।বৃটিশ প্রশাসন শিক্ষার কন্ট্রোল পুরোপুরি নিজেদের হাতে নেয়ার আগে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ১৯ শতকে বাংলার ভাষায়, কালচার, সাহিত্য, ধর্ম ও সামাজিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক স্কুল প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হওয়ার ফলে এবং তাঁদের খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তকরন প্রচেষ্টার ফলে অনেক হিন্দু নিজের ধর্মের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে, অনেকে ধর্মান্তরিতও হয়।ফলে হিন্দু অভিজাত শ্রেনীর মধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়।
সেই প্রতিক্রিয়া থেকেই রামমোহন রায়ের মত পণ্ডিতগন এগিয়ে আসেন হিন্দু ধর্মের আধুনিক ব্যখ্যা দিতে এবং সেটা করতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম গ্রন্থগুলোকে সাধারনের উপযোগী করতে একটি নতুন ভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয় তাঁদের।এখান থেকেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় আধুনিক বাংলা গদ্যরিতি গড়ে উঠে, যার প্রায় পুরোটাই হিন্দু ধর্মের ভাষা সংস্কৃত অনুসারে বেঁড়ে উঠে।সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিত ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার নতুন অক্ষর, শব্দ ও যুক্ত বর্ণ তৈরিতে অবদান রাখেন। (বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃমিশনারিদের কাজে হিন্দু সমাজের প্রতিক্রিয়া ও আধুনিক গদ্যের সৃষ্টি)
১৮৩০ সালে বৃটিশ পার্লামেন্টে ভারত শাসন সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করে লর্ড মেকাওলে বলেছিলেন;
ভারতবর্ষে ইংরেজের আধিপত্য যদি স্থায়ী হয় তবে তা অন্য কোন শক্তির কারণে নয়, ইউরোপীয় শিক্ষার কারণে।রাজদন্ড হস্তচ্যুত হতে পারে, অপ্রত্যাশিত দুর্বিপাকে আমাদের অতিগুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোর স্খলন ঘটাও অসম্ভব নয়, কিন্তু টিকবে অন্য এক বিজয়, যে-বিজয়কে হতে হবে সাংস্কৃতিক।সকল সাম্রাজ্যেরই পতন সম্ভব, অটল শুধু সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য।ইউরোপীয় জ্ঞানে সুশিক্ষিত হলে ভারতবর্ষীরা ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান চাইবে (উদৃত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০০৭, পৃষ্টা ৩৯১)।
১৮৩৫ সালে এসে বৃটিশ সরকার ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপুর্ন সীদ্ধান্ত গ্রহন করে।এবং এর লক্ষ্য নিয়ে বৃটিশ পার্লামেন্টে দেয়া বক্তৃতায় লর্ড মেকাওলে বলেন; We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions who we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinion, in morals, and in intellect (Macaulay’s Minute on Education, 1835)
অর্থাৎ,’বর্তমানে আমাদেরকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে এমন একটি শ্রেণী তৈরি করতে যারা আমাদের এবং আমরা যাদের শাসন করছি তাঁদের মাঝে ব্যাখ্যাকার (দালাল) হিসেবে কাজ করবে।এটা এমন মানুষের শ্রেণী যারা রক্ত এবং বর্ণে ভারতীয়, কিন্তু রুচিতে, মতামতে,মুল্যবোধে এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংলিশ’
বামপন্থি বুদ্ধিজীবি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন; “interpreters” মানে এখানে আসলে “দালাল” তৈরির কথা বলা হয়েছে যাকে বর্তমানের ভাষায় আমরা বলি “রাজাকার” [সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০০৭]। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকাওলে’র পার্লামেন্টে দেয়া বক্তৃতা পড়লে বুঝা যায় ভারতীয়দেরকে, বিশেষত মুসলমানদের কতটা নিচু ভাবত তারা।আরবী, ফার্সি, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যর প্রতিও তাঁর প্রচন্ড ঘৃণা দেখা যায়। ১৮৩৫ সালে মেকাওলে’র শিক্ষা বিষয়ক দলিলে তৎকালীন ভারতীয়দের পাঠ্যপুস্তক এবং ভাষাতেও আপত্তি তোলা হয়।বলা হয়;
সংস্কৃত ও ফার্সী হচ্ছে মৃত ভাষা;তাদের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয় false history, false astronomy, false medicine, false Religion (মিথ্যা ইতিহাস, মিথ্যা জ্যোতির্বিদ্যা, মিথ্যা চিকিৎসাবিদ্যা, মিথ্যা ধর্ম ) [উদৃত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০০৭, পৃষ্টা ৩৮৯]।
সেজন্য ১৮৩৭ সালে অফিসিয়াল ভাষা ফার্সির স্থলে ইংরেজি চালু হয়।এর ফলাফল হল এই, লক্ষ লক্ষ মুসলিম যারা সরকারী বিভিন্ন পজিশনে চাকুরী করত তারা বেকার হয়ে গেল, তাঁদের জীবনে নেমে এল ঘোর অন্ধকার।ফার্সি ভাষা শেখার ব্যাপারেও আর আগ্রহ থাকল না।ফলে ফার্সিতে রচিত বিপুল সংখ্যক সাহিত্য ভান্ডার থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিমরা।
বছরের পর বছর, শতকের পর শতক ফার্সিতে যে সাহিত্য মুসলিম স্কলারগন তৈরি করেছিলেন তার সাথে বাংলার মুসলিমদের সংযোগ এক প্রকার হারিয়েই গেল।জাতি হিসেবে মুসলমানদের এত বড় ক্ষতি মনে হয় আর কোনটাই নয়। এর ফলে যে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই তাঁদের মাঝে দেখা গেছে ঐতিহাসিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তির নেতৃত্বদানকারী শ্রেণীর সাথে সংযোগহীন একটি শ্রেণী, যাদের বেঁড়ে উঠা হয়েছে কলকাতা কেন্দ্রিক নয়া বুদ্ধিজীবীদের হাতে গড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় ও সাহিত্য পড়ে।
একই সাথে ১৭৭৩ সালে লাখেরাজ সম্পত্তির (ওয়াকফ) মালিকানা বাদ দেয়ার ফলে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, মক্তব (যাদের খরচ নির্বাহ হতে এই সম্পত্তি থেকে)বন্ধ হয়ে যায়।ফলে আরবী শিক্ষাও হয়ে পরে কষ্টকর।কেননা পুর্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য বেতনতো দিতেই হতনা বরং মুঘল আমলে ছাত্রদেরকে বৃত্তি দেয়া হত।ধীরে ধীরে শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পরে মুসলিম সমাজে। (বিস্তারিতঃ ওয়াকফ সম্পত্তির বেদখল ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস)
১৮৫৪ সালে Wood’s Despatch নামে একটি শিক্ষা কমিশন হয় বৃটিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। চার্লস উড ছিলেন ভারত কন্ট্রোল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট।তাঁর রিপোর্টের প্রস্তাবনা অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে ভারতে শিক্ষা কাঠামো তৈরি হয়।প্রাথমিক স্তরে, মাধ্যমিক স্তরে এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে কিভাবে কি পড়ানো হয়ে তার বিভাগ করে দেয়া হয়। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি এবং প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় ভাষাকে গ্রহণ করা হয়। দেশীয় ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইঙ্গ-দেশীয় ভাষা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও অনুমোদিত কলেজগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে (Ali Riaz, 2010).
এই প্রথম পশ্চিমা শিক্ষা (যাকে বলা হল স্যাকুলার শিক্ষা) এবং ধর্মীয় শিক্ষা আলাদা হয়ে গেল।মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাখা হল ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর স্যাকুলার শিক্ষায় সরকারী সাহায্য পেতে হলে ইংরেজি শিখতে হবে এমন শর্ত দিয়ে দেয়া হল। এভাবে করে মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা (যেখানে দ্বীন ও দুনিয়া দুটোর সমন্বয় ছিল) ও মাদ্রাসাগুলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধীরে ধীরে আরো মার্জিনালাইজ হয়ে পরল।এসব কারণেই মুসলিম কমিউনিটিতে ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে।
অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায় ততদিনে ‘ইয়াং বেঙ্গল’ গ্রুপকে মোকাবেলা করে পুনর্জাগরণি হিন্দু ধর্মের একটা ভিত তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং একটি শক্ত কালচারাল পাটাতন তৈরিতে সমর্থ হয়। ১৮৭০ সালে মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরের ফতওয়ার মাধ্যমে বাংলার মুসলমানেরা প্রথমবারের মত ইংরেজি শিক্ষায় আসে। সেই সময়ে হিন্দুদের আদি শিক্ষা মাধ্যম টোল সংস্কৃত কলেজের একটি ডিপার্টমেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ, মুসলমানদের যেখানে শুরু সেখানে হিন্দু সম্প্রদায় সুপ্রতিষ্ঠিত। মোদ্দাকথা, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে বাস্তব অর্থে একটি হিন্দু রেনেসাঁস ঘটে যায় বাংলায়। দুঃখজনক হল, এই হিন্দু রেনেসাঁস কে ‘বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁস’ বলা হয়ে থাকে ( এম আর আখতার মুকুল, ১৯৮৭) এবং এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের বর্তমান ভাষা, সাহিত্য, কবিতা এমনকি পাঠ্যপুস্তক।
ভারতবর্ষে ইংরেজি প্রচলনের আগে যে ব্রিটিশরাও মাদরাসা শিক্ষার মুখাপেক্ষী ছিলো তথা মুসলমানদের মুখাপেক্ষী ছিলো, সেই ইতিহাস বর্তমান মুসলমানরা জানে না।
Image result for ইংরেজীভারতবর্ষে ইংরেজি প্রচলনের আগে যে ব্রিটিশরাও মাদরাসা শিক্ষার মুখাপেক্ষী ছিলো তথা মুসলমানদের মুখাপেক্ষী ছিলো, সেই ইতিহাস বর্তমান মুসলমানরা জানে না।
বর্তমান সময়ের মুসলমানদের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে একটি অবজ্ঞার মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। কারণ সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকসমূহে একটি ভুল কথা স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরকে মুখস্থ করানো হয় যে, ব্রিটিশ আমলে মুসলমানরা মাদরাসা শিক্ষা ত্যাগ করতে চায়নি দেখে তারা পিছিয়ে পড়েছিলো। বলা বাহুল্য, এই কথাগুলো পড়ার পর স্কুল-কলেজের মুসলমান শিক্ষার্থীদের মনে এই চিন্তা উদিত হয় যে, মুসলমান জাতির দুরবস্থার পেছনে বোধহয় মাদরাসা শিক্ষাই দায়ী। নাউযুবিল্লাহ!
সাথে সাথে পাঠ্যপুস্তকে এধরণের আষাঢ়ে গল্পও লেখা থাকে যে,ব্রিটিশরা উন্নত ছিলো, ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা মাদরাসা শিক্ষার তুলনায় উন্নত ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, ব্রিটিশরা ১৭৫৭ ঈসায়ীতে ক্ষমতা দখলের পরপরই কেন ইংরেজি শিক্ষা জারি করলো না? কেন ব্রিটিশরা ইংরেজি চালু করতে ১৮৩৫ ঈসায়ী পর্যন্ত সময় নিলো?
এর উত্তর হলো, ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা থাকা তো দূরের কথা, তারা তো শিক্ষিতই ছিলো না! পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধে জয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সামনে দেশ শাসনের দায়িত্ব চলে আসে, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্রিটিশরা দেশ শাসনের উপযুক্ত ছিলো না। কারণ তারা ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন সাগরে সাগরে ঘুরে বেড়ানো নৌ-দস্যু। ব্যবসার খাতিরে ছোটখাটো হিসাব কষতে পারলেও রাজস্ব আদায়ের নিয়ম ও দেশশাসনের নিয়ম তাদের আয়ত্ত্বে ছিলো না।
সবচেয়ে বড় কথা, এই অঞ্চলটি ব্রিটিশদের অন্যান্য কলোনী, যেমন আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনদের মতো অসভ্য জনগোষ্ঠীর বসতি ছিলো না। ভারতবর্ষের মুসলমানগণ ছিলেন অনেক অনেক শিক্ষিত। এখন মূর্খরা মূর্খদের উপরই প্রভাব বিস্তার করতে পারে, শিক্ষিত ব্যক্তিদের উপরে নয়। যার ফলে নৌ-দস্যু ক্লাইভ বাধ্য হয়ে ‘দ্বৈত শাসন’ নামে একটি শাসনব্যবস্থা জারি করে। এই শাসনব্যবস্থায় দেশশাসন, বিচারব্যবস্থা পরিচালনা ও রাজস্ব আদায়ের নিয়মকানুন পূর্ববর্তী মুসলিম নিয়মেই পরিচালিত হয়, ইংরেজরা শুধু একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লাভ সংগ্রহ করতো মাত্র। এই ‘দ্বৈত শাসন’ ব্যবস্থায় ইরান থেকে আগত রেযা খাঁ নামক একজন সম্ভ্রান্তবংশীয় মুসলমানকে নাবালক নবাবের প্রতিনিধি করে তার হাতে দেশশাসনের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।

কিন্তু ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলার সম্পদ লুট করা। এ লক্ষ্যে তারা বাংলার শিক্ষিত মুসলমান প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে কাজ করে প্রথমে রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আয়ত্ত্ব করে, এরপর ব্রিটিশরা নিজেরাই রাজস্ব আদায়ের নামে নির্বিচারে লুটপাটে নেমে পড়ে। রেযা খাঁয়ের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ব্রিটিশদের অন্যায় লুটপাটের ফলশ্রুতিতে ১৭৭০ ঈসায়ীতে এদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। সেই দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়।
১৭৯১ সালে লুটপাটের সুবিধার্থে মিথ্যা অভিযোগ তুলে রেযা খাঁকে অপসারণ করে ব্রিটিশরা। কিন্তু একজন রেযা খাঁকে সরিয়েই বা কী হবে? প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও রাজস্ব আদায় তখনও মাদরাসা শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই চলতো এবং অবধারিতভাবেই মুসলমানদের প্রাধান্য এতে নিশ্চিত হতো। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ আমলা উইলিয়াম হান্টার ১৮৭৩ ঈসায়ীতে রচিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইতে লিখেছিলো-
“এই ব্যবস্থা (মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা) ভারতে সে সময়ের অন্য যে কোনও বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় বহুগুণে উন্নত ছিলো। এই ব্যবস্থায় তাঁরা (মুসলমানরা) এক বুদ্ধিগত ও বৈষয়িক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছিলেন এবং কেবলমাত্র এর সাহায্যেই হিন্দুরা তাদের নিজেদের দেশে কর্তৃত্বের একটি নূন্যতম অংশ পাবার উপযুক্ত হয়ে ওঠার আশা করতে পারতো। আমাদের শাসনের প্রথম ৭৫ বছর আমরা প্রশাসন ও পরিচালনার জন্য অফিসার তৈরী করার উপায় হিসাবে এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগাচ্ছিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা আমাদের নিজস্ব জনশিক্ষা ব্যবস্থার একটি প্রকল্প চালু করি, এবং একটি প্রজন্ম নয়া পরিকল্পনা অনুযায়ী এর ফলে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠতেই পুরোনো মুসলমানী ব্যবস্থাকে রদ করে দিই। মুসলমান যুবকদের সামনে সরকারি কর্মী হিসেবে জীবনযাপনের সবধরণের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। (তথ্যসূত্র: দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১২৪)
উপরের অংশটুকু পড়লেই পাঠকদের নিকট পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ব্রিটিশরা যদি মুসলমানদের তুলনায় ‘উন্নত’ হতোই, সেক্ষেত্রে তাদের শাসনামলের প্রথম ৭৫ বছর মাদরাসা শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তাদেরকে চলতে হলো কেন? তবে শুধু ব্রিটিশরা নয়, হান্টারের উপরোক্ত বক্তব্য অনুযায়ী হিন্দুরাও ‘কর্তৃত্বের একটি নূন্যতম অংশ পাবার জন্য’ মাদরাসা শিক্ষার উপর নির্ভরশীল ছিলো।
আমরা মুসলিম শাসনামলে হিন্দুদের রাজকর্মচারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার বিভিন্ন ঘটনা শুনতে পাই। এখানে পাঠকদের জানা উচিত যে, ঐসব হিন্দুরা ধুতি-নেংটি পরা হিন্দু ছিলো না। ঐসব হিন্দুরা ছিলো মাদরাসায় পড়াশোনা করা, ফারসী ভাষায় কথা বলা, মুসলমানী পোষাক পরা হিন্দু। প্রশাসনে অন্তর্ভূক্ত হতে চাইলে একজন হিন্দুকে পোষাক আশাক থেকে শুরু করে কথাবার্তা সবকিছুতে মুসলমানী আদব-কায়দা অনুসরণ করতেই হতো। হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বা ধুতি নেংটির কোনো অবস্থানই শাসনব্যবস্থায় ছিলো না।
পেটের দায়ে মুসলমান হবার অভিনয় করলেও হিন্দুরা তাদের ধুতি নেংটি ধরে রেখেছিলো তাদের গোঁড়া হিন্দুয়ানী পারিবারিক পরিম-লে। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক নীরদ সি চৌধুরী বলেছে-
“বাঙালি (হিন্দু) পুরুষ ইংরেজ রাজত্বের আগে একমাত্র মুসলমান নবাবের কর্মচারী হইলে মুসলমানী পোষাক পরিত, উহা অন্দরে লইয়া যাওয়া হইত না। বাহিরে বৈঠকখানার পাশে একটা ঘর থাকিত, সেখানে চোগা-চাপকান-ইজার ছাড়িয়া পুরুষেরা ধুতি পরিয়া ভিতরের বাড়িতে প্রবেশ করিত। তাহার প্রবেশদ্বারে গঙ্গাজল ও তুলসীপাতা থাকিত, ম্লেচ্ছ পোষাক পরিবার অশুচিতা হইতে শুদ্ধ হইবার জন্য পুরুষেরা গায়ে গঙ্গাজল ছিটাইয়া মাথায় একটা দুইটা তুলসীপাতা দিত।” (তথ্যসূত্র: আত্মঘাতী বাঙালী- নীরদ সি চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৫০)
অর্থাৎ হিন্দুরা উপার্জনের স্বার্থে মুসলমানী পোষাক পরলেও তাদের মনে তারা ঠিকই চরম বিদ্বেষ পুষে রাখতো। এজন্য ব্রিটিশ আর হিন্দু, এই দুই অক্ষশক্তি মিলে একমত হয় যে, মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হবে। কারণ মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা যতোদিন টিকে থাকবে, ততোদিন হিন্দু আর ব্রিটিশদেরকে মুসলমানদের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হবে। মূর্খ ব্রিটিশরা শাসক হয়েও শিক্ষিত মুসলমানদের ভীড়ে কাঠের পুতুল হয়ে থাকবে, আর হিন্দুদেরকে তাদের ধুতির বদলে ‘ইজার’ তথা সেলাইবিহীন সুন্নতী লুঙ্গী ও চোগা-চাপকান পরেই কেরানিগিরি করতে হবে।
তাই মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের লক্ষ্যে এই দুই অক্ষশক্তি একযোগে এগিয়ে যায়। প্রথমে ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশরা চালু করে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আইন। মুসলমানদের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হতো লাখেরাজ বা নিষ্কর জমির আয় দিয়ে, যেসব জমি এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আইনের আওতায় কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়। যার ফলে মুসলিম শাসনামলের আরদালি শ্রেণীর হিন্দুগুলো রাতারাতি ‘জমিদার’ সেজে যায় আর মাদরাসাগুলো সব আয়ের অনুপস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায়।
যার ফলে মাদরাসা শিক্ষার ধারকবাহক যেসব ছূফী-দরবেশ ও মুজাদ্দিদ ছিলেন, উনারা ব্রিটিশবিরোধী জিহাদে লিপ্ত হলেন। এই জিহাদে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে বাঙালি মুসলমানগণ, কারণ বাঙালি মুসলমানদের নিকট থেকেই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এর নামে লাখেরাজ জমি কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। অনেকের ধারণা করে যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিলো মুসলিম রাজত্ব রক্ষার জন্য। কিন্তু না, আসল ইতিহাস হচ্ছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিলো মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা রক্ষার জন্য, মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি তাহযীব তামাদ্দুন রক্ষার জন্য। ব্রিটিশবিরোধী জিহাদ শুরু হয়েছিলো হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নেতৃত্বে। তিনি সহ ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের মূলধারার সকলেই ছিলেন ছূফী-দরবেশ শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা দিল্লীর পতন ও শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মুসলমানদের এই প্রচেষ্টার ইতি ঘটে। ব্রিটিশদের শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয় আর মুসলমানরা চিরকালের জন্য ভুলে যায় তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সোনালি অতীত। যেই মাদরাসা শিক্ষা ছিলো কাফির-মুশরিকদের উপর মুসলমানদের প্রাধান্য নিশ্চিতকরণের মূল নিয়ামক, অথর্ব মুসলমানরা ইতিহাস ভুলে সেই মাদরাসা শিক্ষাকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শুরু করে। নাউযুবিল্লাহ! আর যেই ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো মুসলমানদের একঘরে করা, তাকেই মুসলমানরা আজ উন্নতির পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। নাউযুবিল্লাহ!
এই যে আজ এদেশে হিন্দুরা প্রাধান্য বিস্তার করছে, উপজাতিরা প্রাধান্য বিস্তার করছে, এর মূল কারণই হলো এদেশে আজ মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা নেই। এখন ইংরেজরা যেভাবে মুসলমানদের প্রাধান্য খর্ব করতে মাদরাসা শিক্ষা রদ করেছিলো, ঠিক সেভাবেই মুসলমানদের প্রাধান্য ফের ফিরিয়ে আনতে মাদরাসা শিক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমস্ত মুসলমানকে একত্রিত হয়ে মাদরাসা শিক্ষাকেই মূলধারার শিক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং বর্তমানে প্রচলিত কুফরী সিলেবাসকে বয়কট করতে হবে। মুসলমানদের বুঝতে হবে যে, ইসলামবর্জিত কুফরী সিলেবাসই কাফির মুশরিকদের দম্ভের মূল স্তম্ভ। এটা রদ করতে পারলেই কাফির মুশরিকদের সমস্ত লম্ফঝম্ফ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
মুসলমানের ওয়াকফ কৃত সম্পত্তি বৃটিশেরা হিন্দুদের দিয়ে দেয়
মুসলমানের ওয়াকফ কৃত সম্পত্তি বৃটিশেরা হিন্দুদের দিয়ে দেয়
Image result for ওয়াকফঅর্থনৈতিক দিক দিয়ে গোটা মুসলমান সমাজকে নিষ্পেষিত ও নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেছিল ইংরেজ শাসকগণ। মুসলমান আমলে সকল প্রকার সরকারী চাকুরীতে সিংহভাগ ছিল মুসলমানদের। ইংরেজ এদেশের মালিক মোখতার হওয়ার পর ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সকল বিভাগের চাকুরী থেকে বিতাড়িত হতে লাগলো। শেষে সরকারের বিঘোষিত নীতিই এই হ’য়ে দাঁড়ালো যে, কোনও বিভাগে চাকুরী খালি হ’লেই বিজ্ঞাপনে এ কথার বিশেষভাবে উল্রেখ থাকতো যে মুসলমান ব্যতীত অন্য কেউ প্রার্থী হ’তে পারে। ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত আইন পাশ করে মুসলমান বাদশাহগণ কর্তৃক প্রদত্ত সকলপ্রকার জায়গীর, আয়মা, লাখেরাজ, আলতমগা, মদদে মায়াশ প্রভৃতি ভূসম্পদ মুসলশানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পথের ভিখারীতে পরিণত করে। একমাত্র বাংলাদেশেই অন্যূন পঞ্চাশ হাজার ও ইনাম কমিশন দ্বারা দাক্ষিণাত্যের বিশ হাজার লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের বহু লক্ষ টাকা আয়ের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি সরকার অন্যায়ভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রকৃত হকদারকে বঞ্চিত করে। সরকারের এসব দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেল ফলে বহু প্রাচীন মুসলিম পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষঅ ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যান্ত আইন দ্বারা মুসলমানদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেল। বাংলার কৃষকদের মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ছিল মুসলমান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণী হলো হিন্দু এবং জমির একচ্ছত্র মালিক। কৃষককুল হলো তাদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল। তাদের শুধু জমি চাষের অনুমতি রইলো, জমির উপর কোন অধিকার বা স্বত্ব রইলো না। হিন্দু জমিদারগণ প্রজাদের নানাভাবে রক্ত শোষণ করতে লাগলো। জমির উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধি, আবহাওয়া, সেলামী, নজরানা, বিভিন্ন প্রকারের কর প্রভৃতির দ্বারা কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো। যেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর প্রমুখ মনীষীগণ।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার অংগন থেকেও মুসলমানদেরকে বহু দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ব্যবসা ও শিল্পবাণিজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবদুল মওদূদ বলেণ, “দেশীয় কারিগর শ্রেণীকে নির্মমভাবে পেষণ করে দেশীয় শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়া হয়। তার দরুন শ্রমজীবীদের জীবিকার পথ একমাত্র ভূমি কর্ষণ ব্যতীত আর কিছুই খোলা রইলোনা। আর ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বণিক-রাজের কুঠিরগুলিতে আশ্রয়ে নতুন দালাল শ্রেণীর ব্যবসায়ীও জন্মলাভ করলো বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, মুন্সী, দেওয়ান উপাধিতে। বহির্বাণিজ্যে ও অন্তর্বাণিজ্যে সবদিক দখল করে যে দালাল শ্রেণীর জন্মদান করলো, তারাও হয়ে উঠলো স্বার্থ ভোগের লোভে দেশীয় শিল্প ও কারিগরির প্রতি বিরূপ। এই নতুন আর্থিক বিন্যাসের ফলে যে নতুন ভূস্বামী ও দালাল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো, তাদের একজনও মুসলমান নয় –মুসলমানদের সে সমাজে প্রবেশাধিকারও ছিলনা এবং এই সম্প্রদায়ই ছিল বিস্তৃত গণবিক্ষোভ বা জাতীয় জাগরণের প্রধান শত্রু। এ কথা লর্ড বেন্টিংকও স্বীকার করে গেছে-
“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে সত্য, তবে এর দ্বারা জনগণের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশালী বড়ো একদল ধনী ভূস্বামী সম্পদায়ের সৃষ্টি হয়। তার একটি বড়ো সুবিধা এই যে, যদি ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লবের ফলে শাসনকার্যের নির্বিঘ্নতা ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এই সম্প্রদায়ই নিজেদের স্বার্থে সর্বদাই ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখার জন্যে প্রস্তুত থাকবে”। [সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ (শতাব্দী পরিক্রমা), পৃঃ ৬২]।

১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম হিসাব করে বের করে যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য (অর্থাৎ হিন্দুদেরকে দিয়ে লাভবান হওয়ার জন্য) এক ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখে।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এমআর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮)।

মুসলমানদের শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত জমি-সম্পত্তির উপর ব্রিটিশ আর হিন্দুদের শকুনি দৃষ্টি পতিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতেই ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ছূফী-দরবেশ, আলিম-উলামা উনাদের নিকট থেকে এসব লাখেরাজ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়।

তৎকালীন ভারত সরকারেরই একজন ইংরেজ সদস্য চার্লস মেটকাফ ব্রিটিশদের এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সম্পর্কে ১৮২০ সালে মন্তব্য করেছিল যে, “এ নীতি হচ্ছে অন্যায় অবিচারের চূড়ান্ত; কোনো দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠীর হিন্দু বাবুদের হাতে তুলে দেয়া হলো যারা নানা দুর্নীতি ও উৎকোচের আশ্রয় নিয়ে দেশের ধনসম্পত্তি চুষে খেতে চায়।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃষ্ঠা ৭৯)।
নেহেরু যে কারণে ভারত ভাগ করতে রাজী হল
Image result for নেহেরুনেহেরু যে কারণে ভারত ভাগ করতে রাজী হল


ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে হবে- এ কথা তারা ১৯৪৫ সাল নাগাদ পুরোপুরি বুঝে গিয়েছিল।
তখনকার ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুনের আগেই ভারতবর্ষের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
সেজন্য ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে কেবিনেট মিশন নামে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে।
এর কয়েক মাস পরেই জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলেও মুসলিম লীগ প্রথমে তাতে যোগ দেয়নি।
অনেক আলোচনার পর ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেয়।
ইতোমধ্যে কলকাতা এবং নোয়াখালী সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।
সে প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ২২শে মার্চ নতুন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে এসে পৌঁছান।
তখন থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে।
ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগ করা কেবিনেট মিশনের লক্ষ্য ছিল পুরো ভারতবর্ষকে অখণ্ড রেখে বিভিন্ন অঞ্চলে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া।
কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন নতুন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর ইংরেজদের মাথায় ভিন্ন চিন্তাও আসা শুরু করে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে তখন অনেকগুলো বৈঠক করেন ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির তখনকার প্রেসিডেন্ট মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তার আগে ভারতবর্ষে চলমান হিন্দু-মুসলমান সংঘাত বন্ধের জন্য একটা পদক্ষেপ নিতে হবে।

মৌলানা আজাদ মি: মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যকার মত-পার্থক্য অনেক কমে এসেছে।
তখন ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন ভারত ভাগের ক্ষেত্রে বাংলা এবং আসামকে একত্রে রেখেছিল।
কিন্তু কংগ্রেস এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে। আসাম এবং বাংলা একসাথে থাকবে কি-না এ নিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তীব্র মত-পার্থক্য শুরু হলো।
দুই পক্ষের মত-পার্থক্য এমন একটি জায়গায় পৌঁছাল যে তখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়ে পড়লো।
মৌলানা আজাদ প্রস্তাব করেছিলেন এ বিষয়টি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের উপর ছেড়ে দিতে।
কিন্তু তখনকার কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল তাতে রাজী হলেন না। তারা এ বিষয়টিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মধ্যস্থতা চাননি।
এরই মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতা দাঙ্গার পর হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে।
একদিকে যখন সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে প্রশাসন তখন একটি গা ছাড়া ভাব নিয়েছে।
প্রশাসনে থাকা ইউরোপীয়রা তখন কাজে মন দিচ্ছে না। কারণ তারা বুঝতে পারছিল, যেকোন সময় ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, তাই তারা শুধু দিন গুনছিল।
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশরা যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দিয়েছিল, সেখানে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে কিছু দপ্তর ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।
এর ফলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেল এবং অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানকে।
কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেস নেতারা বুঝতে পারলেন, মুসলিম লীগের হাতে অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া বিরাট ভুল হয়েছে।
কারণ লিয়াকত আলী খানের অনুমোদন ছাড়া সরদার প্যাটেল একজন চাপরাশিও নিয়োগ করতে পারছিলেন না।
ফলে কংগ্রেস নেতাদের নেয়া সিদ্ধান্তু গুলো বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো।

মৌলানা আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী, কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেলের কারণেই এ পরিস্থিতির তৈরি হয়।
কারণ সরদার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিজ হাতে রেখে লিয়াকত আলী খানকে অর্থ দপ্তর দিয়েছিলেন।

এমন প্রেক্ষাপটে লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিলেন।
র্নিবাহী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের সুযোগে তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণ ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়ে নেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, একমাত্র ভারত বিভক্ত হলে এর সমাধান হতে পারে।
মৌলানা আজাদ লিখেছেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন এবং উভয়পক্ষকে বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই।
মি: মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের মনে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন করেছিলেন।
আর ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনের এ ধারণা সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারতবর্ষ ভাগ করার জন্য সরদার প্যাটেল আগে থেকেই মানসিকভাবে অর্ধেক তৈরি ছিলেন। মি: প্যাটেল ধরে নিয়েছিলেন, মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করা যাবে না।
সরদার প্যাটেল এক পর্যায়ে জনসম্মুখে বলেই ফেললেন, মুসলিম লীগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ভারতবর্ষ ভাগ করতেও রাজী আছেন। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে সরদার প্যাটেলই ছিলেন ভারতবর্ষ ভাগের স্থপতি।
ভারতবর্ষ বিভক্ত করার ফর্মুলা বিষয়ে সরদার প্যাটেল মনস্থির করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন মনোযোগ দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহেরুর দিকে। এ ধরনের ফর্মুলার কথা শুনে প্রথমে নেহেরু খুবই রাগান্বিত হন।কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলাল নেহেরুকে ভারতবর্ষ ভাগ করার বিষয়ে ক্রমাগত বোঝাতে থাকেন। এ বিষয়ে মি: নেহেরুর রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত মি: মাউন্টব্যাটেন তাঁর তৎপরতা চালিয়ে গেছেন।
কিন্তু ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু শেষ পর্যন্ত কিভাবে রাজী হলেন?
মৌলানা আজাদ মনে করেন, এর দুটি কারণ আছে।
প্রথমত; জওহরলাল নেহেরুকে রাজী করানোর বিষয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রীর একটি বড় প্রভাব ছিল। লেডি মাউন্টব্যাটেন ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। এছাড়া তাঁর মধ্যে আকর্ষণীয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল যার মাধ্যমে সে অন্যদের আকৃষ্ট করতে পারতো।
লেডি মাউন্টব্যাটেন তাঁর স্বামীকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক সময় যারা প্রথমে তাঁর স্বামীর কাজের সাথে একমত হতে পারতেন না, তাদের কাছে স্বামীর চিন্তা-ভাবনা পৌঁছে দিয়ে তাদের সম্মতি আদায় করতেন।
ভারত ভাগ করার পেছনে নেহেরুর রাজী হবার আরেকটি কারণ ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। এ ভারতীয় ব্যক্তি ১৯২০'র দশক থেকে লন্ডনে বসবাস করতেন। কৃষ্ণ মেনন ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর একজন বড় ভক্ত এবং মি: নেহেরুও কৃষ্ণ মেননকে খুবই পছন্দ করতেন।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে ভারতবর্ষে যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় তখন মি: নেহেরু কৃষ্ণ মেননকে লন্ডনে হাই কমিশনার নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ মেননের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি ছিল। কারণ ১৯৩০'র দশকের প্রথম দিকে ব্রিটেনের লেবার পার্টির একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কৃষ্ণ মেনন ভারত সফর করেছিলেন।
১৯৪৬ সালের দিকে কৃষ্ণ মেনন যখন আবার ভারতে আসেন তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারত ভাগ করার বিষয়ে কৃষ্ণ মেননের মাধ্যমে মি: নেহেরুকে রাজী করানো যাবে।

মৌলানা আজাদ যখন জানতে পারলেন যে ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল মোটামুটি একমত হয়েছে তখন তিনি ভীষণ হতাশ হয়েছিলেন।
মৌলানা আজাদ মনে করতেন, ভারত বিভক্ত হলে সেটি শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়, পুরো ভারতের জন্যই সেটি খারাপ হবে।
তাঁর দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের মূল সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক। সাম্প্রদায়িক সমস্যা কোন বড় সমস্যা ছিল না।
ভারত ভাগ করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিতে সরদার প্যাটেল এবং জওহরলাল নেহেরুকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মৌলানা আজাদ। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল এতোটাই অনড় ছিলেন যে তিনি অন্য কারো মতামত শুনতে মোটেই রাজি ছিলেন না।
সরদার প্যাটেলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মৌলানা আজাদ তাঁর বইতে লিখেছেন, " আমরা পছন্দ করি কিংবা না করি, ভারতবর্ষে দুটো জাতি আছে। হিন্দু এবং মুসলমানরা একজাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। যখন দুই ভাই একসাথে থাকতে পারে না, তখন তারা আলাদা হয়ে যায়। তাদের পাওনা নিয়ে আলাদা হয়ে যাবার পরে তারা আবার বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু তাদের যদি একসাথে থাকতে বাধ্য করা হয় তাহলে তারা প্রতিদিন ঝগড়া করবে।প্রতিদিন মারামারি করার চেয়ে একবার বড় ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো।"
মি: আজাদের বর্ণনায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয়তো ভারত ভাগ করার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কিন্তু এখন সরদার প্যাটেল সে পতাকা বহন করছেন।
ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল যেভাবে প্রকাশ্যে কথা বলতেন, জওহরলাল নেহেরু সেভাবে বলতেন না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী পরিষদে মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করতে গিয়ে মি: নেহেরুর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
তাদের মধ্যে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। সেজন্য জওহরলাল নেহেরু মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন ভারতবর্ষ ভাগ না করে কোন উপায় নেই।
মি: নেহেরু মৌলানা আজাদকে অনুরোধ করলেন, তিনি যাতে ভারত ভাগের বিরোধিতা না করেন এবং বাস্তবতা মেনে নেন।
নেহেরু এবং সরদার প্যাটেলের এ অবস্থানের কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে আরো জোরালো অবস্থান নিলেন।
জওহরলাল নেহেরুকে সতর্ক করে মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, " আমরা যদি ভারত ভাগ করার বিষয়ে একমত হই তাহলে ইতিহাস কোনদিনও আমাদের ক্ষমা করবে না।"

কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাশে বসিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর ভারত ভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন
সরদার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহেরুকে বোঝাতে ব্যর্থ হবার পর মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী ছিলেন মৌলানা আজাদের শেষ ভরসা।
একদিন মৌলানা আজাদ মি: গান্ধীর সাথে দেখা করতে গেলে মি: গান্ধী বলেন, " ভারত ভাগের বিষয়টি এখন বড় একটি ভয়ের কারণ হয়েছে। মনে হচ্ছে বল্লবভাই (সরদার প্যাটেল) এবং জওহরলাল আত্নসমর্পন করেছে। আপনি এখন কী করবেন? আপনি কি আমার পাশে থাকবেন নাকি আপনিও মত পরিবর্তন করেছেন? কংগ্রেস যদি ভারত ভাগের প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে সেটা আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে হতে হবে। আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন ভারতবর্ষ ভাগ মানব না।"
কয়েকদিন পরে মি: গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে দেখা করলেন। এরপর সরদার প্যাটেল মি: গান্ধীর সাথে দেখা করে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করলেন। সে আলোচনার বিষয়বস্তু জানা যায়নি। কিন্তু এরপর যখন মৌলানা আজাদ মি: গান্ধীর সাথে দেখা করলেন, তখন বিস্ময়ে হতবাক হলেন মৌলানা আজাদ।
কারণ ভারত ভাগ করার ফমূর্লা নিয়ে মি: গান্ধীর আগের অবস্থান বদলে গেছে। তিনি ভারত বিভক্তি সমর্থন না করলেও, আগের মতো জোরালো বিরোধিতাও করছেন না।
মি: গান্ধীর এ অবস্থান দেখে হতাশ হয়েছিলেন মৌলানা আজাদ। তবে মি: গান্ধী জানালেন, তিনি প্রস্তাব করেছেন যাতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সরকার গঠন করে এবং তাঁর পছন্দ মতো ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রীসভা তৈরি করে। এ বিষয়টি মি: গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে তুলে ধরেন এবং মি: মাউন্টব্যাটেন তাতে রাজী হয়েছেন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, মি: গান্ধীর প্রস্তাব যদি কংগ্রেস মেনে নেয় তাহলে ভারত বিভক্তি এড়ানো যেতে পারে।
কিন্তু জওহরলাল নেহেরু ও সরদার প্যাটেল মি: গান্ধীর প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা দুজনে মিলে মি: গান্ধীকে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহারে বাধ্য করেন।
তখন মি: গান্ধী বলেন, ভারতবর্ষ বিভক্তি অনিবার্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কিভাবে ভাগ হবে।
মৌলানা আজাদ রাজী না থাকলেও ভারত ভাগ করার বিষয়ে কংগ্রেসের বাকি নেতৃত্ব সেটি গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারপরেও মৌলানা আজাদ তাঁর শেষ চেষ্টা হিসেবে মি: গান্ধীকে আবারো বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
তিনি মি: গান্ধীকে বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে সেটি আরো দুই বছর চলুক। প্রকৃত ক্ষমতা এখন ভারতীয়দের হাতে। এ পরিস্থিতি যদি দুই বছর পর্যন্ত চলে তাহলে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এ সময়ের মধ্যে তাদের অবস্থান বদলে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতেও পারে।
মৌলানা আজাদ ভেবেছিলেন, দুই বছর পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ একমত হতে বাধ্য হবে।
কিন্তু মি: গান্ধি এ প্রস্তাব বাতিল করলেন না এবং কোন আগ্রহও দেখালেন না।
এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডন চলে যান। মৌলানা আজাদ মনে করেন, মি: মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্ত করার পক্ষেই ছিলেন এবং তিনি তাঁর পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে গিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের ৩০শে মে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। ২রা জুন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন।
তার পরের দিন ৩রা জুন মি: মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত 'হোয়াইট পেপার' বা 'শ্বেতপত্র' প্রকাশ করেন। সেখানে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়।
ব্রিটিশ সরকারের সে ঘোষণার মাধ্যমে ভারতবর্ষ অখণ্ড রাখার সব আশা শেষ হয়ে গেল।
মৌলানা আজাদ মনে করেন, ভারতবর্ষ ভাগ করার পেছনে ভারতীয়দের স্বার্থের চেয়ে ব্রিটিশদের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এজন্য শেষ পর্যন্ত বিচার বিশ্লেষণ করে তারা ভারত ভাগ করার দিকেই এগিয়ে গেল।
ব্রিটেন মনে করেছিল, যদি অখণ্ড ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে সে দেশটির উপর তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব থাকবে না।
বিভক্ত ভারতবর্ষ ব্রিটেনের স্বার্থ হাসিল করতো বলেই তাদের ধারণা।
মৌলানা আজাদ লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত হয়ে তার স্বাধীনতার মূল্য দিতে হলো।
(ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি এবং কংগ্রেস নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের 'ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম' বই থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ করে এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর পূর্ণাঙ্গ বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৮ সালে। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।সে সময় তিনি কংগ্রেস পার্টির পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ফিরোজ বখত। কিন্তু যৌবনে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন মুহিউদ্দিন আহমেদ নামে। পরবর্তীতে তিনি ছদ্মনাম ধারণ করেন আবুল কালাম আজাদ হিসেবে এবং সেটিই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠে।)
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগদের সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞ তাদের পুরনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
Image result for বৌদ্ধ ধর্মবৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগদের সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞ তাদের পুরনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
‘মগের মুলুক’ বাংলাদেশে একটি সুপরিচিত বাগধারা। বাংলা একাডেমি এর অর্থ লিখেছে—১. ব্রহ্মদেশ বা আরাকান রাজ্য। ২. অরাজক রাষ্ট্র, যে রাজ্যে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, যেখানে যথেচ্ছাচার হয়। বার্মিজরা ঐতিহাসিকভাবেই বর্বর, নিষ্ঠুর। মানুষের গলায় দড়ি বাঁধা, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া রাখাইনদের পুরনো অভ্যাস। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ক্রোনিকলস’-এর বর্ণনায় জানা যায়, ১৭১৮ সালে বার্মার রাখাইন রাজা দক্ষিণবঙ্গ তছনছ করে অন্তত এক হাজার ৮০০ জন সাধারণ অধিবাসীকে ধরে নিয়ে যান। বন্দিদের রাজার সামনে হাজির করা হলে রাখাইন রাজা সেখান থেকে বেছে বেছে এক দলকে তাঁর নিজের দাস বানান, আর অবশিষ্টদের গলায় দড়ি বেঁধে ক্রীতদাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দেন। মগের মুলুক বলতে জোর যার মুলুক তার। এ বাগধারা মিয়ানমারের মগদের বর্বরতা ও দস্যুপনা থেকেই এসেছে।



সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমাংশে তখনকার বাংলা বা বঙ্গদেশ খুব সমৃদ্ধ ছিল। ওই সময় দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ‘মগ’ জাতির দস্যুরা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে খুব লুটপাট ও ডাকাতি করত। বর্তমানে যারা রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর আক্রমণ করছে, তাদের বলা হচ্ছে রাখাইন উপজাতি। এ রাখাইন উপজাতির আগের নাম মগ। সেই মগরাই ৪০০ বছর আগেও অত্যাচার ও লুটপাট চালাত। তখনকার আমলের মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লি থেকে নিযুক্ত, তৎকালীন বাংলা-প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থানকারী শাসনকর্তা বা সুবেদার, পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। মগরা যা ইচ্ছা তাই করেছিল। অর্থাৎ তখন সরকার ছিল না, মোগলদের পরিবর্তে দেশের মালিক হয়ে গিয়েছিল মগ দস্যুরা। মুলুক শব্দটির অর্থ দেশ বা এলাকা ইত্যাদি। পর্তুগিজ নৌ-দস্যুদের সঙ্গে যখন আরাকানি বৌদ্ধরা হাত মিলিয়ে বাংলার উপকূলীয় এলাকায় সম্ভ্রমহরণ-লুণ্ঠন-হত্যার মতো জঘন্য কর্মে লিপ্ত হয় তখন থেকেই ‘মগ’ ও ‘মগের মুলুক’ জাতি ও দেশবাচক শব্দ দুটি অরাজকতার নামান্তররূপে ব্যবহৃত হতে থাকে। (তথ্যসূত্র : বঙ্গে মগ-ফিরিঙ্গি ও বর্গির অত্যাচার, মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা ২৫)