২০০১ সালের ১৫ এবং ১৬ এপ্রিল সিলেট সীমান্তে পদুয়ায়, ১৮ এপ্রিল কুড়িগ্রামের রৌমারী এবং ১৯ এপ্রিল পুনরায় পদুয়া সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের সাথে বিডিআরের সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। এই তিনটি যুদ্ধেই বাংলাদেশের সে সময়ের বিডিআরের জোয়ানরা অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে এবং তিনটিতেই বিজয় অর্জন করে। এসময় বিডিআর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আ.ল.ম ফজলুর রহমান। এই যুদ্ধের বীরত্বগাথা বর্ণনা করেছেন তিনি নিজেই। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন দেশের খবর সম্পাদক হাসান খালিদ।
আমাদের যে বর্তমানে যে ‘বিজিবি’ এটার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ২১৩ বছরের ইতিহাস- এটি প্রথমে ‘রামগড় ব্যাটালিয়ান’ হিসেবে রেইজ হয় এবং তাদের যাত্রা শুরু করে। পুরো বৃটিশ আমল তারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন নামে দায়িত্ব করার পরে পাকিস্তান যখন হয় তখন এই বাহিনীটার নাম ‘ইপিআর’ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্। এই বাহিনীর বিশেষত্ব হলো যে এর প্রত্যেকটা সদস্য ঐ সময় ১৯৭১ সালে সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং দু’জন বীরশ্রেষ্ঠ এই বাহিনীতে আছে। অনেক বীরবিক্রম, বীরউত্তম, বীরপ্রতীক এই বাহিনীতে আছে। যখন যুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো, তখন এই বাহিনীর নাম হলো ‘বিডিআর’ বাংলাদেশ রাইফেলস্।
আমি ২০০০ সালে এই বাহিনীতে ‘মহাপরিচালক’ হিসেবে নিয়োগ পাই। এবং নিয়োগ পাওয়ার পরে আমি দেখলাম যে ভারতীয় আগ্রাসন সীমান্তে চলছে এবং আমাদের বাংলাদেশীদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। আমি ভারতীয় কাউন্টার পার্ট বিএসএফ তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম- যে তোমরা বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধ কর। কিন্তু যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না তখন আমি খোলা আদেশ দিলাম, যে ক্যাম্পের যে ব্যাটালিয়ান এরিয়ায় কোন বাংলাদেশীকে হত্যা করা হবে, যে বিএসএফের ক্যাম্পের বিএসএফ এই হত্যাকাণ্ড চালাবে ঐ বিএসএফ ক্যাম্পের তিন জন বিএসএফকে গুলি করে মেরে ডেডবডি আমাকে প্রদর্শন করতে হবে, এবং আমরা সেটা নিশ্চিত করলাম। পরে ভারতীয় আগ্রাসন কমে গেলো।
‘পদুয়া’ আপনারা জানেন যে- সিলেটের জাফলং এলাকায় এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ক্যাম্প ছিল। বাংলাদেশের সীমান্তের প্রায় দেড় কিলোমিটারের মতো ভেতরে। যেহেতু ভারতীয় বাহিনী ঐ সময় আমাদেরকে সহায়তা দিয়েছিল।
তো এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো- সবার জন্য আমি বলছি- নির্মোহভাবে। ভারত চেয়েছিল- পাকিস্তান ভাঙতে, আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভারতের যেমন স্বার্থ এ যুদ্ধে, আমাদেরও স্বার্থ ছিল- আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা। আট মাস আমরা যুদ্ধ করেছি, এই আট মাস আমাদেরকে সহায়তা করেছে, কিন্তু যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে নভেম্বর মাসের দিকে এবং ডিসেম্বর মাসে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তো আমি বলতে চাই- যে আমরা আট মাস যুদ্ধ করেছি নিজেদের যুদ্ধ এবং ভারতীয়দের হয়েও আমরা তাদের যুদ্ধ করেছি পাকিস্তান ভাঙার জন্য। এই যুদ্ধের কৃতিত্ব আমাদের নব্বই ভাগ, ভারতের দশ ভাগ। কাজেই আমাদের কারো এটা মনের মধ্যে থাকা উচিত নয় যে, ভারত আমাদের স্বাধীন করে দিয়েছে। না, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এবং আমরা নিজের শক্তিতে, আত্মশক্তি দ্বারা আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
সেই পদুয়াতে একটা ক্যাম্প ছিল যেখানে ভারতের বিএসএফ আর্মি এবং মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে মিলে ঐ অঞ্চলে মিলে যুদ্ধ করত। যখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেল- ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানীরা সারেন্ডার করলো, তখন আমরা ঐ ক্যাম্পটা ওখানকার যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল তারা ছেড়ে দিয়ে দেশের ভিতরে চলে এলো, কিন্তু ভারত সেটা ছাড়েনি। প্রায় ২৩০ একরের মতো একটা জায়গা পদুয়া। সেখানে তারা লোকজনকে নিয়ে এসে পুনর্বাসন করলো খাসিয়াদেরকে, এবং ঐ এলাকায় নানান ধরনের ইনফোর্সমেন্ট নানান ধরনের অন্যায়-অত্যাচার তারা শুরু করলো।
তো আমি ডিজি বিডিআর হয়ে যাওয়ার পরে দেখলাম, যে তারা ওখান থেকে দশ কিলোমিটারের মতো দূরে আরেকটা ক্যাম্প থেকে নোম্যান্স ল্যান্ডের উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে তারা পদুয়াকে কানেক্ট করছিল। হয়তো তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এটাকে কুক্ষিগত করার। আমরা প্রোটেস্ট এর প্রোটেস্ট নোট পাঠাতে থাকলাম তাদের কাছে, ফ্ল্যাগ মিটিং চাইলাম। তারা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তো যেহেতেু ডিজি বিডিআর হিসেবে আমি বাংলাদেশের স্বার্বভৌম এলাকার উপরে কারো পারমিশন ছাড়া টেম্পরারি অপারেশনাল ক্যাম্প এস্টাবিøশ করতে পারি, এই পারমিশনের উপর ভিত্তি করে ২০০১ সালের এপ্রিল মাসের ১৫-১৬ রাত আমি চার শ’র মতো ফোর্স পদুয়াতে মুভ করে দেই। আমরা কোন গুলি-ফায়ার করিনি। বিএসএফের ওখানে প্রায় ৭০ জনের মতো সোলজার ছিল, ছয়টা গুলি-ফায়ার করার পরে তারা সেখানে সারেন্ডার করে। পরের দিন সকাল বেলা যখন (খবর ওরা রাত্রেবেলাই পেয়ে গেছে) তাদের কাউন্টার পার্ট সেখানে আসা শুরু হয়ে গেছে, তখন আমরা করলাম কি যে তিনবিঘা করিডরে যেখানে আমাদের এক ঘন্টা পরপর বাঙালিদেরকে সেই আঙ্গারপোতা-দহগ্রামের লোকজনকে যেতে দেয়া হয় করিডোরের উপর দিয়ে, আমরা সেখানে বাঁশ দিয়ে একটা ব্যারিকেড দিলাম এবং ওদের যারা কমাণ্ডার তাদের সারেন্ডার করা সৈন্যদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেছিল তাদের আমরা ওখানে একঘন্টা করে দাঁড় করিয়ে রাখতাম এবং এক ঘন্টা পরে তাদেরকে এন্ট্রি দেয়া হতো।
১৬ তারিখে নেগসিয়েশন শুরু হলো ইন্ডিয়ার সঙ্গে, যে এই পদুয়ার কি হবে এবং পদুয়া নিয়ে ফারদার কি পদক্ষেপ নেয়া যায়। এই নেগসিয়েশন যখন ডাহুকীতে চলছিল- তখন ভারত বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের অজান্তে ১৮ এপ্রিল, ১৬ এপ্রিল নেগসিয়েশন শুরু হলো- ১৭ এপ্রিলে নেগসিয়েশন চলছিল আমরা একটা কনক্লুশনে আসতেছিলাম তখন তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে ওখান থেকে প্রায় দুশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার বরাইবাড়ীর ওখানে আমাদের একটা ক্যাম্প আছে, সেই ক্যাম্প ও ঐ এলাকাকে দখলে নেবার জন্য প্রায় ৫০০ ফোর্স সেখানে আগ্রাসন চালায়, আমাদের দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে। এবং ৩০ বছরের মাথায় এটাই বহির্শত্রæদ্বারা আমাদের দেশ প্রথম আক্রান্ত হয়। যখন আমি খবর পেলাম তখন ভোর চারটার মতো বাজে। কর্নেল এনায়েত ছিলেন তখন সেক্টর কমাণ্ডার ময়মনসিংহ আর নেত্রকোনাতে ঐ সময় কমান্ডিং অফিসার ছিল লে. কর্নেল শায়রুজ্জামান। আমি তাদেরকে ডাকি সেটে (ওয়ারলেস)। ডেকে আমি বলি যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফোর্স মুভ করে দেয়ার জন্য। ইতিমধ্যে ঐ ক্যাম্প থেকে এবং বিডিআরের ঐ সময় যোগাযোগ একেবারে ক্যাম্প পর্যন্ত ছিল, এখনো আছে। তো ক্যাম্প থেকে আমরা খবর পাচ্ছিলাম যে প্রায় চার/পাঁচ শ’র মতো ফোর্স ঐ এলাকায় ডুকেছে এবং তারা ক্যাম্পটাকে লোকেট করতে পারেনি। এর একটা ইতিহাস আছে, ছোট গল্প আছে, যখন তারা (ভারতীয় বাহিনী) ঢোকে চারটার দিকে (ভোর রাত) এরমধ্যে ভারতের আর্মি ছিল, ব্ল্যাক ক্যাট ছিল, বিএসএফ ছিল- ঢুকে তারা দেখে যে ঐ এলাকার (বরাইবাড়ী এলাকার) গ্রামের এক ছেলে (আবদুল মালেক) ভোরে জমিতে পানি দিতে গেছে। প্রথমে সে বুঝতে পারেনি অন্ধকারের মধ্যে। তারপর যখন সে দেখলো যে ভারতীয় বাহিনী ভেতরে ঢুকেছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছে বরাইবাড়ী ক্যাম্পটা কোথায়। সে বুদ্ধি করে ক্যাম্পের উল্টোদিকের জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে তাদেরকে। যাইহোক ওরা তখন গোলকধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে গেছে। আর্মিতে একটা টারমোলজি আছে ‘রিকোনসেন্স’। তো ওদের রিকোনসেন্স ছিল না বলে এই জিনিসটা হয়েছে। তারা খুঁজে পাচ্ছিলো না। ইতিমধ্যে আমরা খুব কুইকলি ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনা থেকে প্রায় চারশ’ ফোর্স সেখানে মুভ করে দেই এবং এরা দশটার দিকে ওখানে পৌঁছে যায়। আমার ধারণা ছিল আরো সময় লাগবে, কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে গেছে এরা। রাস্তা যেহেতু শুকনা ছিল কোন অসুবিধা হয় নাই। দশটার সময় ভারতীয় বাহিনীকে ওপেন গ্রাউন্ডে পেয়ে যায় এবং পাঁচ শ’র মধ্যে ওদের চার শ’ই ক্যাজুয়ালটি হয়ে যায়। তারমধ্যে আঠারটা ডেডবডি তারা নিয়ে যেতে পারেনি। আমাদের মধ্যে তিনজন শাহাদত বরণ করে। আমি তখন ডিজি বিএসএফকে বারবার বলছিলাম যে তোমরা ফায়ার বন্ধ কর আমরা ডেডবডিগুলো নিয়ে আসি, গরমের মধ্যে-রোদের মধ্যে এগুলো গুলি খেয়েছে, রক্তক্ষরণ হয়েছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একবার তারা ফায়ার বন্ধ করলো, আমাকে বললো- ‘হ্যা এক্সেসেলেন্সি আমি ফায়ার বন্ধ করছি’। সরল বিশ্বাস করে যখন আমরা টুলস্ মুভ করে ঐ ডেডবডিগুলো আনার সময় তখন টুরা থেকে ফায়ার আসে, ওখানে একটা ব্রিজের মতো আছে, ব্রিজ থেকে ফায়ার এসে মাহফুজুর রহমান নামে এক সৈনিক শহীদ হয়ে যায়। যাই হোক পরে আমরা ঐ ডেডবডিগুলো কালেক্ট করি। ভারতীয়রা প্রায় পাঁচ ট্রাক ডেডবডি নিয়ে যায়। আমাদের আন্দাজ যে প্রায় চার শ’র মতো সৈনিক মারা যায় এখানে। এগুলো টুরাতে নিয়ে গিয়ে তারা ডেডবডিগুলো হ্যান্ডওভার করার কথা আমরা শুনেছি- কিন্তু ডেডবডি হ্যান্ডওভার করেনি। তারা ঐ বডিগুলো জ্বালিয়ে তাদের ধর্মমতে যে ছাই হয়, ভস্ম হয় সেই ভস্মটা হ্যান্ডওভার করেছে পরিবারের কাছে। কারণ আমার ধারণা, তারা এটা করেছে এইজন্য যে- এই চার শ’ ডেডবডি যদি ভারতের পরিবারের কাছে যেত তাহলে সরকারের পতন হয়ে যেত। যদিও বিজেপি সরকার ইলেকশনে আসতে পারেনি, তাদের পতন হয়ে গেছে।
ঐ ডেডবডিগুলো নিয়ে এসে সংগে সংগে আমরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেই। পোস্টমর্টেম হয় এবং পোস্টমর্টেম এর রিপোর্টসহ আমরা এইগুলাকে ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করি এবং ওদের দু’জন প্রিজনার্স অব ওয়ার আমাদের হাতে ধরা পড়ে সেদু’জনকে আমরা নিয়ে আসি এবং পরবর্তীতে এই প্রিজনার্স অব ওয়ার দু’জনকে আমরা ভারতের যে হাইকমিশন এখানে আছে সেখানে আমরা হ্যান্ডওভার করে দেই এবং এখানেই এই যুদ্ধটা শেষ হয়ে যায়।
পদুয়াতে তো প্রথমে ওদের সত্তর জন সারেন্ডার করাই আছে, ওখানে চার শ’ ফোর্স আমাদের টাগিং পজিশনে আছে, ফরটি ফাইভ লোকেশনে। আর রৌমারীতে আঠার তারিখে যুদ্ধ হলো- ঊনিশ তারিখ ভোর বেলা আমি খবর পেলাম যে পদুয়া পুনরায় ভারত আক্রমণ করবার জন্য এক ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে আরেকটা আর্টিলারি ইউনিট সাপোর্টসহ তারা পদুয়া আক্রমণ করবার জন্য ফর্মিআপ করছে। তখন আমি সংগে সংগে আমাদের স্টাফ অফিসারদের ডাকলাম, ডেকে পরামর্শ করলাম। এদিকে তো ভারতের পার্লামেন্ট তিনবার কল করা হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত ওখানে করা হচ্ছিল যে, আমাদের বিডিআর হেডকোয়ার্টার বম্বিং করা হবে। আমি যখন খবর পেলাম যে ওদের একটা ব্রিগেড সংগঠিত হচ্ছে আমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য, তখন আমি কানেক্ট করলাম ওখানে মেজর কালাম তার সাথে। হঠাৎই সংবাদ আসলো যে ওখানে দুটো আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ার, ওদের প্রায় ২০টা ক্যারিয়ার ছিল তার মধ্যে দুটো আর্মার পার্স ক্যারিয়ার আমাদের ডিফেন্সের প্রায় ১০ গজের মধ্যে চলে আসে। ওখানে খুব হেভি ওয়েপেন ছিল আমাদের। মর্টার ছিল, বøান্ডিসাইড ছিল, ফরটি এমএম রকেট লাঞ্চার ছিল যেটা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী। আমাকে খবর দেয়া হলো যে দুটো এপিসি (আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ার) দুই সেকশনের মতো সৈন্য আছে তারা আমাদের ১০ গজের মধ্যে চলে আসছে। তো ঐটাকে আমি সুযোগটা আমি গ্রহণ করলাম, টেকনিক্যালি। আমি আমার স্টাফ অফিসারদেরকে ডেকে বললাম যে, মেজর কালামকে আমাদের স্যাকরিফাইস করতে হতে পারে ফর সেক অব দি নেশন। ওরা প্রথমে জিনিসটা বুঝে উঠতে পারেনি। আমাকে বললো, স্যার স্যাকরিফাইস বলতে আপনি কি বোঝাাচ্ছন! যদিও আমি এক্সপ্লেইন করিনি ব্যাপারটা তাদের কাছে, আমার ধারণা ছিল যে মেজর কালামকে যখন অর্ডার দিবো যে সে ডিফেন্স থেকে উঠে ঐ আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ারে গিয়ে তাদেরকে সারেন্ডার করতে বলবে, যেহেতু আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ারে সামনে দুটো মেশিনগান পেছনে দুটো মেশিনগান আছে হয়তো তারা গুলি করে দেবে এবং মরে যাবে এই অফিসারটা। তারপরেও একটু চান্স- আমি একটা ডেসপারেট অ্যাকশন নেই। কেননা এইটার উপরেই আমার ধারণা ছিল জয়-পরাজয় নির্ভর করছে আমাদের। তো বড় ক্যাজুয়েলটি এড়াতে আমি এই জিনিসটা করি এবং কালামকে আমি পার্সোনালই অর্ডার দিই, তুমি বাঙ্কার থেকে উঠে তোমার পার্সোনাল ওয়েপন নিয়ে তুমি সোজা আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ারের কাছে গিয়ে বলো, উপরে যে ঢাকনা থাকে টপলা বলে ওটাকে, তুমি ওখানে টপলাতে হিট করে বলবা যে তোমরা সারেন্ডার কর উইদ ইন টেন, ফর ইয়র ডিফেন্স। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছি যে- শুনতেছিলাম ঐ সময়, সে গেছে এবং আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ারে টপলাতে টোকা দিয়ে বলেছে, তোমরা সারেন্ডার করো। দুই সেকশন সৈন্য সারেন্ডার করে গেছে। তো দুই সেকশন সৈন্য যখন সারেন্ডার করে গেলো তখন আগে তো সত্তর জন ছিল- আরো বারো বারো ২৪ জন এসে জমা হয়ে গেলো ওদের সঙ্গে। বেলা দেড়টার দিকে আমার কাছে রিকোয়েস্ট আসলো যে, স্যার ভারতীয় বাহিনী আপনার কাছে সারেন্ডার করতে চায়। ঐ সময় যেহেতু আমাদের ফোর্স টাগিং পজিশনে ছিল, আমাদের বাড়তি কোনো ফোর্স ছিল না, কাজেই ফর্মাল যে সারেন্ডার গ্রহণ করার সেই জিনিসটা আমরা গ্রহণ করিনি। আমি তখন ঐ কালামকে বললাম যে, ফেস দি এনিমি কমান্ডার, ফোর্স কমান্ডার। তো ওখানে একজন ব্রিগেডিয়ার আমার সঙ্গে কথা বললো, ও বললো যে- স্যার, আই অ্যাম সারেন্ডারিং টু ইউ। আমি বললাম- আই অ্যাকসেপ্ট ইউর সারেন্ডার, তুমি তোমার ফোর্স যারা আছে তাদেরকে ফর্মিংআপ প্লেস থেকে পিছনে সরিয়ে নিয়ে যাও এবং এক জায়গায় জমা করো এবং হাতিয়ারগুলো আরেক জায়গায় জমা করো। তোমাদের কারো কাছে কোনো হাতিয়ার থাকবে না। উই আর নট সেন্ডিং এনি ফোর্স টু টেক ওভার দি ওয়েপেনস এন্ড এমুনিশেসন্স। তো তোমরা আলাদা কর হাতিয়ারগুলোকে, তোমাদের পার্সোনাল এমুনিশনগুলো তোমাদের কাছে থাক কোনো অসুবিধা নাই। ওরা তাই করলো। সন্ধ্যার দিকে আমাকে এনিমি কমান্ডার ভারতীয় বাহিনীর যে ব্রিগেডিয়ার আমাকে বললো যে, স্যার হট ইজ দ্য অর্ডার ফর মি আজকের জন্য। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি বললাম তোমার জন্য অর্ডার হলো এই- যে রাস্তা তোমরা সাড়ে চার কিলোমিটার বানিয়েছো সে রাস্তাটা তুমি পার্সোনালি দাঁড়িয়ে থেকে ডিসপ্যাটেল করবা এবং আমাকে রাতে রিপোর্ট দিবা আমি জেগে থাকবো। ঠিক রাত্রে একটার দিকে আমাকে রিপোর্ট দেয়া হয় যে, এই রাস্তাটা সে দাঁড়িয়ে থেকে ডিসপ্যাটেল করে দিয়েছে। সম্ভবত পরের দিন আমরা একটা চিঠি রিসিভ করলাম ইন্ডিয়ার মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে, চিঠিটার কনটেন্ট এইরকম (অলমোস্ট না, ভারবাটিম এই রকম, যদিও আমার অত লাইন বাই লাইন আমার খেয়াল নাই), উই ইনভাইট এ ডেলিগেশন ফ্রম বাংলাদেশ উইদআউট এনি প্রিকন্ডিশন টু ডিসকাস অল আর্মস্ট্যান্ডিং ম্যাটার্স বিটুইন দি টু কান্ট্রিস। এই চিঠিটা ভারতের তরফ থেকে যখন আসলো তখনই উই ডিসাইডেড দ্যাট ইন্ডিয়া হ্যাজ এক্সেপ্টেড ডিফিট। তখন আমরা টিম তৈরি করলাম। জালিমুল হক নামে, জয়েন্ট সেক্রেটারি মিনিস্ট্রি অব হোম, তখন পলিটিক্যাল সাইডটি দেখাশোনা করতেন, ওনার নেতৃত্বে কর্নেল আসিফ ছিল সেক্টর কমান্ডার সিলেট তাকে এবং আরো কয়েকজন অফিসারকে আমরা ডাহুকীতে পাঠিয়ে দিই, ইন্ডিয়ার রিকোয়েস্টে। পরে সেখানে হোল ডে নেগোসিয়েশন হয় সম্ভবত ২১ তারিখে। ডিসাইড হয় এইটাই যখন ইন্দিরা-মুজিব টিটি ফাইনালি রেটিফাই হবে দ্যান ইন্ডিয়া এন্ড বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট বসে এটা বাংলাদেশের যে সভরেন্ট টেরিটরি সেটা বাংলাদেশ ফেরত পাবে। তারপরে আমরা কয়েকদিন পরে সেখান থেকে আমাদের ফোর্সকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।ভরতের চিঠি পাবার পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জুগ্মসচিব জানিবুল হকের নেতৃত্বে ডি ও টি বি ডি আর কর্নেল রফিকুল ইসলাম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্ভবত মোস্তফিজুর রহমান দিল্লি যান এবং চানক্যপুরিতে ভারতীয় প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনা করে উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ।“
এখানে একটা প্রশ্ন অনেকেই করেন- আমরা ওখানে থেকে গেলে কি হতো? ঐ সময় চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান। আমি ওনাকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম যে, কুমিল্লা ডিভিশন থেকে আমাকে একটা আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়ার জন্য। আনফরচুনেটলি উনি সেটা দেননি। না দেয়াতে আমি চিন্তা করে দেখলাম যে, যেটা আমরা চেয়েছিলাম অ্যাচিভ করতে, আমাদের টেরিটরি আমরা ফেরত পাবো এবং ইন্দিরা-মুজিব টিটি, এটা যখন জবর দখল অপদখলে আছে (অপদখলীয় অনেক জমি আছে ভারতের হাতে, আমাদেরও দখলে আছে ভারতের অনেক অপদখলীয় জমি) এগুলো যখন ডিসিশন হবে বোথ দ্য গভর্নমেন্ট উইল ডিসাইড। আমি যে জিনিসটা চিন্তা করে দেখলাম- যদি আমরা এখানে স্টে করি তাহলে সিচুয়েশনটা কাম-ডাউন করবে না, শান্তিপ্রতিষ্ঠা হবে না এবং একটা অলআউট ওয়ারে হয়তো আমরা ভারতের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারি যেটারে জন্য আই নট প্রিপিয়ার্ড। আর একজন জেনারেল হিসাবে আমি যতটুকু অ্যাচিভ করতে চেয়েছিলাম ‘এ ভিক্টরি’ ঐটা আমরা অ্যাচিভ করেছি। পদুয়া এবং রৌমারীতে তিন তিনবার ভারত পরাজিত হয়েছে, পদুয়াতে প্রথমে একবার, রৌমারীতে একবার আবার পদুয়াতে আরেকবার। তাদের এক ব্রিগেড সৈন্য আমাদের কাছে সারেন্ডার করেছে, তারা চিঠি দিয়ে ‘ডিফিট এক্সসেপ্ট’ করেছে। নেগোসিয়েশন করতে বাধ্য হয়েছে আমাদের সঙ্গে উইদ আউট এনি প্রিকন্ডিশন। এটাই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট। এরপরে আমি আর সামনে অগ্রসর হতে চাইনি, এই কারণের জন্য যে, এটা নিয়ে যদি একটা অলআউট ওয়ারে যদি জড়িয়ে আমরা পড়তাম তাহলে সমস্ত ‘দোষটা এসে আমার উপরে পড়ত। তো আমার এইম তো সেটা ছিল না, আমার এইম ছিল- পদুয়া উদ্ধার করা, সেটা ঐ সময়ে উদ্ধার করেছিলাম।