পলাশীর যুদ্ধকে প্রায় সবাই বলেন, ‘প্রহসন’। সেই দিনটি ছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। পলাশীর যুদ্ধে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীকে ‘পরাজিত’ করেছিল ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানির অধিনায়ক রবার্ট কাইভের বাহিনী। ইংরেজ ঐতিহাসিক লে. কর্নেল ম্যালিসনের মতে, নবাব বাহিনীতে ছিল ৩৫ হাজার পদাতিক সিপাহি, ১৫ হাজার অশ্বারোহী সেনা এবং ৫৩টি কামান; ঐতিহাসিক ওর্মির মতে, ৫০ হাজার পদাতিক, ১৪ হাজার অশ্বারোহী এবং ৫০টি কামান, আর স্ক্রাফটনের মতে ৫০ হাজার পদাতিক, ১৫ হাজার অশ্বারোহী এবং ৫০টি কামান। অপর দিকে, কোম্পানি বাহিনীতে ছিল ৯ হাজার ইউরোপীয় সৈন্য, ১০০ তোপাসী এবং দুই হাজার দেশীয় সিপাহি। স্পষ্টতই ইউরোপীয় ও দেশীয় সিপাহি তোপাসী নিয়ে সর্বমোট তিন হাজারের মতো এক ুদ্র বাহিনী হারিয়ে দিয়েছিল প্রায় ৬৫ হাজারের এক বিশাল বাহিনীকে। এমনিতে ব্যাপারটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। কোনো ইংরেজ ঐতিহাসিক পর্যন্ত এই যুদ্ধকে যুদ্ধই বলতে চাননি। পলাশীর যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ষড়যন্ত্রমূলক একটা যুদ্ধের অভিনয় মাত্র।
ঐতিহাসিক শ্রী নিখিলনাথ রায়ের কথায়, ‘বিশ্বাসঘাতকতার জন্য পলাশীতে যে ইংরেজরা জয়লাভ করিয়াছিল, ইহা নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক মাত্রেরই মত’। ৬৫ হাজার সৈন্যের মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্যই ছিল বিশ্বাসঘাতক সেনানায়কদের অধীনে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের কথা : ‘ভারতীয় সমাজের বিপর্যয়ের সুযোগ লইয়া বিদেশী ইংরেজ শক্তি সহজলব্ধ শিকার হিসেবে ভারতবর্ষকে গ্রাস করিতে আরম্ভ করিল। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয় তাহারই আরম্ভ মাত্র। .... তৎকালে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী নিজ নিজ গভীর সঙ্কটের আবর্তে তলাইয়া যাইতেছিল, সমাজের উপরতলার বিভিন্ন শক্তি পরস্পরের সহিত হানাহানি করিয়া পরস্পরের ধ্বংসের পথ প্রস্তুত করিতেছিল। বিদেশী ইংরেজদের উন্নত শক্তির আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কাহারও আর অবশিষ্ট ছিল না। ইংরেজ শক্তিও এতদিন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। এবার তাহারা দ্রুত অগ্রসর হইয়া ভারতের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ অঞ্চল বঙ্গদেশে জাঁকিয়া বসিয়া ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষকেই গ্রাস করিতে আরম্ভ করিল।’ (ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ.৭)।
পলাশী বিপর্যয়ের সাথে জড়িত ছিল তিনটি প্রধান শক্তি। নবাবের অনুগত প্রধানেরা, নবাবের বিরোধী প্রধানেরা এবং ইংরেজরা। নবাবের বিরোধী গ্রুপটি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতো জগৎশেঠ, মাহতাব চাঁদ, রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণ দুর্লভরাম প্রমুখ হিন্দু প্রধানদের দিয়ে।
ঐতিহাসিক তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় ‘পলাশীর যুদ্ধ’ গ্রন্থে লিখেছে : ‘ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র’...। হিন্দুদের চক্রান্ত হলেও বড় গোছের মুসলমান তো অন্তত একজন চাই। নইলে সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় বাংলার নবাব হবেন কে? ক্লাইভ তো নিজে হতে পারে না। হিন্দু গভর্নরও কেউ পছন্দ করবে কি না, সন্দেহ? জগৎশেঠরা তাদেরই আশ্রিত ইয়ার লুৎফ খাঁকে সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় মসনদে বসাতে মনস্থ করেছিল। উমিচাঁদেরও এতে সায় ছিল। কিন্তু ক্লাইভ ঠিক করল অন্য রকম। সে এমন লোককে নবাব করতে চায় যে ইংরেজদেরই তাবেদার থেকে তাদেরই কথা শুনে নবাবী করবে। ক্লাইভ মনে মনে মীরজাফরকেই বাংলার ভাবী নবাব পদের জন্য মনোনীত করে রেখেছিলে। পৃ. ১৫৮-১৫৯)।
১৮ মে ১৯৯১ কলকাতার দেশ সাপ্তাহিকীতে ‘পলাশী কার চক্রান্ত?’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে শ্রী সুশীল চৌধুরী লিখেছে : বিশ্বাসঘাতকতার দায় শুধু মীরজাফরের নয়। জগৎশেঠদের দায় মীরজাফরের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পিছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব ক’টা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য অংশ নিয়েছে। এ সময়কার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদের হাতে। ...রবার্ট কাইভের লেখা চিঠিপত্র দেখার পর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, পলাশী চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদদ পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।