ছয় শতকের গোড়ার দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে স্থানীয় রাজাদের উত্থান হতে থাকে এবং স্থানীয় রাজাদের হাতেই বাংলা এবং উত্তর ভারত শাসিত হতে থাকে। সাত শতকের শুরুতে (৬০১ খ্রিস্টাব্দে) পশ্চিম বঙ্গে হিন্দু রাজা শশাঙ্কের আবির্ভাব হয়। তার শাসনকাল ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শশাঙ্ক ছিল চরম বৌদ্ধ বিদ্ধেষী। শশাঙ্কের নিষ্ঠুর অত্যাচারে অনেক বাঙালি বৌদ্ধ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় ( R .C. Majumdar, বাংলা দেশের ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ, ১৯৮৮, পৃঃ১২৮)
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্ৰমণকারী চীনা পরিব্রাজক হিউয়ান সাং বলে রাজা শশাঙ্ক গয়ায় বোধিবৃক্ষ ছেদন করে এবং নিকটবর্তী বৌদ্ধ মন্দির থেকে বুদ্ধমূর্তি সরিয়ে সেখানে শিবের মূর্তি প্রতিস্থাপন করে [T. Walters, on Yuan Chwang’s Travels in India (A.D 629-45), 1905, page 111, 115]। এছাড়াও পাটালিপুত্তা ও কুশীনারাতে বৌদ্ধদের অনেক বিহার এবং সৌধ ধ্বংস করা হয় (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯২)।
রাজা শশাঙ্কের বৌদ্ধনীতি সম্পর্কে রামাই পন্ডিতের শূন্য পুরান থেকে ধারণা পাওয়া যায়। ‘সেতুবন্ধ হইতে হিমালয় পর্যন্ত যেখানে যত বৌদ্ধ আছে তাহাদের বৃদ্ধ ও বালকদের পর্যন্ত যে না হত্যা করিবে, সে প্রাণদন্ডে দণ্ডিত হইবে-রাজভৃত্যদিগের প্রতি রাজার এই আদেশ (শ্রীচারু বন্দোপাধ্যায়, রামাই পন্ডিতের শূন্য পুরান, পৃষ্ঠা ১২৪)।
সংখ্যালঘু হিন্দুরা মেজরিটি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের শাসন করতে গিয়ে যেই দমন-নিপীড়ন শুরু করে তাতে এক গুমোট পরিবেশ তৈরী হয়, শশাঙ্কের মৃত্যুর সাথে সাথে এই পরিস্থিতির বিস্ফোরণ ঘটে। পরবর্তী একশত বছর পর্যন্ত অরাজক পরিস্থিতি চলতে থাকে যেটাকে মাৎসান্যায়ের একশো বছর বলা হয়। এই সময়ে একক কোনো রাষ্ট্র প্রধান ছিল না, ছোট ছোট সামন্তরা নিজ নিজ এলাকায় ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল।
ফলে সংখ্যাগুরু ধর্মালম্বীদের প্রতিনিধি হিসেবে গোপালের ক্ষমতার গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসে। গোপাল তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন ব্রাহ্মণকে নিয়োগ দেয়। গোপালের পূর্ব পুরুষরা ছিল ব্রাহ্মণ, পরবর্তীতে তারা মহাযানী বৌদ্ধে কনভার্ট হয়। ফলে গোপাল বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হলেও তার মধ্যে অত্যাধিক ব্রাহ্মণ প্রভাব ছিল এবং ব্রাহ্মণদের মধ্যে গোপালের গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। (ড. আব্দুল মু’মিন চৌধুরী, Rise and Fall of Buddhism in South Asia, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২২৮)।
গোপালের ছেলে ধর্মপাল, প্রথম মহিপাল এর সন্তান নয়াপাল ব্রাহ্মণদের প্রতি খুব সহানুভুতিশীল ছিল এবং ভূমি দান করেছ। অর্থাৎ পাল শাসনামলে বৌদ্ধদের প্রতি কোনো অত্যাচার-নির্যাতন হয়নি কিন্তু নীরবে-নিভৃতে ব্রাহ্মণায়ন ঘটেছে। রাষ্ট্র বৌদ্ধ ধর্মের মূলস্রোত থেরাবাদী বৌদ্ধদের তুলনায় হিন্দু প্রভাবিত মহাযানী, বজ্রযানী এসব সম্প্রদায়কেই মূলত পৃষ্ঠপোষকতা করেছে (ড. আব্দুল মু’মিন চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২০-২২৫)। ধারণা করা হয় রাষ্ট্র কর্তৃক বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃত সম্প্রদায়গুলোর পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর বাংলাদেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য তিব্বত চলে যায় (ড. আব্দুল মু’মিন চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩১)।
দক্ষিত ভারত থেকে আগত হিন্দু ধর্মালম্বী সেন বংশের লোকেরা পাল বংশের রাজা থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়। শুরু হয় বৌদ্ধদের উপর আরেক দফা নির্যাতন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজিয়ের আগ পর্যন্ত সেনরা বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চলতে থাকে। ঐতিহাসিক তারানাথ এবং সুম্পার (Sumpa) উদ্ধৃতি দিয়ে ড. মু’মিন চৌধুরী বলেন সেন রাজাদের অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা বাংলা থেকে প্যাগান, পেগু, আরাকান, কুকি এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩৬)। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণদের এসব অত্যাচারের কথা রামাই পন্ডিত রচিত ‘শুন্য পুরানে’ বিস্তারিত রয়েছে। সেন শাসনামলে বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ/হিন্দুদের অত্যাচারের মাত্রা ছিল অনেকটা শশাঙ্কের মত।
সেন রাজাদের অন্যতম ছিল রাজা বল্লাল সেন। সে কুলীন প্রথা চালু করে। বৌদ্ধদের একটা অংশকে কুলীন পদমর্যাদা দিয়ে হিন্দু ধর্মে গ্রহণ করে নেয়া হয় যারা কায়স্থ নামে পরিচিত। যারা সেনদের শাসনকে মাথা পেতে নেয়নি তারা হয়ে গেল নিম্ন বর্ণ (ড. মু’মিন চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪১)। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে ‘বস্তুত কৌলিন্য সে সকল লোককে দেওয়া হইয়াছিল, যাহারা ব্রাহ্মণ শাসন শিরোধার্য্য করিয়া লইয়াছিলেন’ (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-৪৮৩)।
সামাজিকভাবে সেন শাসনামলে পতিতাবৃত্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল, এমনকি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের মন্ত্রীমহোদয়গন পতিতা ও নর্তকিদের সাথে দামাদামি করতো(S.Sen: 1963 উদৃত ড. মু’মিন চৌধুরী, প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা-২৪৪)। লক্ষণ সেনের অনেকগুলো স্ত্রী ছিল।পয়সাওয়ালারা সেন আমলে নারীদেরকে দাসী হিসেবে রাখত এবং সেটা শুধু যৌন আমোদ প্রমোদের জন্যই।যদি কোন দাসীর একাদিক মালিক থাকত তাহলে তারা শেয়ার অনুসারে পর্যায়ক্রমে তাদের ব্যবহার করত (N. R. Roy 1993:466 উদৃত ড. মু’মিন চৌধুরী, প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা-২৪৪)। এ থেকে একথা প্রতিয়মান হয় যে, সমাজে অশ্লীলতার বিস্তার ব্রাহ্মণ্যবাদের একটি আদি কৌশল।