জাতীয় মর্যাদাসম্পন্ন ও স্বাধীনতাব্রতী যে কোনো মুসলিম শাসন অবসানের লক্ষ্যে আয়োজিত পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজের পতন ঘটাবার ষড়যন্ত্রটা ছিল যেহেতু আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র তাই এতদ্দেশীয় মুসলিম মানসে সিরাজ স্মৃতি আজও অম্লান চির দেদীপ্যমান। তাদের কাছে সুবে বাঙ্গালার নবাব সিরাজ চির বরেণ্য শহীদ সিরাজ এবং মুসলমানদের কাছে পলাশী বিপর্যয় তাদেরই পতন ইতিহাসের এক নির্মম প্রকাশ, রোদনভরা এই শিক্ষণীয় অনুভূতি।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনকালে নবাব সিরাজ অবিভক্ত বাংলায় এক স্মরণীয় বীর হিসেবে সম্মান ও প্রচারণা পেয়েছিলেন। তারপর বঙ্গভঙ্গ রদ হলো এবং যথাসময়ে ভারত ভঙ্গই হয়ে গেল। ভারত ভঙ্গের দুই যুগ পরে আবার পাকিস্তান ভঙ্গের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটলো স্বাধীন বাংলাদেশের। এ সময়টায় রাজনীতির রীতি অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলার একাংশ পশ্চিমবঙ্গে নবাব সিরাজের স্মৃতি বা সম্মান নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা পায়নি। হালে সিরাজের বিপরীতে সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে জগৎশেঠের স্মৃতি বা সম্মান। এমনকি মীরজাফরের সম্মানও নাকি সেখানে নবাব সিরাজের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের আজকের বাংলাদেশেও কোনো কোনো লেখকও কথিত বুদ্ধিজীবির মুখে শুনতে পাওয়া যায় মীরজাফরের গুণগাথা!
মৃত্যুশয্যায় নবাব আলীওয়ার্দীর অন্তিম উপদেশানুসারে এক দুর্যোগঘন পরিস্থিতিতে হাতে তুলে নেন দেশের শাসনভার। এদেশে মুঘল শাসনের যে তরী টালমাটাল অবস্থায় ডুবে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল, তারই কর্ণধারের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন নিজেকে। কিন্তু শেষ রক্ষা তিনি করতে পারেননি। পারেননি নিজের চারপাশের হিন্দু সেনাপতি ও সভাসদদের দুশ্চরিত্রতা বেঈমানী ও উপমহাদেশীয় বিরূপ পরিস্থিতির জন্য। তারই সৃষ্ট সুযোগে উপমহাদেশের এই পূর্বপ্রান্তে বিজয়ীর বেশে আবির্ভুত হয় পাশ্চাত্যের নবরূপী ক্রুসেডারদের অন্যতম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী হানাদার শক্তি। যাদের মূল চালিকা শক্তি ছিল হিন্দুরা এবং সব ষড়যন্ত্রের মূল হোতাও ছিল হিন্দুরা। ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে হিন্দুদের কারণেই শক্তি যোগাতে পেরেছিল এবং পলাশীতে জয়ী হয়েছিল। ইতিহাসের নিরীখে কোনো কোনো হিন্দু ঐতিহাসিকও এ সত্য স্বীকারে বাধ্য হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৮ মে ১৯৯১ সালের কলকাতার দেশ সাপ্তাহিকীতে ‘পলাশী কার চক্রান্ত?’ শিরোনামে এক হিন্দু প্রাবন্ধিক সুশীল চৌধুরীর লিখা উল্লেখ করা যেতে পারে। সে লিখেছে, ...কোনো কোনো ঐতিহাসিক ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যথার্থ প্রমাণে ব্যস্ত এসব ঐতিহাসিক প্রাক পলাশী বাঙালি সমাজের একটি দ্বিধাবিভক্ত চিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টায় খুবই সচেষ্ট। এদের বক্তব্য পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিভক্ত ছিল। মুসলমান শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান নবাবের হাত থেকে অব্যাহতির জন্য কোনো ত্রাণকর্তার প্রত্যাশায় অধীর হয়ে পড়েছিল এবং ইংরেজদের জানিয়েছিল সাদর অভ্যর্থনা। অতি সম্প্রতি আবার কিছু ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজদের বাংলা বিজয় একটি আকস্মিক ঘটনা, এর পিছনে ইংরেজদের কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। পলাশী বিপ্লবের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হচ্ছে, সিরাজ-উদ-দৌলা নবাব হয়ে প্রভাবশালী শাসকগোষ্ঠীকে তার প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট দেখা দেয়, তার শেষ পরিণতিই পলাশী বিপ্লব।
উপরোক্ত বক্তব্যগুলো কতটা সঠিক এবং তথ্য ও যুক্তিনির্ভর তার সূক্ষ্ম এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন মহাফেজখানায় যেসব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি, তার পাশাপাশি আগের জানা তথ্য ও সমসাময়িক ফার্সী ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পুনর্বিচার করে সমগ্র বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন সম্ভব।
বর্তমান আলোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যাবে- উপরের অধিকাংশ বক্তব্যই সঠিক নয় এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে এই বক্তব্যগুলোকে খ-ন করা হয়। (সাপ্তাহিক দেশ পৃষ্ঠা- ৬৫)
কে বা কারা পলাশীর বিশ্বাসঘাতক এ সম্পর্কে সুশীল চৌধুরীর সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য হচ্ছে- সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতার দায় শুধু মীরজাফরের নয়, জগৎশেঠদের দায় মীরজাফরের চাইতে বেশি বই কম নয়। আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পিছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব কটা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য অংশ নিয়েছে। এ সময়কার রাজনীতিতে পট পরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদের হাতে। ...... রবার্ট ক্লাইভের লেখা চিঠিপত্র দেখার পর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে- পলাশী চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদদ পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।
সুশীল চৌধুরীর গবেষণা মতে- সিরাজ-উদ-দৌলার পতন হয়েছিল শাসকশ্রেণীর কুচক্রী হিন্দু ও ইংরেজদের মিলিত ষড়যন্ত্রে।
তার মতে, লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী ও হল্যান্ডের রাজকীয় মহাফেজখানায় ঠিক প্রাক পলাশী বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকার প্রথমটিতে রবার্ট ওরম-এর তালিকায় দেখা যায়- নবাব আলিওয়ার্দীর সময় (১৭৫৪ তে) দেওয়ান, তন দেওয়ান, সাব দেওয়ান, বকসী প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুদের দখলে ছিল। একমাত্র মুসলমান বকসী ছিল মীরজাফর।
আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই ছিল হিন্দু। বাংলার ওলন্দাজ কোম্পানীর প্রধান ইয়ান কারসেবুমের তালিকাতেও (১৭৫৫ সালের) নায়েব দেওয়ান রায় রায়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদের একচ্ছত্র প্রধান্য।
১৭৫৪/৫৫’র এই যে চিত্র নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সময় তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়- মুসলমান রাজত্বে হিন্দুরা মুসলমানদের চাইতেও অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। .... বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হতো, তাহলে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য ও ফরাসী ইতিহাসে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যেতো। কিন্তু সেরকম কোনো নির্দিষ্ট ইঙ্গিত আমরা তৎকালীন সাহিত্য বা ইতিহাসে পাই না। (সাপ্তাহিক দেশ, পৃ. ৬৯, ৭০)