সংস্কৃত হইতে বাংলা ভাষা উৎসারিত হয় নাই।
Image result for সংস্কৃত হইতে বাংলা ভাষাসংস্কৃত হইতে বাংলা ভাষা উৎসারিত হয় নাই।

বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইতে উদ্ভূত কাজেই উহা আর্যভাষা-এ দাবীও বিচারসহ নয়।সংস্কৃত ভাষাভাষি আর্যদের আসিবার বহু পূর্ব হইতেই এ দেশবাসীদের যে নিজস্ব ভাষা ছিল, একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।প্রাচীনকালে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করিতে গিয়া ঐতিহাসিক (Marshman 1859) যাহা বলিয়াছে, তাহা এখানে উল্লেখযোগ্য:

“অতি প্রাচীনকালে বঙ্গদেশে কি অবস্থা ছিল তাহা নিশ্চয় করা অতি দুষ্কর ৷ বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম কোন সময় হইতে চলিল, তাহা জানা যায় না ৷ যে মানুষেরা বঙ্গদেশে প্রথম বাস করিয়াছিল, তাহারা হিন্দু ছিল না।কিন্তু পশ্চিম সীমার পার্বতীর লোকদের তুল্য এক জাতি ছিল। যে ভাষা এখন চলিত আছে, তাহা কোন সময় উৎপন্ন হইল, ইহাও নিশ্চয় করা আমাদের পক্ষে অসাধ্য। সংস্কৃত, আরবী ও ফারসী ভিন্ন আরও অন্য অনেক শব্দ বঙ্গভ্যষার চলিত আছে । তাহাতে অনুমান হয় যে, বঙ্গদেশবাসী লোকেরা যে ভাষা ব্যবহার করিত তাহার সহিত সংস্কৃত ভাষার কোনো সম্পর্ক ছিল না ।” [বঙ্গদেশের পুরাবৃত্ত]

শুধু তাই নয়।সুপ্রসিদ্ধ বাঙালী ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় আরও কঠিন কথা বলিয়াছে।তাহার মতে আর্যভাষা তো দূরের কথা, বাংলাদেশে আদৌ কোন আর্য আছে কিনা, তাহাই তো সন্দেহের বিষয়। বলে:
“যে সময় ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অথবা আরণ্যকে আমরা বঙ্গ অথবা পুণ্ড্র জাতির উল্লেখ দেখিতে পইি, সেই সময় অঙ্গে-বঙ্গে অথবা মগধে আর্য জাতির বাস ছিল না।”
অন্যত্র বলিতেছে: “এই প্রাচীন দ্রাবিড় জাতিই বঙ্গ-মগধের আদিম অধিবাসী।নৃতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা আধুনিক বঙ্গবাসিগণের নাসিকা ও মস্তক পরীক্ষা করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, তাহারা দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন। মগধে ব্রাহ্মণাদি ও উচ্চ জাতীয় ব্যক্তিগণকে আর্যজাতীয় অথবা আর্য-সংমিশ্রণে উৎপন্ন বলিয়া মনে হয়।কিন্তু বঙ্গবাসিগণকে জাতিনির্বিশেষে দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণের ফল বলা যাইতে পারে । উত্তরাঞ্চললের পশ্চিমাংশ আর্যগণ-কর্তৃক বিজিত হইবার বহুকাল পরেও মগধ স্বাধীন ছিল। সেই সময় তাহাদের কেহ এখানে আসিলে তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত। প্রাচীন সাহিত্যে আর্যগণ-কর্তৃক মগধ ও বঙ্গ অধিকারের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না। সুতরাং কোন সময় আর্যজাতি বঙ্গ মগধ অধিকার করিয়াছেন, তাহা নির্ণয় করা দু:সাধ্য ।” [বাঙ্গালার ইতিহাস]

বিখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক V.C Pillai সুস্পষ্টভাবে বলিতেছে যে, আর্যদিগের ভারতাগমনের পূর্বে-(যাহা আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ শতাব্দে সংঘটিত হইয়াছিল) এদেশ সম্পূর্ণভাবে দ্রাবিড়দের শাসনাধীন ছিল:

“The theme which first set up upon this investigation is the intricate subject known as the Aryo-Dravidian problem. It is needless to mention that the question was first set in motion on the day the Aryan entered India; which event we shall soon see took place in the fifteenth century BC. India, prior to this entry, was a Dravidian land.”

ইহা হইতে স্পষ্টভাবেই বুঝা যাইতেছে যে, সংস্কৃত হইতে বাংলা ভাষা উৎসারিত হয় নাই। আর্যদের বহুপূর্ব হইতে যখন এদেশে দ্রাবিড়রাই বাস করিত, তখন স্বীকার করিতেই হইবে বাংলা ভাষা তাহাদের হাতেই জন্মলাভ করিয়াছিল-আর্যদের হাতে নয়।প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, আধুনিক বাংলা ভাষাতেও বহু দ্রাবিড় শব্দ মিশিয়া রহিয়াছে। এদেশের বহু প্রাচীন নগর ও গ্রামের নাম, নদ-নদী ও পর্বতের নাম এখনও দ্রাবিড়।যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, পাবনা, ঝিনাইদাহ, দামুকদিয়া, রএড়া, নাগিরাট, গড়াই,তিস্তা, কড়া, গণ্ডা, পণ, কুড়ি, খোকা, খুকি- ইত্যাদি অসংখ্য দ্রাবিড় শব্দ আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় চালু আছে।

তবে অনেক শব্দ ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতেছে, কারণ হিন্দু-মুসলমান ইংরাজ ও অন্যান্য জাতিরা কালে কালে ঐ সব শব্দ হয় বর্জন করিয়াছে, নয় বিকৃত বা রূপান্তরিত করিয়া ব্যবহার করিতেছে। যেমন নাগিরাট হইয়াছে নাগের হাট, যসর হইয়াছে যশোহর ইত্যাদি। ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতও ঠিক তাই । তিনি বলেন:

“প্রাগৈতিহাসিক কালের বাঙ্গালার অধিবাসীরা কি প্রকারের মানুষ ছিল, তাহা জানা অসম্ভব, তবে এইটুকুই অনুমান হয় যে, যে যুগের ইতিহাস খুঁজিয়া পাওয়া যায়না, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতেই বাঙ্গালা দেশে আধুনিক বাঙ্গালীর পুর্ব পুরুষেরাই বাস করিয়া আসিতেছে। ভাষাতত্ত্ব হইতে এইটুকু বুঝিতে পারা যায় যে, বাঙ্গালা দেশে আর্য ভাষা আসিবার পূর্বে এ দেশের লোকেরা অষ্ট্রীক জাতীয় ভাষা এবং কতকটা দ্রাবিড় ভাষা বলিত।বাঙ্গালা দেশের ভৌগোলিক নামে দ্রাবিড় ও অস্ট্রীক কথার সন্ধান পাওয়া যায়।এইগুলি হইতে ইহা প্রমাণিত হয় যে, আর্যভাষা উত্তর-ভারতে ও বাঙ্গালায় প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্বে এ দেশে অষ্ট্রীক ও দ্রাবিড় ভাষার প্রচলন ছিল; অষ্ট্রীক ও দ্রাবিড় ভাষী লোকেরা নিজ নিজ ভাষার কথা দিয়াই এ দেশের নদনদী, পাহাড়-পর্বত ও গ্রামের নামকরণ করিয়াছিল। সেই সকল নামকে ঈষৎ পরিববর্তিত করিয়া উত্তরকালে সংস্কৃত রূপ দেওয়া হইয়াছিল, কোথাও বা সেই সকল নাম বিকৃত হইয়া অর্থহীন নাম রূপে এখনও প্রচলিত আছে । [জাতি সংস্কৃতি ও সাহিত্য]



মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে বঙ্গ-বিজয় বাংলা-ভাষার পক্ষে এক মহামুক্তির দিন
Image result for মুহম্মদ বিন বখতিয়ারেরমুহম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে বঙ্গ-বিজয় বাংলা-ভাষার পক্ষে এক মহামুক্তির দিন

লিপি কাহাদের?

বাংলা ভাষা যে আর্যদের সৃষ্টি নয়, অন্যদিক দিয়াও তাহা প্রমাণিত হয়।ভাষা ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাহন হইতেছে তাহার লিপি। লিপি ছাড়া কোনো ভাষা প্রসারিত বা পল্লবিত হইতে পারে না। কিন্তু আর্যদিগের কোনো লিপি ছিল কি?-না। আর্যেরা কোনো লিপিচর্চা করিত না। ভারতের প্রাচীনতম লিপি ছিল ‘ব্রাক্ষী’ ও ‘খরোষ্ঠী’ লিপি। ‘অশোক’ লিপিও পরে প্রবর্তিত হয়। কিন্তু কোনো লিপিই আর্যদের নিজস্ব নয়- সব লিপিই সেমিটিক। লিপিতত্ত্ববিদ Rawlinson বলে: “The Brahmi script, the parent script of India, was borrowed from Semitic source probably about the seventh century BC.” উপরোক্ত তিনটি লিপিই যে সেমিটিক, তার আর এক বড় প্রমাণ এই যে, উহাদের প্রত্যেকটিই দক্ষিণ হইতে বামে লিখিত (from right to left)।

এই সব লিপি দ্রাবিড়রাই আমদানি করিয়াছিল। খ্রীষ্টের জন্মের চারি হাজার বৎসর অথবা তাহারও পূর্ব হইতে ভারতীয় দ্রাবিড় জাতিদের সহিত আরবদিগের বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিল।সেই সূত্রেই তাহারা এইসব লিপি ভারতে আনিয়াছিল।বলাবাহুল্য, দ্রাবিড় জাতি ছিল সেমিটিক জাতিদেরই জ্ঞাতি।ব্যাবিলন অঞ্চল হইতে তাহাদের এক শাখা বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়া ভারতে প্রবেশ করে এবং কালে কালে পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বাংলাদেশে অধিকার বিস্তার করে। সিন্ধুর ময়েন-জো-দারোতে কিছুকাল পূর্বে (১৯২১) প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে যে লিপি ও সীলমোহর আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাও সেমিটিক, কেননা সে লিপিও দক্ষিণ হইতে বামে লিখিত।[The Indus Script runs from right to left : Sir John Marshal]


অতএব কোনো দিক দিয়াই বাংলা ভাষার সৃজনে বা বিকাশে আমরা আর্যদের কোনো দানেরই পরিচয় পাইতেছি না।বাংলাদেশের প্রতি এবং বাংলা ভাষার প্ৰতি মনোভাবও সুকুমার সেনের অনুমানকে সমর্থন করে না।তিনি তো নিজেই বলিয়াছেন “বাংলাদেশ আর্যেতর জাতির দ্বারা অধ্যুষিত ছিল বলিয়া এদেশে আগমন ও বসতি উত্তর ভারতবাসী আর্যদিগের পক্ষে বহুদিন অবধি নিষিদ্ধ ছিল ।”

ঠিকই তো, আর্যেরা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে চিরদিনই অস্পৃশ্য জ্ঞান করিয়া আসিয়াছে।বাংলার অধিবাসীদিগকে তাহারা ম্লেচ্ছ, যবন, রাক্ষস, বর্বর ইত্যাদি বলিয়া গালাগাল দিয়াছে এবং তাহাদের ভাষাকে ‘পক্ষীর ‘ভাষা’ বলিয়া উপহাস করিয়াছে।এমন কি যদি কোনো আর্য ভুলক্রমেও বাংলাদেশের মাটি মাড়াইত, তবে বিনা প্রায়শ্চিত্তে আর্যেরা তাহাকে সমাজে গ্রহণ করিত না। নিম্নের শাস্ত্রবাণীই তাহার প্রমাণ:

“অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্র মগধেষু চ।
তীর্থ যাত্রাং বিনা গচ্ছন পুনঃ সংস্কার মহতি।।”

এই অবস্থায় কি করিয়া আর্যদের হাতে বাংলা ভাষায় জন্ম হইতে পারে যাহারা বাংলাদেশকে ভালোবাসিল না, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসিল না, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসিল না, বাঙালীদের সহিত মেলামেশা, উঠাবসা বা কোনোরূপ সামজিক সম্বন্ধ স্থাপন করিল না, যাহাদের লিপিজ্ঞান ছিল না, ছুঁৎমার্গের ভয়ে যাহারা লিপিচর্চাই করিল না, তাহারা কি করিয়া বাংলা ভাষার স্রষ্টা হইতে পারে?
খ্রীষ্টের জন্মের পরে

খ্রীষ্টের জন্মের পূৰ্বাবস্থা তো দেখিলাম।এইবার দেখা যাউক খ্রীষ্টের জন্মের পর হইতে দশম-একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত (অর্থাৎ মুসলমানদের বঙ্গবিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত) আর্যেরা কখন কিভাবে বাংলাদেশে আসিয়া আত্মপ্ৰতিষ্ঠা লাভ করিল এবং বাংলা ভাষাকে কতখানি উত্সাহ দিল৷

ডক্টর সুকুমার সেন বলিতেছেন, “পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বেই বাংলাদেশের সর্বত্র আর্যবসতি প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল এবং সেই সঙ্গে আর্য ভাষাও সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছিল।” কিন্তু ইতিহাসে সেরূপ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।দশম-একাদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত (অর্থাৎ পাল বংশের পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত) আর্যেরা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে নাই।কর্নাট হইতে আগত আর্য-ভক্ত সেনাগণ যখন বৌদ্ধ পালদিগকে পরাজিত করিয়া বাংলাদেশ দখল করিল, তখনই আর্যেরা এদেশে আসিবার সুযোগ পাইল।


একটা গূঢ় কথা এখানে চাপা পড়িয়া আছে। আর্যেরা যে বাংলাদেশ এবং বাঙালীদিগকে ঘৃণা করিত বলিয়াই এদেশে আসে নাই, ইহা পূর্ণ সত্য নহে।ইহাতে মনে হয় যেন আর্যেরা আসিতে চাহিলেই এদেশবাসী তাহাদিগকে বরণ করিয়া লইত।সেরূপ ধারণা নিতান্তই ভুল।এদেশে দ্রাবিড়-বৌদ্ধ প্রভৃতি অনার্যরাও আর্যদিগকে রীতিমত শত্রুজ্ঞান করিত। দ্রাবিড়-বৌদ্ধদের কি কোনোরূপ আত্মমর্যাদাবোধ ছিল না? দেশপ্রেম ছিল না? শক্তি সাহস ছিল না? আর্যরা যখন তাহাদিগকে ‘যবন’ ‘ম্লেচ্ছ’ ‘রাক্ষস’ ‘বর্বর’ ইত্যাদি বলিয়া গালাগালি দিত, তখন তাহারাই বা আর্যদিগকে পূজা করিবে কেন?তাহারাও প্রাণপণে আর্যদিগকে বাধা দিত।কাজেই আর্য-অনার্য বিরোধ সর্বদা লাগিয়াই ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া এদেশের লোকেরা তাই আর্যদিগকে বাহিরে ঠেকাইয়া রাখিয়াছে। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই সত্যের কিছুটা আভাস দিয়াছেন:

“The country (i.e. Bengal) was for centuries in open novolt against Hindu orthodoxy. Buddhist and Jain influence was so great that the codes of Mann, while including Bengal within the geographical boundary of Aryyavarta, distinctly prohibited all contact with the land for fear of contamination.” [History of Bengali Language & Literature]

ডক্টর সুকুমার সেন মনে করে, পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বেই আর্যেরা বাংলাদেশ দখল করিয়াছিল এবং আর্যভাষায় সারা দেশ ছাইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আমরা তো দেখিতেছি অন্যরূপ। গুপ্তদের দ্বারা (পঞ্চম শতাব্দী) বাংলাদেশ (সমতট) যে বিজিত হইয়াছিল এমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নাই। অন্ততঃ হিন্দুদের সহিত তখনও যে বৌদ্ধদের ভীষণ যুদ্ধবিগ্রহ চলিতেছিল, একথা চীন-পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ও হুয়েন-সাঙ তাহাদের ভ্রমণ-বৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন:


“The Chinese pilgrims Fa-Hien in the fifth century and Huen Tsang in the seventh century found the Buddhist religion prevailing in Bengal, but already engaged in a fierce struggle with Hinduism, which ended about the ninth or tenth century in the general establishment of the later faith. In the eleventh century the Senas rose to power in Bengal while in the next century, both the Palas and the Senas were submerged beneath the flood of Muslim conquest. [Encyclopaedia Britannica]

উপরোক্ত উদ্ধৃতি হইতে পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাইতেছে যে, পাল রাজাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই আর্যহিন্দুরা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

প্রায় দুইশত বৎসর ধরিয়া বাংলাদেশ তাহাদের শাসনাধীন ছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও কি বাংলা ভাষার প্রতি তাহারা কোনোরূপ দরদ দেখাইয়াছে?-মোটেই না।বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেনঃ

“আমরা হিন্দু-কালের কোনো বাঙ্গালা সাহিত্য পাই নাই। হিন্দু সেনরাজগণ সংস্কৃতের উৎসাহদাতা ছিল ৷ ব্রাহ্মণেতর ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট বলিয়াই সম্ভবতঃ তাহারা বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিল।” [বাঙ্গালা ব্যাকরণ]
কোনোরূপ সাহায্য করা তো দূরে থাকুক, বাংলা ভাষার উচ্ছেদ-সাধনের জন্যই তাহারা প্রয়াস পাইয়াছিল।সুপণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক্ ঠিকই বলিয়াছেন:

“বাংলার শেষ হিন্দু রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন ৷ তাঁহার সভায় ধোয়ী, উমাপতি ধর প্রভৃতি কবি এবং হলায়ুধ মিশ্র প্রভৃতি পণ্ডিত ছিলে।কিন্তু নানা পণ্ডিত ও কবির সমাবেশে তাহার রাজধানীতে যে সংস্কৃত ভাষা চর্চার ও পাণ্ডিত্য-প্রকাশের সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়িয়া উঠে, তাহা জয়দেবের গীত-গোবিন্দের মাধ্যমে সমগ্র উত্তর ভারতে প্রভাব বিস্তার করিলেও বাংলা ভাষা চর্চার কোনো আয়োজন তথায় ছিল না”।
আর একটি মূল্যবান মন্তব্যও তিনি করিয়াছেন:

“১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কীবীর ইখতিয়ার বিন মুহম্মদ বখতিয়ার লক্ষণ সেনকে লক্ষণাবতী হইতে বিতাড়িত করিয়া বাংলায় সংস্কৃত চর্চার মূলে কুঠারাঘাত হানিয়া বাংলা চর্চার পথ উন্মুক্ত করেন।”[মুসলিম বাংলা-সাহিত্য]
বস্তৃতঃ মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে বঙ্গ-বিজয় বাংলা-ভাষার পক্ষে এক মহামুক্তির দিন । মুসলমানদের দ্বারা বঙ্গ-বিজয় না হইলে আর্যদের হাতে যে বাংলাভাষা লোপ পাইত অথবা শুদ্ধিকৃত হইয়া ভিন্নরূপ ধারণ করিত, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই। সেন রাজাদিগের অল্প-পরিসর সময়-রেখার মধ্যই আর্য ব্রাহ্মণগণ আইন করিয়া বাংলা ভাষার উৎখাত সাধনের প্রয়াস পাইয়াছিলেন। তাঁহারা এই নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, যদি কোনো আর্য হিন্দু বেদ, পুরাণ, রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রসমূহ কোনো মানব ভাষায় (অর্থাৎ বাংলা ভাষায়) আলোচনা করে, তবে তাহাকে ‘রৌরব’ নামক নরকদণ্ড ভোগ করিতে হইবে-

“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চারিতানি চ।
ভাষায়ং মানবঃ শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।।”

ইহাই সংস্কৃতের সহিত বাংলা ভাষার প্রথম সংঘাতের ফল।


নোটঃ
১.সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৪৬ পৃষ্ঠা।
নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, বাঙ্গালা সাহিত্যের নূতন ইতিহাস,৪৬-৫০ পৃষ্ঠা



আর্যরাই যে সর্বপ্রথম প্রাচীন ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালাইয়াছিল এ কথার মূলে কোনো সত্য নাই
Image result for মুসলিম-সাহিত্যআর্যরাই যে সর্বপ্রথম প্রাচীন ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালাইয়াছিল এ কথার মূলে কোনো সত্য নাই

এতকাল ইতিহাসে আমরা পড়িয়া আসিতেছি যে, অতি প্রাচীনকালে পাক-ভারত উপমহাদেশে অনার্য জাতিরা বাস করিত।তাহারা অত্যন্ত অসভ্য ও বর্বর ছিল। তাহারা ফলমূল ও কাঁচা মাংস ভক্ষণ করিত এবং বনে-জঙ্গলে বাস করিত।তারপর আসিল দ্রাবিড় জাতি।তাহারাও অনার্য ও অসভ্য ছিল। তবে পূর্ববর্তীদের অপেক্ষা কিছুটা উন্নত ছিল। সর্বশেষে আসিল এক সুশ্ৰী গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় ও সুসভ্য জাতি। ইহাদের নাম আর্যজাতি।ইহারা মধ্য-এশিয়ায় বাস করিত। কালে কালে সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে তাহারা দেশ-বিদেশে ছড়াইয়া পড়ে।মেটোমুটিভাবে দুইভাগে তাহারা বিভক্ত হয়।এক ভাগ যায় পশ্চিম দিকে, অপর ভাগ আসে পূর্বদিকে।পূর্বশাখা ইরান হইয়া ভারতে প্রবেশ করে এবং দ্রাবিড় ও অন্যান্য অনার্য জাতিদিগকে পরাজিত করিয়া এই দেশ অধিকার করে। তাহারাই সর্বপ্রথম এদেশে সভ্যতার আলো জ্বালে।জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে ও ললিত কলায় তাহারাই এদেশকে সমৃদ্ধ করিয়া তোলে।

ময়েনজোদারো

কিন্তু এই থিওরী এখন একরূপ অচল ৷ সিন্ধুর ময়েন-জো-দারো, পাঞ্জাবের হরপ্পা ও অন্যান্য স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের পর এখন আর একথা কেহই বলিতে সাহস করে না যে, পাক-ভারতের সভ্যতা আর্যদের দান।প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইতেছে যে, আর্যদের অপেক্ষা দ্রাবিড়রাই ছিল অধিকতর উন্নত ও সভ্য।
ময়েন-জো-দারো ধ্বংসাবশেষ হইতে জানা যায় যে, সেখানে সুপরিকল্পিত নগর ছিল, ইষ্টক নির্মিত গৃহ ছিল, রাজপথ ও পয়ঃপ্রণালী ছিল, এমন কি সে-যুগের লোকেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কৌশলও জানিত। বিভিন্ন কারুকার্যখচিত মৃৎপাত্র, নানা ধরনের তৈজসপত্র, বহু সৌখিন আসবাবপত্র ও প্রসাধন দ্রব্য এবং অন্যান্য আরও অনেক নিদর্শনই পাওয়া গিয়াছে-যাহাদের মধ্যে উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ছাপ রহিয়াছে। আর একটি বিশেষ বস্তুর সন্ধান পাওয়া গিয়াছে-তাহা হইতেছে ৫০০ সীলমোহর । সীলমোহরগুলির উপরে এক বিশেষ ভাষার অক্ষর অঙ্কিত। সেগুলি দক্ষিণ হইতে বামে লিখিত এবং প্রাচীন ব্যাবিলন ও মিসর-লিপির সহিত সাদৃশ্যযুক্ত। অন্য কথায় লিপিগুলি সেমিটিক।

বলাবাহুল্য, এই সভ্যতা ছিল দ্রাবিড়দের।ইহার সহিত আর্য সভ্যতার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না, কেননা এ সভ্যতা ছিল আর্যদের ভারত আগমনের অন্ততঃ দেড় হাজার বৎসর অগ্রগামী। Sir John Marshal বলেন: “They (i.e. material remains of Mohen-jo-daro) exhibit the Indus people of the fourth and the fifth millennium BC. in possession of a highly developed culture in which no vestige of any Indo-Aryan culture is to be found.”

কাজেই আর্যরাই যে সর্বপ্রথম প্রাচীন ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালাইয়াছিল এ কথার মূলে কোনো সত্য নাই।প্রসিদ্ধ ভারতীয় ঐতিহাসিক K.M. Panikkar অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবেই এই মতের প্রতিবাদ করিয়াছেন:

“One thing is certain, and can no longer be contested: civilisation did not come to India with the Aryans. The doctrine of the Aryan origin of Indian civilisation is the result of the theories of the Indo-Germanic scholars who held that anything valuable in this world originated from the Aryans…. not only is Indian civilisation pre-Vedic, but also the essential features of the Hindu religion as we know it today, were perhaps present in Mohen-jo-daro.” [A Survey of Indian History]
তারপর আর্যদের আদি নিবাস যে কোথায় ছিল, আজ পর্যন্ত তাহা কেহ নিশ্চয় বলিতে পারে না। কেহ বলে মধ্য এশিয়ার, কেহ বলে ইউরোপে, কেহ বলে ভারতে, কেহবা বলে অন্যরূপ।প্রত্যেক প্রাচীন জাতিরই একটা আদিম উৎপত্তিস্থল এবং তাহার জাতীয় সংস্কৃতির কিছু না কিছু নিদর্শন আছে। মিসরীয়দের পিরামিড, ব্যাবিলোনিয়ানদের শূন্মোদ্যান, চীনাদের মহাপ্রাচীর, বৌদ্ধদের নালন্দা, তক্ষশীলা, দ্রাবিড়দের ময়েন-জো-দারাে ইত্যাদি স্মৃতিচিহ্ন এখনও বিদ্যমান।কিন্তু আর্যদের সেরূপ কােনো কীর্তি-চিহ্ন কই? কোথাও আছে কি? শ্ৰীযুক্ত অবিনাশ চন্দ্র দাস (এম এ. বি.এল) তাই আর্যসভ্যতার প্রাচীনতার দাবী মিথ্যা বলিয়া মনে করেন:

“The Indo-Aryans claim that they are the most ancient people in India; but that claim is false. India has no ancient monuments or relics like Egypt, Babylonia or Assyria.”
এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া সত্যসন্ধানী ঐতিহাসিকেরা আর্য-থিওরীকে এখন একটি অলীক কাহিনী (myth) বলিয়া মনে করেন।কেহ বা বলেন, থিওরীটি শুধুমাত্র একটা অনুভূতির উপর দাঁড়াইয়া আছে (based on a solid basis of sentiment)। আবার কেহ বা ইহাকে একটা ঐতিহাসিক প্ৰলাপ (a historical nonsense) বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন।
আর্য-থিওরীর জন্ম
Image result for আর্য-থিওরীর জন্মআর্য-থিওরীর জন্ম

এইবার আর্য-থিওরী সম্বন্ধে শেষ কথা বলিব।আর্য-অনার্যের কথা শুনিলেই আমরা আমাদের চিন্তা ও ধারণাকে সুদূর অতীতে টানিয়া লইয়া যাই এবং ভাবি যে, আলো ও অন্ধকারের মতো দুই স্বতন্ত্র পরিমণ্ডলে আর্য ও অনার্যেরা বাস করিতেছে এবং সেখান হইতেই মানব-গোষ্ঠীর এই দুই ধারা বহিয়া আসিতেছে।কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল।আর্য-থিওরীর বয়স এখন মাত্র দেড়শত বৎসর।ইহার পূর্বে কোনো ইতিহাসে ‘আর্য’ অথবা ‘অনার্য’ বলিয়া কোনো বিশেষ চিহ্নিত জনগোষ্ঠী অথবা কোনো ভাষা ছিল না। এসব তীক্ষ্ণ শ্রেণী বিভাগ আমরা এখানে বসিয়া করিতেছি মাত্র!কাজেই সমস্ত কল্পনাটাই একটা কৃত্রিম আবরণ দিয়া মোড়া৷থিওরীটির উৎপত্তি কাহিনী নিম্নরূপ:

১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের তদানীন্তন চীফ জান্টিস এবং ‘এসিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর প্রেসিডেন্ট Sir William Jones সোসাইটির এক বার্ষিক সভায় একটি মূল্যবান ভাষণ দান করেন।ঐ ভাষণে তিনি ল্যাটিন, গ্রীক, ইংরাজী, ফরাসী, জার্মানি, পহলবী, সংস্কৃত প্রভৃতি কতিপয় ভাষার অনেকগুলি শব্দ ও ধাতৃরূপ বিশ্লেষণ করিয়া দেখান যে, ঐ সব ভাষার মূলে ঐক্য রহিয়াছে।তিনি তাই অনুমান করেন, ঐসব ভাষাভাষীজনেরা আদিতে একই স্থানে বাস করিত এবং একই ভাষায় কথা বলিত।কালে কালে বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহারা নানা দেশে ছড়াইয়া পড়িতে বাধ্য হইয়াছিল। এইরূপেই বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হইয়াছিল।

এই ইংগিত পাইয়া জার্মান পণ্ডিতদের মনে এক নতুন চিন্তার উদ্রেক হইল।তুলনামূলক ভাষাতত্বের (Comparative Philology) আলোচনায় তাঁহারা প্ৰবৃত্ত হইলেন।Max Muller, Bopp, Kalaproth প্রভৃতি পণ্ডিতগণ এই বিষয়ে বহু গবেষণা করিলেন।অতঃপর ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে Sir Thomas Young নামক জনৈক মিসরভাষাবিদ পণ্ডিত আলোচ্য ভাষাগুলিকে “Family of Indo-European Language” বলিয়া অভিহিত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঐসব ভাষাভাষী জনগণকে Indo-European Races নামে পরিচয় দেন।ইহার পরই Indo-Aryan এবং Aryan নামের উৎপত্তি হয়।

তাহা হইলে একথা অনায়াসেই বুঝা যায় যে, আর্য-অনার্যের প্রভেদ নিতান্তই আধুনিক যুগের সৃষ্টি।এই জন্যই ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় বলেন যে, আর্য, অনার্য বা দ্রাবিড় কোনো নৃতাত্তিক প্রকারভেদ নয়; উহারা ভাষার নাম; অর্থাৎ আর্য ভাষাভাষী যাহারা তাহারাই ছিল আর্য, দ্রাবিড় ভাষাভাষী যাহারা তাহারা ছিল দ্রাবিড়।[বঙ্গালীর ইতিহাস]
কিন্তু এ ব্যাখ্যাও খুব সন্তোষজনক বলিয়া মনে হয় না।তবে ইহাতে আর্যদের আভিজাত্যের ভঙ্গি নষ্ট হয় বটে।

আর্য-থিওরীর কুফল

আর্য-থিওরীর স্বরূপ দেখান হইল।ইহাতে ভারতীয় আর্যদের ভূমিকা থাকিলেও তাহারা ইহার স্রষ্টা নহে; ইউরোপ হইতে-বিশেষ করিয়া জার্মান জাতির দ্বারা-এই থিওরী উদ্ভাবিত ও প্রচারিত। উৎকট সেমিঢিক বিদ্বেষ এবং দুর্বল জাতিদিগকে গ্রাস করিবার গভীর দুরভিসন্ধি এই থিওরীর প্রধান প্রেরণা। ইউরোপে জার্মান জাতিই গোঁড়া আর্য বলিয়া খ্যাত। বিগত দুইটি মহাযুদ্ধ তাহাদের গোঁড়ামির ফলেই সংঘটিত হইয়াছে।পাক-ভারত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের যে অবনতি ঘটিয়াছে তাহার মূলেও আছে এই আর্য-থিওরীর প্রভাব।

বস্তৃতঃ এই থিওরী নিতান্তই মানবতা বিরোধী, মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে ও দেশে দেশে বিরোধ ও বৈষম্য সৃষ্টি করিতে এই থিওরী এক অমোঘ অস্ত্র।এই থিওরী মানব-সভ্যতার ইতিহাসকেও বিকৃত ও কলুষিত করিয়াছে এবং মানবজাতির সত্য পরিচয়কে সকলের চোখের আড়াল করিয়া রাখিয়াছে।কাজেই প্রত্যেক কল্যাণকামী মানুষের উচিত এই থিওরীর অবসান ঘটানো।



মধ্যয্যগে বাংলা ভাষার প্রভাব
Image result for মুসলিম-সাহিত্যমধ্যযুগে বাংলা ভাষার প্রভাব
মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাংলা ভাষার মধ্যযুগের প্রবেশ-দুয়ারে আসিয়া পৌঁছিলাম। এ যুগকে মুসলিম যুগও বলা যাইতে পারে। ১৩৫০-১৭৫০ খ্রী: পর্যন্ত দীর্ঘ চারিশত বৎসর ধরিয়া বাংলা সাহিত্য মুসলিমদিগের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের প্রারম্ভে কিছুকাল যাবৎ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্ম তেমন উৎকর্ষ লাভ করিতে পারে নাই, কারণ যুগ-বিপ্লবের পর শান্ত পরিবেশ ফিরাইয়া আনিতে কিছুটা সময় লাগে।

বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের আমল হইতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয় এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিমদিগের সেবার, দানে, সাহায্যে ও সহানুভূতিতে বাংলা ভাষা নানা গৌরবে সমৃদ্ধ হইতে থাকে। বাংলা ভাষার সর্ব প্রথম মুসলিম কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর আযম শাহের রাজত্বকালে ‘য়ুসুফ জুলিখা’ নামক কাব্য লিখিয়া যশস্বী হন। মুহম্মদ সগীরের ‘য়ুসুফ্ জুলিখা’ এবং তৎপূর্ববর্তী বড় চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণর্কীর্তন’ই বাংলা সাহিত্যের দুই প্রথম গ্রন্থ।

য়ুসুফ জুলিখার ভাষা ছিল এইরূপঃ

কহে শাহ্-মোহাম্মদ যুসুফ জুলিখা পদ
দেশিভাষা-পয়ার রচিত।
কিতাব কোরাণ মধ্যে দেখিনু বিশেষ
য়ুসুফ জুলিখা কথা অমিয়া অশেষ।
কহিব কিতাব চাহি সুধারস পুরি।
শুনহ ভকত জন শ্রুতিঘট ভরি।।
দোষ খেম, গুণ ধর রসিক সুজন।
মোহাম্মদ ছগীর ভনে প্রেমিক বচন।। [মুসলিম বাংলা সাহিত্য]

সুলতান হুসেন শাহ্ এবং তাঁহার বংশধরদিগের আমলই মধ্য-বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ।এই উদারমনা সাহিত্য-রসিক গুণগ্ৰাহী সুলতান সত্যই বাংলা সাহিত্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের কবি-সাহিত্যিকদিগকে ডাকিয়া তিনি দরবারে স্থান দেন।আরবী-ফারসী হইতে নানা ধর্মগ্রন্থ, ইতিহাস, গল্প ইত্যাদি অনুবাদ করাইবার কাজে তিনি মুসলিম কবিদিগকে নিয়োগ করেন। সেই সঙ্গে মৌলিক রচনাবলীরও মর্যাদা দেন।gulam-mostafa


শুধু মুসলিম কবি নন, হিন্দু কবিদিগকেও তিনি এবং তাঁহার অনুবর্তিগণ সাদরে আহবান করেন। তাহাদেরই উৎসাহে রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য হিন্দু গ্রন্থাদি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। হুসেন শাহের আমলে শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব হওয়ায় বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব-ধারাও সংযোজিত হয়।এইরূপে বাংলা ভাষা জাতিধর্ম-নির্বিশেষে গোটা বাঙালী জাতির প্রতিনিধিত্ব করিবার সুযোগ পায়।

কিন্তু একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। হুসেন শাহের দরবারে যখন বাংলা সাহিত্য চর্চার এমন সমারোহ চলিতেছে, তখনই-বা বাংলা ভাষার প্রতি আর্য-হিন্দুদিগের মনোভাব কিরূপ ছিল? পূর্বের সেই জাতক্রোধ, বিদ্বেষ ঘৃণার ভাব তাহারা তখনও অন্তরে অন্তরে পোষণ করিতেছিল, এই জন্য সুলতানের আবেদনে অগ্রে তাহারা সাড়া দেয় নাই।পরে যখন অন্যান্য কবিরা নিজেদের কাব্য-রচনার জন্য সুলতানের নিকট হইতে প্রচুর ইনাম, খেতাব ও পুরস্কার লাভ করিতে লাগিল, কেবল মাত্র তখনই তাহারা রাজ-দরবারে আসিয়া সাহিত্য সেবার আত্মনিয়োগ করিল।

“The Brahmins could not resist the influence of this high patronage. They were, therefore compelled to favour the language they had hated so much and latterly they themselves came forward to write poems and compile works of translation in Bengali.“ [History of Bengali Literature]

শুধু তাই নয়।সুলতানদেব দেখাদেখি দেশীয় অন্যান্য হিন্দু রাজারাও তখন নিজেদের রাজসভায় বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদিগকে সমাদর করিতে লাগিলেন।এই ভাবেই বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন হইল এবং উহার সমস্ত গৌরব মুসলমানদের প্রাপ্য: “Thus the appointment of Bengali poets to the courts of Hindu Rajas grew to be fashion after the example of the Muslim chiefs.” [Ibid]


এইসব তথ্যের মুকাবেলায় কি করিয়া বলা যায় যে, বাংলা ভাষা আর্যভাষা?

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদিগের দান এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে । তাহাদের রচিত সাহিত্যে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যও ছিল প্রচুর।ধর্ম, ইতিহাস, জীবনী, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব, লৌকিক কেচ্ছা ও কাহিনী এবং অনুবাদই ছিল তাহাদের সাহিত্য-কর্মের মূলধারা।

কাসাসােল আম্বিয়া, ফতুহুশ্বাম, ফতহুল মেছের, আলেফ-লায়লা, জঙ্গনামা, শহীদে-কারবালা, লায়লি-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, আমির হামজা, চাহার দরবেশ, ছয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান, সোনাভান, গাজী কালু ইত্যাদি অসংখ্য পুঁথি মুসলমান কবিরা রচনা করিয়া গিয়াছেন।ডক্টর আব্দুল গফুর সিদ্দিকীর মতে মুসলিম পুঁথির সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০ হইবে। মুসলিম পুঁথি-সাহিত্যের ভাষা ও রচনা-রীতির কিঞ্চিৎ নমুনা নিম্নে দেওয়া হইলঃ

“মেছের সহর হইতে বাহির হইয়া
মকদ্দস পানে নবি জান নেকালিয়া
সামের সহর বিচে ফলগুন গ্রাম
তথা উতরিল যদি নবি নেককাম।
জিবরিল আসিয়া কহে শোন সমাচার
দেখ হেথা জমিনেতে কেমন বাহার।।” [কাসাসুল আম্বিয়া]

“উজিরের পানে বাদশা আঁখি ঘুমাইল।
দেলেতে হইল গোশ্বা কিছু না কহিল।
উজির কহিল বাদশা আমি সব জানি।
আমিরের বেটা এই উম্মর ইউসানি।।[আমির হামজা]

“শুন যত বেরাদার, কহি কিছু সমাচার
শুন সবে আগামি কালাম।
রুমের সহর বিচে, কুস্তনতুনিয়া দেশে
এস্তাম্বুল বলে যার নাম।” [চাহার দরবেশ]

এই চলিত ভাষা এতই জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল্ যে, অনেক হিন্দু কবিও এই ভাষায় পুঁথি লিখিয়া গিয়াছেন। একটি দৃষ্টান্ত দিই:

“আল্লা আল্লা বল পাক পরোয়ারদিগার।
আখেরে দোজখে ডালি…যার।।
দোজখ তরিতে বান্দা করহ ফিকির।
জাহিরে বাতুনে লইলাম আল্লার জিকির।।
আল্লার আরশ কোর্সে কিছু মেহেরবানী চাই।
ইমামগণের কেচ্ছা কিছু মিলাইয়া গাই।
শ্ৰীযুক্ত সাহেবের কেচ্ছা রাধাচরণ গাএ।
আল্লা আল্লা বল নবি পাঞ্জাতনের পাএ’’।।

অষ্টাদশ শতাব্দীতেও হিন্দু কবিরা তাঁহাদের কাব্যে আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার করিতে কুষ্ঠাবোধ করেন নাই।দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতচন্দ্র ও বিদ্যাপতির নাম করা যায়। নিম্নে দুইটি উদ্ধৃতি দিতেছি:

“মানসিংহ জোড় হাতে অঞ্জলি বাঁধিয়া মাথে
কহে জাহাঁপনা সেলামত।
রামজির কুদরতে মহিম হইল ফতে
কেবল তোমারই কেরামত।
হুকুম শাহানশাহী আর কিছু নাহি চাহি
জের হৈল নিমকহারাম।
গোলাম গোলামী কৈল জালিম কয়েদ হৈল
বাহাদুরী সাহেবের নাম।” [ভারতচন্দ্র রায়]

হৈয়া বান্দার বান্দা নুঙাইয়া শির।
বন্দির বড় খাঁ গাজী পীর দস্তগীর।
নিয়ৎ হাছিল সত্যপীরের কালাম।
কহে বিদ্যাপতি করি হাজার ছালাম।। [বিদ্যাপতি]

প্রাচীন গদ্য

প্রাচীন বাংলা গদ্যের নিদর্শন খুবই বিরল।শুধু সরকারী দলিল-দস্তাবিজের মধ্যেই যা কিছু নমুনা পাওয়া যায়।নিম্নে সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর ভাষার নমুনা দেখানো হইতেছে:

সপ্তদশ শতাব্দী (১৬৬২)

“শ্রী যশোমাধব ঠাকুর কুমড়াল গ্রামে দেবালয়ৎ আছিলা।রাম শর্মা ও গায়রহ্ আপনার ২ ওয়াদা মাফিক সেবা করিতেছিল।রাত্রদিন চৌকি দিতেছিল। শ্রী রামজীবন মৌলিক সেবার সরবরাহ পুরুষানুত্রুমে করিতেছেন।” ইত্যাদি। (শ্রী মনোমোহন ঘোষের ‘বাংলা গদ্যের চারযুগ’)

অষ্টাদশ শতাব্দী (১৭৮৬)

“শ্ৰীযুক্ত ওলন্দেজ কোম্পানীতে আড়ঙ্গ বিরভূমের খরিদর দাদনী আমি লইয়া ঢাকা আড়ঙ্গ চালানী করিয়াছি।আপরেল মাহেতে এবং মোকাম মজবুরের গােমস্তা কাপড় খরিদ করিতেছিল এবং কাপড় কথক ২ আমদানি হইয়াছে এবং হইতেছে দাস্ত কথক ২ তৈয়ার হইতেছে এবং মবলগ কাপড় ধোবার হাতে দাস্তর কারণ রহিয়াছে।তাহাতে সংপ্রীতি মে: গেল সাহেবের তরফ পেয়াদা আসিয়া খামখা জবরদস্তী ও মারপিঠ করিয়া ঘাট হইতে ধোবা লোককে ধরিয়া লইয়া গেল।”… ইত্যাদি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এই মিলিত রূপ অব্যাহত ছিল।কিন্তু ইহার পরই বাংলা ভাষার খাত পরিবর্তিত হইল। তখন এদেশে ইংরাজ শাসন প্রবর্তিত হইয়াছে।শাসন কার্যেরর ‘সুবিধার’ জন্য ইংরাজেরা ভেদনীতির আশ্রয় লইল।সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাহারা এই নীতি অবলম্বন করিল।
শেষ পর্বঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য

[উৎসঃ গোলাম মোস্তফা, বাংলা ভাষার নূতন পরিচয়, গোলাম মোস্তফা প্রবন্ধ সংকলন, আহমদ পাবলিশং হাউস, ঢাকা, ১৯৬৮ থেকে সংগৃহীত]