ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম-সাহিত্য

Image result for মুসলিম-সাহিত্যঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম-সাহিত্য
রাজ্যহারা মুসলমানেরা যখন বুঝিতে পারিল যে, ইংরাজী ও বাংলা না শিখিয়া তাহাদের গত্যন্তর নাই, তখন তাহারা এইদিকে মনোযোগ দিল।এই নতুন যুগের প্রথম মুসলিম সাহিত্য-স্রষ্টা হইতেছেন মরহুম মীর মোশারফ হোসেন (১৮8৭-১৯১১)।তাঁহার প্রণীত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ সাধু ভাষায় লিখিত হইলেও তাহার ভাষা যে কতো সাবলীল ও প্রাণবন্ত, নিম্নের উদ্ধৃতি হইতেই তাহা বুঝা যাইবে:

“রক্ত দর্শনে হোসেন চমকিয়া উঠিলেন। আজ ভয়শূন্য মনে ভয়ের সঞ্চার হইল।সভয়ে চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন: আবদুল্লাহ্ জেয়াদ, ওমর, সীমার এবং আরও কয়েকজন সেনা তাঁহার চতুর্দিকে ঘিরিয়া যইিতেছে।সকলের হাতেই তীর-ধনু।ইহা দেখিয়াই তিনি চমকিয়া উঠিলেন।যে সমুদয় বসনের মাহাত্ম্যে তিনি নির্ভ্য-হৃদয়ে ছিলেন, তৎসমুদয় এখন পরিত্যাগ করিয়াছেন; তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম, বর্ম, খঞ্জর কিছুই তাঁহার সঙ্গে নাই।কেবল দুইখানি হাত মাত্র সম্বল।অন্যমনস্কভাবে তিনি দুই এক পদ করিয়া চলিলেন, শত্রুরাও পূর্ববৎ ঘিরিয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল ৷” [বিষাদ-সিন্ধু]

কিন্তু মুসলিম কাব্য-সাহিত্য ও পুঁথির ধারা তখনও মন্থর গতিতে চলিতেছিল । এই সময়কার জনৈক মুসলিম কবির রচিত নিম্নের ব্যঙ্গ কবিতাটিতে কিছুটা আধুনিকতার ছাপ এবং উন্নত রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় । কবিতাটি ইনকামট্যাক্সকে লক্ষ্য করিয়া রচিতঃ

“বালেশ্বর বিচে গড় পদ্দা পরগনা
ভিক্টোরিয়া শাহাজাদী যার মালিকানা।
লেয়সন করোসন দুই লাট বন্দি,
খাজানা দাখিল করি মোরা হাত বান্ধি।
জরিপেতে বন্দবস্ত হইয়াছে যার
বহুত মশকেলে দিতে হবে রাজকর !
তাহাতে যাহোক করি দুঃখেতে গুজরাণ
এইরূপে দিনপাত চালান রহমান।
রাতদিন দোওয়া করি মহারাণীর তরে,
রাজ্যবৃদ্ধি হয় তার খোদাতালা করে ৷
এমন আমল দুটা হয় না জাহানে
এক জাগায় রাখে বাঘ বকরী দুইজনে।
কেহ কারো জবরদস্তি করিতে না পারে,
কায়েম হুকুম যে আইন অনুসারে।
এই মতে কতদিন যায় গুজারিয়া
পালেন সবার তরে মেহের করিয়া।
তাহাতে আইল এক এমন রাক্ষস
তাহার বিখ্যাত নাম ইনকাম ট্যাকস।”

এই ধারা এখনও বাঁচিয়া আছে।নজরুল ইসলামের হাতে ইহার রূপান্তর ঘঢিয়াছে।আরবী-ফার্সী শব্দ দ্বারা, বলিষ্ঠ আঙ্গিক দ্বারা এবং ইসলামী ভাবধারা দ্বারা তিনি বাংলা ভাষাকে প্রচুর শ্রী ও সমৃদ্ধি দান করিয়াছেন।

উপসংহার

প্রাগৈতিহাসিক কাল হইতে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় এতক্ষণ আমরা দিলাম। এই পরিচয়ে দেখিলাম বাংলা ভাষা আর্য ভাষা নয়, অনার্য ভাষা। অনার্য ভাষার অর্থে অসভ্য বর্বর অস্পৃশ্যদের ভাষা নয়-আর্য-বহির্ভূত নরগােষ্ঠীর ভাষা; অন্য কথায় বাংলার ভাষা-বাঙালীদের ভাষা। অবশ্য একথা স্বীকার্য যে, পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা দ্বারা কিছুটা প্রভাবান্বিত হইয়াছে।কিন্তু সে প্রভাব ‘অত্যন্ত নগণ্য’ এবং “অত্যন্ত আধুনিক’।ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক্ বলেন:

“বর্তমান বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রত্যক্ষ প্রভাব যেমন নগণ্য, তেমনই অত্যন্ত আধুনিকও বটে ৷” [মুসলিম বাংলা সাহিত্য]

বাংলা ভাষার সংগঠনে সংস্কৃত হইতে যতটুকু সাহায্য লাভ করিয়াছি, তাহা আমরা অবশ্যই স্বীকার করি।কিন্তু বাংলা যে সংস্কৃতের দুহিতা এবং কাজেই আর্যভাষা এই দাবী অস্বীকার করি। আর্যামির গোঁড়ামি হইতে বাংলা ভাষাকে আমরা মুক্ত রাখিতে চাই।ইহইি হইবে বাংলা ভাষার কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথ।

আজ বাংলা ভাষা দ্বিধা-বিভক্ত।পশ্চিম বঙ্গের বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা এক হইয়াও এক নয়। উভয়ের গতি ও লক্ষ্য বিভিন্ন। ইহাতে আমাদের আনন্দের কারণ আছে। এখানকার বাংলা সংস্কৃতের আওতা হইতে অনেক দূরে থাকিবে।সংস্কৃত একটি মৃতভাষা; সুতরাং মৃতের সহিত যাহারা যত বেশী মিতালী করিবে, তাহারা ততাে বেশী আড়ষ্ট ও প্রাণহীন হইবে।
পাক-ভারত উপমহাদেশের বহু প্রাদেশিক ভাষা রহিয়াছে ৷ যেমন বাংলা, উর্দু, হিন্দী, গুজরাটী, মারাঠি, আসামী ইত্যাদি।ইহাদের মধ্যে বাংলা ও উর্দুই যে শীর্ষস্থানীয়, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ লাভ করিয়াছেন।উর্দুর কবি ইকবাল আজ সারা জগতের বিপ্লবী কবি ও দার্শনিক।এই দুই ভাষাতেই বহু বিশিষ্ট মনীষী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।এ গৌরব এক হিসাবে ইসলামের। উর্দু ও বাংলা যে আজ এত প্রগতিশীল ও জীবন্ত তাহার কারণ যে উহারা আর্য ভাষা নহে; অন্য কথায় সংস্কৃত হইতে উহাদের জন্ম হয় নাই। সংস্কৃত হইতে যে ভাষা যতো দূরে রহিয়াছে, সে ভাষা আজ ততো জীবন্ত, ততো প্রগতিশীল।

পাক-ভারত উপমহাদেশের সমস্ত আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে আজ যে উর্দু ও বাংলা ভাষাই সর্বাপেক্ষা উন্নত, বলিষ্ঠ ও ব্যাপক,তাহার অন্যতম প্রধান কারণ এই যে, ইহাদের প্রকৃতি ও রক্তে আছে ইসলামের বিশ্বজনীন উদারতা ও মানবিকতার ছাপ।প্রচারধর্মী সাম্যবাদী মানুষেরাই ইহাদের জন্মদাতা ও পালয়িতা।

বাংলা ভাষার গতিপথ লক্ষ্য করিলেও এ সত্য সহজেই বুঝা যায়।দ্রাবিড়, বৌদ্ধ, সুলতানী আমল পার হইয়া সে আসিল বৃটিশ আমলে। এখানে আসিয়া পাদ্রী ও পণ্ডিতদের ষড়ষন্থে সে অনেকখানি স্বাধীনতা হারাইয়া ফেলিল বটে, কিন্তু মুক্তির নূতন পথ ধরিয়া বাহিরে আসিতে তাহার বিলম্ব ঘটিল না।

এই মুক্তি-সংগ্রামে সাহায্য করিলেন মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ উদারধর্মী কবি-সাহিত্যিকেরা।পাকিস্তান আসিয়া তাহার রূপান্তর ঘটিয়াছে। সুখস্মৃতি ঘেরা পূর্ব পাকিস্তানেই তো তাহার আদি বাসভূমি।এখানে আসিবা মাত্রই সে আবার তাহার হৃতগৌরব ফিরিয়া পাইয়াছে।

উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাও এখন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা।এই গৌরব বাংলা ভাষা অন্যত্র লাভ করিতে পারে নাই। পূর্ব-পাক বাংলা সাহিত্যে এবারেও ইসলাম এক নূতন ভূমিকা গ্রহণ করিবে।ইসলামের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা ও মহামানবতার বাণী এবং তাহার রূপ, রস ও সুর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে প্রেরণা যোগাইবে এবং সম্ভাবনার এক নূতন দিগন্ত খুলিয়া দিবে।

[উৎসঃ গোলাম মোস্তফা, বাংলা ভাষার নূতন পরিচয়, গোলাম মোস্তফা প্রবন্ধ সংকলন, আহমদ পাবলিশং হাউস, ঢাকা, ১৯৬৮ থেকে সংগৃহীত]