মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে বঙ্গ-বিজয় বাংলা-ভাষার পক্ষে এক মহামুক্তির দিন

Image result for মুহম্মদ বিন বখতিয়ারেরমুহম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে বঙ্গ-বিজয় বাংলা-ভাষার পক্ষে এক মহামুক্তির দিন

লিপি কাহাদের?

বাংলা ভাষা যে আর্যদের সৃষ্টি নয়, অন্যদিক দিয়াও তাহা প্রমাণিত হয়।ভাষা ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাহন হইতেছে তাহার লিপি। লিপি ছাড়া কোনো ভাষা প্রসারিত বা পল্লবিত হইতে পারে না। কিন্তু আর্যদিগের কোনো লিপি ছিল কি?-না। আর্যেরা কোনো লিপিচর্চা করিত না। ভারতের প্রাচীনতম লিপি ছিল ‘ব্রাক্ষী’ ও ‘খরোষ্ঠী’ লিপি। ‘অশোক’ লিপিও পরে প্রবর্তিত হয়। কিন্তু কোনো লিপিই আর্যদের নিজস্ব নয়- সব লিপিই সেমিটিক। লিপিতত্ত্ববিদ Rawlinson বলে: “The Brahmi script, the parent script of India, was borrowed from Semitic source probably about the seventh century BC.” উপরোক্ত তিনটি লিপিই যে সেমিটিক, তার আর এক বড় প্রমাণ এই যে, উহাদের প্রত্যেকটিই দক্ষিণ হইতে বামে লিখিত (from right to left)।

এই সব লিপি দ্রাবিড়রাই আমদানি করিয়াছিল। খ্রীষ্টের জন্মের চারি হাজার বৎসর অথবা তাহারও পূর্ব হইতে ভারতীয় দ্রাবিড় জাতিদের সহিত আরবদিগের বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিল।সেই সূত্রেই তাহারা এইসব লিপি ভারতে আনিয়াছিল।বলাবাহুল্য, দ্রাবিড় জাতি ছিল সেমিটিক জাতিদেরই জ্ঞাতি।ব্যাবিলন অঞ্চল হইতে তাহাদের এক শাখা বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়া ভারতে প্রবেশ করে এবং কালে কালে পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বাংলাদেশে অধিকার বিস্তার করে। সিন্ধুর ময়েন-জো-দারোতে কিছুকাল পূর্বে (১৯২১) প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে যে লিপি ও সীলমোহর আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাও সেমিটিক, কেননা সে লিপিও দক্ষিণ হইতে বামে লিখিত।[The Indus Script runs from right to left : Sir John Marshal]


অতএব কোনো দিক দিয়াই বাংলা ভাষার সৃজনে বা বিকাশে আমরা আর্যদের কোনো দানেরই পরিচয় পাইতেছি না।বাংলাদেশের প্রতি এবং বাংলা ভাষার প্ৰতি মনোভাবও সুকুমার সেনের অনুমানকে সমর্থন করে না।তিনি তো নিজেই বলিয়াছেন “বাংলাদেশ আর্যেতর জাতির দ্বারা অধ্যুষিত ছিল বলিয়া এদেশে আগমন ও বসতি উত্তর ভারতবাসী আর্যদিগের পক্ষে বহুদিন অবধি নিষিদ্ধ ছিল ।”

ঠিকই তো, আর্যেরা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে চিরদিনই অস্পৃশ্য জ্ঞান করিয়া আসিয়াছে।বাংলার অধিবাসীদিগকে তাহারা ম্লেচ্ছ, যবন, রাক্ষস, বর্বর ইত্যাদি বলিয়া গালাগাল দিয়াছে এবং তাহাদের ভাষাকে ‘পক্ষীর ‘ভাষা’ বলিয়া উপহাস করিয়াছে।এমন কি যদি কোনো আর্য ভুলক্রমেও বাংলাদেশের মাটি মাড়াইত, তবে বিনা প্রায়শ্চিত্তে আর্যেরা তাহাকে সমাজে গ্রহণ করিত না। নিম্নের শাস্ত্রবাণীই তাহার প্রমাণ:

“অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্র মগধেষু চ।
তীর্থ যাত্রাং বিনা গচ্ছন পুনঃ সংস্কার মহতি।।”

এই অবস্থায় কি করিয়া আর্যদের হাতে বাংলা ভাষায় জন্ম হইতে পারে যাহারা বাংলাদেশকে ভালোবাসিল না, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসিল না, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসিল না, বাঙালীদের সহিত মেলামেশা, উঠাবসা বা কোনোরূপ সামজিক সম্বন্ধ স্থাপন করিল না, যাহাদের লিপিজ্ঞান ছিল না, ছুঁৎমার্গের ভয়ে যাহারা লিপিচর্চাই করিল না, তাহারা কি করিয়া বাংলা ভাষার স্রষ্টা হইতে পারে?
খ্রীষ্টের জন্মের পরে

খ্রীষ্টের জন্মের পূৰ্বাবস্থা তো দেখিলাম।এইবার দেখা যাউক খ্রীষ্টের জন্মের পর হইতে দশম-একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত (অর্থাৎ মুসলমানদের বঙ্গবিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত) আর্যেরা কখন কিভাবে বাংলাদেশে আসিয়া আত্মপ্ৰতিষ্ঠা লাভ করিল এবং বাংলা ভাষাকে কতখানি উত্সাহ দিল৷

ডক্টর সুকুমার সেন বলিতেছেন, “পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বেই বাংলাদেশের সর্বত্র আর্যবসতি প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল এবং সেই সঙ্গে আর্য ভাষাও সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছিল।” কিন্তু ইতিহাসে সেরূপ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।দশম-একাদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত (অর্থাৎ পাল বংশের পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত) আর্যেরা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে নাই।কর্নাট হইতে আগত আর্য-ভক্ত সেনাগণ যখন বৌদ্ধ পালদিগকে পরাজিত করিয়া বাংলাদেশ দখল করিল, তখনই আর্যেরা এদেশে আসিবার সুযোগ পাইল।


একটা গূঢ় কথা এখানে চাপা পড়িয়া আছে। আর্যেরা যে বাংলাদেশ এবং বাঙালীদিগকে ঘৃণা করিত বলিয়াই এদেশে আসে নাই, ইহা পূর্ণ সত্য নহে।ইহাতে মনে হয় যেন আর্যেরা আসিতে চাহিলেই এদেশবাসী তাহাদিগকে বরণ করিয়া লইত।সেরূপ ধারণা নিতান্তই ভুল।এদেশে দ্রাবিড়-বৌদ্ধ প্রভৃতি অনার্যরাও আর্যদিগকে রীতিমত শত্রুজ্ঞান করিত। দ্রাবিড়-বৌদ্ধদের কি কোনোরূপ আত্মমর্যাদাবোধ ছিল না? দেশপ্রেম ছিল না? শক্তি সাহস ছিল না? আর্যরা যখন তাহাদিগকে ‘যবন’ ‘ম্লেচ্ছ’ ‘রাক্ষস’ ‘বর্বর’ ইত্যাদি বলিয়া গালাগালি দিত, তখন তাহারাই বা আর্যদিগকে পূজা করিবে কেন?তাহারাও প্রাণপণে আর্যদিগকে বাধা দিত।কাজেই আর্য-অনার্য বিরোধ সর্বদা লাগিয়াই ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া এদেশের লোকেরা তাই আর্যদিগকে বাহিরে ঠেকাইয়া রাখিয়াছে। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই সত্যের কিছুটা আভাস দিয়াছেন:

“The country (i.e. Bengal) was for centuries in open novolt against Hindu orthodoxy. Buddhist and Jain influence was so great that the codes of Mann, while including Bengal within the geographical boundary of Aryyavarta, distinctly prohibited all contact with the land for fear of contamination.” [History of Bengali Language & Literature]

ডক্টর সুকুমার সেন মনে করে, পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বেই আর্যেরা বাংলাদেশ দখল করিয়াছিল এবং আর্যভাষায় সারা দেশ ছাইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আমরা তো দেখিতেছি অন্যরূপ। গুপ্তদের দ্বারা (পঞ্চম শতাব্দী) বাংলাদেশ (সমতট) যে বিজিত হইয়াছিল এমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নাই। অন্ততঃ হিন্দুদের সহিত তখনও যে বৌদ্ধদের ভীষণ যুদ্ধবিগ্রহ চলিতেছিল, একথা চীন-পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ও হুয়েন-সাঙ তাহাদের ভ্রমণ-বৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন:


“The Chinese pilgrims Fa-Hien in the fifth century and Huen Tsang in the seventh century found the Buddhist religion prevailing in Bengal, but already engaged in a fierce struggle with Hinduism, which ended about the ninth or tenth century in the general establishment of the later faith. In the eleventh century the Senas rose to power in Bengal while in the next century, both the Palas and the Senas were submerged beneath the flood of Muslim conquest. [Encyclopaedia Britannica]

উপরোক্ত উদ্ধৃতি হইতে পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাইতেছে যে, পাল রাজাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই আর্যহিন্দুরা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

প্রায় দুইশত বৎসর ধরিয়া বাংলাদেশ তাহাদের শাসনাধীন ছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও কি বাংলা ভাষার প্রতি তাহারা কোনোরূপ দরদ দেখাইয়াছে?-মোটেই না।বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেনঃ

“আমরা হিন্দু-কালের কোনো বাঙ্গালা সাহিত্য পাই নাই। হিন্দু সেনরাজগণ সংস্কৃতের উৎসাহদাতা ছিল ৷ ব্রাহ্মণেতর ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট বলিয়াই সম্ভবতঃ তাহারা বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিল।” [বাঙ্গালা ব্যাকরণ]
কোনোরূপ সাহায্য করা তো দূরে থাকুক, বাংলা ভাষার উচ্ছেদ-সাধনের জন্যই তাহারা প্রয়াস পাইয়াছিল।সুপণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক্ ঠিকই বলিয়াছেন:

“বাংলার শেষ হিন্দু রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন ৷ তাঁহার সভায় ধোয়ী, উমাপতি ধর প্রভৃতি কবি এবং হলায়ুধ মিশ্র প্রভৃতি পণ্ডিত ছিলে।কিন্তু নানা পণ্ডিত ও কবির সমাবেশে তাহার রাজধানীতে যে সংস্কৃত ভাষা চর্চার ও পাণ্ডিত্য-প্রকাশের সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়িয়া উঠে, তাহা জয়দেবের গীত-গোবিন্দের মাধ্যমে সমগ্র উত্তর ভারতে প্রভাব বিস্তার করিলেও বাংলা ভাষা চর্চার কোনো আয়োজন তথায় ছিল না”।
আর একটি মূল্যবান মন্তব্যও তিনি করিয়াছেন:

“১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কীবীর ইখতিয়ার বিন মুহম্মদ বখতিয়ার লক্ষণ সেনকে লক্ষণাবতী হইতে বিতাড়িত করিয়া বাংলায় সংস্কৃত চর্চার মূলে কুঠারাঘাত হানিয়া বাংলা চর্চার পথ উন্মুক্ত করেন।”[মুসলিম বাংলা-সাহিত্য]
বস্তৃতঃ মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে বঙ্গ-বিজয় বাংলা-ভাষার পক্ষে এক মহামুক্তির দিন । মুসলমানদের দ্বারা বঙ্গ-বিজয় না হইলে আর্যদের হাতে যে বাংলাভাষা লোপ পাইত অথবা শুদ্ধিকৃত হইয়া ভিন্নরূপ ধারণ করিত, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই। সেন রাজাদিগের অল্প-পরিসর সময়-রেখার মধ্যই আর্য ব্রাহ্মণগণ আইন করিয়া বাংলা ভাষার উৎখাত সাধনের প্রয়াস পাইয়াছিলেন। তাঁহারা এই নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, যদি কোনো আর্য হিন্দু বেদ, পুরাণ, রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রসমূহ কোনো মানব ভাষায় (অর্থাৎ বাংলা ভাষায়) আলোচনা করে, তবে তাহাকে ‘রৌরব’ নামক নরকদণ্ড ভোগ করিতে হইবে-

“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চারিতানি চ।
ভাষায়ং মানবঃ শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।।”

ইহাই সংস্কৃতের সহিত বাংলা ভাষার প্রথম সংঘাতের ফল।


নোটঃ
১.সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৪৬ পৃষ্ঠা।
নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, বাঙ্গালা সাহিত্যের নূতন ইতিহাস,৪৬-৫০ পৃষ্ঠা