ইসলামি সভ্যতায় প্রাচীন গ্রন্থাগার: সূচনা ও ক্রমবিকাশ
ইসলামি সভ্যতায় প্রাচীন গ্রন্থাগার: সূচনা ও ক্রমবিকাশ

ইসলাম-পূর্ব আরব উপদ্বীপে নিরক্ষরতার বিস্তার সত্ত্বেও আরবদের লিপি-শিল্পের ‘ধারণা’র বিষয়ে ঐতিহাসিক বহু প্রমাণ মেলে। ইবনুন নাদীম (মৃ. ৩৮০ হি.) তার ‘আল ফিহরিসতে’ আলোকপাত করেন যে, আরবরা তৎকালে হাবাশি লিপি-শৈলীতে অভ্যস্ত ছিল। এ ছাড়াও দক্ষিণ উপদ্বীপাঞ্চলীয় গোত্র সাবা এবং হিময়ারের লিপি-ধারাতেও তাদের কেউ কেউ পারঙ্গম ছিল বলে জানা যায়।

কাগজপত্তর-যাত্রা
প্রাক-ইসলাম যুগ থেকে পরবর্তী কালে বহুদিন লিপিকলার প্রধানতম উপাদান ছিলো কাষ্ঠ-ফলক, খেজুর বৃক্ষ, হাড়, শুকনো চামড়া প্রভৃতি। প্রথম দিকে ওহীও এভাবেই লেখা হতো। মাক্কী আস সিবাঈ’র ভাষায়, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিহাসের সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি জাজিরাতুল আরবে সিল-মোহর পদ্ধতি চালু করেন। এরপর নথিপত্র আদান-প্রদানে এর বহুল ব্যবহার শুরু হয়।কিছুকাল এভাবেই চলে।

একটা সময়ে আরবরা চিনাদের থেকে কাগজ ব্যবহার এবং এর রকমফের সৃষ্টি-শিল্পের প্রশিক্ষণ নেয়। ফলে তাদের শিক্ষা ও লেখনীতে বিশাল বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। বিস্তর পরিসরে ইসলামী বিশ্বে লিপি-শিল্পের ক্রমবিকাশ ঘটে। ‘সিনাআতুল ওয়ারাক’ বাগদাদেও পৌছে যায়। আব্বাসী মন্ত্রী জাফর বিন ইয়াহয়া বুরমাকী রাষ্ট্রীয় সকল লেনদেনে ‘রুকুক’ তথা চামড়ার মুদ্রার পরিবর্তে কাগুজে মুদ্রা প্রতিকল্পন করার আদেশ দেন। কাগজের প্রসার ও শিল্প-বিকাশের সঙ্গে রুকুক এবং প্যাপিরাসের তুলনায় এর মূল্যও সহনীয় মাত্রায় নেমে আসে।বড় বড় শহরগুলোতে কাগজ-শিল্প ছড়িয়ে পড়ে।কিতাবাদীর বাজার রমরমা হয়ে ওঠে।


বলা চলে, দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ থেকেই কাগুজে সাংস্কৃতিক বানিজ্য একটি জনপ্রিয় রূপ ধারণ করে।

কাগজের লিখিয়েদের নাম দেওয়া হয় ‘ওয়াররাক’ বহু বচন হলে ‘ওয়াররাকিন’। দারুল খিলাফাতে তাদের স্বতন্ত্র স্থান এবং ব্যবসায়-নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে তারা অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন।

বাগদাদে এক মুহূর্তের জন্য হলেও আগমন করেছেনে এমন সব বরেণ্য ব্যাক্তিদের নিয়ে লেখা প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারিখু বাগদাদ'; যার গ্রন্থপ্রণেতা হলেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস খতীব আবু বকর আল বাগদাদী (মৃ. ৪৬৩ হি.)। বহু জায়গায় তিনি ঐতিহাসিক সূত্র-পরম্পরা প্রমাণে শুধু এসব ব্যবসায়ী ওয়াররাকদের বর্ণনাকেই ভিত্তিমূল ঠাওর করেছেন। ইতিহাসজ্ঞ মোহাম্মাদ শা'বান আয়্যুব ৮৫০টি জায়গা চিহ্নিত করেছেন। তবে আরো বহু স্থান রয়ে গেছে শা'বান আয়্যুবের গণনার বাইরে।
স্বয়ং ইবনুন নাদীম (মৃ. ৩৮০হি.) ছিলেন চতুর্থ শতকের একজন বিশিষ্ট ওয়াররাক। যিনি প্রাচীন আরবীয় বায়োগ্রাফিক গ্রন্থ ‘আল ফিহরিস’ প্রণেতা। লাইব্রেরি সংরক্ষণ, পরিশীলন, নুসখা প্রতিলিপি করণ এবং সবশেষ-পেশাদারিত্বের তাগিদে গ্রন্থ ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্য দিয়েই তিনি লিখে ফেলেছেন এই বিখ্যাত কিতাব; যা আজও মুসলিম মনিষীদের কাছে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ বলা চলে একে। ইবনুন নাদীম তার কাল পর্যন্ত অস্তিত্বে আসা কত বর্ণ-মতাদর্শ, সভ্যতা ও গ্রন্থমালার হিসাব এখানে কষেছেন, পাঠক কিতাবটির পাতা উল্টালেই তা বুঝতে সক্ষম হবেন।


শরিয়াহ, আইন, ব্যাকরণ, ভাষা, ইতিহাস, আখবার, অনুপাত, ফিকহ, হাদিস, দর্শন, প্রকৃতি ও রসায়ন-বিজ্ঞানসহ সহস্র বিষয় টেনে এনেছেন এখানে। এমনকি কল্প কাহিনী, মনস্তত্ত্ব ও জাদু-টোনা বিষয়ে লিখিত কিতাবাদী নিয়েও আলাপ করেছেন দীর্ঘ। শাখাগত মাসালায় অনুসরণীয় ‘মাযাহেব ও ইতিকাদাত’ বিষয়ে তো লিখেছেন-ই।
গণ-গ্রন্থাগার
ইসলামী সভ্যতায় মাকতাবার (লাইব্রেরী) গুরুত্ব অপরিসীম। পাঠ-পঠনে সবকালেই আলোকবর্তিকার ভূমিকা রেখেছ এসব মাকতাবা। আমির-উমারা ছাড়াও সমাজে ধর্মীয়-মূল্যবোধ লালন করেন—এমন বহু বিত্তশালী মানুষ মাকতাবা প্রতিষ্ঠা এবং সচল রাখার পেছনে অসামান্য ভূমিকা রেখে এসেছেন সব যুগে।

বিশেষত যখন আমাদের আজকের প্রযুক্তি তাদের হাতে ছিল না। ছাপার হরফে কোন কিতাব দেখার সুযোগ তাদের হতো না কখনো; বহু টাকার বিনিময়ে ওয়াররাকদের থেকে নুসখার প্রতিলিপি করিয়ে নিতে হতো,সর্বসাধারণের জন্য যা কষ্টসাধ্য ছিলো অবশ্যই। সে সময়ে জ্ঞান-চর্চার মাধ্যম হিসেবে একটা গণ-গ্রন্থাগারের কী ভূমিকা হতে পারে,তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ক্ষুদে ক্ষুদে চিন্তা থেকেই কিন্তু বৃহৎ পরিসরের পাবলিক লাইব্রেরিগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

মাকতাবার বহু রূপ, শৈলী ও ধরনের সঙ্গে ইসলামী সভ্যতা পরিচিত সেই আদিকাল থেকেই। ইসলামী দেশগুলোর বলতে গেলে প্রায় সব শহরেই এই মাকতাবার ইতিহাস পাওয়া যায়। সেটা চাই ক্ষুদ্র হোক কিংবা বড়...।

একাডেমিক গ্রন্থাগার
এটা ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত গ্রন্থাগারের ধারা। এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হলো-বাগদাদের ‘বাইতুল হিকমাহ’। ফাতেমীদের সময় ছিল কায়রোতে 'দারুল হিকমাহ'। এর পরে আসে ‘বিশেষ’ গ্রন্থাগারের আলাপ। এই প্রকার গ্রন্থাগারের বিস্তর প্রসার ঘটেছিলো গোটা বিশ্বে। উল্লেখযোগ্য হলো খলিফা মুসতানসিরের মাকতাবা। ফাতাহ বিন খাকানের মাকতাবা। যাহাবী তারিখুল ইসলামে তার সম্পর্কে লেখেন, ‘বিন খাকাব হাটতেন, আস্তিনে কিতাব থাকতো, ইচ্ছে হলে চোখ বুলাতেন।’ বলা চলে অনেকটা স্বতন্ত্র ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার।

ছিল আলে বাওয়াইহের প্রসিদ্ধ মন্ত্রী ইবনুল আমিদের মাকতাবা। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ‘ইবনু মাসকুয়াহ’ উল্লেখ করেন, তিনি ইবনুল আমীদের গ্রন্থাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। একদিন তার বাড়িতে বড় ধরনের চুরি হয়। বহু সরঞ্জাম নিয়ে যায় ‘চোর’। ইবনুল আমিদের কাছে সব চেয়ে মূল্যবান এবং প্রিয় বস্তু ছিল তার কিতাবগুলো। সব ধরনেরর কিতাবাদি ছিল তার এ সুবিশাল গ্রন্থাগারে; পরিমাপ করলে যা একশ' উটের হাওদাজের সমান হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সকালে উঠে তিনি আমাকে সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল তার কিতাবগুলোর কথাই জিজ্ঞেস করলেন। আমি দেখছিলাম, ইতিমধ্যে তার চেহারা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল।


বললাম, সেগুলো নিরাপদ আছে, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন! ইবনুল আমিদ তখন বললেন, আমার কাছে পৃথীবির তাবৎ ধনভাণ্ডারের বিকল্প আছে, কিন্তু আমার এইসব বিরল কিতাবগুলোর কোনো বিকল্প নেই।

কর্ডোভার ঐতিহাসিক গন-গ্রন্থাগারও এই ধারাই ছিলো। উমাইয়্যা খলিফা মুসতানসির বিল্লাহ ৩৫০ হিজরিতে প্রতিষ্ঠা করেন এ গ্রন্থাগার। সরকারি কোষাগার থেকে শতাধিক ‘মুয়ায্যিফ’ নির্ধারণ করা হয় গ্রন্থাগার সংরক্ষণের স্বার্থে। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত বহু নুসখা প্রতিলিপিকার, ঝানু লিখিয়ে ও প্রসিদ্ধ ওয়াররাকদেরর মিলনমেলা ঘটে এখানে।

আন্দালুসের সহস্র বিদ্যান-পণ্ডিতের জ্ঞানের খোরাকে পরিণত হয় কর্ডোভার এ বিদ্যানিকেতন। জানা যায়, ইউরো সভ্যতার বহু আদীম নথিপত্রও গচ্ছিত ছিলো এখানে, ফলে তাদের কাছেও যথেষ্ট গুরুত্বের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় মুসতানসির প্রতিষ্ঠিত এই মাকতাবা।

ইবনুল আবার ‘তাকমিলা লি কিতাবিস সিলাহ' গ্রন্থে লেখেন, ‘সে সময় গ্রন্থাগারের কিতাবের 'তালিকা' সম্বলিত সূচিপত্রের সংখ্যা ৪৪ খণ্ড ছিলো।’

বর্তমান লিবিয়ার লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলী,তখন তারাবুলুস নামে পরিচিত ছিলো ইলমি মহলে। বনু আম্মার প্রতিষ্ঠিত সুবিশাল গ্রন্থাগার আজও সেখানে বহাল তবিয়তে আছে। রাষ্ট্র কতৃক নিয়োজিত একটি দল এমন ছিল, যারা রাষ্ট্রীয় ভাতা নিয়ে সমগ্র-ইসলামী বিশ্ব চষে বেড়াত বিরলতর কিতাবাদির অনুসন্ধানে।

৮৫ জন লিপিকার ছিলেন, যারা রাত দিন নুসখা প্রতিলিপির কাজ করে যেতেন শুধু।

এভাবেই খলিফা থেকে শুরু করে বিত্তশালী সমাজপতিসহ সাধারণ ধনী ব্যবসায়ী মুসলিমদের অনেকে এসকল গন-গ্রন্থাগারের সূচনা করেন। ইতিহাসে পাওয়া যায, নুরুদ্দিন মুহাম্মাদ যানকী দামেশকে একটি মাদ্রাসা কায়েম করেন,সঙ্গে বড় রকমের একটি গ্রন্থাগারও জুড়ে দেন।সালাউদ্দিন আইয়ুবি রহমতুল্লাহি আলাইহি তার পথেই হাটেন। উনার প্রধান বিচার প্রতি-যিনি আল কাদী,আল ফাদিল' নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন- কায়রোতে মাদ্রাসা কায়েম করেন এবং ফাতেমিদের ভাণ্ডার থেকে প্রাপ্ত প্রায় দুই লক্ষ কিতাবের বিশাল এক গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন মাদ্রাসার পাশেই।


ইতিহাসে ‘আল ফাদিলিয়্যা’ নামে পরিচিতি পায় সে মাদ্রাসা এবং তৎ-সংলগ্ন গ্রন্থাগার।

পাতা উল্টালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এরূপ বহু চর্চা-কেন্দ্রের খোঁজ মিলবে, আজ আর সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। মাত্র একটি ঐতিহাসিক ধারার প্রসঙ্গ টেনেই ক্ষান্ত হবো।

প্রাচীন মসজিদের সঙ্গে গড়ে ওঠা গ্রন্থাগার
জামে আজহার মসজিদের (যে মসজিদ থেকে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়) গ্রন্থাগার এর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকার কাইরাওয়ান অঞ্চলের জামে কাবির মসিজদের গ্রন্থাগারও ইতিহাসের বড় একটি অংশ জুড়ে রেখেছে। আর মসজিদে নববী তো হাজার বছরের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে। আগন্তুক জ্ঞান-অন্বেষীর জন্য এক মহা জ্ঞান-ভাণ্ডার নববী মসজিদের এই গ্রন্থাগার।

দামেশকে জামে উমাওয়ির সঙ্গে লাগোয়া খিযানাতুল কুতুব তো এখন ইসলামি দুনিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ প্রকাশনা বিভাগ।অথচ এর সূচনা যে আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগে হয়েছিলো একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে, তা কজন জানে!

আন্দালুসে মসজিদ-কেন্দ্রিক গণ-গ্রন্থাগারগুলো প্রাচ্যের তুলনায় অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কর্ডোভার গ্রান্ড মসজিদকে সবচেয়ে বড় মসজিদ মনে করা হয়। ১৭০ হিজরীতে উমাইয়্যা খলিফা আব্দুর রহমান আদ-দাখিল এ মসজিদ প্রান্তরে মুসহাফ এবং কুতুবে ইসলামিয়্যার বিশাল এক ভাণ্ডার জমা করেন। কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য, দ্বিতীয় সম্রাট 'ফার্ডিনান্ড' ৬৩৪ হিজরিতে কর্ডোভা দখলের সময় সবগুলো কিতাব জ্বালিয়ে দেয়। বিখ্যাত আন্দালুসি ইতিহাসবেত্তা আল-মাক্কারি তার গ্রন্থ ‘নাফহুত ত্বীব ফি তারিখী আন্দালুস আর রাত্বীব’-এ লেখেন, ‘এসব গ্রন্থমালার মধ্যে উসমান ইবনে আফফান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর স্ব-হস্তে লিখিত মুসহাফটিও ছিল, যা পুড়িয়ে ফেলা হয়।’

এ ছিল সুখ-দুঃখ মিশ্রিত ঐতিহ্যময় ইসলামী সভ্যতার সামান্য বর্ণনা। শেখার ব্যাপার হলো— সমাজপতি, ধনকুবের, বিত্তশালী সে সময়েও ছিল, আজও আছে।

কিন্তু আমাদের চেতনার অবক্ষয় ঘটেছে পূর্বের তূলনায় কঠিন ভয়াবহ মাত্রায়। মসজিদ-মাদ্রাসা এবং লিল্লাহ বোর্ডিং ছাড়াও যে ‘ওয়াকফের’ বহু জায়গা রয়ে গেছে শরিয়তে এবং আমাদের সালাফের শিক্ষায়, তা আমরা সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে সক্ষম হই নি।

মূলত সভ্যতা যে চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং অধুনা দুনিয়ায় বুদ্ধিবৃত্তিকার অনুসঙ্গে চিন্তা-বিকাশের প্রশ্নে যে সভ্যতা-চর্চা নানামাত্রিক কল্পনাবল এবং বিনির্মাণীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম—সে আলাপই বা আমরা কজন উঠাই।
সিপাহী বিদ্রোহ উত্তর ইংরেজ বাহিনী যখন দিল্লিতে নির্বিচারে মানুষ খুন করছিল, মুসলমান তখন খেলায় মত্ত ছিল
সিপাহী বিদ্রোহ উত্তর ইংরেজ বাহিনী যখন দিল্লিতে নির্বিচারে মানুষ খুন করছিল, মুসলমান তখন খেলায় মত্ত ছিল

জনগণের মধ্যে 'আমাকে জানানো হয়নি' বা 'রাজনীতি বুঝিনা' বা 'আই হেইট পলিটিকস' বলা লোকেরা বিপদে পরে সবচেয়ে বেশি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত দিল্লি জেনোসাইডে এটাই ঘটেছিল।

দিল্লিতে যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা কামানের গোলা নিক্ষেপ করছিল দিল্লির অধিবাসীরা মশকরা করে মজা লুটতেছিল। তাঁরা মনে করেছে এটা এক ধরনের আতশবাজি। সূফী ও উর্দু কবি খাজা হাসান নিজামি তাঁর Delhi Ki Jan Kuni (The Agony of Delhi) বইয়ে লিখেন (১);

''The residents of Delhi have always been known at times of joy and in times of hardship never to lose their sense of joy and leisure. When the British started shelling Delhi, the residents instead of feeling terrified or afraid looked at the spectacle as a show of fireworks. When the firing started they would climb on their roofs to see the shells coming they would then shout and point them out to each other and then wait to see where the shells were falling.'' (P:27)


তাঁদের মজা এতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। যখন দিল্লিতে নির্বিচারে মানুষদের মারা হচ্ছিল তখনো তাঁদের কোন হুঁশ ছিলনা। প্রভাবশালী ও অভিজাত লোকদের গ্রেফতার করা হচ্ছিল, গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছিল। অথচ ফাঁসিতে ঝুলানোর আগের দিন রাতেও তারা দাবা ও অন্যান্য খেলায় ব্যস্ত ছিল। খাজা হাসান নিজামি লিখেন;

''The feeling of fun and leisure amongst the residents of Delhi was not limited to this spectacle, even after the capture of Delhi when people were being killed and murdered everywhere; the residents of Delhi were not cowered. Famous nobles from Delhi were captured, were tried and condemned to death but the night before they were to be hanged, they would pass their time playing chess, and other games such as Kunjafa, and Chaucer''. (P:28)

মুসলিমদেরকে দুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে মেরে ফেলা হচ্ছিল। তাঁদেরকে ফাঁসিতে ঝুলানোর দৃশ্যটা ছিল মর্মান্তিক। তাঁদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করানো হত। এক গ্রুপের সামনে অন্য গ্রুপকে মারা হত এবং এই দৃশ্য দেখতে বাধ্য করত। হাত বেঁধে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হত ভিক্টিমদের। এবং যখন কামান দাগানো হত সেই মানুষের শরীরটা উড়ে গিয়ে পরত শহরের বাহিরে। আর এই দৃশ্য দেখে মজা নিতে আসত সাধারণ ব্রিটিশরা,এসব দেখে তাঁরা আনন্দ পেত। খাজা হাসান নিজামি লিখেন;


''Opposite the Chandni Chowk Police Station there used to be a pond, this has now gone. On three sides of it the British had erected gallows for hanging people. At the time of the hangings, the arrangements were quite dreadful. The people who were to be hanged were made to stand in a line. Half of them were hanged and the other half were made to watch the fate that awaited them. Civilised nations do not act in this manner and consider this type of behaviour obnoxious.

The victims would be taken out of the Fort in a cart with their hands tied behind their backs. The British spectators would come around the Police Station to view the hanging. When the hanging took place the spectators would laugh with joy, and the body of the victim was thrown on the cart head down for burial outside the city'' (P:34)

মা-বোন ও নারীদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুণ। তাঁদের অনেকেই এমন ছিলেন যে ঘরের বাহিরে যায়নি, পর্দার মধ্যে ছিল। ঘরে ঘরে যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা যেতে লাগল তাঁরা ধর্ষণ থেকে বাঁচতে, সম্মান, ইজ্জত বাঁচাতে পানির কুপগুলোতে লাফিয়ে পরতে লাগল। মরতে মরতে পুরো কূপগুলো এতটাই ভরে গিয়েছিল যে শেষের দিকে যারা লাফিয়ে পরত, পরত অন্য দেহের ওপর। মানব শীরের লাশে কূপ ভর্তি হয়ে গভীরতা কমে আসায় শেষের দিকে আত্মহত্যা করতে যাওয়া কেউ কেউ মরতনা। পরে তাদের অনেককেই আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

এর ওপর ছিল গণলুটপাট। পাঞ্জাবী শিখ, মুসলিম ও বেলুচিস্তান থেকে আগত সৈন্যদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। খাজা হাসান নিজামি'র বইয়ে একটা অংশ আছে যার শিরোনাম 'How did the Hindus in Delhi become rich'। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটা সম্ভ্রান্ত জনগোষ্ঠী রাতারাতি ফকির, ভিক্ষুতে পরিনত হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লি'র মুসলিমেরা এমন একটি উদাহরণ। অথচ ৯০% এর বেশি জনগন এই বিদ্রোহের সাথেও ছিলনা, পাছেও ছিলনা।

৬ মাস পর স্যার লরেন্স যখন দিল্লির দায়িত্ব নিয়ে আসে সে মুসলিমদের দিল্লিতে ফিরতে অনুমতি দেয়। হাসান নিজামীর বর্ণনায় জানা যায় মাত্র কয়েক মাসে দিল্লির মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাত্র ২৫% তাদের আবাসে ফিরে আসতে পেরেছিল। In short, the Mutiny which came as an angel of destruction for the Muslims became a Goddess of Wealth for its Hindu residents. (P:40)

দিল্লীতে মুসলিম শাসনকালে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, বিদ্রোহের ফলে তা একেবারে মুছে গেল। ১৮৫৮ সালের ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকার জানুয়ারী-জুন সংখ্যায় জনৈক প্রবন্ধ লেখক লিখেছেনঃ

''পাঁচ বছর আগে আমি দিল্লীতে গিয়েছিলাম, সেখানে মুসলিম পত্রিকার সংখ্যাধিক্য দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ যখন দিল্লী বিধস্ত করল, তখন আর তার কিছুই অবশিষ্ট রইল না। সংস্কৃতির কুসম শুকিয়ে ধুলায় ঝরে পড়ল। ‘জাকাউল্ল্যা অব দিল্লী’ গ্রন্থে সি. এফ, এডজে লিখেছে, “বিদ্রোহের এক বছর পর পর্যন্ত দিল্লীর উপর দিয়ে যে মরণ-ঝঞ্জার তাণ্ডব গিয়েছে তাতে সংস্কৃতির আর লেশমাত্র অবশিষ্ট রইল না। সে আঘাতের জের মুসলিম শিক্ষা আজও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। অন্যদিকে হিন্দু সংস্কৃতির পুনরুত্থানের পীঠ ছিল কলকাতায়। সেখানে বিদ্রোহের ঝড় বয়নি, তার রধিরাক্ত বন্যার প্লাবন থেকে সে রক্ষা পেয়েছে, তার ধন-সম্পত্তি জনপ্রাণী রয়েছে অক্ষত, তার সংস্কৃতি রয়েছে অনাহত। এর ফলেই হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। ব্যবধান অপ্রীতির সন্দেহের এবং তিক্ততার। আজ ভারতবর্ষের জাতীয় জীবন যে সাম্প্রদায়িক কলহের দ্বারা কণ্টকিত তা সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরবর্তী কালের উত্তরাধিকার।'' (২)

নোটঃ
(১) Syed Khwaja Hasan Nizami, Delhi Ki Jan Kuni, Published by Ibn Arbi, 1922, Translated by A Sattar Kapadia as 'The Agony of Delhi' 2003,https://www.scribd.com/…/44684266/Agony-of-Delhi-Khwaja-Has…


(২) উদৃত, হায়দার আলী চৌধুরী, পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৭ পৃঃ ৩০৫-৩০৬
রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন ছিলো ভাষা আন্দোলন, মুখের ভাষা কেড়ে নেবার নয়
রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন ছিলো ভাষা আন্দোলন, মুখের ভাষা কেড়ে নেবার নয়
ভাষা আন্দোলনের পর কিছু ন্যারেটিভ তৈরি হয়। যার বেশিরভাগই ছিলো বানোয়াট এবং মিথ্যে ন্যারেটিভ। তারমধ্যে একটি হলো ‘মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া’। শিল্পী আবদুল লতিফের গানের মধ্যে এরকম লাইন খুঁজে পাইঃ
“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়।”

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেন ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতা। যেই কবিতার মধ্যে পাইঃ
“মাগো ওরা বলে
সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।”

অথচ ভাষা আন্দোলন আদতে মুখের ভাষা কেড়ে নেবার বিপক্ষে আন্দোলন ছিলোনা, বরং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন ছিলো। যখন ভাষা আন্দোলন হয় ততদিনে এই অঞ্চলের প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। তাহলে কেন ভাষা আন্দোলনকে ‘মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন’ নামে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে?

এইসব স্লোগানের মধ্যে মিথ্যে আবেগ থাকলেও সত্যের ছিটেফোঁটা নেই। ভারতে হিন্দি ভাষা 'অফিশিয়াল' ভাষা হবার ফলে কি আসাম সহ ভারতের বাংলাভাষীদের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে? কিংবা তামিল, তেলেগু এসব ভাষা কি হারিয়ে গেছে?


আবার, এই অঞ্চলের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবার ফলে কি এই অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে?

আবহমান কাল থেকে এদেশের রাষ্ট্রভাষা ছিলো পালি, সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি। অন্য ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হবার দরুন কখনো তো বাংলা ভাষা হারিয়ে যায়নি। উর্দু ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবার দরুন মুখের ভাষা কেড়ে নেবার কথা যারা বলেন, সেটা প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুনা।

আরেকটা মজার বিষয় হলো, ভাষা আন্দোলন যেখানে ছিলো মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন (মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন নয়) সেখানে ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ‘আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবস’ না হয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে!


ভাষা আন্দোলনের ফলে আমরা কী পেয়েছি? আর এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যই বা কতটুকু সফল হয়েছে?

এতো বছর পর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে এখনো দেখতে পাই, বাংলা আজও এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার ভাষা হতে পারেনি। বিজ্ঞান, গবেষণার কাজগুলোর লেখার ভাষা আজও বাংলা হয়ে ওঠেনি। উচ্চতর প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- বিচার বিভাগ, ব্যাংক, বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের কাজে বাংলা ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলা কেবল কবিতা, উপন্যাস আর নাটক-সিনেমার ভাষা হয়ে আছে!


এমনকি যারা ভাষা আন্দোলনকে প্রমোট করেছিলেন তাদের ঘরের ভাষা পর্যন্ত এখন আর বাংলা নেই! আবদুর রহিম নামের একজন লেখক একবার ইংল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে তার বন্ধু আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাইলেন, যিনি ছিলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির রচয়িতা। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বাসায় টেলিফোন করলে এক মেয়ে ফোন ধরে বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় কথা বলা শুরু করলে তিনি একটু অবাক হয়ে ভাবলেন, ভুল জায়গায় ফোন করলাম কি-না। কিছুক্ষণ পর নিশ্চিত হলেন, ইংরেজি বলা মেয়েটি আবদুল গাফফার চৌধুরীর মেয়ে। পরে জানতে পারলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ছেলেমেয়েরা বাসায় নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলে!

বাংলা ৮ ই ফাল্গুন ভাষা আন্দোলন হলেও ভাষা আন্দোলনের গান-কবিতায় যে তারিখটি জড়িয়ে আছে সেটিও বাংলা তারিখ নয়, ইংরেজি ২১ শে ফেব্রুয়ারি।

ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু, এই আন্দোলন আমাদেরকে বানিয়েছে ‘ভাষিক মৌলবাদ’। যার ফলে উর্দু-ফারসি ভাষার প্রতি আমাদের তৈরি হয়েছে বিদ্বেষ। বাঙালী জাতীয়তাবাদ যারা লালন করে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই এই দুটি ভাষাকে ঘৃণা করে।

পৃথিবীর সর্বত্র বহুভাষিতা যেখানে সাধারণ ঘটনা সেখানে আমরা সেই বিরল জাতিগুলোর একটি যারা একভাষী। আমরা না পারি ভালো বাংলা, না পারি ভালো ইংরেজি, না পারি ভালো আরবি। অথচ এদেশে সুলতানি শাসনামলে সুলতানদের ঘরের ভাষা ছিলো তুর্কি, ধর্মীয় ভাষা ছিলো আরবি আর রাজ-দরবারের ভাষা ছিলো ফারসি।




কাশ্মিরের মুনাফিক শেখ আবদুল্লাহ মতিলাল নেহরুর অবৈধ সন্তান
কাশ্মিরের মুনাফিক শেখ আবদুল্লাহ মতিলাল নেহরুর অবৈধ সন্তান

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীভারতে বিজেপি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দিয়েছে। বিজেপির প্রতিটি নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে ৩৭০ ধারা বাতিলের কথা সন্নিবেশিত থাকতো। প্রথমবার বিজেপি সরকার গঠন করেছিল অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে। দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে।

সংবিধান প্রণয়নের সময়ও হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ৩৭০ ধারার বিরোধিতা করেছিল। তখন ৩৭০ ধারায় কাশ্মিরে কোনও ভারতীয় প্রবেশ করতে হলে পারমিট ভিসার প্রয়োজন হবে বলেও উল্লেখ ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে লোকসভার সদস্য মাওলানা হাসরাত মোহানীর সংশোধনী প্রস্তাবের কারণে পারমিট প্রথা বাতিল হয়েছিল।


সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কাশ্মিরে তার সমর্থক কিছু লোক নিয়ে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তির দাবিতে পদযাত্রা করেছিল। ঝিলাম অতিক্রম করার পর যখন শ্যামাপ্রসাদ কাশ্মিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তখন শেখ আবদুল্লাহ’র সরকার তাকে গ্রেফতার করেছিল। একটা ডাকবাংলোতে তাকে অন্তরীণ করে রেখেছিল। অন্তরীণ অবস্থায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু হয়।

৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে থেকে বিজেপি তাদের পিতামহ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির আত্মত্যাগ সম্পর্কে কখনও বিস্মৃত হয়নি। বিজেপি মনে করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে শেখ আবদুল্লাহ সরকার হত্যা করেছিল। সুতরাং বিজেপি তাদের পিতামহের এ দাবি পূরণের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। সোমবার ৫ আগস্ট ২০১৯ তারা তাই করেছে।

জম্মু, কাশ্মির, লাদাখ—এতদিন এই তিন অঞ্চল নিয়ে ছিল কাশ্মির রাজ্য। লাদাখ বৌদ্ধ অধ্যুষিত। কাশ্মির ছিল শতাংশে মুসলমান অঞ্চল। আর জম্মুতে হিন্দু, মুসলমান, শিখসহ মিশ্র জনসংখ্যা অঞ্চল, তবে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলটা ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনের এলাকাভুক্ত ছিল। কিন্তু ১৮৪৬ সালে ইংরেজরা পঁচাত্তর লাখ রুপির বিনিময়ে গুলাব সিংয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়। সে থেকে ডোগড়া রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত বিভক্তির সময় হরি সিং ছিল ডোগড়াদের শেষ রাজা।


ভারত বিভক্তির সময় কাশ্মিরে শেখ আবদুল্লাহর কাশ্মির ন্যাশনাল কনফারেন্স ছিল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। শেখ আবদুল্লাহ ন্যাশনাল কনফারেন্সের বর্তমান সভাপতি ফারুক আবদুল্লাহর পিতা। তখন কংগ্রেস, মুসলিম লীগের তেমন উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব কাশ্মিরে ছিল না। শেখ আবদুল্লাহ নিজেকে কাশ্মিরের জিন্নাহ মনে করত। শেখ আবদুল্লাহ পরিবারের সঙ্গে নেহরু পরিবারের সম্পর্ক ছিল কয়েক পুরুষ ধরে। মোরারজি দেশাই তো তার ‘মোরারজিস পেপার’ নামক গ্রন্থে শেখ আবদুল্লাহকে মতিলাল নেহরুর অবৈধ সন্তান বলে উল্লেখ করেছে।

মহারাজ হরি সিং সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগত। আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন হয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত সে কি পাকিস্তানের যোগ দেবে না ভারতে যাবে সে সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। অ্যালান ক্যাম্পবেল জনসন ছিল বড়লাটের সেরেস্তার উচ্চপদস্থ কর্মচারী। সে প্রত্যক্ষভাবে ভারত বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিল। অ্যালান ক্যাম্পবেল তার লিখিত গ্রন্থ ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’-এ হরি সিং এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম সম্পর্কে লিখেছে, ‘যেমন কাশ্মিরের মহারাজ তেমনি হায়দ্রাবাদের নিজাম, বৃহৎ কোনও সংকটপূর্ণ অবস্থাকে প্রতিরোধ করার পন্থা জানে না। জানে শুধু দায়িত্ব এড়িয়ে কালক্ষেপণ করা। তাদের রাজনৈতিক বুদ্ধির ভান্ডারে এই দীর্ঘসূত্রতার কৌশলশাস্ত্র ছাড়া আর কোনও অস্ত্র ছিল না।’

কিন্তু তখন তো সেই কৌশল অবলম্বনের সময় ছিল না। কারণ পাঠান আর আফগান উপজাতির হাজার হাজার লোক কাশ্মিরের প্রবেশ করা শুরু করেছিল এবং তারা এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল যে ২৮ অক্টোবর তারা রাজধানী শ্রীনগরে ৩৫ মাইলের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ডোগড়া ব্যাটালিয়ন তাদের প্রতিরোধ করতে পারছিল না।

কাশ্মির সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেন এবং উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের কোনও অস্পষ্টতা ছিল না। তারা মনে করত এটা যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল সুতরাং তারা পাকিস্তানে যোগদান করবে। সর্দার প্যাটেল লিয়াকত আলী খানকে বলেছিল 'নিজাম পাকিস্তানে যোগ দিতে চাচ্ছে আর হরি সিং চাচ্ছে ভারতে যোগদান করতে। সুতরাং এতে আমাদের হাতে উভয় রাজ্য একচেঞ্জ করার সুযোগ থাকবে এবং আমরা তাই করব'।

কিন্তু নেহরু কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ। তার অভিলাষ ছিল কাশ্মির ভারতের সঙ্গে থাকুক। এরই মাঝে হরি সিং ভারতের কাছে সৈন্য ও সমরাস্ত্র সাহায্য চাইল। নেহরু সৈন্য পাঠাতে উতলা হয়ে উঠল, কিন্তু গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন বলল 'হরি সিং আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে যোগদান না করলে ভারতের সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি তিনি অনুমোদন দিতে পারবে না'।

হরি সিং ভারতে যোগদানের কথা ঘোষণা দেওয়ার পর গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সৈন্য পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছিলে এই শর্তে, কাশ্মিরে শান্তি ফিরে এলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে এবং রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। জাতিসংঘ বিরোধ মেটানোর জন্য গণভোটের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল।

ভারতের অনেক নেতা সেদিন গভর্নর জেনারেলের গণভোটের প্রস্তাব গ্রহণ করতে চায়নি। তখন ক্যাম্বেল তার বইতে লিখেছে মাউন্টব্যাটেন নাকি নেহরুকে বলেছিল, ‘ভণ্ডামি করে রাষ্ট্র গঠন করা যায় না।’ কাশ্মির নিয়ে নেহরুর ভণ্ডামির ইতি টেনে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার পর্দা তুলল। শেষ পর্যন্ত মাউন্টব্যাটেনের কথাই সত্য প্রমাণিত হবে—‘ভণ্ডামি করে রাষ্ট্র গঠন করা যায় না’।