ইসলাম-পূর্ব আরব উপদ্বীপে নিরক্ষরতার বিস্তার সত্ত্বেও আরবদের লিপি-শিল্পের ‘ধারণা’র বিষয়ে ঐতিহাসিক বহু প্রমাণ মেলে। ইবনুন নাদীম (মৃ. ৩৮০ হি.) তার ‘আল ফিহরিসতে’ আলোকপাত করেন যে, আরবরা তৎকালে হাবাশি লিপি-শৈলীতে অভ্যস্ত ছিল। এ ছাড়াও দক্ষিণ উপদ্বীপাঞ্চলীয় গোত্র সাবা এবং হিময়ারের লিপি-ধারাতেও তাদের কেউ কেউ পারঙ্গম ছিল বলে জানা যায়।
কাগজপত্তর-যাত্রা
প্রাক-ইসলাম যুগ থেকে পরবর্তী কালে বহুদিন লিপিকলার প্রধানতম উপাদান ছিলো কাষ্ঠ-ফলক, খেজুর বৃক্ষ, হাড়, শুকনো চামড়া প্রভৃতি। প্রথম দিকে ওহীও এভাবেই লেখা হতো। মাক্কী আস সিবাঈ’র ভাষায়, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিহাসের সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি জাজিরাতুল আরবে সিল-মোহর পদ্ধতি চালু করেন। এরপর নথিপত্র আদান-প্রদানে এর বহুল ব্যবহার শুরু হয়।কিছুকাল এভাবেই চলে।
একটা সময়ে আরবরা চিনাদের থেকে কাগজ ব্যবহার এবং এর রকমফের সৃষ্টি-শিল্পের প্রশিক্ষণ নেয়। ফলে তাদের শিক্ষা ও লেখনীতে বিশাল বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। বিস্তর পরিসরে ইসলামী বিশ্বে লিপি-শিল্পের ক্রমবিকাশ ঘটে। ‘সিনাআতুল ওয়ারাক’ বাগদাদেও পৌছে যায়। আব্বাসী মন্ত্রী জাফর বিন ইয়াহয়া বুরমাকী রাষ্ট্রীয় সকল লেনদেনে ‘রুকুক’ তথা চামড়ার মুদ্রার পরিবর্তে কাগুজে মুদ্রা প্রতিকল্পন করার আদেশ দেন। কাগজের প্রসার ও শিল্প-বিকাশের সঙ্গে রুকুক এবং প্যাপিরাসের তুলনায় এর মূল্যও সহনীয় মাত্রায় নেমে আসে।বড় বড় শহরগুলোতে কাগজ-শিল্প ছড়িয়ে পড়ে।কিতাবাদীর বাজার রমরমা হয়ে ওঠে।
বলা চলে, দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ থেকেই কাগুজে সাংস্কৃতিক বানিজ্য একটি জনপ্রিয় রূপ ধারণ করে।
কাগজের লিখিয়েদের নাম দেওয়া হয় ‘ওয়াররাক’ বহু বচন হলে ‘ওয়াররাকিন’। দারুল খিলাফাতে তাদের স্বতন্ত্র স্থান এবং ব্যবসায়-নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে তারা অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন।
বাগদাদে এক মুহূর্তের জন্য হলেও আগমন করেছেনে এমন সব বরেণ্য ব্যাক্তিদের নিয়ে লেখা প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারিখু বাগদাদ'; যার গ্রন্থপ্রণেতা হলেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস খতীব আবু বকর আল বাগদাদী (মৃ. ৪৬৩ হি.)। বহু জায়গায় তিনি ঐতিহাসিক সূত্র-পরম্পরা প্রমাণে শুধু এসব ব্যবসায়ী ওয়াররাকদের বর্ণনাকেই ভিত্তিমূল ঠাওর করেছেন। ইতিহাসজ্ঞ মোহাম্মাদ শা'বান আয়্যুব ৮৫০টি জায়গা চিহ্নিত করেছেন। তবে আরো বহু স্থান রয়ে গেছে শা'বান আয়্যুবের গণনার বাইরে।
স্বয়ং ইবনুন নাদীম (মৃ. ৩৮০হি.) ছিলেন চতুর্থ শতকের একজন বিশিষ্ট ওয়াররাক। যিনি প্রাচীন আরবীয় বায়োগ্রাফিক গ্রন্থ ‘আল ফিহরিস’ প্রণেতা। লাইব্রেরি সংরক্ষণ, পরিশীলন, নুসখা প্রতিলিপি করণ এবং সবশেষ-পেশাদারিত্বের তাগিদে গ্রন্থ ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্য দিয়েই তিনি লিখে ফেলেছেন এই বিখ্যাত কিতাব; যা আজও মুসলিম মনিষীদের কাছে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ বলা চলে একে। ইবনুন নাদীম তার কাল পর্যন্ত অস্তিত্বে আসা কত বর্ণ-মতাদর্শ, সভ্যতা ও গ্রন্থমালার হিসাব এখানে কষেছেন, পাঠক কিতাবটির পাতা উল্টালেই তা বুঝতে সক্ষম হবেন।
শরিয়াহ, আইন, ব্যাকরণ, ভাষা, ইতিহাস, আখবার, অনুপাত, ফিকহ, হাদিস, দর্শন, প্রকৃতি ও রসায়ন-বিজ্ঞানসহ সহস্র বিষয় টেনে এনেছেন এখানে। এমনকি কল্প কাহিনী, মনস্তত্ত্ব ও জাদু-টোনা বিষয়ে লিখিত কিতাবাদী নিয়েও আলাপ করেছেন দীর্ঘ। শাখাগত মাসালায় অনুসরণীয় ‘মাযাহেব ও ইতিকাদাত’ বিষয়ে তো লিখেছেন-ই।
গণ-গ্রন্থাগার
ইসলামী সভ্যতায় মাকতাবার (লাইব্রেরী) গুরুত্ব অপরিসীম। পাঠ-পঠনে সবকালেই আলোকবর্তিকার ভূমিকা রেখেছ এসব মাকতাবা। আমির-উমারা ছাড়াও সমাজে ধর্মীয়-মূল্যবোধ লালন করেন—এমন বহু বিত্তশালী মানুষ মাকতাবা প্রতিষ্ঠা এবং সচল রাখার পেছনে অসামান্য ভূমিকা রেখে এসেছেন সব যুগে।
বিশেষত যখন আমাদের আজকের প্রযুক্তি তাদের হাতে ছিল না। ছাপার হরফে কোন কিতাব দেখার সুযোগ তাদের হতো না কখনো; বহু টাকার বিনিময়ে ওয়াররাকদের থেকে নুসখার প্রতিলিপি করিয়ে নিতে হতো,সর্বসাধারণের জন্য যা কষ্টসাধ্য ছিলো অবশ্যই। সে সময়ে জ্ঞান-চর্চার মাধ্যম হিসেবে একটা গণ-গ্রন্থাগারের কী ভূমিকা হতে পারে,তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ক্ষুদে ক্ষুদে চিন্তা থেকেই কিন্তু বৃহৎ পরিসরের পাবলিক লাইব্রেরিগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
মাকতাবার বহু রূপ, শৈলী ও ধরনের সঙ্গে ইসলামী সভ্যতা পরিচিত সেই আদিকাল থেকেই। ইসলামী দেশগুলোর বলতে গেলে প্রায় সব শহরেই এই মাকতাবার ইতিহাস পাওয়া যায়। সেটা চাই ক্ষুদ্র হোক কিংবা বড়...।
একাডেমিক গ্রন্থাগার
এটা ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত গ্রন্থাগারের ধারা। এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হলো-বাগদাদের ‘বাইতুল হিকমাহ’। ফাতেমীদের সময় ছিল কায়রোতে 'দারুল হিকমাহ'। এর পরে আসে ‘বিশেষ’ গ্রন্থাগারের আলাপ। এই প্রকার গ্রন্থাগারের বিস্তর প্রসার ঘটেছিলো গোটা বিশ্বে। উল্লেখযোগ্য হলো খলিফা মুসতানসিরের মাকতাবা। ফাতাহ বিন খাকানের মাকতাবা। যাহাবী তারিখুল ইসলামে তার সম্পর্কে লেখেন, ‘বিন খাকাব হাটতেন, আস্তিনে কিতাব থাকতো, ইচ্ছে হলে চোখ বুলাতেন।’ বলা চলে অনেকটা স্বতন্ত্র ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার।
ছিল আলে বাওয়াইহের প্রসিদ্ধ মন্ত্রী ইবনুল আমিদের মাকতাবা। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ‘ইবনু মাসকুয়াহ’ উল্লেখ করেন, তিনি ইবনুল আমীদের গ্রন্থাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। একদিন তার বাড়িতে বড় ধরনের চুরি হয়। বহু সরঞ্জাম নিয়ে যায় ‘চোর’। ইবনুল আমিদের কাছে সব চেয়ে মূল্যবান এবং প্রিয় বস্তু ছিল তার কিতাবগুলো। সব ধরনেরর কিতাবাদি ছিল তার এ সুবিশাল গ্রন্থাগারে; পরিমাপ করলে যা একশ' উটের হাওদাজের সমান হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সকালে উঠে তিনি আমাকে সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল তার কিতাবগুলোর কথাই জিজ্ঞেস করলেন। আমি দেখছিলাম, ইতিমধ্যে তার চেহারা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল।
বললাম, সেগুলো নিরাপদ আছে, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন! ইবনুল আমিদ তখন বললেন, আমার কাছে পৃথীবির তাবৎ ধনভাণ্ডারের বিকল্প আছে, কিন্তু আমার এইসব বিরল কিতাবগুলোর কোনো বিকল্প নেই।
কর্ডোভার ঐতিহাসিক গন-গ্রন্থাগারও এই ধারাই ছিলো। উমাইয়্যা খলিফা মুসতানসির বিল্লাহ ৩৫০ হিজরিতে প্রতিষ্ঠা করেন এ গ্রন্থাগার। সরকারি কোষাগার থেকে শতাধিক ‘মুয়ায্যিফ’ নির্ধারণ করা হয় গ্রন্থাগার সংরক্ষণের স্বার্থে। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত বহু নুসখা প্রতিলিপিকার, ঝানু লিখিয়ে ও প্রসিদ্ধ ওয়াররাকদেরর মিলনমেলা ঘটে এখানে।
আন্দালুসের সহস্র বিদ্যান-পণ্ডিতের জ্ঞানের খোরাকে পরিণত হয় কর্ডোভার এ বিদ্যানিকেতন। জানা যায়, ইউরো সভ্যতার বহু আদীম নথিপত্রও গচ্ছিত ছিলো এখানে, ফলে তাদের কাছেও যথেষ্ট গুরুত্বের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় মুসতানসির প্রতিষ্ঠিত এই মাকতাবা।
ইবনুল আবার ‘তাকমিলা লি কিতাবিস সিলাহ' গ্রন্থে লেখেন, ‘সে সময় গ্রন্থাগারের কিতাবের 'তালিকা' সম্বলিত সূচিপত্রের সংখ্যা ৪৪ খণ্ড ছিলো।’
বর্তমান লিবিয়ার লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলী,তখন তারাবুলুস নামে পরিচিত ছিলো ইলমি মহলে। বনু আম্মার প্রতিষ্ঠিত সুবিশাল গ্রন্থাগার আজও সেখানে বহাল তবিয়তে আছে। রাষ্ট্র কতৃক নিয়োজিত একটি দল এমন ছিল, যারা রাষ্ট্রীয় ভাতা নিয়ে সমগ্র-ইসলামী বিশ্ব চষে বেড়াত বিরলতর কিতাবাদির অনুসন্ধানে।
৮৫ জন লিপিকার ছিলেন, যারা রাত দিন নুসখা প্রতিলিপির কাজ করে যেতেন শুধু।
এভাবেই খলিফা থেকে শুরু করে বিত্তশালী সমাজপতিসহ সাধারণ ধনী ব্যবসায়ী মুসলিমদের অনেকে এসকল গন-গ্রন্থাগারের সূচনা করেন। ইতিহাসে পাওয়া যায, নুরুদ্দিন মুহাম্মাদ যানকী দামেশকে একটি মাদ্রাসা কায়েম করেন,সঙ্গে বড় রকমের একটি গ্রন্থাগারও জুড়ে দেন।সালাউদ্দিন আইয়ুবি রহমতুল্লাহি আলাইহি তার পথেই হাটেন। উনার প্রধান বিচার প্রতি-যিনি আল কাদী,আল ফাদিল' নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন- কায়রোতে মাদ্রাসা কায়েম করেন এবং ফাতেমিদের ভাণ্ডার থেকে প্রাপ্ত প্রায় দুই লক্ষ কিতাবের বিশাল এক গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন মাদ্রাসার পাশেই।
ইতিহাসে ‘আল ফাদিলিয়্যা’ নামে পরিচিতি পায় সে মাদ্রাসা এবং তৎ-সংলগ্ন গ্রন্থাগার।
পাতা উল্টালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এরূপ বহু চর্চা-কেন্দ্রের খোঁজ মিলবে, আজ আর সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। মাত্র একটি ঐতিহাসিক ধারার প্রসঙ্গ টেনেই ক্ষান্ত হবো।
প্রাচীন মসজিদের সঙ্গে গড়ে ওঠা গ্রন্থাগার
জামে আজহার মসজিদের (যে মসজিদ থেকে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়) গ্রন্থাগার এর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকার কাইরাওয়ান অঞ্চলের জামে কাবির মসিজদের গ্রন্থাগারও ইতিহাসের বড় একটি অংশ জুড়ে রেখেছে। আর মসজিদে নববী তো হাজার বছরের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে। আগন্তুক জ্ঞান-অন্বেষীর জন্য এক মহা জ্ঞান-ভাণ্ডার নববী মসজিদের এই গ্রন্থাগার।
দামেশকে জামে উমাওয়ির সঙ্গে লাগোয়া খিযানাতুল কুতুব তো এখন ইসলামি দুনিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ প্রকাশনা বিভাগ।অথচ এর সূচনা যে আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগে হয়েছিলো একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে, তা কজন জানে!
আন্দালুসে মসজিদ-কেন্দ্রিক গণ-গ্রন্থাগারগুলো প্রাচ্যের তুলনায় অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কর্ডোভার গ্রান্ড মসজিদকে সবচেয়ে বড় মসজিদ মনে করা হয়। ১৭০ হিজরীতে উমাইয়্যা খলিফা আব্দুর রহমান আদ-দাখিল এ মসজিদ প্রান্তরে মুসহাফ এবং কুতুবে ইসলামিয়্যার বিশাল এক ভাণ্ডার জমা করেন। কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য, দ্বিতীয় সম্রাট 'ফার্ডিনান্ড' ৬৩৪ হিজরিতে কর্ডোভা দখলের সময় সবগুলো কিতাব জ্বালিয়ে দেয়। বিখ্যাত আন্দালুসি ইতিহাসবেত্তা আল-মাক্কারি তার গ্রন্থ ‘নাফহুত ত্বীব ফি তারিখী আন্দালুস আর রাত্বীব’-এ লেখেন, ‘এসব গ্রন্থমালার মধ্যে উসমান ইবনে আফফান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর স্ব-হস্তে লিখিত মুসহাফটিও ছিল, যা পুড়িয়ে ফেলা হয়।’
এ ছিল সুখ-দুঃখ মিশ্রিত ঐতিহ্যময় ইসলামী সভ্যতার সামান্য বর্ণনা। শেখার ব্যাপার হলো— সমাজপতি, ধনকুবের, বিত্তশালী সে সময়েও ছিল, আজও আছে।
কিন্তু আমাদের চেতনার অবক্ষয় ঘটেছে পূর্বের তূলনায় কঠিন ভয়াবহ মাত্রায়। মসজিদ-মাদ্রাসা এবং লিল্লাহ বোর্ডিং ছাড়াও যে ‘ওয়াকফের’ বহু জায়গা রয়ে গেছে শরিয়তে এবং আমাদের সালাফের শিক্ষায়, তা আমরা সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে সক্ষম হই নি।
মূলত সভ্যতা যে চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং অধুনা দুনিয়ায় বুদ্ধিবৃত্তিকার অনুসঙ্গে চিন্তা-বিকাশের প্রশ্নে যে সভ্যতা-চর্চা নানামাত্রিক কল্পনাবল এবং বিনির্মাণীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম—সে আলাপই বা আমরা কজন উঠাই।