রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন ছিলো ভাষা আন্দোলন, মুখের ভাষা কেড়ে নেবার নয়

রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন ছিলো ভাষা আন্দোলন, মুখের ভাষা কেড়ে নেবার নয়
ভাষা আন্দোলনের পর কিছু ন্যারেটিভ তৈরি হয়। যার বেশিরভাগই ছিলো বানোয়াট এবং মিথ্যে ন্যারেটিভ। তারমধ্যে একটি হলো ‘মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া’। শিল্পী আবদুল লতিফের গানের মধ্যে এরকম লাইন খুঁজে পাইঃ
“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়।”

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেন ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতা। যেই কবিতার মধ্যে পাইঃ
“মাগো ওরা বলে
সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।”

অথচ ভাষা আন্দোলন আদতে মুখের ভাষা কেড়ে নেবার বিপক্ষে আন্দোলন ছিলোনা, বরং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন ছিলো। যখন ভাষা আন্দোলন হয় ততদিনে এই অঞ্চলের প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। তাহলে কেন ভাষা আন্দোলনকে ‘মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন’ নামে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে?

এইসব স্লোগানের মধ্যে মিথ্যে আবেগ থাকলেও সত্যের ছিটেফোঁটা নেই। ভারতে হিন্দি ভাষা 'অফিশিয়াল' ভাষা হবার ফলে কি আসাম সহ ভারতের বাংলাভাষীদের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে? কিংবা তামিল, তেলেগু এসব ভাষা কি হারিয়ে গেছে?


আবার, এই অঞ্চলের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবার ফলে কি এই অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে?

আবহমান কাল থেকে এদেশের রাষ্ট্রভাষা ছিলো পালি, সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি। অন্য ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হবার দরুন কখনো তো বাংলা ভাষা হারিয়ে যায়নি। উর্দু ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবার দরুন মুখের ভাষা কেড়ে নেবার কথা যারা বলেন, সেটা প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুনা।

আরেকটা মজার বিষয় হলো, ভাষা আন্দোলন যেখানে ছিলো মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন (মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন নয়) সেখানে ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ‘আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবস’ না হয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে!


ভাষা আন্দোলনের ফলে আমরা কী পেয়েছি? আর এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যই বা কতটুকু সফল হয়েছে?

এতো বছর পর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে এখনো দেখতে পাই, বাংলা আজও এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার ভাষা হতে পারেনি। বিজ্ঞান, গবেষণার কাজগুলোর লেখার ভাষা আজও বাংলা হয়ে ওঠেনি। উচ্চতর প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- বিচার বিভাগ, ব্যাংক, বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের কাজে বাংলা ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলা কেবল কবিতা, উপন্যাস আর নাটক-সিনেমার ভাষা হয়ে আছে!


এমনকি যারা ভাষা আন্দোলনকে প্রমোট করেছিলেন তাদের ঘরের ভাষা পর্যন্ত এখন আর বাংলা নেই! আবদুর রহিম নামের একজন লেখক একবার ইংল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে তার বন্ধু আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাইলেন, যিনি ছিলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির রচয়িতা। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বাসায় টেলিফোন করলে এক মেয়ে ফোন ধরে বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় কথা বলা শুরু করলে তিনি একটু অবাক হয়ে ভাবলেন, ভুল জায়গায় ফোন করলাম কি-না। কিছুক্ষণ পর নিশ্চিত হলেন, ইংরেজি বলা মেয়েটি আবদুল গাফফার চৌধুরীর মেয়ে। পরে জানতে পারলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ছেলেমেয়েরা বাসায় নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলে!

বাংলা ৮ ই ফাল্গুন ভাষা আন্দোলন হলেও ভাষা আন্দোলনের গান-কবিতায় যে তারিখটি জড়িয়ে আছে সেটিও বাংলা তারিখ নয়, ইংরেজি ২১ শে ফেব্রুয়ারি।

ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু, এই আন্দোলন আমাদেরকে বানিয়েছে ‘ভাষিক মৌলবাদ’। যার ফলে উর্দু-ফারসি ভাষার প্রতি আমাদের তৈরি হয়েছে বিদ্বেষ। বাঙালী জাতীয়তাবাদ যারা লালন করে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই এই দুটি ভাষাকে ঘৃণা করে।

পৃথিবীর সর্বত্র বহুভাষিতা যেখানে সাধারণ ঘটনা সেখানে আমরা সেই বিরল জাতিগুলোর একটি যারা একভাষী। আমরা না পারি ভালো বাংলা, না পারি ভালো ইংরেজি, না পারি ভালো আরবি। অথচ এদেশে সুলতানি শাসনামলে সুলতানদের ঘরের ভাষা ছিলো তুর্কি, ধর্মীয় ভাষা ছিলো আরবি আর রাজ-দরবারের ভাষা ছিলো ফারসি।