পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী রয়েছে অনেক অবদান
Image result for পার্বত্যচট্টগ্রাম সেনাপার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী রয়েছে অনেক অবদান
সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অপরিহার্য প্রয়োজনে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিংকে পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী গিয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে সরকারী নির্দেশে। সাপ, মশা, জোক হিংস্র বন্যপ্রাণী, দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রতিকুল পরিবেশ, বৈরী ভূপ্রকৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে মোকাবেলা করে এবং পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হুমকি ও অপতৎপরতার মুখে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অটুট রেখেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকের অনেকে এ কথা বহুবার বলেছেন যে, সেনাবাহিনী না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বহু আগেই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো। এ কাজে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ৩৫১ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩৮৪ জন এবং অন্যভাবে ২২৭ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।


তারপরও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরে আসেনি। এখনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাষ্ট্রীয় নির্দেশ পালনে নিয়োজিত। শুধু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায়ই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী অপারেশন উত্তোরণের আওতায় অসংখ্য উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজের সাথে জড়িত। এরমধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফ্রি বিষেশায়িত ও সাধারণ চিকিৎসাসেবা, ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৭টি বিনামূল্যে চক্ষুশিবির পরিচালনা করে। এতে ৩৫২৫ জন লোক সেবা গ্রহণ করে- যার মধ্যে ২১১৮ জন পাহাড়ী ও ১৪০৭ জন বাঙালি। একই বছরে ৮২৮টি বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে। এতে ১২৯১৪৯ জন সেবা গ্রহণ করে। এর মধ্যে পাহাড়ী ৫৪৫৯৬ জন এবং বাঙালি ৭৪৭০৩ জন রয়েছে।

২০১৫ সালে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৫৯৮০ জনের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, ৮৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ বা সংস্কার, ২৬টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ২৭৭৩৩ জনকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, ৩৯০৮ জনকে আর্থিক অনুদান, ১২২টি ধর্মীয় উপাসনালয়কে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা, ৪৮টি ব্রিজ ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ ও সংস্কার, ১৪০টি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা, ৩৬১টি উন্মুক্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শনসহ ৯২টি অন্যান্য সহায়তা করে। প্রত্যেক বছরই এই সেবা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।


পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ব্যাপক অবদান রয়েছে। এরমধ্যে বিদ্যালয় নির্মাণ, সংস্কার, পরিচালনা, শিক্ষকদের বেতন প্রদান, বই, খাতা, কম্পিউটার, পোশাকসহ বিভিন্ন শিক্ষা সামগ্রী প্রদান, ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, সহশিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা ইত্যাদি রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের বেকার তরুণদের উন্নয়নে নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, কম্পিউটারসহ আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করে থাকে। মহিলাদের জন্য নানা ধরনের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ পরিচালনা, কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণ করে।

বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সংস্কারের পাশাপাশি ফ্যান, লাইট, চার্জার, মাইক বিতরণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সারা বছর বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ করে থাকে। একইভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক সামগ্রী বিতরণ করে থাকে।

গভীর নলকূপ স্থাপনসহ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ফিল্টার প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম, দরিদ্র জনগণের বসতঘর নির্মাণ, হাঁস-মুরগী-ছাগলের খামার ও কুটির শিল্প স্থাপনে সহায়তা, যাত্রী ছাউনি নির্মাণ, সৌর প্যানেল প্রদান, সাংবাদিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, কৃষি সরঞ্জাম, সার, বীজ, কীটনাশক বিতরণ করে থাকে। পাহাড়ী-বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ধরনের কর্মকা- পরিচালনা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোনো উদ্ধার ও সংস্কার তৎপরতায় সেনাবাহিনী সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে সেনাবাহিনীর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। দুর্গম পাহাড়ে সড়ক নির্মাণ, সংস্কার এ কাজে জড়িতদের নিরাপত্তা প্রদান, পর্যবেক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা অবিচ্ছিন্ন রাখতে নিরাপত্তা প্রদানের কাজ করে থাকে। ৩ পার্বত্য জেলার ১৫৩৫ কিমি রোড নেটওয়ার্কের অর্ধেকই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্মাণ করেছে।

আলীকদম-থানচি সড়ক, সাজেক, নীলগিরি সড়কের মতো উঁচু সড়ক নির্মাণ করে দেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাতের উন্নয়নে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাধ দমন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, মাদক উৎপাদন ও পাচার, জঙ্গি তৎপরতা দমন, অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্য, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস দমনে অসামান্য ভূমিকা পালন করছে।

যুক্তির খাতিরে ধরা যাক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এর পরিণতি ও প্রভাব কী পড়তে পারে তা ভেবে দেখা জরুরি।

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শর্তানুযায়ী এ পর্যন্ত একটি ব্রিগেডসহ ২৩৮টি বিভিন্ন ধরনের সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেসব এলাকা পুনরায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। বিজিবি বা পুলিশ থাকার পরও সন্ত্রাসীরা ঐ সকল অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়েছে। পার্বত্য বাঙালি গণমঞ্চের নেতা শওকত আকবরের মতে, তাদের অঞ্চল থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার পরই বাঙালিদের উচ্ছেদ করে তাদের বিপুল পরিমাণ বৈধ জমি পাহাড়ীরা দখল করে নিয়ে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছে। সন্ত্রাসীদের অবস্থানের ৫শ গজের মধ্যেই পুলিশ রয়েছে।

কিন্তু সন্ত্রাসীরা পুলিশকে থোড়াই কেয়ার করছে, আর পুলিশও সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ করছে না। এরকম ঘটনা তিন পার্বত্য জেলার সর্বত্রই।
শান্তিচুক্তিমতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাক্যাম্প সরাতে পারেনা
Image result for পার্বত্যচট্টগ্রাম সেনাশান্তিচুক্তিমতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাক্যাম্প সরাতে পারেনা
কয়েক বছর আগে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এবং মিয়ানমারের সাথে সৃষ্ট উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে রাঙামাটির কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড সরিয়ে নেয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন চারটি ব্রিগেডই রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নতুন কোনো সেনা ব্রিগেড প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। একটি ব্রিগেড গঠিত হয় কয়েকটি ব্যাটালিয়নের সমষ্টিতে। এর অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি ব্রিগেড ও তার অধিনস্ত ব্যাটালিয়নগুলো এবং তার অন্তর্গত সেনাসদস্যরা থাকছে। তাহলে বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার ও পাহাড়ীদের উল্লসিত হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস রাখার কথা বলা হয়। শান্তিচুক্তির ঘ খ-ের ১৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, “সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে।

আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন”।

এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে, শান্তিচুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ৪টি ব্রিগেড বাদে ‘বাকিগুলো সব সরিয়ে নেয়ার’ ঘোষণা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কি শান্তিচুক্তি সংশোধনের কথা বলল? এটাও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ একটি ভুল বোঝাবুঝি। কেননা শান্তিচুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই সেনানিবাসগুলোর ফর্মেশনের কথা শান্তিচুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা নেই।

এই ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস কিরূপে সেখানে অবস্থান করবে- ডিভিশন আকারে, ব্রিগেড আকারে না ব্যাটালিয়ন আকারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। এই অপশনটি রাষ্ট্রের হাতে রয়ে গেছে। রাষ্ট্র প্রয়োজন মতো তা ব্যবহার করতে পারবে। ৪টি ব্রিগেড ও শান্তিচুক্তি সমন্বয় করলে আমরা দেখতে পাবো, তিন পার্বত্য জেলা সদরে তিনটি ব্রিগেড রয়েছে। এর বাইরে গুইমারা ব্রিগেড দিঘীনালায় সরে গেলে রুমা ও আলীকদমে দুইটি ব্যাটালিয়ন থাকতে পারে।

তবে শান্তিচুক্তির মধ্যেই সমাধান খুঁজলে এ চুক্তির ঘ খ-ের ১৭(ক) ধারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এই ধারায় যেমন স্থায়ী সেনানিবাসের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। তেমনি অস্থায়ী সেনানিবাসের সংজ্ঞাও দেয়া নেই। অর্থাৎ অস্থায়ী সেনানিবাস বলতে ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন/জোন, সাবজোন, কোম্পানী স্থাপনা নাকি সেনা আউট পোস্ট বোঝানো হবে তার কিছুই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই ব্যাখ্যাটাও রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ৪টি ব্রিগেডের মধ্যে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান ব্রিগেডে ৫ ব্যাটালিয়ন করে সৈন্য রয়েছে, গুইমারায় রয়েছে ৩ ব্যাটালিয়ন। সব মিলিয়ে ১৮ ব্যাটালিয়ন সৈন্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। একটি ব্যাটালিয়নে গড়ে ৭০০ করে সৈন্য ধরলে ১৮টি ব্যাটালিয়নে ১২-১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফর্মেশন অনুযায়ী ৩-৫টি ব্যাটিলিয়ন নিয়ে একটি ব্রিগেড গঠিত হয়। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪টি ব্রিগেড থাকলে সেখানে ১২-২০ ব্যাটালিয়ন সৈন্য থাকতেই হবে। ব্যাটালিয়নগুলো আবার গড়ে ওঠে কতকগুলো সাবজোনের সমষ্টিতে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই জোন, সাবজোনগুলো কোথায়, কিভাবে অবস্থান করবে?
শান্তিচুক্তির ঘ খ-ের ১৭(ক) ধারায় আরো বলা হয়েছে, “আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে”। উল্লিখিত বাক্যটি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে বা জাতীয় অন্যান্য দরকারে রাষ্ট্র প্রয়োজনানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে প্রয়োজন যে কোনো ফর্মেশনে সেনাবাহিনী রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে চারটি ব্রিগেড বা ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস বিবেচ্য নয়- রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বিবেচ্য।
একই ধারায় আরো গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার শর্ত বাস্তবায়িত হতে হবে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে’..। অর্থাৎ চুক্তিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি শর্তহীন নয়। বরং এর সাথে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার’ শর্ত যুক্ত রয়েছে।
এ নিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই যে, জেএসএসের সকল সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। জেএসএস ও তার সকল সদস্যকে অস্ত্র সমর্পণ করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেনি।
চুক্তি অনুয়ায়ী ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জেএসএসের অস্ত্র সমর্পণের সময় চুক্তির বিরোধিতা করে অস্ত্র সমর্পণ না করে তাদেরই একটি অংশ জেএসএস থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউপিডিএফ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে। এরপর স্বার্থগত দ্বন্দ্বে জেএসএসও ভেঙে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে নতুন আরো একটি সংগঠন তৈরি হয়। এদিকে জেএসএসের মূলের সামরিক শাখাও সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি।
এই তিন পাহাড়ী সংগঠন প্রকাশ্য ও গুপ্ত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গুপ্ত বা গোপন শাখা আসলে তাদের সাস্ত্রে সামরিক শাখা। যদিও প্রকাশ্যে তারা কখনই এই সামরিক শাখার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে না।
তবে এই তিন সংগঠনের সামরিক শাখার দৌরাত্ম্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থার ওপর কিঞ্চিত আলোকপাত উপরে করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমানে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চাঁদা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ নাগরিক তো দূরে থাক, সরকারী কর্মকর্তাদেরও বসবাস অসম্ভব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি পাহাড়ী সংগঠনের নির্ধারিত চাঁদা দিতে না পারলে সেখানে বসবাস যে কারো জন্যই অসম্ভব।
সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়, পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখ-তা, বাঙালি ও সরকার বিরোধী নানা তৎপরতায় লিপ্ত। এরূপ পরিস্থিতিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী বাধ্যতামূলক নয়।
১৩ হাজার সন্ত্রাসীর হাতে মায়ানমার ও ভারতের ৩ হাজার মারণাস্ত্র
Related image১৩ হাজার সন্ত্রাসীর হাতে মায়ানমার ও ভারতের ৩ হাজার মারণাস্ত্র
পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপের রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। এর মধ্যে আর্মড ক্যাডারের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। তাদের হাতে রয়েছে তিন হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র। পুরনো অস্ত্রের পাশাপাশি নতুন এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রও রয়েছে তাদের।

এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এম-১৬ রাইফেল, মিয়ানমারে তৈরি এম-১ রাইফেল, একে-৪৭ রাইফেল, একে-২২ রাইফেল এবং এলএমজি (লাইট মেশিনগান), হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেলের মতো ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র। প্রতিবেশী দুটি দেশ থেকে তারা এসব অস্ত্র, গুলি ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অস্ত্র আসছে। মাঝে মধ্যে কিছু ধরা পড়লেও তা খুবই সামান্য। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্রের একটি অংশ সমতলের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতেও চালান হচ্ছে।


গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে, মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে পাহাড়ি চারটি সশস্ত্র গ্রুপ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও গ্রেনেড এনে মজুদ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে সশস্ত্র সংগঠনের হাতে ১৩০ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ৮৫ জন বাঙালি নিহত হন। এ সময় আহত হন ২২৩ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ৫৫১ জন বাঙালি। অপহরণের ঘটনা ঘটে প্রায় ৪০০টি। গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে ১৩০টি এবং ৫০০টি অস্ত্র ও সাত হাজার গুলি উদ্ধার হয়।

গত ১৮ এপ্রিল পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে দুটি ৭.৬২ মি.মি. এসএমজি, একটি অ্যাসল্ট রাইফেল, দুটি পিস্তল, ১৬ রাউন্ড অ্যামোনিশন, দুটি এসএমজির ম্যাগাজিন, একটি অ্যাসল্ট রাইফেলের ম্যাগাজিন, দুটি পিস্তলের ম্যাগাজিন ও একটি সিলিং।

সম্প্রতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নানিয়ারচরে ঘটে যাওয়া ছয় হত্যাকাণ্ডের কারণ চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জেএসএস সংস্কার নেতা সুদর্শন চাকমা আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালে স্থানীয় একটি আঞ্চলিক সংগঠনের জন্য ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হতো। বিশেষ করে নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়িতে তারা নির্বিঘ্নে নির্বাচনী কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারত না। অন্যদিকে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও জেএসএস সংস্কার মিলে খাগড়াছড়িতে প্রার্থী দিলে মহালছড়ি, দিঘীনালায় ইউপিডিএফ (প্রসিত) নির্বাচনে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতো। বর্তমানে জেএসএস (মূল) ও ইউপিডিএফের (মূল) মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার সূত্রে সিজ ফায়ার রয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে প্রচার রয়েছে।


বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি হঠাৎ করেই জটিল হয়ে উঠছে। আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্বে চার ভাগ হলেও তৃণমূল পর্যায়ে এ বিভক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়া এ সহিংসতার কারণ বিশ্লেষণ করে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চুক্তির (শান্তি চুক্তি) ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক নয়, এমন অভিযোগ এনে ‘পাহাড়ে আগুন জ্বলবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেয়। এরপরই ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ সমর্থিত অনাধি রঞ্জন চাকমা (৫৫) নামের নানিয়ারচর উপজেলার সাবেক এক ইউপি সদস্যকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে নতুন করে হত্যাযজ্ঞ শুরু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্গম সীমান্তের কারণে খুব সহজেই সন্ত্রাসীদের হাতে মারণাস্ত্র চলে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮৫ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে কোনো সীমান্তচৌকি (বর্ডার আউটপোস্ট-বিওপি) নেই। ফলে সেখানে বাধাহীনভাবে অস্ত্র প্রবেশ করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ি সীমান্তে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় উন্মুক্ত সীমান্তে বিওপি স্থাপন করা যাচ্ছে না। কেননা বিওপি স্থাপন করতে হলে তার নিরাপত্তায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নীতকরণ জরুরি। বর্তমান অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন দুর্গম স্থানও রয়েছে যেখানে কোনো সশস্ত্র হামলা হলে নিরাপত্তা বাহিনীর পৌঁছতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

অভিজ্ঞ মহলের মতে, নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে সেই সংঘাত ততোই বৃদ্ধি পাবে। সে কারণে সরকারকে এখনই তৎপর হতে হবে। তাদের মতে, দ্রুততার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস নির্মূলে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের নেতৃত্বে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতায় সন্ত্রাসীদের ভয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করতে সাহস পায় না। তাই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে সন্ত্রাসীদের আটক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
পার্বত্য চট্রগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যে কাজগুলো সরকারের করা উচিত
Image result for পার্বত্যচট্টগ্রামপার্বত্য চট্রগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যে কাজগুলো সরকারের করা উচিত

পার্বত্যাঞ্চলে হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, বেপরোয়া চাঁদাবাজিসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। এমনকি তারা স্বাধীন রাষ্ট্র কথিত জুম্মল্যান্ড এরও অলীক স্বপ্ন দেখে! পার্বত্যাঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে এমন অরাজকতা চলতেই আছে। যা স্বাধীন এই দেশে মানা যায়না। সরকার যদি আসলেই চায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসুক তাহলে সরকারকে অবশ্যই নিন্মোক্ত পদক্ষেপ নিতেই হবে -

১) শান্তি চুক্তি বাতিল করা
২) পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন বাতিল করা
৩) অবৈধ সি এইচ টি কমিশন বাতিল ঘোষণা করা
৪) জে এস এস , ইউপিডিএফ নামক সকল সন্ত্রাসী সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষনা করা
৫) ইউএনডিপি কার্য্যক্রম বন্ধ করা
৬) খৃষ্টান, বৌদ্ধ, বিদেশী কতৃক পরিচালিত সকল এনজিও নিষিদ্ধ করা
৭) মিশনারি চার্চের কার্য্যক্রম বন্ধ করা
৮) সেনানিবাস এবং সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধি করা
৯) পুরো সীমান্ত সীলগালা করে কঠোর নজরদারীতে রাখা
১০) সংবিধানবিরোধী আদিবাসী শব্দ যারা ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা
১১) গণতান্ত্রিক দেশে অবৈধ রাজা উপাধি ব্যবহার বাতিল করা
১২) উপজাতি কোটা বাতিল করা
১৩) আঞ্চলিক চেয়ারম্যান,সার্কেল প্রধান প্রথা বাতিল করা
১৪) উপজাতি রাজাকারদের বিচার করা
১৫ ) বাইরের দেশের সকল হস্তক্ষেপ বরদাস্ত না করা
১৬) চিরুনি অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের নির্মুল করা
১৭) উপজাতি নয় , বাঙ্গালী পরিচয়ে বাস করা
১৮ ) বাকী ৬১ জেলায় যে আইন সে একই আইন ৩ পার্বত্য জেলায় জারী করা
১৯ ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল কারখানা চালু করা
২০ ) ৩ পার্বত্য জেলায় সরকারী জায়গা জমি ব্যতীত অন্যান্য জায়গা জমি সবার জন্য ক্রয়- বিক্রয় উন্মুক্ত করা
২১ ) দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা
২২ ) সন্ত্রাসী সন্তু লার্মাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা



এরপরেও যদি তারা সন্ত্রাসীপনা না ত্যাগ করে তাহলে সরকারকে অবশ্যই “ সকল উপজাতিদের পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে বের করে দিয়ে তাদের আদিনিবাস মায়ানমারে পাঠিয়ে দিতে হবে”।
কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারনে উপজাতিদের দুর্দশা কেবলই মিথ্যা অপপ্রচার
Related imageকাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারনে উপজাতিদের দুর্দশা কেবলই মিথ্যা অপপ্রচার
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা নিয়ে যেকোনো আলোচনার শুরুতেই দেশের সুশীল সমাজ. বিদগ্ধজন, এমনকি অনেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষককে বলতে শোনা যায়, পাকিস্তান আমলে সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি করে বিপুল পরিমাণ পাহাড়ীদের পানিতে ডুবিয়ে বাস্তচ্যুত করায় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম অসন্তোষ দানা বাঁধে, তারা ক্ষুদ্ধ হয়, বিদ্রোহী হয়। তাদের এ বক্তব্যের সারবত্ত্বা কতটুকু তা বিবেচনার দাবী রাখে।

কর্ণফুলী নদীকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা এবং এর ‘অববাহিকার নিম্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণহীন সর্বনাশা বন্যা নিয়ন্ত্রণের’ কথা মাথায় রেখে ১৯০৬-০৭ সালে সর্বপ্রথম এবং ১৯২২ সালে পুনরায় নদীতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৪০ সালে প্রিলিমিনারি রিপোর্ট এবং ১৯৫২ সালে কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্পের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। ( সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ, প্রকাশ: ১৯৯৩ )। ঐ সময় এই প্রকল্প থেকে নিম্নোক্ত পাঁচটি সুবিধা বিবেচনা করা হয়েছিলঃ

ক। বিদ্যুৎ উন্নয়ন।
খ। সেচ ও পানি নিষ্কাশন।
গ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ।
ঘ। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি।
ঙ। বনজ সম্পদ আহরণে সুবিধা।
বিরাজ মোহন দেওয়ান কর্তৃক রচিত ও ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ হতে জানা যায় যে, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ‘সুচারুরূপে’ পরিচালনার জন্যে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৫ সাল থেকে তৎকালীন চাকমা সার্কেল চীফ (যে চাকমা রাজা নামেও পরিচিত) ত্রিদিব এর সভাপতিত্বে সরকারী ও বেসরকারী কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এক সাব-কমিটি গঠন করেন।

“Sub-Committee উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট এক বিস্তৃত রিপোর্ট প্রদান করেন। ফলে, কাচলং, রাইংখ্যং, ও ঠেগা রিজার্ভ ফরেস্টের কিয়দংশ এলাকা বন বিভাগ হইতে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য মুক্ত করিয়া দেওয়া হয়। রাজা বাহাদুর ঐ সময় পুনর্বাসন এলাকাদি পরিদর্শন করতঃ উদ্বাস্তুদের উৎসাহ প্রদানে তাহাদের সুখ সুবিধার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়া তাহাদের কষ্ট লাঘব করিয়া দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় আজ সেইখানে স্থাপিত হইয়াছে এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।” (সূত্র: বিরাজ মোহন দেওয়ান, পৃষ্ঠা-১৫২ দ্রষ্টব্য)।

স্মরণযোগ্য যে, বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত উপরোল্লিখিত বইয়ের পুণঃমুদ্রণের সময় দেবাশীষ রায় বইটিকে “পুস্তকটি অত্রাঞ্চলের ইতিহাস রচনাবলীর মধ্যে অগ্রজ ভুমিকার দাবীদার।” হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেছিল। (সূত্র: বিরাজ মোহন দেওয়ান, ২০০৫, অভিমত দ্রষ্টব্য)।

একথা মনে করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, বইটির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া এবং এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করা যে, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে স্বয়ং চাকমা রাজার নেতৃত্বে পুণর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।

শুধু তাই নয়, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের যথাযথ পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল, যার ফলে পুণর্বাসিতগণ ঐ সময়েই ‘এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ’ এর দেখা পেয়েছিল। আরো স্মরণযোগ্য যে, কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল (নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে)। এই সত্য মেনে নিলে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে এত বছর পরে যারা কাপ্তাই বাঁধের দোহাই দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য আসলে কী?

কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয় যে, ২৫৬ বর্গমাইল এলাকার ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি তলিয়ে গেছে, প্রায় এক লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তন্মধ্যে কিছু লোক ক্ষতিপূরণ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। প্রদীপ্ত খীসা তার ‘পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা’ বইয়ে উল্লেখ করেছে, “১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে তার পরিণতিতে ৯৯ হাজার ৯শ’ ৭৭ জন বাস্তু ও জমিহারা হয়ে পড়ে”। (সূত্র: প্রদীপ্ত খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রকাশ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৩৫ দ্রষ্টব্য)।”

পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই লেক ছিল রাঙামাটি মহকুমার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৬১ সালের আদম শুমারী মোতাবেক রাঙামাটি মহকুমার আয়তন ১৬০১ বর্গমাইল, মোট জনসংখ্যা ১,৬২,৪৯৫ জন এবং মোট বাড়ি ছিল ২৮,৩৭২ টি। শুমারীর তথ্যানুসারে, রাঙামাটি মহকুমায় প্রতি বর্গ মাইলে বাস করত ১০২ জন লোক। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৩ দ্রষ্টব্য)

যদি ধরে নেয়া হয় যে, কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা এক লাখ; তাহলে উপরের তথ্য অনুসারে, রাঙামাটি মহকুমার মাত্র ৬.২৫% এলাকায় সমগ্র মহকুমার ৬১.৫৪% বাড়ি ও মানুষ ছিল। (মোট আয়তন ১৬০১ বর্গমাইলের মধ্যে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ২৫৬ বর্গমাইল; মোট জনসংখ্যা ১,৬২,৪৯৫ জন, ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ)। পুরো মহকুমার শুধুমাত্র এই ২৫৬ বর্গমাইলে জনসংখ্যার বসতি ছিল, প্রতি বর্গমাইলে ৩৯০ জন। যা যৌক্তিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

সঙ্গত কারণেই, আনিসুল হক তার পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি বইয়ে তথ্য পর্যালোচনা করে ক্ষতিগ্রস্থের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে,
- উপজাতীয় বা বিদেশি লেখকদের কোন লেখায়ই উল্লেখ করা হয়নি যে, পাহাড়িদের সমতল এলাকা প্রীতি আছে, বা পাহাড়ির বিরাটসংখ্যক লোক একটা নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস কিংবা কৃষির প্রতি আগ্রহী।
- বরং সবাই একটা বিষয়ে একমত যে পাহাড়িরা ‘জুম নির্ভর যাযাবরী জীবনে অভ্যস্ত’।
- বর্তমানে অনেক খালি সমতল জায়গা থাকা সত্ত্বেও, ‘উপজাতীয়রা পাহাড় বা পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করছে’।
- পাহাড়িদের গ্রামে অন্য এলাকার মতই এক সাথে অনেকগুলো পরিবার থাকে। কিন্তু বর্তমানে যে গ্রামের জনসংখ্যা ১৯৬১ সালের তুলনায় পায় ৪ গুন হয়ে গেছে, সেখানেও ১০০ হতে ১৫০ পরিবারের গ্রাম খুব একটা পাওয়া যাবে না। (সূত্র: প্রাগুক্ত দ্রষ্টব্য)।
(সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৩ দ্রষ্টব্য)

ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার চিত্র দেখেও এটা বোঝা যায় যে, এক লাখ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হলে অনেকগুলো ইউনিয়নকে পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে দিতে হবে। রাঙ্গামাটি জেলার ম্যাপের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, বিষয়টি কতটা অবাস্তব হতে পারে। সুতরাং, শুধুমাত্র ২৫৬ বর্গমাইলে প্রায় এক লাখ লোকের বাস ছিল এমন দাবী করা মোটেও যুক্তি সংগত নয়।

ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের একটা পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ’ বইয়ে। এ বইয়ে উল্লেখ করেছে, “প্রকল্পের প্রতিবেদনে বাঁধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যার হিসাব দেওয়া হয়নি। বাঁধ নির্মাণের পর ১২৫ টি মৌজার মোট ১৮ হাজার পরিবারে ১ লক্ষ লোকের কৃষি জমি অথবা বসতবাড়ী ডুবে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাস্তচ্যুত হয়েছিল। এই ১৮ হাজার পরিবারের মধ্যে ১০ হাজার নদী অববাহিকার সমতল এলাকার চাষী এবং বাকী ৮ হাজার পরিবার জুমিয়া” (সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ, প্রকাশ: ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৩০ দ্রষ্টব্য)।

জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার পূর্বোক্ত বই হতে আরো জানা যায় যে, পাকিস্তান আমলেই একাধিক দফায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল যা ১৯৫৭ সালে শুরু হয়ে ৩০ জুন ১৯৭৫ সালে সমাপ্ত হয়।
(সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ, প্রকাশ: ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৩০-৩১ দ্রষ্টব্য)

অর্থাৎ, সর্বমোট ২৫০৪৭ টি পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে পুনর্বাসন করা হয়। এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাঁধের নির্মাণ কাজের সময়েই শুরু হয় এবং পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলেও চলমান ছিল।

উপরের তথ্যাবলী থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য প্রভাব সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথা সময়েই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে স্বয়ং চাকমা রাজার নেতৃত্বে উপযুক্ত কমিটি গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত সংখ্যা না জানা গেলেও শুমারি ও পাহাড়িদের বসবাসের রীতি পর্যালোচনায় এটা ধারণা করা অমুলক নয় যে, অনেকের দাবিকৃত প্রায় এক লাখ হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২৫০৪৭ টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৬১ সালে রাঙামাটি মহকুমায় মোট বাড়ি ছিল ২৮,৩৭২ টি এবং জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার পুস্তকে ১৮ হাজার পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধুমাত্র আলোচনার জন্যে বিবেচনা করলেও দেখা যায় যে, ১,৬২,৪৯৫ জন ২৮,৩৭২ টি বাড়িতে বসবাস করত। অর্থাৎ, আলোচনার খাতিরে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা এক লাখ ধরে নিলেও (ইতিপূর্বে দেখা গেছে, এক লাখ লোকের ক্ষতি হওয়ার সুযোগ নেই), কাপ্তাই বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা কোন মতেই ১৭,৪৬০ এর বেশী হতে পারে না। এর বাইরেও সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু পরিবার সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল বলে অনেকেই দাবী করে থাকেন।

অনেকেই বলেন যে, বাস্তভিটার ক্ষতিপূরণ না দেয়াও পাহাড়িদের ক্ষোভের একটা কারণ। আসলেই, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জায়গা-জমি ও বাড়ির জন্যে ভিন্ন ছিল, যথাক্রমে একর প্রতি গড়ে ২৫০ টাকা ও ঘরবাড়ির জন্যে গড়ে ৪০০ টাকা। কিন্তু তখনকার দিনে পাহাড়িরা বসতবাড়ির ভিটা বন্দোবস্ত নিত না। তাই তারা বাড়ির ক্ষতিপূরণ পায়নি, শুধুমাত্র বাস্তভিটার আশেপাশের গাছ-গাছালির ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল।

আনিসুল হকের হিসেব মতে, “ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা বড় জোর ৫০ হাজার হতে পারে”। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬৩ দ্রষ্টব্য) । এই সংখ্যা মেনে নিলে (যা বেশী যুক্তিসংগত), মোট ৭১৫৯ জনকে শুধুমাত্র বাস্তভিটার (গাছ-গাছালী বাদে) ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।

সুতরাং, ধারণা করা যেতে পারে যে, ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বর্তমানে অনেক বেশী বলা হচ্ছে। এছাড়াও, এই সিদ্ধান্তে আসা মোটেও অযৌক্তিক নয় যে, ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় আশে পাশে বসবাসকারী কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন লোকদেরও ধরা হয়েছিল। এরই পাশাপাশি “নাম, ঠিকানা ও চেহারায় সনাক্তকরণে অসুবিধে, ভীত সন্ত্রস্ত মানসিকতা, ভাষাগত দুর্বোধ্যতা ছাড়াও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সুযোগী মানসিকতা এবং মানবিক সহযোগিতা প্রদান না করায় কিছু লোক সরকারী সাহায্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে, কিছু লোক বার বার সুযোগ-সুবিধে গ্রহণ করতে পারে, এমন কি আত্নসাতের ঘটনাও ঘটতে পারে।” (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬৪ দ্রষ্টব্য)। একই প্রেক্ষাপটে এও অমুলক নয় যে, ক্ষতিপূরণের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা অংশ তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নিজেরা কুক্ষিগত করেছিলেন।

তাছাড়া পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ দেয়া অর্থের একটা বড় অংশ এই কমিটি ব্যবহার করতে না পারায় তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত যায়। কাজেই পুণর্বাসনের ব্যর্থতার দায় সরকারের চেয়ে চাকমা রাজার নেতৃত্বাধীন কমিটির উপর বর্তায়।

সহজ কথায়, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ভয়াবহতা সরকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং ক্ষতিপূরণের ও পুনর্বাসনের যথাযথ পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন যথাসময়য়েই। কিন্তু, নেতৃবৃন্দের ব্যক্তি স্বার্থের শিকার হয়েছে সাধারণ পাহাড়ি মানুষেরা। এখনো ব্যক্তি স্বার্থেই কর্ণফুলী বাঁধ নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই উন্নয়নমুলক কাজের ফলে জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই ভয়ে উন্নয়নমুলক কাজ স্থগিত করার কোন নজির নেই। বরং, বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে উন্নয়নমুলক কাজের পাশাপাশি সব দেশের সরকারই ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণও তেমনি একটি উন্নয়নমুলক পদক্ষেপ। সরকার কর্তৃক যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও যদি ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পায় এবং পুনর্বাসনের সুফল পেতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।

তবে, কর্ণফুলী প্রকল্পের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে দায়ভার যতটা না তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী স্থানীয় নেতৃবৃন্দের যারা এর বাস্তবায়নের সাথে জড়িত ছিলেন। এক্ষেত্রে, তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের দায় সবচেয়ে বেশী। কারণ, তার নেতৃত্বেই ১৯৫৫ সালে পুনর্বাসন কাজ পরিচালনার জন্যে কমিটি করে দেয়া হয়েছিল। কমিটি যে নামমাত্র ছিল না তা বোঝা যায়, যখন কমিটির সুপারিশেই রিজার্ভ ফরেস্ট এর অংশবিশেষ পুনর্বাসনের জন্যে মুক্ত করে দেয়া দেয়া হয়।

এখানে একটি কথা না বললেই নয়, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি ও এর ফলে পানিতে ডুবে বাস্তচ্যুত চাকমা সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তান সরকারের প্রতি ক্ষুদ্ধ হওয়ার কথা। বিশেষ করে যে চাকমার সার্কেল চিফের রাজমহল পানিতে ডুবে গেলো তার তো পাকিস্তান সরকারের প্রতি প্রবলভাবে ক্ষুদ্ধ ও বিদ্রোহী হওয়ার কথা, যেমনটা হয়েছিল বাঙালীরা। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালীরা ক্ষুদ্ধ ও বিদ্রোহী হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখলাম?

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাঙালী জাতি যখন স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন চাকমা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরও একই কারণে বাঙালীদের মতোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হবার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম রাঙামাটিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে রাজাকারে নাম লেখায়। এমনকি নিজের রাজত্বের বিশাল এলাকা ও রাজমহল ডুবিয়ে দেয়া এবং নিজের বিপুল পরিমাণ প্রজাকে বাস্তচ্যুত করায় যে চাকমা সার্কেল চিফের সবচেয়ে বেশী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার কথা, অথচ সেই চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় হল দেশের সবচেয়ে কুখ্যাত রাজাকার। যে আমৃত্যু পাকিস্তানের আনুগত্য পোষণ করে পাকিস্তানেই মৃত্যুবরণ করেছিল।

এ থেকে প্রমাণিত হয় চাকমা সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ এবং চাকমা নেতৃত্ব, কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি করে বাস্তচ্যুত করার পরও পাকিস্তান সরকারের প্রতি বিরূপ বা বিক্ষুদ্ধ ছিল না। বরং পাকিস্তান প্রেমী ছিল। এর কারণ কী হতে পারে? তারা কি পাকিস্তান সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পে সন্তুষ্ট ছিল?

তাই এতবছর পরে যখন পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের একাংশ সাধারণ পাহাড়িদের চোখের সামনে জাজ্বল্যমান কাপ্তাই বাঁধ দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে তখন বুঝতে কষ্ট হয় না, এখানে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অভিপ্রায়ই প্রধান নিয়ায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের মত কিছু নেতৃত্বের ব্যক্তিস্বার্থেই সাধারণ পাহাড়িরা কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার মতলবেই এখনও নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে তারা সোচ্চার – এমনকি সাধারণ পাহাড়ীদের জন্যে দুর্দশার বিনিময়ে হলেও।

তথ্যসুত্রঃ
খীসা, প. (১৯৯৬). পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা. ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ।
চাকমা, জ. ব. (১৯৯৩). ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ. রাঙামাটি: স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
দেওয়ান, ব. ম. (২০০৫). চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত. রাঙ্গামাটি: উদয় শঙ্কর দেওয়ান।
হক, আ. (২০০৭). পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি. ঢাকা: নওরোজ সাহিত্য সম্ভার।