কয়েক বছর আগে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এবং মিয়ানমারের সাথে সৃষ্ট উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে রাঙামাটির কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড সরিয়ে নেয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন চারটি ব্রিগেডই রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নতুন কোনো সেনা ব্রিগেড প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। একটি ব্রিগেড গঠিত হয় কয়েকটি ব্যাটালিয়নের সমষ্টিতে। এর অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি ব্রিগেড ও তার অধিনস্ত ব্যাটালিয়নগুলো এবং তার অন্তর্গত সেনাসদস্যরা থাকছে। তাহলে বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার ও পাহাড়ীদের উল্লসিত হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস রাখার কথা বলা হয়। শান্তিচুক্তির ঘ খ-ের ১৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, “সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে।
আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন”।
এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে, শান্তিচুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ৪টি ব্রিগেড বাদে ‘বাকিগুলো সব সরিয়ে নেয়ার’ ঘোষণা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কি শান্তিচুক্তি সংশোধনের কথা বলল? এটাও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ একটি ভুল বোঝাবুঝি। কেননা শান্তিচুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই সেনানিবাসগুলোর ফর্মেশনের কথা শান্তিচুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা নেই।
এই ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস কিরূপে সেখানে অবস্থান করবে- ডিভিশন আকারে, ব্রিগেড আকারে না ব্যাটালিয়ন আকারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। এই অপশনটি রাষ্ট্রের হাতে রয়ে গেছে। রাষ্ট্র প্রয়োজন মতো তা ব্যবহার করতে পারবে। ৪টি ব্রিগেড ও শান্তিচুক্তি সমন্বয় করলে আমরা দেখতে পাবো, তিন পার্বত্য জেলা সদরে তিনটি ব্রিগেড রয়েছে। এর বাইরে গুইমারা ব্রিগেড দিঘীনালায় সরে গেলে রুমা ও আলীকদমে দুইটি ব্যাটালিয়ন থাকতে পারে।
তবে শান্তিচুক্তির মধ্যেই সমাধান খুঁজলে এ চুক্তির ঘ খ-ের ১৭(ক) ধারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এই ধারায় যেমন স্থায়ী সেনানিবাসের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। তেমনি অস্থায়ী সেনানিবাসের সংজ্ঞাও দেয়া নেই। অর্থাৎ অস্থায়ী সেনানিবাস বলতে ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন/জোন, সাবজোন, কোম্পানী স্থাপনা নাকি সেনা আউট পোস্ট বোঝানো হবে তার কিছুই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই ব্যাখ্যাটাও রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ৪টি ব্রিগেডের মধ্যে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান ব্রিগেডে ৫ ব্যাটালিয়ন করে সৈন্য রয়েছে, গুইমারায় রয়েছে ৩ ব্যাটালিয়ন। সব মিলিয়ে ১৮ ব্যাটালিয়ন সৈন্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। একটি ব্যাটালিয়নে গড়ে ৭০০ করে সৈন্য ধরলে ১৮টি ব্যাটালিয়নে ১২-১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফর্মেশন অনুযায়ী ৩-৫টি ব্যাটিলিয়ন নিয়ে একটি ব্রিগেড গঠিত হয়। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪টি ব্রিগেড থাকলে সেখানে ১২-২০ ব্যাটালিয়ন সৈন্য থাকতেই হবে। ব্যাটালিয়নগুলো আবার গড়ে ওঠে কতকগুলো সাবজোনের সমষ্টিতে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই জোন, সাবজোনগুলো কোথায়, কিভাবে অবস্থান করবে?
শান্তিচুক্তির ঘ খ-ের ১৭(ক) ধারায় আরো বলা হয়েছে, “আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে”। উল্লিখিত বাক্যটি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে বা জাতীয় অন্যান্য দরকারে রাষ্ট্র প্রয়োজনানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে প্রয়োজন যে কোনো ফর্মেশনে সেনাবাহিনী রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে চারটি ব্রিগেড বা ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস বিবেচ্য নয়- রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বিবেচ্য।
একই ধারায় আরো গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার শর্ত বাস্তবায়িত হতে হবে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে’..। অর্থাৎ চুক্তিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি শর্তহীন নয়। বরং এর সাথে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার’ শর্ত যুক্ত রয়েছে।
এ নিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই যে, জেএসএসের সকল সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। জেএসএস ও তার সকল সদস্যকে অস্ত্র সমর্পণ করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেনি।
চুক্তি অনুয়ায়ী ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জেএসএসের অস্ত্র সমর্পণের সময় চুক্তির বিরোধিতা করে অস্ত্র সমর্পণ না করে তাদেরই একটি অংশ জেএসএস থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউপিডিএফ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে। এরপর স্বার্থগত দ্বন্দ্বে জেএসএসও ভেঙে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে নতুন আরো একটি সংগঠন তৈরি হয়। এদিকে জেএসএসের মূলের সামরিক শাখাও সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি।
এই তিন পাহাড়ী সংগঠন প্রকাশ্য ও গুপ্ত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গুপ্ত বা গোপন শাখা আসলে তাদের সাস্ত্রে সামরিক শাখা। যদিও প্রকাশ্যে তারা কখনই এই সামরিক শাখার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে না।
তবে এই তিন সংগঠনের সামরিক শাখার দৌরাত্ম্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থার ওপর কিঞ্চিত আলোকপাত উপরে করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমানে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চাঁদা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ নাগরিক তো দূরে থাক, সরকারী কর্মকর্তাদেরও বসবাস অসম্ভব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি পাহাড়ী সংগঠনের নির্ধারিত চাঁদা দিতে না পারলে সেখানে বসবাস যে কারো জন্যই অসম্ভব।
সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়, পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখ-তা, বাঙালি ও সরকার বিরোধী নানা তৎপরতায় লিপ্ত। এরূপ পরিস্থিতিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী বাধ্যতামূলক নয়।