গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে'র মন্দির হচ্ছে ভারতে
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে যিনি হত্যা করেছিলেন, সেই নাথুরাম গডসের একটি মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে।
গান্ধী হত্যার দায়ে মি. গডসেকে ১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তাঁর এক সহযোগী নারায়ন আপ্তেরও ফাঁসি হয়েছিল একই সঙ্গে।
সেই দিনকে স্মরণ করেই হিন্দু মহাসভা গোয়ালিয়রে তাদের দপ্তরেই গডসের মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মাণ কাজ শুরু করেছে বুধবার।
সেখানে ইতোমধ্যেই মি: গডসের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে, সন্ধ্যায় আরতির পরে প্রসাদ বিতরণও করা হয়েছে।
মধ্য প্রদেশের ক্ষমতাসীন বিজেপি'র দিকে আঙ্গুল তুলে কংগ্রেস অভিযোগ করেছে। তাদের ভাষায়, জাতির জনকের হত্যাকারীর মন্দির কীভাবে তৈরি হচ্ছে রাজ্যে?
তবে হিন্দু মহাসভার নেতারা বলছেন, তারা যদিও আগে নাথুরাম গডসের মন্দির গড়ার জন্য সরকারের কাছে জমি চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। এখন তারা নিজেদের দপ্তরেই মন্দিরটি তৈরি করছেন।
হিন্দু মহাসভার সহ সভাপতি নারায়ণ শর্মা সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে জানিয়েছেন, "১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে যে ভাবে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা একজন কট্টর হিন্দু হিসাবে মেনে নিতে পারেননি গডসে। সেজন্যই তিনি গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। এই ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানানোর দরকার।"
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি দিল্লির 'বিড়লা হাউস'-এ বিকেলের প্রার্থনায় যাওয়ার সময়ে মি. গান্ধীকে সামনে থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন নাথুরাম গডসে।
যে ব্যারেটা পিস্তল থেকে মি. গডসে পরপর তিনটে গুলি চালিয়েছিলেন, সেটি গোয়ালিয়র থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে।
দিল্লির লাল কেল্লায় গান্ধী হত্যা মামলার বিচার চলার সময়ে নাথুরাম গডসে নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি দেশভাগের জন্য মি. গান্ধীকেই দায়ী বলে মনে করতেন।
"গান্ধীজী দেশের জন্য যা করেছেন, আমি তাকে সম্মান করি। গুলি চালানোর আগে তাই আমি মাথা নীচু করে তাঁকে প্রণামও করেছিলাম।
কিন্তু সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে ভাগ করার অধিকার কারও নেই, তিনি যতবড়ই মহাত্মা হোন না কেন। আর এর বিচার করবে, এমন কোনও আইন-আদালত নেই, সেজন্যই আমি গান্ধীকে গুলি করেছিলাম," আদালতে বলেছিলেন নাথুরাম গডসে।
নাথুরাম গডসে আর নারায়ন আপ্তে'র ফাঁসির সাজা শোনালেও নাথুরামের ভাই গোপাল গডসেসহ পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছিল আদালত। পরে দুজন ছাড়া পেয়ে যান।
১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর গডসে আর আপ্তের ফাঁসি হয় পাঞ্জাব রাজ্যের আম্বালা জেলে।
তাঁদের পরিবারের হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়া হয়নি। জেল কর্তৃপক্ষই অন্তিম সংস্কারের বন্দোবস্ত করে কড়া নিরাপত্তায়।
তবে চিতার আগুন প্রায় নিভে যাওয়ার সময়ে অত্রি নামে হিন্দু মহাসভার এক কর্মী লুকিয়ে সেই শ্মশানে পৌঁছেছিলেন।
সেখান থেকেই কিছুটা অস্থি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তিনি।
গডসে পরিবারের কাছে সেই অস্থি একটা রুপোর কলসে রাখা রয়েছে নাথুরামের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী।
গডসে পরিবার প্রতিবছর ১৫ই নভেম্বর সেই ইচ্ছাপত্র পড়ে শোনান সবাইকে, যেখানে লেখা আছে, 'শরীরের কিছুটা অংশ যত্ন করে রেখে দিও আর যখন সিন্ধু নদ আবারও স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হবে আর অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সিন্ধু নদে আমার অস্থি বিসর্জন দিও। এই কাজে দুই-চার প্রজন্ম লাগলেও সমস্যা নেই।"
কেমন ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবনের শেষ দিনগুলো
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান একজন রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের একজন, এবং স্বাধীনতার পর ভারত তাঁকে জাতির জনকের মর্যাদা দেয়।
সময় ১৯৪৮ সাল। ৩০শে জানুয়ারি। ভারত ভাগের প্রায় দেড় বছর পরেই দিল্লির বিরলা হাউজে হত্যা করা হয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে, বেশীরভাগ মানুষ যাকে চেনেন মহাত্মা গান্ধী নামে।
আজ মঙ্গলবার গান্ধী হত্যার ৭০ বছর পূর্তি হচ্ছে।
সারা ভারত ঘুরে বেড়ানো মোহনদাস গান্ধী কেন শেষ সময়ে দিল্লির বিরলা হাউসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং কেমন ছিল তাঁর সেই শেষ দিনগুলো তা অনেকের কাছেই অজানা।
কয়েকদিন আগে আমি গিয়েছিলাম দিল্লির বিরলা হাউজে, মি. গান্ধী কীভাবে তাঁর জীবনের শেষ সময়টা কাটিয়েছিলেন সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে।
বিরলা হাউজ
বিরলা হাউজ দিল্লির সুপরিচিত ব্যবসায়ী ঘনশ্যাম দাস বিরলার একটি বড় বাড়ী বা ম্যানশন। তিনি নিজেও গান্ধীর অনুসারী ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর শেষবারের মত মি. গান্ধী দিল্লিতে আসেন।
এর আগে যখনই তিনি দিল্লি এসেছেন, প্রত্যেকবার তিনি 'ভাঙ্গি কলোনি' নামের এক জায়গায় থাকতেন।
কিন্তু শেষবার যখন তিনি দিল্লি আসেন, তখন শহরের বিভিন্ন জায়গায় শরণার্থীরা অবস্থান করছিল। তাই তিনি অবস্থান নেন বিরলা হাউজে।
কেন দিল্লিতে থাকার সিদ্ধান্ত?
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দিল্লি আসেন কোলকাতা থেকে। সে সময় হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে অশান্তি চলছিল - সেটা থামিয়ে তিনি দিল্লিতে আসেন।
কিন্তু দিল্লিতে এসে দেখলেন এখানে মুসলমানদের উপর হামলা হচ্ছে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন দিল্লিতে তিনি থেকে যাবেন।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ বলছিলেন "কোলকাতায় তিনি যেটা করেছিলেন অর্থাৎ হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে মিল করেছিলেন, সেটা দিল্লিতেও করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া শিখ এবং হিন্দুদের তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন মুসলমানদের উপর যেন হামলা না করে"।
সরকারের তরফ থেকেও বিরলা হাউজে থাকার কথা বলা হয় তাঁকে।
সেখানে তাঁর অফিস ছিল, রাজনৈতিক সমস্ত বৈঠকও সেখানে অনুষ্ঠিত হত। রাজনীতিবিদরা ছাড়াও অনেক সাধারণ মানুষ আসতেন তাঁর সাথে দেখা করতে, বিভিন্ন অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে।
স্বাধীনতার পরপরেই ছিল সময়টা। তাই মি. গান্ধী মনে করেছিলেন বিরলা হাউজ থেকে সরকারের সাথে যোগাযোগ করাটা যেমন সহজ হবে, তেমনি প্রয়োজনে যে কেউ তাঁর কাছে সহজে আসতে পারবেন।
অধ্যাপক অপূর্বানন্দ বলছিলেন, "বিরলা হাউস থেকে বলা চলে তিনি সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সচিব এবং গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সাথে প্রতিদিন বৈঠক করতেন। যেখানে ত্রাণ পাঠানো দরকার সেটা তিনি তাদের বলতেন। কোন স্থান থেকে বেশি অভিযোগ আসছে - সেটা কীভাবে সামলানো যায় - সেটা নিয়ে আলোচনা করতেন"।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুটি দেশ সৃষ্টির পর অনেক রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ইস্যু অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছিল।
উত্তেজনা বিরাজ করছিল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। জওহারলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মৃদুলা মুখার্জী আমাকে বলছিলেন, বিরলা হাউজে থাকার সময়টা মোটেও শান্তিপূর্ণ ছিল না মি. গান্ধীর জন্য।
"চারদিক থেকে দাঙ্গার খবর গান্ধীজি নিজেও পাচ্ছিলেন," বলছিলেন মৃদুলা মুখার্জী। "কিন্তু তাঁর উপর হামলা হতে পারে এই আশঙ্কা করে কখনো তিনি কোন নিরাপত্তা রক্ষী রাখতেন না।"
অনশন
বিরলা হাউজে মি. গান্ধীকে পরিচর্যার দায়িত্বে ছিলেন ব্রিজ কৃষ্ণা চান্দিওয়ালা, মানু এবং আভা নামে তাঁর কয়েকজন আত্মীয়।
তিনি নিজে দিল্লির বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাম্পে সশরীরে যেতেন পরিস্থিতি দেখতে।
মূলত ভারত সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তিনি এ সময় সাহায্য করেছেন।
তবে মুসলমানদের উপর হামলা যখন একেবারেই থামছিল না, তখন তিনি জানুয়ারির ১৩ তারিখে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনশন করার ঘোষণা দেন।
১৮ই জানুয়ারি বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বিরলা হাউজে এসে তাকে আশ্বস্ত করেন যে মুসলমানদের উপর আর হামলা হবে না।
তাদের কথা বিশ্বাস করে তিনি ১৯ তারিখে অনশন ভঙ্গ করেন। কিন্তু এর দুই দিন পরেই বিরলা হাউজে এক বোমা হামলা হয়।
হত্যা
তবে তখন মোহনদাস গান্ধীর কোন ক্ষতি হয়নি। এর আগেও কয়েকবার তাঁর ওপর হামলা করা হয়েছিল।
কিন্তু মি. গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের ৩০শে জানুয়ারির লক্ষ্য ছিল নির্ভুল।
সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা সভা করতেন তিনি। সেখানে সব ধর্মের কথা বলা হতো, প্রতিদিন অংশ নিতেন কয়েকশ' মানুষ।
সেদিন সন্ধ্যার প্রার্থনা সভার জন্য মি. গান্ধী প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই মূহুর্তেই নাথুরাম গডসে খুব কাছ থেকে পিস্তলের তিনটি গুলি ছোড়েন তাঁর বুক লক্ষ্য করে।
ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমী বলছিলেন, গুলি ছোড়ার আগে গডসে মি. গান্ধীর দিকে ঝুঁকে প্রণাম করেন।
স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা ১৭ মিনিটে মৃত্যু হয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর। মি. হাশমী বলছিলেন, গুলির পরে তাঁকে ঘরে নিয়ে আসা হলেও ধারণা করা হয় ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
গান্ধী হত্যার দায়ে মি. গডসেকে ১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
দিল্লির লালকেল্লায় গান্ধী হত্যা মামলার বিচার চলার সময়ে নাথুরাম গডসে নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি দেশভাগের জন্য মি. গান্ধীকেই দায়ী বলে মনে করতেন।
"গান্ধীজী দেশের জন্য যা করেছেন, আমি তাকে সম্মান করি। গুলি চালানোর আগে তাই আমি মাথা নীচু করে তাঁকে প্রণামও করেছিলাম," আদালতে বলেছিলেন নাথুরাম গডসে।
তার এক সহযোগী নারায়ন আপ্তেরও ফাঁসি হয়েছিল একই সঙ্গে।
গান্ধী, নেহরুদের প্রেম-যৌনতা নিয়ে ভারতে চর্চা মানা?
ভারতে গান্ধী-নেহরু বা বাজপেয়ীর মতো জাতীয় রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম বা যৌনতা নিয়ে লিখে তোপের মুখে পড়েছেন আম আদমি পার্টির নেতা ও প্রধান মুখপাত্র আশুতোষ।
দিল্লির যে মন্ত্রী যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বরখাস্ত হয়েছেন, তার সমর্থনে নিজস্ব ব্লগে আশুতোষ লিখেছিলেন, ভারতের সমাজ যদি গান্ধী-নেহরুর মতো জাতীয় নায়কদের সব সম্পর্ক মেনে নিতে পারে, তাহলে দুজন প্রাপ্তবয়স্কর মধ্যে নিজেদের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক হলে অসুবিধা কোথায়?
এরপরই কংগ্রেস ও বিজেপি একযোগে আশুতোষকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছে, জাতীয় মহিলা কমিশনও তাকে তলব করেছে।
গোটা ঘটনায় নতুন করে এই প্রশ্নটাই উঠে আসছে যে জাতীয় নায়কদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভারত কি মাথা ঘামাতেও রাজি নয়?
গত সপ্তাহে আম আদমি পার্টির সিনিয়র নেতা আশুতোষ লেখেন, "গান্ধীজি-র সঙ্গে সরলা চৌধুরী নামে এক মহিলার সম্পর্ক নিয়ে কংগ্রেস নেতারা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।"
"রবীন্দ্রনাথের দূর সম্পর্কের আত্মীয় সরলা-কে গান্ধী বলেছিলেন তার আধ্যাত্মিক স্ত্রী। এতে গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবাও ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েন, পরে কংগ্রেস নেতাদের চাপে গান্ধী সরলাকে ছাড়তে বাধ্য হন। আর তা ছাড়া দুই ভাইঝির পাশে নগ্ন হয়ে শুয়ে তার ব্রহ্মচর্য পরীক্ষার কথা তো সবারই জানা।"
প্রত্যাশিতভাবেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে কংগ্রেস। দলের টম ভারাক্কান বা অজয় মাকেনের মতো নেতারা আশুতোষকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি করেছেন।
গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটে গিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়ে এসে যে দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেই আম আদমি পার্টি কীভাবে তাঁকেই অপমান করার সাহস পায়, সে প্রশ্নও তুলেছেন তারা - এবং প্রতিবাদ করেছেন বিজেপি নেতা তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর চরিত্র হননেরও।
ওই একই ব্লগে নেহরুর সঙ্গে তাঁর অসংখ্য মহিলা সহকর্মী ও এডুইনা মাউন্টব্যাটেনের প্রেমের কথাও উল্লেখ করেছেন আশুতোষ।
বাজপেয়ী সম্পর্কে লিখেছেন, "পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন অবিবাহিত হলেও তিনি ব্রহ্মচারী নন - এবং কলেজ জীবনের বান্ধবীর সঙ্গে বাজপেয়ীর একসঙ্গে থাকা নিয়ে সমাজ কখনও আপত্তি তোলেনি।"
যথারীতি এতে ক্ষুব্ধ বিজেপিও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা মুখতার আব্বাস নাকভি বলছেন, "এগুলো মানসিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার প্রমাণ। যাদের দেশের ইতিহাস, ভূগোল, পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কোনও ধারণা নেই তারাই এগুলো বলতে পারেন।"
বিজেপি এমপি মহেশ গিরি আরও একধাপ এগিয়ে জাতির পিতা গান্ধীর অপমানের জন্য আশুতোষের গ্রেফতার দাবি করেছেন।
বিজেপি ও কংগ্রেসের রাগের আরও একটা কারণ, আশুতোষ এই সব মন্তব্য করেছেন যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত এক মন্ত্রীর হয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে - পরে যাকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হতে হয়েছে।
ভারতে জাতির পিতা গান্ধী-র সঙ্গে একজন ধর্ষণকারীর তুলনায় অত্যন্ত ক্ষিপ্ত গান্ধীর নাতি তুষার গান্ধীও।
তুষার গান্ধী বলছেন, "গোটা পরিস্থিতি না-জেনে, শুধু কোনও বই থেকে দুচারটে লাইন টুকে গান্ধীর চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্রহ্মচর্য নিয়ে বাপুর পরীক্ষা বা তার বিভিন্ন সম্পর্কর সঙ্গে বরখাস্ত হওয়া একজন মন্ত্রীর যৌন সম্পর্কের তুলনা টানা কতটা সঙ্গত দেশই তার বিচার করবে।"
তাহলে কি ভারত তার জাতীয় রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনও সমালোচনাতেই আগ্রহী নয়? দিল্লি ইউনিভার্সিটির প্রবীণ অধ্যাপক নির্মলাংশু মুখার্জির মতে উত্তরটা হ্যাঁ, আর তার কারণও আছে।
অধ্যাপক মুখার্জি বলছেন, "ভারতে রাজনীতি যত না ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি ইস্যুকেন্দ্রিক এবং মানুষঘেঁষা। তা ছাড়া একটা সামাজিক রক্ষণশীলতা তো আছেই। সাধারণভাবে রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত জীবনে ভূমিকা নিয়ে মানুষের আগ্রহটা ততটা নয়, যতটা তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে!"
পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে বুঝে আম আদমি পার্টিও ওই ব্লগকে এখন আশুতোষের ব্যক্তিগত মত বলে দূরত্ব বাড়াচ্ছে। আর স্পর্শকাতর ওই সব মন্তব্যের জেরে আশুতোষের রাজনৈতিক কেরিয়ারই এখন প্রশ্নের মুখে!
গান্ধীর নতুন জীবনী: 'শুধু আনন্দের জন্য' যৌনমিলনের বিরোধী ছিলেন তিনি
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চাইতেন - শুধু আনন্দের জন্য যৌনমিলন করাকে নারীরা যেন প্রতিরোধ করে। তাঁর মতে নর-নারীর যৌনসম্পর্ক হবে শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য যতটুকু দরকার - ততটুকুই।
একজন আমেরিকান জন্মনিয়ন্ত্রণকর্মী এবং যৌন শিক্ষাবিদ মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে ১৯৩৫ সালে মি. গান্ধীর যে কথোপকথন হয়েছিল - তার সম্প্রতি-প্রকাশিত বিবরণ থেকে এসব জানা গেছে।
সম্প্রতি মি. গান্ধীর এক নতুন জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যা লিখেছেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। এ বইতে নারী অধিকার, যৌনতা এবং কৌমার্য বিষয়ে গান্ধীর ভাবনা উঠে এসেছে। মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে গান্ধীর কথোপকথনের বিস্তারিত নোট নিয়েছিলেন গান্ধীর সচিব মহাদেব দেশাই।
তিনি লিখছেন: 'মনে হচ্ছিল দু'জনেই একমত যে নারীর মুক্তি হওয়া উচিৎ - তার নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হওয়া উচিৎ' - কিন্তু খুব দ্রুতই তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা গেল।
মিসেস স্যাঙ্গার ১৯১৬ সালের নিউ ইয়র্কে খুলেছিলেন আমেরিকার প্রথম পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। তিনি মনে করতেন, জন্মনিরোধকই হচ্ছে নারীর মুক্তির সবচেয়ে নিরাপদ পথ।
কিন্তু গান্ধী বললেন, পুরুষদের উচিৎ তার 'জান্তব কামনা'কে সংযত করা, আর নারীদের উচিৎ তাদের স্বামীদের বাধা দেয়া।
তিনি মিসেস স্যাঙ্গারকে বললেন, যৌনক্রিয়া করা উচিৎ শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্যই।
সে বছর ভারতের ১৮টি শহরে সফর করেছিলেন মিজ স্যাঙ্গার, কথা বলেছিলেন ডাক্তার ও কর্মীদের সাথে। কথাবার্তার বিষয়বস্তু ছিল - জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং নারীমুক্তি।
তিনি মহারাষ্ট্র রাজ্যে গান্ধীর আশ্রমেও গিয়েছিলেন, এবং সেখানেই তার সাথে মিজ স্যাঙ্গারের এই কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা হয়।
তবে গান্ধীর মতামত শুনেও মিসেস স্যাঙ্গার দমে গেলেন না। তিনি বিতর্ক চালিয়ে গেলেন।
"কিন্তু নারীরও তো গভীর যৌন অনুভুতি আছে, তারা পুরুষের মতোই গভীর এবং তীব্র" - তিনি বললেন, "এমন সময় আছে যখন নারীরাও ঠিক তাদের স্বামীদের মতোই শারীরিক মিলন চায়।"
"আপনি কি মনে করেন যে যখন একজন নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রেমে আবদ্ধ এবং সুখী, তখন তারা শুধু বছরে দু'একবার যখন সন্তান চাইবে তখনই যৌনমিলন করবে - এটা কি সম্ভব?" প্রশ্ন করলেন মিসেস স্যাঙ্গার।
তিনি যুক্তি দিলেন - "ঠিক এই ক্ষেত্রেই জন্মনিয়ন্ত্রণ খুবই সুবিধাজনক - যা নারীকে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা করবে এবং তার দেহের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।"
কিন্তু গান্ধী একগুঁয়েভাবে তার বিরোধিতা করতে থাকলেন।
তিনি স্যাঙ্গারকে বললেন, তিনি সব যৌনতাকেই 'কামনা' বলে মনে করেন।
গান্ধী বললেন, তার স্ত্রী কস্তুরবার সাথে তার সম্পর্ক তখনই 'আধ্যাত্মিক' হয়ে উঠেছিল যখন তিনি 'শারীরিক কামনার জীবনকে বিদায় দিয়েছিলেন।'
এগারোশ' উনত্রিশ পাতার এই বইয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শান্তিবাদী নেতার ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সাথে তার নিহত হওয়া পর্যন্ত সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে।
গান্ধী বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়েসে। এর পর ৩৮ বছর বয়েসে - যখন তিনি চার সন্তানের পিতা - তখন তিনি 'ব্রহ্মচর্য' বা যৌনসম্পর্কবিরহিত জীবনযাপন শুরু করেন।
গান্ধী নিজেই আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার পিতা যখন মারা যান - তখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে যৌনমিলন করছিলেন বলে পিতার পাশে থাকতে পারেন নি - এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করছিল।
অবশ্য, মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে কথাবার্তার শেষ দিকে গান্ধী তার সাথে কিছুটা একমত হলেন।
তিনি বললেন, পুরুষের স্বেচ্ছামূলক বন্ধ্যাকরণে তার আপত্তি নেই, কারণ পুরুষই মুখ্য ভুমিকা নেয়। তা ছাড়া গর্ভনিরোধক ব্যবহারের চাইতে প্রতিমাসে নারীর যে 'নিরাপদ সময়' থাকে তখন স্বামী-স্ত্রী যৌনমিলন করতে পারে।
মিসেস স্যাঙ্গারের এসব যুক্তি খুব পছন্দ হলো না। তার ভাবনাকে গান্ধী যে স্বীকৃতি দিলেন না এতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন।
তিনি পরে লিখেছিলেন, প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়া এবং অবাধ যৌনাচার সম্পর্কে গান্ধীর প্রচন্ড ভীতি আছে।
মি গান্ধীর দিক থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা অবশ্য এই প্রথম নয়।
তিনি একবার একজন নারী-অধিকার কর্মীকে বলেছিলেন: "আপনি কি মনে করেন যে জন্মনিরোধক দিয়ে শরীরের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব? নারীদের বরং শেখা উচিৎ কিভাবে তাদের স্বামীদের ঠেকাতে হয়। পশ্চিমা দেশের মতো গর্ভনিরোধক ব্যবহার করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, নারী আর পুরুষ বাঁচবে শুধু যৌনতার জন্য, তাদের মস্তিষ্ক হবে দুর্বল । নীতিবোধ ভেঙে পড়বে।"
'দি ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড' নামের বইটিতে রামচন্দ্র গুহ বলছেন, গান্ধী মনে করতেন যৌনতা হচ্ছে 'জান্তব কামনা' মাত্র, যা বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ এই জান্তব কামনাকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে।
এর অনেক বছর পর বঙ্গ প্রদেশের নোয়াখালীতে ভারত ভাগকে কেন্দ্র করে যথন ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছে - তখন গান্ধী এক বিতর্কিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি তার নাতনী এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী মানু গান্ধীকে বললেন, তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে।
তিনি চাইছিলেন এটা পরীক্ষা করতে যে তিনি তার যৌন আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছেন কিনা।
মি. গুহ লিখছেন, গান্ধী মনে করতেন - তিনি যে পরিপূর্ণ ব্রহ্মচারী হতে ব্যর্থ হয়েছেন তার সাথে ভারতের ধর্মীয় সংঘাতের একটা সম্পর্ক আছে।
তবে মানু গান্ধীকে নিয়ে ঘুমানোর পরীক্ষার কথা যখন গান্ধী তার সহযোগীদের বললেন, তখন তারা সতর্ক করেছিলেন যে তিনি যেন এটা না করেন এবং এতে তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।
একজন সহকারী বলেছিলেন, এটা দুর্বোধ্য এবং সমর্থনের অযোগ্য। আরেক জন এর প্রতিবাদে গান্ধীর সাথে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
স্পষ্টতই নারীদের সাথে গান্ধীর সম্পর্ক ছিল জটিল।
যে নারীরা পুরুষদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করে তাদের তিনি দেখতে পারতেন না। "আধুনিক চুলের স্টাইল এবং পোশাক সম্পর্কে তার ছিল তীব্র ঘৃণা।"
মানু গান্ধীকে তিনি লিখেছিলেন, তিনি মুসলিম নারীদের বোরকারও বিরোধী ছিলেন।
অন্যদিকে তিনি আবার নারীদের শিক্ষা, কাজ করার অধিকার এবং নারীপুরুষের সাম্যেরও সমর্থক ছিলেন।
তিনি নারীদের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন, সরোজিনী নাইডুকে কংগ্রেসের নেত্রী বানিয়েছিলেন - যখন পশ্চিমা দেশেও নারী রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন খুবই কম।
তবে গান্ধী এটাও মনে করতেন যে সন্তান লালন-পালন এবং গৃহকর্ম নারীদেরই কাজ।
তার একজন সহযোগী বলেছিলেন, তার মানসিকতা ছিল অনেকটা মধ্যযুগের খ্রীষ্টান সন্তদের বা জৈন সাধুদের মত।
ইতিহাসবিদ প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, গান্ধীর চিন্তাধারা প্রাচীন হিন্দু দর্শনে প্রোথিত মনে হলেও, আসলে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রতিভূ।
রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, আজকের মাপকাঠিতে বিচার করলে গান্ধীকে রক্ষণশীল বলা যায়, তবে তার নিজ সময়ের বিচারে তিনি নি:সন্দেহে প্রগতিশীল ছিলেন।
লিংক : https://tinyurl.com/y979p45w