কোন আইনের ভিত্তিতে আম নষ্ট করা হচ্ছে ?
বর্তমানে এমন অবস্থা হয়ে গেছে, ঝড়ে অনেক এলাকায় আম পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই আম পচে নষ্ট হয়ে গেলেও কেউ হাত দিচ্ছে না। কারণ- কাচা আমে হাত দিলে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। নওগাতে ঝড়ে আম পড়ে যাওয়ার পর সেই আম ১ টাকা কেজিতেও কেউ কিনতে চাইছে না। (
https://bit.ly/2MoHUtd)
বাজারে আসলে প্রশাসন ধরবে, এই ভয়ে বাগানগুলোতে কত আম নষ্ট হচ্ছে তার সঠিক হিসেব কারো কাছে নেই।
কিন্তু তারপরও অভিজান পরিচালনাকারী ম্যাজিস্টেটরা বলছেন ভিন্ন করা। যেমন-
দৈনিক প্রথম আলোর খবরে-
“ মিরপুরে ২ হাজার কেজি আম ধ্বংস করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী হাকিম নিজাম উদ্দিন আহমেদ। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের জন্য অপরিপক্ব ল্যাংড়া আম নির্ধারিত সময়ের আগেই পেড়ে রাসায়নিকে পাকিয়ে বাজারজাত করছেন। রাসায়নিকে পাকানো এই আম মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।” (
https://bit.ly/2VTrgRE)
জাগো নিউজের খবর-
“আশুলিয়ায় ১৬০০ কেজি আম ধ্বংস করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজোয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ জানান, এ আমগুলো দেখতে পরিপূর্ণ পাকা হলেও এগুলো ভেতরে পুরোপুরিভাবে কাঁচা। কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হয়েছে। যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।” (
https://bit.ly/2EwbHd2)
পাঠক !
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কেউ ফল বিশেষজ্ঞ নয়। বিজ্ঞানীও নয়।
সবাই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এডমিন ক্যাডারে আসছে।
তারা বলছে রাসায়নিক পাকানো আম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
অথচ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের গবেষকরা বলছে- কেমিকেল দিয়ে পাকানো আম বিষাক্ত নয়। (
https://bit.ly/30JAq6S)
এই যে একটা গ্যাপ- এটা কেন ? এটা আগে দূর করা দরকার।
কারণ আমরা সারা দিন বিজ্ঞান বিজ্ঞান করে লাফাই।
কিন্তু নিজেরাই বিজ্ঞান মানি না, অবৈজ্ঞানিকভাবে হাজার হাজার কেজি আম বুলডোজার দিয়ে পিশে ফেলা হচ্ছে, এটা কেমন কথা ?
একটা আম যদি অপরিপক্ক হয়, সেটা তো বিষাক্ত নয়।
তবে সেটা বুল ডোজার দিয়ে কেন পিষে ফেলতে হবে ?
খাবার নষ্ট করার অধিকার তো কাউকে দেয়া হয়নি।
দেশের বহু মানুষ খাদ্যে অভাবে কষ্ট পাচ্ছে, সেখানে বুলডোজার দিয়ে টনকে টন খাবার নষ্ট করা হচ্ছে, এটা কেমন কথা ?
অনেক সময় প্রশাসন জাটকা মাছ আটক করে, জাটকা মাছ তো অপরিপক্ক,
সেটা তো বুল ডোজার দিয়ে পিষে ফেলে না,
তাহলে আমকে কেন পিষে ফেলতে হবে ?
আসলে এই যে আমগুলো ধ্বংষ করা হচ্ছে, তার পেছনের দুটি আইন সব সময় দেখানে হয়।
১) ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৪২ ধারা। যেখানে বলা আছে-
“মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোন দ্রব্য, কোন খাদ্য পণ্যের সহিত যাহার মিশ্রণ কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, কোন ব্যক্তি উক্তরূপ দ্রব্য কোন খাদ্য পণ্যের সহিত মিশ্রিত করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।” (
https://bit.ly/2HBsKw1)
২) ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৪৫ ধারা। যেখানে বলা আছে-
“কোন ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।” (
https://bit.ly/30NLOyy)
প্রথম আইনটি দেখিয়ে দাবী করা হয়, কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো আম। এই আম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই ধ্বংস করা হচ্ছে।
এবং দ্বিতীয় আইনটি দেখিয়ে দাবী করা হয়, এই আমগুলো অপরিপক্ক। অপরিপক্ক আম পাকানো হয়েছে, তাই সেটা ধ্বংস করা হচ্ছে।
বর্তমানে র্যাব বা ভ্রাম্যমান আদালত যারাই এই আইনের দোহাই দিয়ে আম ধ্বংস করতেছে, আইন অনুসারেই সেটা শুদ্ধ হচ্ছে না। আবার এই আইনের (৪২ ধারা) মধ্যেই ফাক আছে। যদি বাংলাদেশের হাইকোর্ট নিজেই পলুটেড না হতো, তবে সেখানে রিট করে এইসব অভিজান বন্ধ করে দেয়া সম্ভব ছিলো।
বিশেষ করে ৪২ ধারার মধ্যে আছে ‘ক্ষতিকারক পন্য মিশ্রণ খাদ্যের সাথে’।
অথচ খাদ্য উপযোগী যে কোন পণ্য বানাতে ক্ষতিকারক বা বিষাক্ত কেমিকেল প্রয়োজন লাগতেই পারে। প্রায় সব ওষুধ তৈরী করতে সালফিউরিক এসিড লাগে। এখন সালাফিউরিক এসিড এমনি খেলে তো একজন মানুষ সাথে সাথে মারা যাবে।
আবার ফসলে কিটনাশক স্প্রে করা হয়। অথচ কীটনাশক এক ধরনের বিষ, কেউ খেলে সে সাথে সাথে মারা যাবে। কিন্তু তারপরও পোকা মাকড় দমনে সেটা ব্যবহার সিদ্ধ।
কথা হলো, ঐ কেমিকেল ব্যবহার করার পর ফলটি নিজে বিষাক্ত হলো কি না ?
যদি হয়, তবে ঠিক আছে। কিন্তু ঐ কেমিকেল প্রয়োগের পর ফল যদি বিষাক্ত না হয়, তবে ঐ ফল ধ্বংসের কোন অধিকার থাকতে পারে না।
আম ধ্বংসে অভিজানগুলো কিভাবে পরিচালিত হয় ?
প্রথমে প্রশাসনের লোকরা একটি আড়তে গিয়ে আম বাহ্যিক পরীক্ষা করে। যদি আমের ছিলকা হালকা হলুদ হয়, কিন্তু ভেতরে আটি নরম থাকে তখন তারা ব্যবসায়ীকে র্যাব-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট মিলে ঘিরে ধরে। এবং জোর করে মৌখিক স্বীকৃতি আদায় করে- “সে এই আমে অমুক অমুক রাসায়নিক মিশিয়েছে”। এরপর সেই স্বীকৃতি মিডিয়ার লোককে ডেকে এনে ক্যামেরার সামনে দিতে বাধ্য করে। এবং এই স্বীকৃতির ভিত্তি করেই ঐ আম ব্যবসায়ীর ফসল ধ্বংস করা হয় এবং জেল-জরিমানা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কেমিক্যাল মেশানোর দৃশ্য তারা সরাসরি দেখে না এবং ফলগুলো পরীক্ষা করার কোন সিস্টেম তাদের কাছে নেই যে, আদৌ ফলগুলো বিষাক্ত না পুষ্টিকর। (১১:৩০ থেকে শুনুন-
https://bit.ly/2X8tv4X)
কথা হলো, যদি ঐ ফলের মধ্যে বিষাক্ত কিছু পরীক্ষা তারা নাই করে, তবে কোন যুক্তিতে তারা ফলগুলো ধ্বংস করে এবং মিডিয়ার সামনে কিভাবে বলে, এ ফলগুলো বিষাক্ত ? যদি সম্ভব হয়, তারা একটি ভ্রাম্যমান ল্যাব সাথে নিয়ে যাক, বা সেখান থেকে কিছু নমুনা এনে পরীক্ষা করে দেখুক, সেখানে বিষাক্ত কিছু আছে না ? সেটা না করে তাৎক্ষণিক কয়েক মিনিটের পরীক্ষায় এভাবে ফল ধ্বংস করে দেশ-বিদেশে আমাদের আম শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ফেলছে খোদ সরকার ও প্রশাসনই।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতিদিন ৬ লক্ষ কেজি শুধু আপেল আমদানি করা হয়। এছাড়া আঙ্গুর, কমলা, মাল্টা প্রচুর পরিমাণে আমদানি করা হয়। ২০১৭ সালের হিসেবে এই আমদানি করা ফলের আর্থিক মূল্য ছিলো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। (
https://bit.ly/2WnniFn)
এই সব আমদানি করা ফলের উপর দৃশ্যতই কিন্তু ওয়াক্স (মোম পলিশ) দেখা যায়। ওয়াক্সের কারণে আপেল-আঙ্গুর চক চক করে এবং এগুলো ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা পায়। রাসায়নিক দিক বিবেচনা করলে ওয়াক্স বা মোম কিন্তু শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং দীর্ঘদিন এই ওয়াক্স সমৃদ্ধ ফল খেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। যদিও ফলগুলো ধুলে খেলে ওয়াক্স দূরীভূত হয়। কিন্তু কথা হলো, যেই ভোক্তা আইনের ৪২ ধারা মোতাবেক দেশী ফলগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে, সেই ৪২ ধারা দিয়েই কিন্তু বিদেশী ফলগুলো ধ্বংস করা যায়, যদিও সেটা কখনই করা হয় না।
পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার আইনের ৪৫ ধারা দেখিয়ে অপরিপক্ক দাবী করে আমগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। এখানেও আইন ও তার প্রয়োগের মধ্যে গ্যাপ আছে। যেমন আইনে বলা আছে ‘প্রদত্ত মূল্য’। এখানে মূল্যটা কিন্তু ফ্যাক্টর। আমের মূল্য কি ফিক্সড থাকে নাকি দরদাম করে কমবেশি করা যায় ? যদি ফিক্সড থাকতো, তবে ৪৫ ধারা অনুসারে এটাকে বিতর্কিত করা যেতো, কিন্তু আমের মূল্য তো ফিক্সড নয়, কোন গ্রাহক আম বাহ্যিক চোখ দিয়ে (প্রয়োজনে দুই একটা আম কেটে) পরীক্ষা করার সুযোগ পান। এখানে অভিজান যারা পরিচালনা করতেছে আর গ্রাহকের মধ্যে তফাৎ তো খুব একটা বেশি না। যদি আম খারাপ হয়, তবে সে কমমূল্য দিবে, সে সুযোগ তো অবশ্যই আছে।
আমি দেখলাম- ভোক্তা অধিকার আইন শুধু গরীব ব্যবসায়ীদের জন্য।
কিন্তু রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ীদের কখনই এই ভোক্তা অধিকার আইন দিয়ে ধরা হয় না।
যেমন- ভোক্তা আইনের ৪৪ ধারায় বলা আছে- “ কোন ব্যক্তি কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।” (
https://bit.ly/2K3t0FL)
অথচ লাক্সে বিজ্ঞাপনে প্রতিনিয়ত দেখাচ্ছে- লাক্স সাবান ব্যবহার করে মেয়েরা ফর্সা হয়, বিশ্বসুন্দরী হয়, চাকুরী পায়, আরো কতকিছু।
কোথায় ? তখন লাক্স বা ইউনিলিভারকে জরিমানা বা লাক্স সাবান ধ্বংস করতে কেউ দেখেছেন ?
মিডিয়াগুলো সেই অসত্য নিউজ প্রচার করে টাকা লুটছে, অথচ তারা কখনই লাক্সের বিরুদ্ধে নিউজ করছে না।
এই জন্যই বলে, আইন শুধু গরীবের জন্য, বড়লোকের জন্য আইন নেই।
আম বিষাক্ত না হলেও হাজার হাজার কেজি আম ধ্বংস করে সেটাই প্রমাণ হয়।