সন্তু লারমাদের তৎপরতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি - ১
Image result for উপজাতি সন্ত্রাসীসন্তু লারমাদের তৎপরতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি - ১


১৯৭৫ সালে ৩টি ক্যান্টনমেন্ট স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। ১৯৭৫ সালের শেষাংশে সন্তু লারমা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে যখন শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে তখন ধীরে ধীরে সেখানে সেনাবাহিনীর মোতায়েনের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন দেশের দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৫ পরবর্তী খন্দকার মোশতাক সরকার। অতঃপর বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েম।

যে পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েন হয়েছিল সে পরিস্থিতি সাধারণ রাষ্ট্রনীতির ভাষায় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অঙ্গ, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের ভাষায় বলা যায় ইন্সারজেন্সী। ইন্সারজেন্সী শব্দটি ইংরেজি। এটার হুবহু বাংলা শব্দ নেই এবং ইন্সারজেন্সি শব্দের বিপরীত যে শব্দ সেটি হলো কাউন্টার ইন্সারজেন্সি। ব্যাখ্যার জন্য শুধু এটুকু বলা যায় যে, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছিল তাদের কিছু দাবী এবং অধিকার আদায়ের জন্য। পৃথিবীর সব জায়গায় সাধারণত যেমনটি হয় পার্বত্য চট্টগ্রামেও তেমনটি হয়েছিল। অর্থাৎ একদিনে দাবীগুলো প্রকাশিত হয়নি, একদিনে সংঘর্ষও ব্যাপক হয়নি, একদিনে সমাধানও আসেনি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জনমতকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার অন্যায়, অযৌক্তিক ও অসাংবিধানিক তথাকথিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। পার্বত্য রাজনীতির প্রবীণ পুরুষ, জেএসএস এবং আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন না ঘটলেও বেশিরভাগ শর্ত বা ধারা বাস্তবায়িত করছে বাংলাদেশ সরকার। স্মরণযোগ্য যে, দেশবাসী তথা পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙ্গালীদের দাবির প্রেক্ষিতে পরে ক্ষমতাসীন বিএনপি চুক্তি স্বাক্ষরকালে এর বিরোধিতা করে তা বাতিলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল। আভিধানিক অর্থে এর নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ হলেও সস্তা বাহাবা লাভের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একে শান্তি চুক্তি বলেও প্রচারণা চালানো অব্যাহত রয়েছে। উক্ত চুক্তির শর্তানুসারে পাহাড়ে শান্তি ও উন্নতির লক্ষ্যে যে পরিবেশ পাবার আশা ছিল বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি।

তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৮ লাখ বাংলাভাষী নাগরিকদের মানবাধিকার ও সমঅধিকারের কোন নিশ্চয়তা উক্ত চুক্তিতে রাখা হয়নি। লারমাদের জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ এর হাতে বহু বে-আইনী অস্ত্র আছে, যার দ্বারা পাহাড়ে চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, সন্ত্রাস, ডাকাতি প্রভৃতি অপকর্ম চলছে। সাধারণ মানুষ ওদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। ফলে চুক্তিটি সম্পূর্ণ একপেশে, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানেক চুক্তি বলে জাতির সামনে প্রস্ফুতি হয়েছে।

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ নেতা প্রসিত বি খীসার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সাথেও চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের টাকা ও আধিপত্য নিয়ে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলছে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। এই সংঘর্ষ, ক্রসফায়ার, দলীয় আধিপত্য ইত্যাদির কারণে পার্বত্যবাসী বাঙ্গালী ও উপজাতীয়দের স্বাভাবিক জীবন ওষ্ঠাগত, ব্যাহত ও সংকটময় হয়েছে।

সন্তু লারমা আজ নিজেই স্বঘোষিত শান্তি চুক্তির শর্ত ও ধারাগুলো একে একে অমান্য করে চলছেন এবং কৌশলে বাংলাদেশ সরকারকেই চুক্তি বাস্তবায়নের আবদার করছেন। তার স্ববিরোধী ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ভূমিকা’ দেশবাসী বুঝতে পারছে। সন্তুর ভাবী এবং পুত্র তাই ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তিকে সংগঠিত করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। ভারতে এজন্য ৩৯টি ক্যাম্পও তারা স্থাপন করেছে। চুক্তির যেসব দিক অতীতে এবং বর্তমানে জনসমক্ষে ধরা পড়ছে তা হলো:

১) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিনিময়ে বাঙ্গালীদের সকল মানবাধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালীদের ভূমির অধিকার, ভোটের অধিকার, বর্তমানে ৩টি সার্কেল চীপ, উপমন্ত্রী, ৩টি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান, টাস্কফোর্স কমিটির চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়াবার অধিকার ইত্যাদি খর্ব করার সাথে সাথে সকল ক্ষমতা উপজাতীয় নেতাদের হাতে দেয়া হয়েছে, সাধারণ উপজাতীয়রা বঞ্চিত ও শোষিত হচ্ছে।

২) পার্বত্য চুক্তির বদৌলতে ৩০ হাজার বাঙ্গালীর ঘাতক সন্তু লারমা ও তার সঙ্গীদের সকল হত্যাকান্ডের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। লারমাকে সরকারের প্রতিমন্ত্রীর সমমর্যাদায় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ (আরসি) চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়েছে। তাছাড়া জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতাদেরকে ক্ষমতাশালী (আরসি) সদস্যপদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ২ হাজার উপজাতি বিদ্রোহীকে (শান্তি বাহিনী) পুলিশে চাকরি দেয়া হয়েছে।

১ লাখের মতো পাহাড়ী শরণার্থীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে স্ব স্ব ভূমিতে পুনর্বাসন করা হয়েছে। কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে লারমা ও তার সঙ্গীদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। দাতা সংস্থা ইউএনডিপি, এডিবি, বিশ্বব্যাংক, ইইসি একতরফাভাবে লারমার নির্দেশমতো বিদেশী সাহায্য ব্যয় করছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু অতীব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও সংস্থাকেও লারমার কথা মতো পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে নিয়ন্ত্রণভূক্ত করা হয়েছে।

৩) লারমা সরকারের অংশ হয়েও নিজেই বহুবার হরতাল-অবরোধ ডেকে পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির ইন্ধন দিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের প্রতি আনুগত্য বিরোধী বিভিন্ন কুটূক্তি করেছেন। লারমা বিবিনিউজকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জোট সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন তো করছেই না, উপরন্তু চুক্তি বিরোধী নানা কর্মকান্ড করেই চলেছে।’ তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

জোট সরকারের মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ সরকার আর চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না। ঢাকায় আঞ্চলিক পরিষদের রেষ্ট হাউসে আলাপচারিতায় তিনি জাতীয় ও পার্বত্য রাজনীতির নানা দিক তুলে ধরেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে জাতীয় রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছি। যতদিন দেশে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িকও গণমুখী সরকার প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে ততদিন জুম্ম (পাহাড়ী) জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। তিনি আরও বলেন, মার খেতে খেতে পাহাড়ীদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। জুম্ম জাতি রুখে দাঁড়াবেই।

সকলেই অধিকার রয়েছে মানুষের মতো বাঁচার। সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আমরা বিগত শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে (১৯৯৬-২০০১ সাল) শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলাম। সে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের একটি অংশের বিরোধিতার কারণে ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা, অস্থায়ী নিরাপত্তা ছাউনি প্রত্যাহারসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে (২০০১-২০০৬) শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করবে বলে ঘোষণা করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের সে ঘোষণা বাস্তবায়নে কোন সততা বা আন্তরিকতা কোনটাই আমরা দেখছি না।

তিনি আরও বলেন, এ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নবিরোধী কাজ করেই চলেছে। চুক্তিতে রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন পাহাড়ী পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া পাবর্ত্য উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা একজন পাহাড়ীর। অথচ মন্ত্রণালয়ে একজন উপমন্ত্রী নিয়োগ করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান পদে একজন অপাহাড়ীকে নিয়োগ করা হয়েছে। উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে পাহাড়ীদের জমিজমা দখলের জন্য, কর্মকান্ড চলছে পাহাড়ী স্বার্থের বিরুদ্ধে। (সূত্রঃ দৈনিক জনকন্ঠ ২৬ মার্চ ২০০৫)

৪) লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্মল্যান্ড বানাতে চান। উপজাতি না বলে নিজেদেরকে বলছেন জুম্মজাতি। জনসংহতির অপর নাম ছিল ‘জুম্ম লিবারেশন আর্মি’। তাদের পত্রিকার নাম ছিল ‘জুম্ম নিউজ বুলেটিন’, ‘জুম্মকণ্ঠ’ প্রভৃতি। অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে ‘বাংলাদেশী কিংবা বাঙ্গালী’ কোনটিতেই পরিচয় দিতে রাজী নন। লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের কোনরূপ ভূমি অধিকার নাই বলেও প্রকাশ্যে দম্ভোক্তি করেছেন। যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল।

৫) চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাংক, হাসপাতাল, অফিস-আদালত ইত্যাদিতে ঢালাওভাবে সমতল থেকে কর্মরত উপজাতীয়দেরকে বদলী/পোস্টিং দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে, বাংলাভাষী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে নানা অজুহাতে পার্বত্যাঞ্চল থেকে সমতলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথবা তাদের হুকুম তামিলে বাধ্য করা হচ্ছে।

৬) জনসংহতি সমিতি পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবীর পক্ষেও জনমত সংগঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও মিডিয়ার একাংশে একপক্ষীয় প্রচারণা চালিয়ে এই মহলটি যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশের জনগণের কাছে ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছে তেমনি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারেও উঠেপড়ে লেগেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৫ রাঙামাটিতে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, এ পর্যন্ত সেখান থেকে মাত্র ৩১টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরিস্থিতি সহায়ক না হওয়ার পরও চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সেখান থেকে ১৫২টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর যে ৬টি স্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে তারও প্রত্যাহার চায় জনসংহতি সমিতি ও কতিপয় বুদ্ধিজীবী।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন জেএসএ-এর কথিত সন্ত্রাস দমন কমিটি বা সদক ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ইউপিডিএফসহ অপরাপর আরো কয়েকটি গোষ্ঠীর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও চাঁদাবাজির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মাঝেই পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী রকেট লাঞ্চারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। এরকম অস্ত্র বিবদমান দলগুলোর কাছে আরো রয়েছে।

কারণ ১৯৯৭ সালে শান্তিবাহিনীর যে ১ হাজার ৯৪৯ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করেন তারা সে সময় জমা দেন মাত্র ৮৭২টি অস্ত্র। এর বেশীরভাগই ছিল আবার পুরনো ও অচল। শান্তিবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও তাদের অনেক সদস্যই অস্ত্র জমা দেননি। এখন যেসব অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে সেগুলো এই জমা না দেয়া অস্ত্রই। পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হলে সেখানে যেমন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি যে কোন মুহূর্তে একটি গ্র“প সশস্ত্র সংগ্রামের পথও বেছে নিতে পারে। (সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ২২ মার্চ ২০০৫)

এদিকে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই এর পক্ষে জনসংহতি সমিতি ও সমমনা পাহাড়ী বনাম চুক্তির বিপক্ষে অবস্থানকারী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এর নেতৃত্বে উপজাতীয়দের গ্র“পগুলো ক্রমাগতই পরস্পর মারমুখী হতে দেখা গেছে। বেপরোয়া চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লুটপাট, রাহাজানি, খুন, চোরাগোপ্তা হামলা, অপহরণ ও জিম্মি করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়সহ মারাত্মক অপরাধবৃত্তিতে মেতে আছে সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ী এসব সংগঠন এলাকাওয়ারী আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিনিয়ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ক্যাডার, গোপন তহবিল সংগ্রহের প্রতিযোগিতা করছে পরস্পরকে পাল্লা দিয়ে।

তিন পার্বত্য জেলা দুর্গম ও অচিহ্নিত সীমান্ত পেরিয়ে আসা অবৈধ ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র হাত বাড়ালেই পেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। চলছে মাদকদ্রব্যের আবাদ ও চোরাচালান। প্রতিবছর সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণ আদায়ের পরিমাণ কোটি টাকা। অব্যাহত সন্ত্রাস নৈরাজ্যের কারণে পার্বত্য জনপদে স্থবিরতা ও হতাশা বিরাজ করছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম। পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা চাপা পড়েছে। চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষের বিবদমান সংগঠন বা গ্র“পগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উম্মোচনের জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসমর্থন আকর্ষণের চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রতিপক্ষের হিংসাত্মক পন্থায় মোকাবিলা করে যাচ্ছে। এর ফলেই পার্বত্য অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, পারস্পরিক ভীতি-সন্দেহ-অবিশ্বাস বর্তমান নাজুক অবস্থায় ঠেকে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয় ও অউপজাতীয় সবাইকে একটি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার আগে কেন এ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে তা বিবেচনা করা উচিত। সরকার বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন কারণ এটি একটি গোলযোগপূর্ণ এলাকা। গোলযোগপূর্ণ এ কারণে যে, এখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহিংস তৎপরতা সাধারণ জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে এবং সে কারণেই নিরাপত্তা বাহিনীকে মোতায়েন রাখতে হয়েছে। পার্বত্য জেলাসমূহের জন্য সরকারের দেয়া অনুদান ও বরাদ্দ যদিও অনেক ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে দমিয়ে রাখছে তবুও দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সংরক্ষণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এ আত্মত্যাগ সদিচ্ছার পরিচয় বহন করবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একটি অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভারতের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। সন্ত্রাসী অপতৎপরতার উদ্ভব, বিস্তার এবং এর গতিধারা নিয়ন্ত্রণে ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে আসছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি বলেও বিস্তৃত পরিসরে প্রচারণা শুরু হয়েছে যেখানে বিদেশীদের বলা হচ্ছে যে, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আগ্রহী নয় ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয অর্থও বরাদ্দ দিচ্ছে না। অথচ বাস্তব অবস্থা হচ্ছে পার্বত্য এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয় শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর আওতায়। এর বাইরে অনেক এনজিও ও দাতা সংস্থা কোটি কোটি ডলারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, হাসপাতালসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের পরিসংখ্যানও যদি দেয়া যায় তাহলেও দেখা যাবে দেশের অনেক এলাকার চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়েছে তুলনামূলক বেশী।

আশির দশকে চাকমা উপজাতীয়দের মধ্য থেকে তৈরি শান্তি বাহিনী ভারতীয় যোগসাজশে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে হত্যা, সন্ত্রাস ও অপহরণের রাজত্ব কায়েম করেছিল সেটা ভিন্ন নামে এখনও টিকে আছে। সেই সময় তারা ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশীকে হত্যাসহ এক নারকীয় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। জনসংহতি সমিতির অ-উপজাতীয় বাংলাভাষী নাগরিকদের খুনি শান্তি বাহিনীর হত্যা, সন্ত্রাস ও অপহরণ থেকে বাঁচানোর জন্য ১৯৮৬ সালের দিকে সেখানে বাঙ্গালী নাগরিকদেরকে তাদের জমিজমা ঘরবাড়ি থেকে উঠিয়ে এনে নিরাপত্তার নামে গুচ্ছ গ্রামে জমা করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের গুচ্ছগ্রামগুলোতে লাখ লাখ বাঙ্গালী নাগরিক গুচ্ছগ্রামের কুড়ে ঘরে সেই ১৯৮৬ সাল থেকে বসবাস করছে। ২৯ বছরে তাদের সন্তান-সন্ততি বেড়েছে পরিবার বড় হয়েছে কিন্তু কুঁড়েঘর বড় হয়নি। কার্যত তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও বন্দি জীবন যাপন করছে। ফিলিস্তিন উদ্বাস্তুদের চেয়েও খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের সংবিধান পরিপন্থী ধারা এ চুক্তিতে সন্নিবেশিত থাকার পরেও সরকার ধীরে ধীরে এ চুক্তির বাস্তবায়ন করছে। চুক্তি বাস্তবায়নের ফলস্বরূপ সন্তু লারমা স্বয়ং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ তারই প্রত্যক্ষ মদদে চলছে জেএসএস’র সন্ত্রাসী কর্মকান্ড।

প্রতিনিয়ত ঘটছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যার ন্যায় জঘন্য ঘটনা এবং দলীয় শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অস্ত্র ক্রয়সহ সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ চলছে পুরোদমে। বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে এবং অপপ্রচার করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেই চলেছেন। সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি প্রায়শঃই বিভিন্ন ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবী-দাওয়া তুলে ধরেন।

২০০৬ সালের ২৬ মার্চ সিরডাপ মিলনায়তনের এক আলোচনা সভায় সন্তু লারমা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এ হুমকিতে চারদলীয় জোট সরকার নতি স্বীকার করেনি। এমনকি ২ বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সন্তু লারমাদের দাবি পূরণ করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। অবশেষে রাজি হলেন আওয়ামী লীগ সরকার। শান্তি চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবশিষ্ট বাংলাদেশ থেকে কার্যত একটা আলাদা অস্তিত্ব দিয়েছে।

এখানে অ-উপজাতীয় নাগরিকদের নাগরিক অধিকার অসাংবিধানিকভাবে খর্ব করা হয়েছে। জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে তাদেরকে বৈষম্যের শিকার করা হয়েছে। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর পর ৬০ হাজার চাকমা উপজাতিকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কিন্তু গুচ্ছগ্রামের ৫৩ হাজার অ-উপজাতীয় পরিবারের লাখ লাখ মানুষকে তাদের বাড়িঘর, জমিজমা ফেরত দেয়া হয়নি।

এই অবিচার শুধু অ-উপজাতি নাগরিকদের প্রতি নয়, এটা আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান এবং বাংলাদেশী জনগণের প্রতি জুলুম। ওই চুক্তির ধারাবাহিকতায়ই সরকার পরে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বলা ভালো জনসংহতি সমিতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর বার বার চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের দাবি করে আসছিল। যদিও সেনা প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা সন্তু লারমাকে এতটুকুও খুশি করতে পারেনি। বললেন, এটা এক ধরনের ‘ধোকাবাজি’। তিনি দাবি করেছেন, যেভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে, তা সঠিক নয়। শুধু অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। তার দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, সেনা প্রত্যাহার করা হলে সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি ঘটবে না।

অথচ তিনি যেদিন সংবাদ সম্মেলন করেন (৫ আগস্ট ২০০৯) সেদিনই খবর আসে বান্দরবানে অপহৃত ব্যবসায়ী ফারুক আহমদ মুক্তি পেয়েছেন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করেছিল। এরই মধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত পাহাড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বেশ কটি রাজনৈতিক দল এই সিদ্ধন্তের সমালোচনা করেছে। পাহাড়ি এলাকায় বাঙ্গালীরা মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেখানে পাহাড়িদের মাঝে যে দ্বন্দ্ব, তা থেকে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর শান্তিবাহিনী নামে কোনো সংগঠন নেই এবং তারা অস্ত্র সমর্পণের নাটক করেছিল, এটা ঠিক। কিন্তু শান্তিবাহিনীর মূল সংগঠন জনসংহতি সমিতির সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পুরোদমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে। বিভিন্ন কাজকর্মের প্রকাশ ও তথ্য থেকে এ বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত যে:
(১) এই সংগঠনটি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে,
(২) এ সংগঠনটি অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে চাঁদা, অপহরণসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক লাভজনক কর্মকান্ডে লিপ্ত আছে,
(৩) সংগঠনটি গোপনে উপজাতীয় যুবক সম্প্রদায়কে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে,
(৪) সংগঠনটি বহিঃবিশ্বে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে।

২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি থেকে ২৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে-এ ধরনের সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে লেখালেখি কম হয়নি। মুলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব অবস্থার দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ব্যাপক সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ অবিবেচক একটি সিদ্ধান্ত। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে- পার্বত্য অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার বড় ধরনের এ সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ৩১ জুলাই ২০০৯)
সন্তু লারমাদের তৎপরতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি - ২
Image result for উপজাতি সন্ত্রাসীসন্তু লারমাদের তৎপরতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি - ২
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে সংবিধান ও দেশের সব মানুষের জন্য মৌলিক মানবাধিকার পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে পৃথকভাবে দুটি রিট মামলা দায়ের করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনৈক অধিবাসী বদিউজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম। ২০০০ সালে ও ২০০৭ সালে দায়ের করা রিট আবেদন দুটি গ্রহণ করে হাইকোর্ট ‘কেন শান্তিচুক্তিকে সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে এর কার্যকারিতা বাতিল করা হবে না’ মর্মে কারণ দর্শানের জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করেন।

এ রুলের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই সরকার ২০০৯ সালের জুলাই মাসে পার্বত্য জেলাগুলো থেকে কয়েক ব্যাটেলিয়ন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে। রুল নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকার এ সেনা প্রত্যাহার কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণার প্রার্থনা জানিয়ে হাইকোর্ট পৃথকভাবে তারা দুটি আবেদন করেন। এ আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৯ আগস্ট ২০০৯ পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। সেনা প্রত্যাহার সংক্রান্ত এ আবেদনের ওপর পর পর দু’দিন শুনানি হয়।


শুনানিতে আবেদনকারীর পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সেনা প্রত্যাহার সরকারের একটি নির্বাহী সিদ্ধান্ত। এর বিরুদ্ধে আদালত আদেশ দিতে পারেন। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য ওই এলাকার অধিবাসীরা সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকুক এটাই চায়। পার্বত্য এলাকা নিয়ে ষড়যন্ত্র নতুন নয়। ওই এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার ষড়যন্ত্রের নতুন মাত্রা কিনা তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেন। পার্বত্য জেলাগুলোতে অব্যাহত হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অ-উপজাতীয়দের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ওই স্থান থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিলে আবার আগের অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইতোমধ্যেই কিছু কিছু ঘটনা ঘটছে। সর্বস্তরের ও সব সম্প্রদায়ের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্যই সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা অতি জরুরি। শুনানীতে জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদসহ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়ে ড. কামাল বলেন, সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার একটি দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়া। বিষয়টিকে আমাদের সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। পার্বত্য এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার হলে দেশের ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে না।

এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পার্বত্য চুক্তির অনেক দিকই কার্যকর হয়ে গেছে। সেনা প্রত্যাহার নিয়ে পার্বত্য এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যই এর বিরুদ্ধে আবেদন করা হয়েছে। আবেদনকারীদের আইনজীবী ব্যারিষ্টার মওদুদের দল বিএনপি এবং ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাকের দল জামায়াতে ইসলামী পার্বত্যাঞ্চলে সেনা প্রত্যাহারের বিরোধিতা করছেন।

রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবেই এ আবেদন সৃষ্টি করা হয়েছে। এ আবেদন গ্রহণ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া সরকার পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করছে না। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নেয়া হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নাই। আদালত সব পক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে আবেদন দুটি খারিজ করে দেন এবং মুল রিটের ওপর ২২ অক্টোবর শুনানির তারিখ ধার্য করেন।

২০ আগষ্ট ২০০৯ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দাখিল করা আবেদন দুটি খারিজ করে দেন। সেই সঙ্গে আদালত পার্বত্য শান্তি চুক্তির সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনের ওপর ২২ অক্টোবর ২০০৯ শুনানির তারিখ ধার্য করেন।

হাইকোর্ট তার আদেশে উল্লেখ করেন, পার্বত্যাঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার নয়, ক্যাম্প স্থানান্তর হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে সেনাবাহিনীকে পার্বত্যাঞ্চলেই ব্যাটলিয়ন হেডকোয়ার্টারে নেয়া হচ্ছে এটা সেনা মোতায়েনেরই অন্তর্ভুক্ত। এটা সেনা মোতায়েনের সংজ্ঞার পরিপন্থীও নয়। তাছাড়া এ বিষয়টি পার্বত্য শান্তিচুক্তির সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মূল রিট মামলায় কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করবে না।

তাছাড়া সরকার পক্ষ বলেছে, সেনাবাহিনীকে পার্বত্যাঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। শুধু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া হচ্ছে এবং সব সেনাবাহিনী পার্বত্য জেলাতেই থাকছে। যেখান থেকে সেনা ক্যাম্প সরানো হচ্ছে, প্রয়োজন হলে সেখানে আবার তা পুনঃস্থাপন করা হবে। সবকিছু বিবেচনা করেই সেনা প্রত্যাহারের আবেদন খারিজ করা হলো। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২১ আগষ্ট ২০০৯)

পার্বত্যাঞ্চলে সবচেয়ে পুরাতন এবং সুসংগঠিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস। চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পর থেকেই তা বাস্তবায়নের দাবী তুলে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে তারা ভিন্ন খাতে প্রবাহ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অথচ চুক্তির আলোকে সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত শর্তসমূহের যথাযথ মূল্যায়ন জেএসএস এবং এর নেতা সন্তু লারমা করছেন না। বরং অবাস্তবায়িত শর্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া অবাস্তবায়িত শর্তসমূহ বাস্তবায়নের পথে বিশেষতঃ ভূমি সমস্যা নিরসনে অসহযোগিতামূলক/অসহনশীল আচরণ প্রদর্শন করছে। বর্তমানে তারা মূলতঃ ৬টি দাবী করছে, যথা:

১. পার্বত্য চট্ট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন উপজাতিকে পূর্ণমন্ত্রীর নিয়োগ দেয়া,
২. পার্বত্য অঞ্চল হতে সেনা অপসারণ এবং অপারেশন উত্তরণের সমাপ্তি ঘটানো,
৩. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা (তাদের দেয়া বাঙ্গালী-বিরুদ্ধ প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী),
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের ক্ষমতায়ন করা,
৫. প্রত্যাবর্তনকারী জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু পুনর্বাসন করা (কেবলমাত্র উপজাতি শরণার্থীদের বিবেচনায় এনে) এবং
৬. স্থায়ী বাসিন্দার ভিত্তিতে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা (বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশকে বঞ্চিত করে)।

সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ঘোষণা করেছে যে, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক ২৬ এপ্রিল ২০০৫)। কিন্তু জেএসএস এ অঙ্গীকারের তোয়াক্কা না করে সন্ত্রাস লালন করছে। প্রথাগত আন্দোলনের পথ পরিহার করে তারা গড়ে তুলেছে সন্ত্রাস দমন কমিটি নামের ভীতি ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী জঙ্গী বাহিনী, যেটি ব্ল্যাক ডগ বা সান্টুস বাহিনী নামেও পরিচিত।

দলীয় সংগঠন জোরদার তৎপরতা ও দলের ব্যয়ভার মিটানোর উদ্দেশ্যে অবৈধ পন্থা অবলম্বনপূর্বক সন্ত্রাসী তৎপরতা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি চলছে, যা পার্বত্য এলাকার সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। যার প্রমাণ এ অঞ্চলে প্রায়শঃই সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে মেলে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হয়েও মনোনয়ন পাওয়া আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণ সরকারের প্রতি অসহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করছেন। এমনকি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সম্মান, সুযোগ/সুবিধার ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। জেএসএস নেতা আঞ্চলিক পরিষদের আরো ক্ষমতায়ন চান।

আর্থিক বিষয়াদির প্রতি তার লোলুপ দৃষ্টি। দায়িত্বের আওতায় রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড অপেক্ষা আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে তার সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। অথচ তিনি তা থেকে বিরত থেকে দলীয় কর্মসূচি, আদিবাসী বিষয়ক ফোরামের কর্মসূচি ইত্যাদি পালনে অধিক হারে মনোনিবেশ করছেন এবং বিভিন্ন অযৌক্তিক রাজনৈতিক কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা দেশের স্বার্থবিরোধী, শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতি বাধাস্বরূপ।

জেএসএস নেতা বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে পার্বত্যাঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে চান। তা করার জন্য তিনি বিভিন্ন নীলনকশ প্রণয়ন করছেন। বাঙ্গালীগণ পার্বত্যাঞ্চলে না থাকলে সর্ববৃহৎ গোত্র হিসেবে চাকমা গোষ্ঠী এ অঞ্চলের প্রধান শক্তিতে পরিণত হবে, যা তার সমর্থন বৃদ্ধি করবে।


তিনি পার্বত্যাঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী অপসারণের জন্যেও বরাবর সোচ্চার রয়েছেন। সেনাবাহিনীর অপসারণ নিশ্চিত করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই বিরাজমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা এলাকার নিরাপত্তা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং অ-উপজাতীয়রা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত হবে। ফলে তার নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসীদের কৃপার উপর সকলকে তখন নির্ভর করতে হবে। এসবই স্বায়ত্তশাসন দাবীর পূর্বশর্ত।

ইউএনডিপি কর্তৃক সূচিত উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়াদিতে জেএসএস/সন্তু লারমার প্রভাব বিস্তারে নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইউএনডিপি সঙ্গত কারণেই অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এ অঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকান্ডে আগ্রহ প্রকাশ করছে। আর তা করতে গিয়ে তারা সন্তু লারমার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে এ কর্মসূচির বাইরে রেখে কেবলমাত্র উপজাতীয়দের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করা হয়েছে। যা এই এলাকায় বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। এ বিষয়ে প্রায়শঃই পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি চলছে। (সূত্রঃ দি ডেইলি স্টার ২৯ মে ২০০৫, দৈনিক ইত্তেফাক ০৫ জুন এবং দৈনিক পূর্বকোণ ০৭ জুন ২০০৫)। উদ্ভুত পরিস্থিতেতে বাঙ্গালীদের মাঝে বিরাজমান এরূপ ক্ষোভ থেকে জন্ম নিতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ন্যায় অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা।

মানবাধিকারের ন্যায় স্পর্শকাতর বিষয়ে আপত্তিকর এবং মনগড়া অভিযোগ উপস্থাপনের মাধ্যমেও তারা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জেএসএস নেতা এবং তার মনোনীত ব্যক্তিবর্গ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সভা, সমিতি ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আদিবাসী বিষয়ক বর্ষ ঘোষণার পর হতে পৃথিবীর অন্যান্য কিছু কিছু স্থানের ন্যায় আমাদের দেশেও এরূপ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীসমূহ সংগঠিত হতে থাকে। এদের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েছেন সন্তু লারমা। সাথে রয়েছে স্বনামধন্য কিছু রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী।

বৈরিতা নয় বরং বন্ধুত্ব এমন বৈদেশিক নীতি অনুসরণকারী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিমন্ডলেও সাম্যের ভিত্তিতে গঠিত জাতীয় উন্নয়ন নীতি। এখানে তথাকথিত আদিবাসীদের উপেক্ষা/অবজ্ঞা করার প্রমাণ নেই। উচ্চ শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য বিষয়ে তাদের বরং রয়েছে অগ্রাধিকার। তথাপি এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে সন্তু লারমা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন/আন্দোলন করছেন। এর মাধ্যমে তিনি বস্তুত বিশ্ব পরিমন্ডলে পরিচিত লাভের প্রয়াস চালাচ্ছেন। তিনি নিজে এবং তার মনোনীত প্রতিনিধিগণ দেশের বাইরেও বিভিন্ন সেমিনার/কর্মসূচিতে যোগ দেন।

একটি বিষয় দৃষ্টিকটুভাবে লক্ষণীয় যে, দেশের অভ্যন্তরে কি বাইরে এরূপ কর্মসূচিতে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিষয়টি জুড়ে দেন, যার সাথে আদিবাসী বিষয়ক ইস্যুর বোধকরি কোন সংযোগ নেই। বাস্তব তথ্য তুলে ধরতে হলে সন্তু লারমারা কয়েকটি বক্তব্যকেই প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতে হবে:
১. ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ এক প্রতিনিধি সম্মেলনে রাঙ্গামাটিতে তিনি তার দাবির পক্ষে জনযুদ্ধের হুমকি দিয়েছিলেন।
২. শান্তি চুক্তির ৬ষ্ঠ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিভিন্ন দাবী-দাওয়ার প্রেক্ষিতে বলেন, ‘সকল শক্তি দিয়ে পাহাড়িদের দাবী আদায়ের চেষ্টা করবো। আন্দোলন পরিচালিত হবে ভিন্ন আঙ্গিকে’, যা সশস্ত্র আন্দোলনেরই পরিচয় বহন করে। (সূত্রঃ দৈনিক ভোরের কাগজ এবং দৈনিক যুগান্তর ৩ ডিসেম্বর ২০০৩)


৩. ৯ ডিসেম্বর ২০০৩ তারিখে দৈনিক ভোরের কাগজকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করে সশস্ত্র আন্দোলনেরই ইঙ্গিত দেন।

৪. ২৮ ডিসেম্বর ২০০৩ তারিখে রাঙ্গামাটিতে পিসিপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে তিনি শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে ফের জনযুদ্ধের হুমকি দেন (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক ২৯ ডিসেম্বর ২০০৩)।
৫. রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় আবারও অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার হুমকি দেন সন্তু লারমা (সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ২৬ মার্চ ২০০৪)

৬. মানবেন্দ্র লারমার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ১০ নভেম্বর ২০০৪ তারিখে বান্দরবানে সমাবেশে তিনি সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘কিছু ভাড়াটিয়া বাহিনী সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে, জুম্ম জনগণ প্রয়োজনে ফের অস্ত্র হাতে তুলে নেবে’। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ১১ নভেম্বর ২০০৪)

৭. রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সভাকক্ষে ‘১৬তম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দিবস উপলক্ষে চুক্তির বর্তমান অবস্থা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় ৭ ডিসেম্বর ২০১৩ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে পার্বত্য চুক্তির কোনো কিছু পাইনি। কিন্তু চুক্তির বাস্তবায়নটা হতেই হবে। না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। মতবিনিময় সভায় তিন পার্বত্য জেলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, যেভাবে চাপ প্রয়োগ করে সরকারকে পার্বত্য চুক্তিতে বাধ্য করা হয়েছে, সেভাবে সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করতে হবে।

সভার শুরুতে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার যা বলে তা মিথ্যাচার। সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও মৌলিক কোনো ধারা বাস্তবায়ন করা হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ যেন অকার্যকর থাকে তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সরকার তার সবকিছু করছে বলে সন্তু লারমা অভিযোগ করেন।

অন্যদিকে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়, শাসকগোষ্ঠী তাদের সব সময় পাহাড়ি বাঙ্গালী দুই ভাগে বিভক্ত করে রাখে। অথচ চুক্তির মাধ্যমে শুধু উপজাতিরা নয়, স্থায়ী বাঙ্গালী অধিবাসীরাও উপকৃত হবে। এ সময় সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে পার্বত্য চুক্তি নিয়ে অপপ্রচার রোধে পাহাড়ি বাঙ্গালি স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে কমিটি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন ইউএনডিপির পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তা প্রকল্পের প্রধান বাস্তবায়নকারী রবার্ট স্টলম্যান্ট, সাবেক অতিরিক্ত সচিব তারাচরণ চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য মোঃ নুরুল আলম, গৌতম কুমার চাকমা। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ৮ ডিসেম্বর ২০১৩)।

সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতিতে ভিন্ন নামে এককালের শান্তি বাহিনীর দৌরাত্ম এবং এদের সাথে ভারতীয় ও এনজিওদের ষড়যন্ত্রের যোগসাজশে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ হয়েও কার্যত আমাদের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ১৯৭৮-৭৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দরিদ্র, উদ্বাস্তু, জাতীয় বাঙ্গালী পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তাদের জায়গা-জমি দেয়া হয়েছিল।

সেই জমি যারা দিয়েছিলেন তারা এই বলে দিয়েছিলেন যে, এগুলো খাস জমি। পরবর্তীতে এ জমি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় এবং বিতর্ক হয়। সে ঝগড়া, বিরোধ এবং বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন। ১৯৮৭-৮৮ সালে প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সকল বাঙ্গালীকে এক জায়গায় এনে গুচ্ছকরণ করা এবং সেগুলোর নাম দেয়া হয়েছিল গুচ্ছগ্রাম।


এরশাদের পরিকল্পনা ছিল তিন বছর সময়ে তিনি জরিপ শেষ করবেন, জরিপ শেষ করে বাঙ্গালীদেরকে তিনি সুনির্দিষ্ট, নিষ্কন্টক খাসজমি বন্দোবস্তি দিয়ে সেটেল করে দিবেন। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি পান নি। আজ পর্যন্ত সেই ১ লাখের বেশি বাঙ্গালী পরিবার তিনটি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন গুচ্ছগ্রাম নামক জায়গায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর জন্য দায়ী তারা নয়, এর জন্য দায়ী সরকার।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। আগে এখানে গোপনে চাঁদাবাজি হতো, কিন্তু এখন সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় প্রকাশে চাঁদাবাজি হচ্ছে। সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের এখনই কন্ট্রোল করা না গেলে পার্বত্য তিন জেলার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। অপর্যাপ্ত পুলিশ এবং সেকেলে অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। কারণ পার্বত্য অঞ্চলের সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের কাছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। বিশেষ করে সেনা প্রত্যাহারের পর সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের বিশেষ নজর দেয়া উচিত।

পার্বত্য অঞ্চলে জরিপ কাজ সম্পাদন করা গেলে ৮০% সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এখন পার্বত্য জেলাগুলোতে বসবাসরত বাঙ্গালীদের দখলদার বলা হচ্ছে। পার্বত্য তিন জেলার বাঙ্গালীদের দখলে থাকা জমিগুলো যেসব পাহাড়ি দাবি করছেন তাদের কাছে কোনো প্রমাণপত্র নেই। নেই দখলি স্বত্ব। কাজেই পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি জরিপের সময় বাঙ্গালীদের দখলে থাকা জমিগুলো তাদের নামেই রেকর্ড করতে হবে।

উপজাতি নেতারা প্রায় অভিযোগ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তাদের সঙ্গে সরকারের যে অঘোষিত চুক্তি হয়েছিল সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের গুচ্ছগ্রাম থেকে মুসলিম বসতি স্থাপনকারীদের তুলে এনে সমতলের হাওর-বাঁওড় ও নদীর জেগে ওঠা চরে পুনর্বাসন করবেন। সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চায় তারা।
বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা, পিসিজেএসএস’র কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী নেতা গৌতম কুমার চাকমা ও রুপায়ন দেওয়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার অফিসে সাক্ষাৎকালে তিনি পাহাড়ি এলাকা থেকে মুসলমানদের সমতলের জেলাগুলোতে সরিয়ে নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ওই সময় শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, মুসলমানদের সমতলে আসতে বাধ্য করার জন্য সেখানকার গুচ্ছগ্রামগুলো ভেঙে দেয়া হবে এবং তাদের সরকারের দেয়া রেশন বন্ধ করে দেয়া হবে।

ওই বৈঠকে জাতীয় সংসদের তখনকার চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, তৎকালীন দফতরবিহীন মন্ত্রী কল্পরঞ্জন চাকমা, তদানীন্তন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। এরই মধ্যে তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাঙ্গালীদের সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে ঢাকার বিভিন্ন কুটনৈতিক মিশনে চিঠিও দিয়েছেন। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নিলে তারা কূটনৈতিক চাপ দিয়ে দাবি আদায় করে নেবেন।

বিভিন্ন ওয়েব সাইটের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের কল্পিত সব কাহিনীকে বাংলাদেশ সরকার ও সেখানে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগণের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে এবং এইভাবে তাদের তথাকথিত ‘স্বাধীন জুমল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। তাছাড়া জনসংহতি সমিতি খৃস্টান ধর্ম প্রচারকারী এনজিওদের বিরুদ্ধে টু-শব্দটি করে না, কিন্তু অন্যদিকে ইসলামের বিরুদ্ধে তারা অব্যাহতভাবে বিষোদগার করে। বহিঃবিশ্বে তাদের প্রচারের একটি বড় বিষয় হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করা। শান্তি বাহিনী থাকা অবস্থায় তারা এটাই করেছে। এখনও তারা এটাই করছে।

বাংলাভাষী নাগরিকদের তাদের জমিতে ফিরতে পারছে না। তাদের বাড়িঘর জমিজমা সব জনসংহতির উপজাতীয়রা দখল করে নিয়েছে। এদেরকে তাদের বাড়িতে জমিতে ফিরিয়ে দেয়ার আগে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হলো কোন যুক্তিতে? সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা ইতিবাচক হয়েছে বলা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? যুক্তি সম্ভব একটাই সেটা হলো ভারত এটা চায়, শান্তিবাহিনী ও জনসংহতি সমিতি এটা চায় এবং এনজিওরা এটা চায়, বলা যায় সরকার এই তিনের ষড়যন্ত্রের কাছে বন্দী। এইভাবে জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাদেরই জয় হলো।
সন্তু লারমা গণতান্ত্রিক বা নিয়মতান্ত্রিক পথ পরিহার করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধীনে থেকেও সশস্ত্র সংগ্রাম বা গৃহযুদ্ধের ন্যায় ক্ষতিকর পন্থার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন।

স্মরণযোগ্য যে, সাবেক গেরিলা এই নেতার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নসহ পার্বত্যাঞ্চলে সেনা উপস্থিতি প্রত্যাহার এবং বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে এই অঞ্চল হতে বিতাড়িত করার দাবীর মধ্যে রয়েছে এ অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনার লক্ষ্য, যা এক প্রকার স্বায়ত্তশাসনেরই সমার্থক। আর স্বায়ত্তশাসনের মাঝেই পরবর্তীতে বিচ্ছিন্নতাবাদের মন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে, যা আগে বলা হয়েছে। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৪) বর্তমানে তার এ সকল উস্কানিমূলক কর্মকান্ড একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে কোনো ক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। অথচ দেশের বিবেকবান অনেক বুদ্ধিজীবীসহ গণমাধ্যমে এর কোনো বিরোধিতা করছে না। বরং কতিপয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবী অজানা কারণে তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন, যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে আপাতঃ দৃষ্টিতে তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছেন। এরূপ বিতর্কিত ভূমিকা পালন করার পরও বিভিন্ন দিক হতে তার ছাড় পাওয়ার কারণটি যেন রহস্যময়।

আমরা চাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটুক। উন্নয়নের ছোঁয়া যেন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী পার্বত্যভূমিতেও গিয়ে লাগে। তার জন্য প্রয়োজন এ অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল নিরাপত্তা পরিবেশ বজায় রাখা। বর্ণিত পরিস্থিতিতে কেবল সুযোগ্য নেতৃত্বই তা নিশ্চিত করতে পারে। সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন এবং সুবিধাভোগী কোন ব্যক্তির পক্ষে তা করা প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই সময় এসেছে নেতৃত্বে পরিবর্তন সাধনের। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মহলকে পার্বত্যাঞ্চল বিষয়ে আরো মনোযোগী হতে হবে, পাছে স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টা দেশের সার্বিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পার্বত্যাঞ্চলকে নিয়ে এই গভীর ষড়যন্ত্রকে আর অবহেলা করা সমীচীন হবে না।

সরকার যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই সিদ্ধান্ত যদি কখনও কখনও সর্বমহলে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য নাও হয়, তারপরও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত। ভালো হতো যদি সংসদে বিষয়টি আলোচিত হতো। সংসদে আলোচনা করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলে সব ধরনের বিতর্ক এড়ানো যেত। এই সেনা প্রত্যাহার এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং সরকারকেই তার জবাব দিতে হবে। প্রথমত, সেনা প্রত্যাহার ও ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়ার ফলে সেখানে যে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে এবং এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে কিভাবে?

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি ঠিক কবে হবে সেটি নিশ্চিত করে সরকারের তরফ থেকে কেউ বলতে পারছেন না। আর এ কারণে পাহাড়ি এবং সরকারের প্যাঁচে কাহিল বাঙ্গালি। তাদের ভয় দেখিয়ে ঠেসে ধরে রাখা হচ্ছে। নেয়া হচ্ছে অন্যায় সুযোগ। তবুও যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ২০১২ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করা নিয়ে সরকারের ভেতরে বিরোধ দেখা দেয়। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে ভূমি আইনের ১৩টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এ আইন কার্যকর করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙ্গালীদের বেরিয়ে আসতে হবে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে সেখানে বৈধ নাগরিকদের থাকার কথা। কেবল বাঙ্গালী নয় সেখানে সরকারও অনেকটা কার্যকরহীন হয়ে পড়বে।

বিশেষ করে সরকারের ভূমির সার্বভৌমত্ব বা কর্তৃত্ব থাকবে না। তার ওপর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জলে ভাসা ভূমি, এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে স্থাপিত রাষ্ট্রের প্রথম ভূ-উপগ্রহের জমির ওপরও সরকারের কর্তৃত্ব থাকবে না। শেষ পর্যন্ত সরকার সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে আইনটি পাস করেছে। রাষ্ট্রের মোট ভূমির ১০ শতাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি নিয়ে সরকারের ভেতরেই সঙ্কট রয়ে গেছে। সরকারের ওপর বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার চাপের কারণে রাজনৈতিকভাবে আইনটি সংশোধন করা হয়। (সূত্রঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত ২ আগষ্ট ২০১৪)

রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্রের আদল গড়ে তুলবে এ আইন। তাই ভূমি মন্ত্রণালয় এ আইনটি সংশোধনের বিপক্ষে তাদের অবস্থানের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য আমলে নেয়নি সরকারের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। তারা মনে করেন, সমস্যা চুকিয়ে ফেলার জন্য আইনটির প্রস্তাবিত ১৩টি সংশোধনীই চূড়ান্ত করতে হবে। তাই করা হয়েছে।



২০০১ সালে এ আইনটি আওয়ামী লীগ সরকারই করেছিল। যেটিকে কালো আইন হিসেবে উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করে আসছিলেন সন্তু লারমা। বাঙ্গালীরা বলছেন, সরকার এখানে যে ভূমি কমিশন করেছিল তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ। এ দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল বিবদমান হলেও বাঙ্গালীদের বিষয়ে তাদের অবস্থান অভিন্ন, এখানে বাঙ্গালী খেদাও আন্দোলন চলছে। এটি চলতে দেয়া উচিত হবে না।