প্রশাসনে হিন্দু নিয়োগ পলাশী পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে
প্রশাসনে হিন্দু নিয়োগ পলাশী পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে
আরব-তুর্কী বংশোদ্ভূত মির্জা মহম্মদ আলীই বাংলার সেই নবাব আলীবর্দী খান, যিনি ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল অপুত্রক অবস্থায় পরলোকগমন করেন। অতঃপর ১৭৩৩ সালে জন্মগ্রহণকারী তার আদরের দৌহিত্র, ২৩ বছর বয়স্ক সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হন।

কিন্তু তার স্বাধীন নবাবী অতি স্বল্পকালেই ষড়যন্ত্রের কালবৈশালী ঝড়ে তছনছ করায়ে বেইমান, মোনাফেক, নবাবিলি, অপরিণামদর্শী মীরজাফর ইংরেজের হাতের এমনই পুতুল-নবাব হন, যে লোকে তাকে ‘ক্লাইভের বুড়া গাধা' বলত।

১) স্বয়ং আলীবর্দী খান তার সৎবোন শাহখানুমকে বিবাহ দিয়ে মীরজাফরকে সর্বোচ্চ বকশীর (সেনাপ্রধান) পদ-নিয়োগে তারই পরবর্তী স্থান দিয়েছিল। একবার মারাঠা (বর্গী) বিরোধী অভিযানে মীরজাফরকে পাঠালে রাজমহলে ফৌজদার আতাউল্লাহর সাথে ষড়যন্ত্র করে সে স্বয়ং আলীবর্দী খানকেই হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। বিষয়টি ফাঁস হওয়ায় উভয়কেই বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরে আবার তাকে পুনর্বহাল করা হয়।


২) সিরাজকে উৎখাত করে নবাব হওয়ার জন্য মীরজাফরকে প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল ধনকুবের মহতাব রায় জগৎশেঠ। জৈন ধর্মাবলম্বী তার পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল যোধপুর রাজ্যের নাগর নামক নগরে, যেখান হতে প্রায় চারশ' বছর পূর্বে তারা গৌড় রাজ্যে আসে।

১৬৫৩ সালে পাটনায় বসবাসকারী এই বংশের হীরানন্দের সাত পুত্রই ভারতের নানা স্থানে মহাজনী ও হুন্ডির ব্যবসা করত। জ্যেষ্ঠ পুত্র মানিকচাঁদ ঢাকায় এসে কুঠি স্থাপন করে। তখন ঢাকায় রাজধানী থাকায় এখান থেকেই দেওয়ানি করতেন মুর্শিদকুলি খান, যিনি মূলতঃ ছিলেন দক্ষিণাত্যের একন্ত্র ব্রাহ্মণ সন্তান। বাল্যকালে তাকে হাজী সফি ইসপাহানী ক্রয় করে মুসলমান করেন এবং পারস্যে নিয়ে যান। সেখানে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় যথেষ্ট অভিজ্ঞ হয়ে তিনি ভারতে ফিরেন। তখন তার নাম ছিল করতালব খান।

১৭০০ সালে আওরঙ্গজেব তাকে বাংলার দেওয়ান ও মুখসুদাবাদের ফৌজদার নিযুক্ত করেন এবং তার কর্ম দক্ষতায় খুশী হয়ে ১৭০২ সালে তিনি তাকে ‘মুর্শিদকুলি খান' উপাধি দেন। ঢাকায় দেওয়ানীকালে তার দক্ষিণহস্ত ছিলেন মানিকচাঁদ।


১৭০৪ সালে ঢাকা হতে দেওয়ানী মুকসুদাবাদে উঠায়ে নিয়ে তিনি তার নামানুসারে নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। মানিকচাঁদও তখন মুর্শিদাবাদে এসে বসবাস শুরু করে এবং সেখানে নব-নির্মিত টাকশালের কর্তৃত্ব পায়। ১৭১৫ সালে সম্রাট ফারুখশায়ার তাকে শেঠ উপাধি দেয়।

পুত্রহীন মানিকচাঁদ, ভাগিনেয় ফতেচাঁদকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করে। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী ফতেচাঁদ ধনকুপের হয় এবং ওই বছরেই সম্রাট মহাম্মদ শাহ তাকে জগৎশেঠ উপাধি দেন।
ফতেচাঁদের দুই পুত্রের, দয়াচাঁদের ঔরসে স্বরূপচাঁদ ‘মহারাজ' এবং আনন্দচাঁদের ঔরসে জম্মিত মহতাব রায় ‘জগৎশেঠ' উপাধি প্রাপ্ত হয়। এই পলাশীর সেই জগৎশেঠ।

১৭৪৯ সালে আলীবর্দী খান ইংরেজদের কাশিমবাজারস্থ কুঠি আক্রমণ করলে ইংরেজরা জগৎশেঠের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়ে নবাবকে প্রদান পূর্বক অব্যাহতি পায়। সিরাজ নবাব হলে ইংরেজের সহিত জগৎশেঠের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়।

৩) ঢাকার (বিক্রমপুর) বৈদ্য জানকীরাম (রাজা) আলীবর্দী খানের আমলে যুদ্ধ বিভাগের প্রধান ছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী ও শেষ বয়সে তাকে দেওয়ান করে পাটনায় পাঠান হয়। আলীবর্দী খানের দুদিনে জানকীরাম তাকে সাহায্য করায় তিনি তাকে অগাধ বিশ্বাস করতেন। তাই, নবাবের উপর তার প্রভাবও ছিল যথেষ্ট।
তারই জ্যৈষ্ঠ পুত্র রায়দুর্লভ বা দুর্লভরাম আলীবর্দী খানের এবং পরে সিরাজের যুদ্ধ বিভাগের প্রধান দেওয়ান ছিল। আবার তারই জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজবল্লভ ঢাকার নায়েব নাজিমের (সহকারী শাসনকর্তা) পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সুবাদে সে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করায় মুর্শিদাবাদ গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আলীবর্দী খান তখন মৃত্যুশয্যায় থাকায় হিসাব পরীক্ষার পূর্বেই রাজবল্লভের শিরশ্চেদ স্থগিত করে ঢাকায় তার সহায়-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। ফলে তীর্থযাত্রার নাম করে তার পুত্র কৃষ্ণবল্লভ সমস্ত অর্থ ও পরিবারবর্গকে নিয়ে ১৭৫৬ সালের ১৩ মার্চ কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পালিয়ে আসে।
সিরাজ নবাব হয়ে কোলকাতার দুর্গ ভেঙ্গে ফেলাসহ কৃষ্ণবল্লভকে তার হাতে অর্পণ করার জন্য পত্র মারফত ইংরেজদের নির্দেশ দেন। কিন্তু, এর কোন প্রস্তাবেই ইংরেজরা কর্ণপাত না করায় ২৪ মে সিরাজ তাদের কাশিমবাজারস্থ কুঠি অধিকার করে ১৬ জুন কোলকাতার দুর্গ আক্রমণ করেন। অনেক ইংরেজ সেখানে জাহাজে আশ্রয় নিলেও কতেক পালিয়ে যায় এবং কতেকে আত্মসমর্পণ করেন।
১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি ইংরেজরা কোলকাতা দুর্গ পুনঃদখল করলে ৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজ তাদের সাথে চুক্তি করেন। ২৩ মার্চ ইংরেজরা চন্দন নগর দখল করে নেয়। অতঃপর তাদের কোলকাতা কাউন্সিল কিছু শর্তে মীরজাফরকে নবাব বানাতে সম্মত হয়। সেমতে তাদের কাশিমবাজার কুঠি প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস মুর্শিদাবাদে গিয়ে ১ মীরজাফরের সঙ্গে সন্ধি ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি করে।


স্যার যদুনাথ সরকারের History of Bengal, Vol. ii-এর ৪৮৬ পৃষ্ঠা এবং ডা. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খন্ড: দ্বিতীয় পর্ব' নামক বই এর ২১ পৃষ্ঠা হতে উদ্ধৃত সেই শর্তগুলো হলো:

‘উভয়ের মধ্যে সহযোগিতামূলক সন্ধি স্থাপিত হইবে, ফরাসী চন্দননগরের সমস্ত ফরাসী আশ্রয় প্রার্থীদের ইংরেজদের হস্তে সমর্পণ করিতে হইবে, কোলকাতা আক্রমণে ইংরেজদের যত ক্ষতি হইয়াছিল সমস্ত করিতে হইবে, ফরমানে উল্লেখিত ইংরেজদের প্রতি প্রদত্ত সমস্ত ধারা-উপধারা স্বীকার করিতে হইবে, কাশিমবাজার ও ঢাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির কুঠি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করিবার অধিকার দিতে হইবে, হুগলীর পরে নবাব আর কোন কেল্লা নির্মাণ বা সৈন্য রাখিতে পারিবে না, ইংরেজ সেনাবাহিনীর জন্য নবাবকে উপযুক্ত জমিজমা দিতে হইবে, নবাবের জন্য ইংরেজ সৈন্য সংরক্ষণের যাবতীয় ব্যয়ভার নবাবকেই বহন করিতে হইবে, কোলকাতার সীমার মধ্যে ইংরেজদের একচ্ছত্র অধিকার মানিতে হইবে,-- সর্বোপরি নবাবের দরবারে কোম্পানির এক শ্বেতাঙ্গ কর্মচারী অবস্থান করিয়া সবকিছু লক্ষ্য করিবেন'।

১ হতে ২ জুন মীরজাফর, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রাজা রামনারায়ণ, রাজা কৃষ্ণদাস, ব্যবসায়ী আমিনচাঁদ, (উমিচাঁদ বলে পরিচিত এবং শিখ) যার বাণিজ্যিক সূত্রে ইংরেজের সঙ্গে বেশ সদ্ভাব ছিল এবং আরো অনেকে জগৎশেঠের গৃহে গোপন ষড়যন্ত্র বৈঠবে বসে সিরাজকে অপসারণ করে মীরজাফরকে নবাব করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এর পরপরই উইলিয়াম ওয়াটস গোপনে ৫ জুন মুর্শিদাবাদে দেখা করে ঐ ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তির ব্যাপারে মীরজাফরের শপথ নেয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জন নদীয়া জেলার ক্ষুদ্র গ্রাম, পলাশীর আমবাগানে উভয়পক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তা পূর্বোক্ত বই এর ২২ পৃষ্ঠায় লিখেছে, ‘সিরাজের পক্ষে ছিল ফরাসি সেনানায়ক মসিয়ে দে সিনফ্রে মীরমদন (গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক), মোহনলাল কাশ্মীরী, ইয়ার লতিফ খাঁ, রায়দুর্লভ ও মীরজাফর। প্রায় ৫০ হাজার সৈন্যসহ সিরাজ রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলেন। ক্লাইভের অধীনে ছিল ৯৫০ জন শ্বেতাঙ্গ সৈন্য, ১৫০ জন গোলন্দাজ, ২১০০

সিরাজের সৈন্যদের ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা জানায়ে আক্রমণ করার জন্য ক্লাইভকে সংবাদ পাঠাল মীরজাফর। ফলে, ইংরেজ আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল সিরাজের বাহিনী আর তাকায়ে তাকায়ে দেখল মীরজাফর, ইয়ার লতিফ খান ও রায়দুর্লভ, যে পরে হয় মীরজাফরের প্রধানমন্ত্রী।

পলাশীতে পরাজিত সিরাজ পলায়নরত অবস্থায় ধরা পড়ায় মুর্শিদাবাদে আনীত হলে মীরজাফরের পুত্র মীরন, সিরাজেরই পিতার পালিত ও মাতার বিবাহ করানো, ঘাতক মোহাম্মদী বেগকে দিয়ে ২ জুলাই সিরাজকে হত্যা করানো হয়। পরে সিরাজের কনিষ্ঠ ভাই মীর্জা মেহেদী ও ১৭৫৪ সালে মৃত ছোট ভাই একরামউদ্দৌলার পুত্র মুরাদউদ্দৌলাকে হত্যা করায়ে নিশ্চিহ্ন করা হয় আলীবর্দী খানের উত্তরাধিকারী। এর মাত্র কয়েক বছর পরে মীরনও বজ্রাঘাতে প্রাণ হারান এবং ১৭৬৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মীরজাফরও কুষ্ঠরোগে মৃত্যুবরণ করে।

বস্তুত অন্তর্নিহিত হেতু ছিল তৎকালীন ভারতে মুসলিম শাসন অবসানে আর্যাবর্ত পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা। এর প্রমাণ হল সমসাময়িক উত্তর ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট এবং সিরাজের পতনে পরবর্তীকালে বিবিধ মন্তব্য, যার কিছু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ষড়যন্ত্র শুধু স্বাধীনচেতা সিরাজ ও মীর কাশেমের বিরুদ্ধেই হওয়ার রয়েছে ঐতিহাসিক প্রমাণ- মীরজাফরের বিরুদ্ধে নয়।

কারণ, তার সমর্থক ছিল সকল প্রভাব প্রতিপত্তিশালী হিন্দুরা এবং তার মাধ্যমেই হয়েছিল মুসলিম শাসন বিদ্বেষীদের নবজাগরণের সূচনা। আলীবর্দী খান ও সিরাজের বিরুদ্ধে তার শত্রুতা ছিল ব্যক্তিগত, যা দিয়ে লক্ষ্যভেদের উপায়স্বরূপ অন্যদের ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সিরাজ নবাব হওয়ার মাত্র প্রায় দেড় মাসের মাথায়।

আলীবর্দী খাঁর আমলেই সন্ধির সাপেক্ষে মারাঠা অভিযান বন্ধ হলেও বাংলায় তৎপর থেকে যায় ইংরেজরা। সিরাজ নবাব হওয়ার কিছু পূর্বে উত্তর ভারতে মারাঠারা এবং রাজস্থানের ভরতপুর হতে বল্লভগড় পর্যন্ত জাঠরা তাদের স্ব স্ব রাজ্য ও শাসন প্রতিষ্ঠা করে। উভয় গোষ্ঠীই মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে উৎখাত করে দিল্লীর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটাতে তৎপর হয়।
পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম
পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম
ইংরেজদের ষড়যন্ত্র ও সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা মসনদচ্যুত হন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে যারা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল, তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়।

পলাশী ষড়যন্ত্রের যাহারা নেতৃত্ব দিয়াছিল; পরবর্তীকালে তাহাদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হইয়াছিল। প্রায় সকলেরই মৃত্যু হইয়াছিল মর্মান্তিকভাবে। কাউকে নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছে, কেহ দীর্ঘদিন কুষ্ঠ রোগে ভুগিয়া মারা গিয়াছে, কাউকে ফাঁসিতে ঝুলাইয়া মারা হইয়াছে, কাউকে নদীতে ডুবাইয়া মারা হইয়াছে, কেহ নিজের গলায় নিজেই ছুরি বসাইয়াছে। অস্বাভাবিক পন্থায় এবং অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে আলিঙ্গন করিতে হইয়াছে মৃত্যুকে। তাহাদের সকলের উপরেই পড়িয়াছিল আল্লাহর লানত।

মিরন
মিরন পলাশী ষড়যন্ত্রের প্রধানতম নায়ক ছিল। তাহার পুরো নাম মীর মহম্মদ সাদেক আলি খান। সে মীর জাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আলীবর্দী খানের ভগ্নী শাহ খানমের গর্ভে তাহার জন্ম হইয়াছিল। এই সূত্রে মিরন ছিল আলিবর্দীর বোনপো। মিরন যে অত্যন্ত দুর্বৃত্ত, নৃশংস ও হীনচেতা ছিল, সে ব্যাপারে কাহারও কোনো সন্দেহ নাই। সিরাজ হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক মিরন। আমিনা বেগম, ঘষেটি বেগম হত্যার নায়কও সে। লুত্ফুন্নিসার লাঞ্ছনার কারণও মিরন। মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়াছিল মিরন। মীর জাফরের সকল অপকর্মের হোতা ছিল সে। মিরনের প্ররোচনাতেই মীরজাফর চলিত।

ইংরেজদের নির্দেশে এই মিরনকে হত্যা করিয়াছে মেজর ওয়ালস। তবে তাহার এই মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইংরেজরা মিথ্যা গল্প বানাইয়াছিল। তাহারা বলিয়াছে, মিরন বিহারে শাহজাদা আলি গওহারের (পরে বাদশা শাহ আলম) সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গিয়া পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে নিহত হয়।

ইংরেজদের অর্থপুষ্ট মুতাক্ষরীনকার লিখিয়াছে, মিরনের আদেশে সিরাজের মাতা আমিনা ও মাতৃস্বসা ঘষেটি বেগম জলমগ্ন হওয়ায়, তাহার মৃত্যুকালে মিরনকে বজ্রাঘাতে প্রাণপরিত্যাগের জন্য অভিসম্পাত করিয়া যান। এই জন্য অনুমান করা হয় যে, বজ্রাঘাতেই মিরনের মৃত্যু হইয়াছিল। ইংরেজরা বলিয়াছে, বজ্রপাতের ফলে তাঁবুতে আগুন ধরিয়া যায় এবং তাহাতেই সে নিহত হয়। ফরাসী সেনাপতি লরিস্টনের Jean-খধ িঘটনাকে অস্বীকার করিয়াছে। বরং এই মত পোষণ করে যে, মিরনকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হইয়াছিল। প্রচণ্ড ঝড় আর ঘন ঘন বজ্রপাতের সময় তাহার তাঁবুতে আগুন লাগাইয়া দেওয়া হয় এবং তাহাকে হত্যা করা হয়। এহা আর কিছুই নহে, আসলে ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। (অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া, ভিনসেন্ট এ, স্মিথ।)
নিখিলনাথ রায় তাহার ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছে, ‘মিরনের মনে স্বাধীনতার ইচ্ছা বলবর্তী হওয়ার পুণ্যশ্লোক ব্রিটিশ পুঙ্গবদের মীর কাসিমের সাহায্যে তাহাকে না-কি কৌশলপূর্বক নিহত করিয়াছিল। পরে বজ্রাঘাতে মৃত্যু বলিয়া প্রকাশ করা হয়।’

ভিনসেন্ট এ, স্মিথ তাহার অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া ও Meadows Taylor তাহার A students Manual of the History of India গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার বক্তব্য উপস্থাপন করিয়াছে। বলিয়াছে যে, মিরনের মৃত্যুর জন্য ইংরেজ এবং মীর কাসিম উভয়কেই সন্দেহ করা হয়। আসলেই মিরনকে হত্যা করা হইয়াছিল। মেজর ওয়ালস ছিল এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক। মীরজাফর ইংরেজদের সাজানো গল্পটি বিশ্বাস করে নাই। জানিত, মিরনকে ইংরেজরা হত্যা করিয়াছে। কিন্তু কাপুরুষ মীরজাফরের ক্রন্দন ছাড়া আর কিছু করিবার ছিল না। এ নিয়া বাড়াবাড়ি করিলে সে জানিত তাহার নিজের নবাবী ও জীবনটাও চলিয়া যাইতে পারে।

মুহাম্মদী বেগ
মুহাম্মদী বেগ ৩ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করিয়াছিল। নবাব সিরাজ এ সময় তাহার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাহেন নাই। তিনি কেবল তাহার কাছ থেকে দুই রাকাত নামাজ পড়িবার অনুমতি চাহিয়াছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদী বেগ সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করিবার পরপরই নবাব সিরাজকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগ মাথা গড়বড় অবস্থায় বিনা কারণে কূপে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া মৃত্যুবরণ করিয়াছিল। এই মুহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলার পিতা ও মাতামহীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। আলীবর্দীর বেগম একটি অনাথ কুমারীর সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন।
মীর জাফর
পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিল মীরজাফর আলি খান। সে পবিত্র কোরআন মাথায় রাখিয়া নবাব সিরাজের সামনে তাহার পাশে থাকিব বলিয়া অঙ্গীকার করিবার পর পরই বেঈমানী করিয়াছিল।

মীর জাফর অত্যন্ত হীনাবস্থায় প্রথমত আলীবর্দী খাঁর সংসারে প্রতিপালিত হন। আলীবর্দী খান তাহাকে অত্যন্ত কাছে টানিয়া নিয়াছিলেন। পরে নবাব নিজে বৈমাত্রেয় ভাগিনী শাহ খানমের সহিত মীর জাফরের বিয়ে দেন।


নবাব তাহার কার্যদক্ষতায় সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে সেনাপতি পদ প্রদান করেন। নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছ, ‘মীরজাফর মহারাষ্ট্রীয় যুদ্ধের সময়ে অসামান্য বীর্যবত্তা দেখাইয়া আপনার সুনাম প্রচার করিয়াছিল কিন্তু আলীবর্দীর ভ্রাতৃজামাতা আতাউল্লা খাঁর সহিত পরামর্শ করিয়া বঙ্গরাজ্য বিভাগ করিয়া লইবার ইচ্ছা করায়, আলীবর্দী খাঁর অনুরোধে তাহাকে পুনর্বার সেনাপতি পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তাহার পর সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নেতা হইয়া মীরজাফর ইংরেজদের সহিত যোগদানপূর্বক সিরাজের সর্বনাশ সাধনের পর মুর্শিদাবাদের মসনদে উপবিষ্ট হয়।’ মীরজাফর সম্পর্কে অনেকে বলিয়াছেন, ‘আর বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর? সর্বস্বীকৃতভাবে সে ছিল পুরোপুরিভাবেই একজন বিশ্বাসঘাতক। সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই সে ছিল একজন মহাবোকা, রাজনীতি জ্ঞানবিহীন একজন সেনাপতিমাত্র।

মীরজাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। সে দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুবরণ করে। নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছে, ক্রমে অন্তিম সময় উপস্থিত হইলে, হিজরি ১১৭৮ অব্দের ১৪ শাবান (১৭৬৫ খ্রি. অব্দের জানুয়ারি মাসে) বৃহস্পতিবার সে কুষ্ঠরোগে ৭৪ বছর বয়সে পরলোকগত হয়। তাহার মৃত্যুর পূর্বে নন্দকুমার কিরিটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিল এবং তাহাই তাহার শেষ পানিপান।

জগেশঠ, মহাতপচাঁদ এবং স্বরূপচাঁদ
পলাশী ষড়যন্ত্রের পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখিয়াছিল জগেশঠ পরিবার, প্রথমত তাহারা ইংরেজদের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং পরে মীরজাফর ও অন্যদের ইহাতে যুক্ত করে।
জগেশঠদের পূর্বপুরুষ মানিকচাঁদের সঙ্গে মুর্শিদকুলী খাঁর বংশের ভালো সম্পর্ক ছিল। মানিকচাঁদ ১৭১৫ সালে বাদশাহ ফরখ শেরের কাছ হইতে শেঠ উপাধি লাভ করে। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদ পরলোকগমন করে। সে অপুত্রদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়া যায়। ১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদের মৃত্যু হয়।

আনন্দচাঁদ, দয়াচাঁদ, মায়াচাঁদ নামে তাহার তিন ছেলে ছিল। পিতার জীবদ্দশাতেই আনন্দচাঁদ ও দয়াচাঁদের মৃত্যু ঘটে। তখন আনন্দচাঁদের পুত্র স্বরূপচাঁদ শেঠ পরিবারের উত্তরাধিকারী মনোনীত হয়।
নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছে, বাদশাহের নিকট হইতে মহাতপচাঁদ জগেশঠ’ ও স্বরূপচাঁদ মহারাজ উপাধি লাভ করে। এই সময়ে শেঠদিগের গদীতে অনবরত ১০ কোটি টাকার কারবার চলিত। জমিদার মহাজন ও অন্যান্য ব্যবসায়ী সকলেই অর্থের জন্য শেঠদিগের নিকট উপস্থিত হইত। ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি বৈদেশিক বণিকগণ তাহাদের নিকট হইতে টাকা কর্জ লইত। ফতেচাঁদের মৃত্যুর পর নবাব আলীবর্দী ও খাঁ জগেশঠ মহাতপচাঁদকে যথেষ্ট সম্মান করিত এবং ফতেচাঁদের ন্যায় তাহারও পরামর্শ গ্রহণ করিতে ত্রুটি করিত না।’


আলীবর্দী খাঁর শাসনামলেই জগেশঠের সহিত ইংরেজদের সম্পর্ক অতি গভীর ছিল। নবাব সিরাজ ক্ষমতায় আসিলে এই গভীরতা বৃদ্ধি পাইল এবং তাহা ষড়যন্ত্রে রূপ নিল। পলাশী বিপর্যয়ের পর জগেশঠ রাজকোষ লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করে।

১৭৬০ সালে মীরজাফর সিংহাসনচ্যুত হইলে তাহার জামাতা কাসেম আলি খাঁ (মীর কাসেম) ক্ষমতায় বসে। এ সময় বিভিন্ন বিষয় লইয়া ইংরেজদের সহিত তাহার বিরোধ বাধে। জগেশঠ ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং ইংরেজ ও মীরজাফরের কাছে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে কয়েকটি পত্র প্রদান করে। পত্রগুলি কৌশলে মীর কাসেমের হস্তগত হয়। এই জন্য মীর কাসেম জগেশঠ মহাতপচাঁদকে বন্দী করিয়া মুঙ্গেরে পাঠাইবার জন্য বীরভূমের ফৌজদার মহাম্মদ তকী খাঁর প্রতি আদেশ পাঠায়।

তকী খাঁ তাহাদেরকে হীরাঝিলের প্রাসাদে বন্দি করিয়া রাখে। পরে নবাবের সেনাপতি আর্মেনীয় মার্কার নবাবের আদেশে সসৈন্যে তাহাদের নিয়া উপস্থিত হইলে তকী খাঁ তাহাদের মার্কারের হস্তে সমর্পণ করে। এ সময়ে মীর কাসেম মুঙ্গেরে ছিল। মার্কার তাহাদের নিয়া মুঙ্গেরে উপস্থিত হয়। তাহাদের সেখানে আটক রাখা হয়।

ইংরেজ গভর্নর ২৪ এপ্রিল ১৭৬৩ নবাবকে লিখিয়া পাঠাইল, ‘আমি এইমাত্র আমিয়টের পত্রে অবগত হইলাম যে, মহম্মদ তকী খাঁ রজনীতে জগেশঠ ও স্বরূপচাঁদের বাটীতে প্রবেশ করিয়া, তাহাদিগকে বন্দী অবস্থায় হীরাঝিলে আনিয়ে রাখিয়াছে। এই ঘটনায় আমি অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়াছি। যখন আপনি শাসন কার্যের ভার গ্রহণ করেন, তখন আপনি, জগেশঠ ও আমি সমবেত হইয়া, এইরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলাম যে, শেঠেরা, বংশমর্যাদায় দেশের মধ্যে সর্বপ্রধান, অতএব শাসনকার্যের বন্দোবস্তে আপনাকে তাহাদিগের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইবে এবং তাহাদিগের কোনোরূপ অনিষ্ট না করিতে আপনি স্বীকৃত হন। মুঙ্গেরে আপনার সহিত সাক্ষাত্কালে আমি শেঠদিগের কথা আপনাকে বলিয়াছিলাম এবং আপনিও তাহাদিগের কোনো ক্ষতি করিবেন না বলিয়া আমাকে নিশ্চিত করেন। তাহাদিগের তত্পরোনাস্তি অবমাননা করা হইয়াছে। আপনার এ সুনামে কলঙ্ক পড়িয়াছে। ভূতপূর্ব কোনো নাজিম তাহাদিগের এরূপ গৃহ হইতে আনয়ন করা অত্যন্ত অন্যায় হইয়াছে; ইহাতে তাহাদিগের প্রতি এরূপ ব্যবহার করেন নাই। সুতরাং আপনি সৈয়দ মহম্মদ খাঁ বাহাদুরকে (মুর্শিবাদের ফৌজদার) তাহাদিগের মুক্তির জন্য লিখিয়া পাঠাইবেন।’

নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছে ‘ইহার পর ক্রমে ইংরেজদিগের সহিত মীর কাসেমের বিবাদ গুরুতর হইয়া উঠিলে, নবাব কাটোয়া, গিরিয়া, উদয়ানালা প্রভৃতি স্থানে পরাজিত হইয়া মুঙ্গেরে জগেশঠ ও অন্যান্য বন্দী কর্মচারী এবং রাজা ও জমিদারদিগের বিনাশ সাধন করে। জগেশঠ মহাতপচাঁদকে অত্যুচ্চ দুর্গশিখর হইতে গঙ্গারগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়।


মহারাজ স্বরূপচাঁদও ঐ সাথে ইহজীবনের লীলা শেষ করিতে বাধ্য। মুতাক্ষরীণের অনুবাদক লিখিয়াছ, ‘চুনী নামক জগেশঠের জনৈক ভৃত্য প্রভুর সহিত একত্রবদ্ধ হইয়া জলমগ্ন হইতে অথবা তাহার পূর্বে প্রাণ বিসর্জন করিবার জন্য অশেষ প্রকার অনুনয় বিনয় করিতে থাকে। কিন্তু তাহার প্রার্থনা পূর্ণ করা হয় নাই। অবশেষে সে নিজেই দুর্গশিখর হইতে পতিত হয়। জগেশঠ তাহাকে নিরস্ত হইবার জন্য অতিশয় অনুনয় বিনয় করিয়াছিল; কিন্তু তাহার কথায় মনোযোগ দেয় নাই।’ জানা যায়, অনুবাদক বাবুরাম নামে চুনীর জনৈক আত্মীয়ের কাছ থেকে এই সংবাদ অবগত হয়।

রবার্ট ক্লাইভ
নবাব সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিল রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভ খুব অল্প বয়সে ভারতে আসে। প্রথমে একটি ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্রে গুদামের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়। এই কাজটি ছিল অত্যন্ত পরিশ্রমের ও বিরক্তিকর। এই কাজটিতে ক্লাইভ মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। এ সময় জীবনের প্রতি তাহার বিতৃষ্ণা ও হতাশা জন্মে। আত্মহত্যা করিবার চেষ্টা করে। রিভলবার দিয়া নিজের কপালের দিকে লক্ষ্য করিয়া পর পর তিনটি গুলি ছোঁড়ে। কিন্তু গুলি থাকা অবস্থাতেইও গুলি রিভলবার হইতে বাহির হয় নাই।
পরে ভাবিল ঈশ্বর হয়ত তাহাকে দিয়া বড় কোনো কাজ সম্পাদন করিবে বলিয়াই এইভাবে তাহাকে বাঁচাইল। পরবর্তীতে দ্রুত ক্ষমতার শিখরে উঠিতে শুরু করে। পরিশেষে পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়া কোটি টাকার মালিক হয়। ইংরেজরা তাহাকে ‘প্লাসি হিরো’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। দেশে ফিরিয়া গিয়া একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকিয়া নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালাইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

ইয়ার লতিফ খান
পলাশী ষড়যন্ত্রের শুরুতে ষড়যন্ত্রকারীরা ইয়ার লতিফ খানকে ক্ষমতার মসনদে বসাইতে চাহিয়াছিল। কিন্তু পরে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিয়া এক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম উচ্চারিত হয়। ইয়ার লতিফ খান ছিল নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি। এই ষড়যন্ত্রের সহিত গভীরভাবে যুক্ত ছিল এবং যুদ্ধের মাঠে তাহার বাহিনী মীরজাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর ন্যায় ছবির মতো দাঁড়াইয়াছিল। তাহার সম্পর্কে জানা যায়, যুদ্ধের পর অকস্মাত্ নিরুদ্দিষ্ট হইয়া যায়। অনেকের ধারণা, তাহাকে কে বা কাহারা গোপনে হত্যা করিয়াছিল। (মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, আসকার ইবনে শাইখ, পরিশিষ্ট)।

নন্দকুমার
নন্দকুমার এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করিয়াছিল। মুর্শিবাদাবাদ কাহিনী গ্রন্থে নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছ নন্দকুমারের অনেক বিবেচনার পর সিরাজের ভবিষ্যত্ বাস্তবিকই ঘোরতর অন্ধকার দেখিয়া, ইংরেজদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের ইচ্ছা করিল। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ বলিয়া থাকে যে, ইংরেজরা সেই সময়ে আমীরচাঁদকে দিয়া নন্দকুমারকে ১২ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছিলে। পলাশী ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীরজাফর স্বীয় দেওয়ান নিযুক্ত করিয়া সব সময় তাহাকে নিজ কাছে রাখিত। মীরজাফর তাহার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজকর্ম নন্দকুমারের পরামর্শানুসারে করিত। তাহার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তাহার মুখে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত তুলিয়া দিয়াছিল।

তহবিল তছরুপ ও অন্যান্য অভিযোগের বিচারে নন্দকুমারের ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু হইয়াছিল। বিচার সম্পর্কে নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছ, ‘প্রধান বিচারপতি জুরীদিগকে চার্জ বুঝাইয়া দেওয়ার পূর্বে মহারাজের কৌঁসুলি ফ্যারার সাহেব জুরিদিগকে লক্ষ্য করিয়া কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিল। ইংল্যান্ডীয় আইনে গুরুতর অপরাধীদিগের কৌঁসুলি আইন সংক্রান্ত কোনো কথা ব্যতীত আর কিছু বলিতে পারে না বলিয়া তাহার আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়।... অতঃপর জুরিরা প্রায় একঘণ্টা পরামর্শ করিয়া, মহারাজ নন্দকুমারকে দোষী বলিয়াই প্রকাশ করিল। তজ্জন্য তত্কালের নিয়মানুসারে ১৬ই জুন মহারাজ নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করা হয়। প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদত্ত মহারাজ নন্দকুমারকে কারাগারের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইল। কারাগারের একটি দ্বিতল গৃহ তাহার আবাসস্থানরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল। সে গৃহে আর কেহ থাকিত না; তথায় মহারাজ বন্ধুবান্ধবগণের সহিত কথোপকথনে ও শাস্ত্রালাপে মৃত্যু সময় পর্যন্ত অতিবাহিত করিয়াছিল।

রায় দুর্লভ
রায় দুর্লভ ছিল নবাবের একজন সেনাপতি। সেও মীরজাফরদের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধকালে সে এবং তাহার বাহিনী মীরজাফরদের সহিত যুক্ত হইয়া নীরবে দাঁড়াইয়াছিল। যুদ্ধের পর সে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয় এবং ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া সেখানেই তাহার মৃত্যু ঘটে।

উমিচাঁদ
ক্লাইভ কর্তৃক উমিচাঁদ প্রতারিত হইয়াছিল। ইয়ার লতিফ খান ছিল উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী। কিন্তু যখন অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা এ ক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম ঘোষণা করিল, তখন উমিচাঁদ বাঁকিয়া বসিল এবং বলিল, আপনাদের প্রস্তাব মানিতে পারি এক শর্তে, তাহা হইল যুদ্ধের পর নবাবের রাজকোষের ৫ ভাগ সম্পদ আমাকে দিতে হইবে। ক্লাইভ তাহার প্রস্তাব মানিল বটে, কিন্তু যুদ্ধের পরে তাহাকে তাহা দেওয়া হয় নাই।
যদিও এই ব্যাপারে একটি মিথ্যা চুক্তি হইয়াছিল। ওয়াটস রমণী সাজিয়া মীরজাফরের বাড়িতে গিয়া লাল ও সাদা কাগজে দুইটি চুক্তিতে তাহার সই করান। লাল কাগজের চুক্তিতে বলা হইয়াছে, নবাবের কোষাগারের পাঁচ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য হইবে। ইহা ছিল নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। যাহাতে করিয়া উমিচাঁদের মুখ বন্ধ থাকে। যুদ্ধের পর ক্লাইভ তাহাকে সরাসরি বলেন, কিছু দিতে পারিব না। এ কথা শুনিয়া সে মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া ফেলিল এবং স্মৃতিভ্রংশ উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিতে ঘুরিতেই তাহার মৃত্যু ঘটে।

রাজবল্লভ
ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে ঘটিয়াছিল। জানা যায়, রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ করিয়াই পদ্মা হয় কীর্তিনাশা।

দানিশ শাহ বা দানা শাহ
দানিশ শাহ সম্পর্কে বিতর্ক রহিয়াছে। অনেকে বলিয়াছ, এই দানিশ শাহ নবাব সিরাজকে ধরাইয়া দিয়াছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখিয়াছ, দানা শাহ ফকির মোটেই জীবিত ছিল না। আসকার ইবনে শাইখ তাহার ‘মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, বিষাক্ত সর্প দংশনে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটিয়াছিল।

ওয়াটস
ওয়াটস এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখিয়াছিল। সে রমণী সাজিয়া মীরজাফরের বাড়িতে যাইয়া চুক্তিতে মীরজাফরের স্বাক্ষর আনিয়াছিল। যুদ্ধের পর কোম্পানির কাজ হইতে বরখাস্ত হইয়া মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় বিলাতেই অকস্মাত্ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

স্ক্রাফটন
ষড়যন্ত্রের পিছনে স্ক্রাফটনও বিশেষভাবে কাজ করিয়াছিল। জানা যায়, বাংলার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করিয়া বিলেতে যাইবার সময় জাহাজডুবিতে তাহার অকাল মৃত্যু ঘটে।

ওয়াটসন
ষড়যন্ত্রকারী ওয়াটসন ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হইলে কোনো ওষুধেই ফল না পাইয়া কলিকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়।

মীর কাসেম
মীরজাফরের ভাই রাজমহলের ফৌজদার মীর দাউদের নির্দেশে মীর কাসেম নবাব সিরাজের খবর পাইয়া ভগবানগোলাঘাট হইতে বাঁধিয়া আনিয়াছিল মুর্শিদাবাদে। পরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সেনবাব হয় এবং এ সময় ইংরেজদের সহিত তাহার বিরোধ বাধে ও কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়। পরে ইংরেজদের ভয়ে হীনবেশে পলাইয়া যায় এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ায়।

অবশেষে অজ্ঞাতনামা হইয়া দিল্লীতে তাহার করুণ মৃত্যু ঘটে। মৃতের শিয়রে পড়িয়া থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত চাপকায়। এ থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান।



এইভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের কিছুকালের মধ্যেই বিভিন্ন পন্থায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পলাশী ষড়যন্ত্রকারীদের উপরে আল্লাহর গজব নাজিল হইয়াছিল বলিয়াই অনেকের ধারণা। আসলে এইসব ঘটনা থেকেই আমাদের অনেক কিছু শিখিবার বিষয় রহিয়াছে।