প্রশাসনে হিন্দু নিয়োগ পলাশী পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে

প্রশাসনে হিন্দু নিয়োগ পলাশী পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে
আরব-তুর্কী বংশোদ্ভূত মির্জা মহম্মদ আলীই বাংলার সেই নবাব আলীবর্দী খান, যিনি ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল অপুত্রক অবস্থায় পরলোকগমন করেন। অতঃপর ১৭৩৩ সালে জন্মগ্রহণকারী তার আদরের দৌহিত্র, ২৩ বছর বয়স্ক সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হন।

কিন্তু তার স্বাধীন নবাবী অতি স্বল্পকালেই ষড়যন্ত্রের কালবৈশালী ঝড়ে তছনছ করায়ে বেইমান, মোনাফেক, নবাবিলি, অপরিণামদর্শী মীরজাফর ইংরেজের হাতের এমনই পুতুল-নবাব হন, যে লোকে তাকে ‘ক্লাইভের বুড়া গাধা' বলত।

১) স্বয়ং আলীবর্দী খান তার সৎবোন শাহখানুমকে বিবাহ দিয়ে মীরজাফরকে সর্বোচ্চ বকশীর (সেনাপ্রধান) পদ-নিয়োগে তারই পরবর্তী স্থান দিয়েছিল। একবার মারাঠা (বর্গী) বিরোধী অভিযানে মীরজাফরকে পাঠালে রাজমহলে ফৌজদার আতাউল্লাহর সাথে ষড়যন্ত্র করে সে স্বয়ং আলীবর্দী খানকেই হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। বিষয়টি ফাঁস হওয়ায় উভয়কেই বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরে আবার তাকে পুনর্বহাল করা হয়।


২) সিরাজকে উৎখাত করে নবাব হওয়ার জন্য মীরজাফরকে প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল ধনকুবের মহতাব রায় জগৎশেঠ। জৈন ধর্মাবলম্বী তার পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল যোধপুর রাজ্যের নাগর নামক নগরে, যেখান হতে প্রায় চারশ' বছর পূর্বে তারা গৌড় রাজ্যে আসে।

১৬৫৩ সালে পাটনায় বসবাসকারী এই বংশের হীরানন্দের সাত পুত্রই ভারতের নানা স্থানে মহাজনী ও হুন্ডির ব্যবসা করত। জ্যেষ্ঠ পুত্র মানিকচাঁদ ঢাকায় এসে কুঠি স্থাপন করে। তখন ঢাকায় রাজধানী থাকায় এখান থেকেই দেওয়ানি করতেন মুর্শিদকুলি খান, যিনি মূলতঃ ছিলেন দক্ষিণাত্যের একন্ত্র ব্রাহ্মণ সন্তান। বাল্যকালে তাকে হাজী সফি ইসপাহানী ক্রয় করে মুসলমান করেন এবং পারস্যে নিয়ে যান। সেখানে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় যথেষ্ট অভিজ্ঞ হয়ে তিনি ভারতে ফিরেন। তখন তার নাম ছিল করতালব খান।

১৭০০ সালে আওরঙ্গজেব তাকে বাংলার দেওয়ান ও মুখসুদাবাদের ফৌজদার নিযুক্ত করেন এবং তার কর্ম দক্ষতায় খুশী হয়ে ১৭০২ সালে তিনি তাকে ‘মুর্শিদকুলি খান' উপাধি দেন। ঢাকায় দেওয়ানীকালে তার দক্ষিণহস্ত ছিলেন মানিকচাঁদ।


১৭০৪ সালে ঢাকা হতে দেওয়ানী মুকসুদাবাদে উঠায়ে নিয়ে তিনি তার নামানুসারে নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। মানিকচাঁদও তখন মুর্শিদাবাদে এসে বসবাস শুরু করে এবং সেখানে নব-নির্মিত টাকশালের কর্তৃত্ব পায়। ১৭১৫ সালে সম্রাট ফারুখশায়ার তাকে শেঠ উপাধি দেয়।

পুত্রহীন মানিকচাঁদ, ভাগিনেয় ফতেচাঁদকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করে। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী ফতেচাঁদ ধনকুপের হয় এবং ওই বছরেই সম্রাট মহাম্মদ শাহ তাকে জগৎশেঠ উপাধি দেন।
ফতেচাঁদের দুই পুত্রের, দয়াচাঁদের ঔরসে স্বরূপচাঁদ ‘মহারাজ' এবং আনন্দচাঁদের ঔরসে জম্মিত মহতাব রায় ‘জগৎশেঠ' উপাধি প্রাপ্ত হয়। এই পলাশীর সেই জগৎশেঠ।

১৭৪৯ সালে আলীবর্দী খান ইংরেজদের কাশিমবাজারস্থ কুঠি আক্রমণ করলে ইংরেজরা জগৎশেঠের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়ে নবাবকে প্রদান পূর্বক অব্যাহতি পায়। সিরাজ নবাব হলে ইংরেজের সহিত জগৎশেঠের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়।

৩) ঢাকার (বিক্রমপুর) বৈদ্য জানকীরাম (রাজা) আলীবর্দী খানের আমলে যুদ্ধ বিভাগের প্রধান ছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী ও শেষ বয়সে তাকে দেওয়ান করে পাটনায় পাঠান হয়। আলীবর্দী খানের দুদিনে জানকীরাম তাকে সাহায্য করায় তিনি তাকে অগাধ বিশ্বাস করতেন। তাই, নবাবের উপর তার প্রভাবও ছিল যথেষ্ট।
তারই জ্যৈষ্ঠ পুত্র রায়দুর্লভ বা দুর্লভরাম আলীবর্দী খানের এবং পরে সিরাজের যুদ্ধ বিভাগের প্রধান দেওয়ান ছিল। আবার তারই জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজবল্লভ ঢাকার নায়েব নাজিমের (সহকারী শাসনকর্তা) পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সুবাদে সে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করায় মুর্শিদাবাদ গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আলীবর্দী খান তখন মৃত্যুশয্যায় থাকায় হিসাব পরীক্ষার পূর্বেই রাজবল্লভের শিরশ্চেদ স্থগিত করে ঢাকায় তার সহায়-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। ফলে তীর্থযাত্রার নাম করে তার পুত্র কৃষ্ণবল্লভ সমস্ত অর্থ ও পরিবারবর্গকে নিয়ে ১৭৫৬ সালের ১৩ মার্চ কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পালিয়ে আসে।
সিরাজ নবাব হয়ে কোলকাতার দুর্গ ভেঙ্গে ফেলাসহ কৃষ্ণবল্লভকে তার হাতে অর্পণ করার জন্য পত্র মারফত ইংরেজদের নির্দেশ দেন। কিন্তু, এর কোন প্রস্তাবেই ইংরেজরা কর্ণপাত না করায় ২৪ মে সিরাজ তাদের কাশিমবাজারস্থ কুঠি অধিকার করে ১৬ জুন কোলকাতার দুর্গ আক্রমণ করেন। অনেক ইংরেজ সেখানে জাহাজে আশ্রয় নিলেও কতেক পালিয়ে যায় এবং কতেকে আত্মসমর্পণ করেন।
১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি ইংরেজরা কোলকাতা দুর্গ পুনঃদখল করলে ৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজ তাদের সাথে চুক্তি করেন। ২৩ মার্চ ইংরেজরা চন্দন নগর দখল করে নেয়। অতঃপর তাদের কোলকাতা কাউন্সিল কিছু শর্তে মীরজাফরকে নবাব বানাতে সম্মত হয়। সেমতে তাদের কাশিমবাজার কুঠি প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস মুর্শিদাবাদে গিয়ে ১ মীরজাফরের সঙ্গে সন্ধি ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি করে।


স্যার যদুনাথ সরকারের History of Bengal, Vol. ii-এর ৪৮৬ পৃষ্ঠা এবং ডা. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খন্ড: দ্বিতীয় পর্ব' নামক বই এর ২১ পৃষ্ঠা হতে উদ্ধৃত সেই শর্তগুলো হলো:

‘উভয়ের মধ্যে সহযোগিতামূলক সন্ধি স্থাপিত হইবে, ফরাসী চন্দননগরের সমস্ত ফরাসী আশ্রয় প্রার্থীদের ইংরেজদের হস্তে সমর্পণ করিতে হইবে, কোলকাতা আক্রমণে ইংরেজদের যত ক্ষতি হইয়াছিল সমস্ত করিতে হইবে, ফরমানে উল্লেখিত ইংরেজদের প্রতি প্রদত্ত সমস্ত ধারা-উপধারা স্বীকার করিতে হইবে, কাশিমবাজার ও ঢাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির কুঠি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করিবার অধিকার দিতে হইবে, হুগলীর পরে নবাব আর কোন কেল্লা নির্মাণ বা সৈন্য রাখিতে পারিবে না, ইংরেজ সেনাবাহিনীর জন্য নবাবকে উপযুক্ত জমিজমা দিতে হইবে, নবাবের জন্য ইংরেজ সৈন্য সংরক্ষণের যাবতীয় ব্যয়ভার নবাবকেই বহন করিতে হইবে, কোলকাতার সীমার মধ্যে ইংরেজদের একচ্ছত্র অধিকার মানিতে হইবে,-- সর্বোপরি নবাবের দরবারে কোম্পানির এক শ্বেতাঙ্গ কর্মচারী অবস্থান করিয়া সবকিছু লক্ষ্য করিবেন'।

১ হতে ২ জুন মীরজাফর, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রাজা রামনারায়ণ, রাজা কৃষ্ণদাস, ব্যবসায়ী আমিনচাঁদ, (উমিচাঁদ বলে পরিচিত এবং শিখ) যার বাণিজ্যিক সূত্রে ইংরেজের সঙ্গে বেশ সদ্ভাব ছিল এবং আরো অনেকে জগৎশেঠের গৃহে গোপন ষড়যন্ত্র বৈঠবে বসে সিরাজকে অপসারণ করে মীরজাফরকে নবাব করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এর পরপরই উইলিয়াম ওয়াটস গোপনে ৫ জুন মুর্শিদাবাদে দেখা করে ঐ ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তির ব্যাপারে মীরজাফরের শপথ নেয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জন নদীয়া জেলার ক্ষুদ্র গ্রাম, পলাশীর আমবাগানে উভয়পক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তা পূর্বোক্ত বই এর ২২ পৃষ্ঠায় লিখেছে, ‘সিরাজের পক্ষে ছিল ফরাসি সেনানায়ক মসিয়ে দে সিনফ্রে মীরমদন (গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক), মোহনলাল কাশ্মীরী, ইয়ার লতিফ খাঁ, রায়দুর্লভ ও মীরজাফর। প্রায় ৫০ হাজার সৈন্যসহ সিরাজ রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলেন। ক্লাইভের অধীনে ছিল ৯৫০ জন শ্বেতাঙ্গ সৈন্য, ১৫০ জন গোলন্দাজ, ২১০০

সিরাজের সৈন্যদের ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা জানায়ে আক্রমণ করার জন্য ক্লাইভকে সংবাদ পাঠাল মীরজাফর। ফলে, ইংরেজ আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল সিরাজের বাহিনী আর তাকায়ে তাকায়ে দেখল মীরজাফর, ইয়ার লতিফ খান ও রায়দুর্লভ, যে পরে হয় মীরজাফরের প্রধানমন্ত্রী।

পলাশীতে পরাজিত সিরাজ পলায়নরত অবস্থায় ধরা পড়ায় মুর্শিদাবাদে আনীত হলে মীরজাফরের পুত্র মীরন, সিরাজেরই পিতার পালিত ও মাতার বিবাহ করানো, ঘাতক মোহাম্মদী বেগকে দিয়ে ২ জুলাই সিরাজকে হত্যা করানো হয়। পরে সিরাজের কনিষ্ঠ ভাই মীর্জা মেহেদী ও ১৭৫৪ সালে মৃত ছোট ভাই একরামউদ্দৌলার পুত্র মুরাদউদ্দৌলাকে হত্যা করায়ে নিশ্চিহ্ন করা হয় আলীবর্দী খানের উত্তরাধিকারী। এর মাত্র কয়েক বছর পরে মীরনও বজ্রাঘাতে প্রাণ হারান এবং ১৭৬৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মীরজাফরও কুষ্ঠরোগে মৃত্যুবরণ করে।

বস্তুত অন্তর্নিহিত হেতু ছিল তৎকালীন ভারতে মুসলিম শাসন অবসানে আর্যাবর্ত পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা। এর প্রমাণ হল সমসাময়িক উত্তর ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট এবং সিরাজের পতনে পরবর্তীকালে বিবিধ মন্তব্য, যার কিছু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ষড়যন্ত্র শুধু স্বাধীনচেতা সিরাজ ও মীর কাশেমের বিরুদ্ধেই হওয়ার রয়েছে ঐতিহাসিক প্রমাণ- মীরজাফরের বিরুদ্ধে নয়।

কারণ, তার সমর্থক ছিল সকল প্রভাব প্রতিপত্তিশালী হিন্দুরা এবং তার মাধ্যমেই হয়েছিল মুসলিম শাসন বিদ্বেষীদের নবজাগরণের সূচনা। আলীবর্দী খান ও সিরাজের বিরুদ্ধে তার শত্রুতা ছিল ব্যক্তিগত, যা দিয়ে লক্ষ্যভেদের উপায়স্বরূপ অন্যদের ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সিরাজ নবাব হওয়ার মাত্র প্রায় দেড় মাসের মাথায়।

আলীবর্দী খাঁর আমলেই সন্ধির সাপেক্ষে মারাঠা অভিযান বন্ধ হলেও বাংলায় তৎপর থেকে যায় ইংরেজরা। সিরাজ নবাব হওয়ার কিছু পূর্বে উত্তর ভারতে মারাঠারা এবং রাজস্থানের ভরতপুর হতে বল্লভগড় পর্যন্ত জাঠরা তাদের স্ব স্ব রাজ্য ও শাসন প্রতিষ্ঠা করে। উভয় গোষ্ঠীই মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে উৎখাত করে দিল্লীর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটাতে তৎপর হয়।