পলাশীর মধ্য দিয়েই এ উপমহাদেশের ঘটনাপ্রবাহ পরিবর্তিত হয়ে এক চোরাবালিতে আটকা পড়ে। পরাধীনতার দীর্ঘ জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
ইংরেজরা বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে শঠতা, প্রতারণা, ষড়যন্ত্র ও বিভেদ নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আর তাদের এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দু শেঠ বেনিয়ারা, যাদেরকে বিশ্বাস করে মুসলিম শাসকরা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু মুসলমানরা যাতে আর কখনো মাথা তুলতে না পারে সে জন্য সব ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ইংরেজ ও তার এদেশীয় এজেন্ট বর্ণহিন্দুরা।
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, নবাব আলী ওয়ার্দী খান এবং সিরাজউদ্দৌলাহর শাসনামলে অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার ছিল হিন্দু। ‘দেওয়ান’ ‘তানদেওয়ান’ ‘সাবদেওয়ান’ ‘বখশী’ প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিতেই হিন্দুরা অধিষ্ঠিত হয়েছিল। এদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম ছিল মীরজাফর।
অপরদিকে ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই ছিল হিন্দু। ফলে একজন স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি হিসেবে তিনি যখন বারবার ইংরেজদের হুঁশিয়ার করে দেন যে, শান্তিপূর্ণভাবে ও দেশের আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা যদি ব্যবসা করে তবে তাদের সহযোগিতা করা হবে। অন্যথায় তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত তো করেইনি, বরং নানা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করে।
এর কারণ সুস্পষ্ট তারা ভিতর থেকে ইন্ধন পাচ্ছিল। এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল নবাবের সুবিধাবাদী, দেশদ্রোহী কিছু রাজকর্মচারী আর ঈর্ষাপরায়ণ কিছু নিকটাত্মীয়। ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল আর বাংলার বিশ্বাসঘাতক কুচক্রী অমাত্যবর্গের মধ্যে ১ মে ১৭৫৭ সালে এক গোপন লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়। দরবারের ষড়যন্ত্রের যারা মূল হোতা তাদের মধ্যে প্রধান সেনাপতি হবার কারণে ঘটনাচক্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল মীর জাফর, এর পেছনের প্রধান চক্রান্তকারীরা ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
পলাশী বিপর্যয়ের জন্য নবাবের নিকটাত্মীয় ও প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে এককভাবে দায়ী করা হয়। মীরজাফর লোভী, অপদার্থ, বিশ্বাসঘাতক ছিল এবং তার কারনেই পলাশী দিবসের প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছিল সবই ঠিক আছে। কিন্তু উপরোল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী শীর্ষ জমিদার আমলারা কি ধোয়া তুলসী পাতা?
উর্মিচাঁদ, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ, মানিকচাঁদ, দূর্লভরাম, রাজবল্লভ, কৃষ্ণচন্দ্ররায়, নন্দকুমার এরা কি শুধুই পার্শ্বচরিত্র ছিল? অন্তত একশ্রেণীর ঐতিহাসিক সে রকম ধারণা দিতেই বদ্ধপরিকর। ঐতিহাসিক মোহর আলী যথার্থই বলেছেন: “মীরজাফর যদি এই চক্রান্তে যোগ নাও দিত ষড়যন্ত্রকারীরা অন্য কাউকে খুঁজে নিত।”
পলাশী বিপর্যয়ের পর বাংলা-বিহার ইংরেজ ও তাদের দেশীয় দালাল বর্ণহিন্দুদের লুটপাটের স্বর্গভূমি হয়ে উঠেছিল। একজন মুসলমানও পাওয়া যায়নি যে পলাশী যুদ্ধের পর সম্পদশালী হয়েছিল। অথচ পেটের দায়ে এদেশে আসা ইংরেজ ও তাদের দেশীয় সেবাদাস জগৎশেঠ গংরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়।
ইংরেজরা এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দুর্নীতি আমদানী করে ব্যাপকভাবে। বৃটিশ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশবছরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা ৬০ লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল। এই ব্যাপক লুন্ঠনের ফলে ১৭৭০ সালে (বাংলা-১১৭৬) বাংলা-বিহারে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কোটি মানুষ মৃত্যের শিকারে পরিণত হয়। ‘‘ছিয়াত্তরের মনন্তর’’ নামে পরিচিত এই মহাদূর্ভিক্ষে ইংরেজ গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চাশ লাখ।
শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় শিক্ষা, ভাষা, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও পলাশী পরবর্তীকালে ব্যাপক বিপর্যয় ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। ঐতিহাসিক ম্যাক্সমুলার উল্লেখ করেছেন যে, ইংরেজদের ক্ষমতা দখল কালে বাংলায় আশি হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রতি চারশ’ লোকের জন্য তখন একটি মাদরাসা ছিল। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই ইংরেজ আমলে লুপ্ত হয়ে যায়।
প্রতিবেশী ইংরেজ অনুকম্পায় উদীয়মান সম্প্রদায় হিন্দুদের প্রভাব ও অনুকরণে বহু কুসংস্কার, ইসলাম বিরোধী রসম রেওয়াজ, হিন্দু ধর্মীয় নানা আচার-আচরণ এসময় মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে। মুসলিম শাসনামলে ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবন উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক গ্রামে মুুফতী, মুহতাসিব প্রভৃতি দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হতো। ইংরেজরা এ পদগুলো বিলুপ্ত করে। ফলে মুসলমানরা দিক নির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে।
পলাশীর এই যে সর্বগ্রাসী বিপর্যয় এর সঠিক ইতিহাসটিও সাধারণকে জানতে দিতে চায়নি ইংরেজ ও তাদের আশীর্বাদে জন্ম নেয়া নব্য ভদ্রলোক বর্ণহিন্দু প্রভাবিত ঐতিহাসিকরা। নবাব সিরাজের পতনের পরপরই ফিরিঙ্গিরা কতক উচ্ছিষ্টভোগী, ইংরেজ আশ্রিতদের দিয়ে ইতিহাস রচনা করায়। যেগুলোর মাধ্যমে সিরাজের চরিত্র হনন করা হয় নির্লজ্জভাবে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো-পলাশীর এই যুদ্ধকে কোন কোন হিন্দু লেখক ‘দেবাসুর সংগ্রাম’ নামে আখ্যায়িত করেছে। এখানে দেবতা হল ক্লাইভ আর ‘অসুর’ ছিল বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে শহীদ নবাব সিরাজ। শুধু এখানেই থেমে থাকেনি বর্ণ হিন্দুরা, তারা পলাশীর শোকাবহ বিপর্যয়কে উপজীব্য করে বিজয় উৎসব পালনের লক্ষ্যে বাংলায় শারদীয় দূর্গোৎসব পালন করে লর্ড ক্লাইভকে দেবতাতুল্য সংবর্ধনা দেয় ১৭৫৭ সালেই। ইতোপূর্বে বসন্তকালে এ দূর্গোৎসব পালন করা হতো।
আজও নব্য বেনিয়ারা অপতৎপরতা চালাচ্ছে নতুন লেবাসে। কখনো বহুজাতিক কোম্পানী কখনো সাহায্য সংস্থা ইত্যাদি বহুনামে তাদের অশুভ থাবা বিস্তারের জন্য তারা তৎপর রয়েছে। বিভিন্ন মহলে নব্য মীরজাফরদের আনাগোনাও চোখে পড়ার মতো।
আধিপত্যবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রচারণা যে কত মারাত্মক হতে পারে তা পলাশী পরবর্তী বিকৃত ইতিহাসের ছড়াছড়ি থেকে প্রমাণিত। আজও নব্য আধিপত্যবাদীদের একই প্রকার অপপ্রচারের শিকার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া এর জ্বলন্ত প্রমাণ। অমুসলিম বিশেষতঃ হিন্দুরা প্রথমত মুসলিম শাসকদের বিশ্বাসভাজন হতে চেষ্টা করে। পরবর্তীতে আস্থার সুযোগ নিয়ে অন্তর্ঘাতী আক্রমণের মাধ্যমে মুসলিম শক্তিকে ধ্বংস করে।
বাদশাহ শাহজাহানের পুত্রদের কলহে সেনাপতি যশোবন্ত সিংহ, ইলিয়াস শাহী সালতানাতের পতনে রাজা গণেশ, পলাশীর যুদ্ধে জগৎশেঠ, রাজবল্লভদের ভূমিকা এ কথা চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিক্ষা দেয়।
সাম্প্রদায়িক ইঙ্গ-হিন্দু লিখিত পলাশীর বিকৃত ইতিহাসকে সরিয়ে সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে তা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
আমাদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বের সাথে পলাশীর মর্মান্তিক ইতিহাস গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এ ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় বেঈমানী, দেশদ্রোহিতা আর বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে জাতির শত্রুদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্র ও আঁতাতের মাধ্যমে আর যেন জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেয়া না হয়।
আমাদেরকে নব্য মীরজাফর-জগৎশেঠদের চিহ্নিত করতে হবে, যারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশ জাতির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে তৎপর। যারা দেশের সার্বভৌমত্বকে অবমাননা করে ভিনদেশীদের জন্য সবকিছু উজাড় করে দিতে প্রস্তুত।
যারা নিজ দেশের সম্পদকে অপরের হাতে তুলে দিতে মরিয়া। আর একটি পলাশী থেকে রক্ষা পেতে নব্য মীরজাফর-জগৎশেঠদের চিহ্নিত করা যেমন জরুরী তেমনি সিরাজের উত্তরসূরীদের সহযোগিতা করাও সমান জরুরী।