জমিদার মানেই মুসলমান,হিন্দুরা নয়। হিন্দুরা ছিলো আরদালী

জমিদার মানেই মুসলমান,হিন্দুরা নয়। হিন্দুরা ছিলো আরদালী

জমিদার ফারসি যামিন (জমি) ও দাস্তান (ধারণ বা মালিকানা)-এর বাংলা অপভ্রংশের সঙ্গে ‘দার’ সংযোগে ‘জমিদার’ শব্দের উৎপত্তি। মধ্যযুগীয় বাংলার অভিজাত শ্রেণির ভূম্যধিকারীদের পরিচয়জ্ঞাপক নাম হিসেবে শব্দটি ঐতিহাসিক পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুগল আমলে জমিদার বলতে প্রকৃত চাষির ঊর্ধ্বে সকল খাজনা গ্রাহককে বোঝানো হতো।

জমিদাররা শুধু খাজনা আদায়ের স্বত্বাধিকারী, জমির স্বত্বাধিকারী নয়। পক্ষান্তরে, জমির মালিকদের বলা হতো রায়ত বা চাষি যাদের নামে জমাবন্দি বা রেন্ট-রোল তৈরি হতো। এ ধারণায় জমিদারগণ রাজস্বের চাষি ছিল মাত্র।

জমিদারেরা জমির মালিক ছিলোনা। জমির মালিক ছিলো সরকার। জমিদার কেবল রাজস্ব আদায় করত।


জমিদার এ পদবি বা শব্দটি ভূঁইয়া বা ভূপতি নামে যে দেশিয় পারিভাষিক শব্দটি প্রচলিত আছে তার সরাসরি প্রতিশব্দ বলা যায়। এ ভূঁইয়া বা ভূপতিরা ছিল ভারতের প্রাক্-মুগল আমলের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক। মুগলগণ তৎকালে প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাকে একটি নতুন ব্যবস্থায় রূপান্তর করে।

১৭২২ সালে সুবাহদার মুর্শিদ কুলীর মালজমিনি (ভূমি রাজস্ব) পদ্ধতি প্রচলিত হয়। তিনি রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা চালু করেন। যেমন - রাজস্ব চুক্তিদার এর অধীনে কাজ করত ৪ টি দল – জমিদার( ২ ভাগ – পেশকশ ,ইজারাদার ) – দিহিদার- মুস্তাজির-ইজারাদার

মুঘল আমলে ভূমি ব্যবস্থা কেমন ছিলো?
মোঘল আমলে ভুমিব্যবস্তা ৪ ভাগে বিভক্ত ছিলো –
১) খালিসাঃ এই জমি মধ্যভোগীদের দিয়ে দেওয়া হত। আবার সৈন্য দ্বারাও পরিচালিত হত।
২) জাগিরদারিঃ তারা নিজেরাই জমি থেকে রাজস্ব আদায় করত।
৩) জমিদারঃ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তারা নিয়মিত দিত। জমিদারি এলাকার ভিতরে জমির সঠিক পরিমাপ করা হত।
৪) লাখেরাজ বা করহীন জমিঃ
এই জমি উপরের ৩ ব্যবস্থাতেই ছিলো। সরকারি দান বলা হত বাদশাহি , জমিদারের দান ছিলো হুকুমি। দ্বীনি এ দান উভয়ই ছিলো করহীন।
লাখেরাজ আরবি শব্দ, অর্থ নিষ্কর। মুগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি অথবা কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি। মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক এ অঞ্চলের মুসলিম ছূফী-দরবেশ ও আলিম-উলামাগণকে মুসলিম শাসকদের তরফ থেকে লাখেরাজ সম্পত্তি দেয়া হতো। যাতে উনারা উক্ত ভুমি ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে দ্বীন ইসলাম প্রচার-প্রসার করতে পারেন।

আবহমান কাল থেকে ভারতের মুসলমান শাসকগণ জনগণের শিক্ষা বিস্তারকল্পে মুসলিম মনীষীদেরকে জায়গীর, তমঘা, আয়মা, মদদে-মায়াশ প্রভৃতি নামে লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি দান করতেন।

“বহুদিন থেকে ভারতবর্ষের শাসনকর্তাগণ সাধারণ মানুষের বিদ্যাশিক্ষার জন্য লাখেরাজ জমি মঞ্জুর করতেন। মসজিদ, মাজার ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের জন্য ভূমি মঞ্জুর করা হতো। এছাড়াও উনারা নানা প্রকার বৃত্তি ভোগ করতেন। শুধু মুসলমান উনাদের জন্যই এসময় পনের প্রকারের আয়কর মওকুফের মঞ্জুরী ছিল, তিন প্রকারের ছিল হিন্দুরের” (ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ব্রিটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, উদৃতি, এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃঃ ৭৭-৭৮)

নমশূদ্ররা আরদালী থেকে কিভাবে কথিত জমিদার সাজলো?
“১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম হিসাব করে বের করে যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য এক ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখে” (কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এম আর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮)।

এর ফলশ্রুতিতেই ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ছূফী-দরবেশ, আলিম-উলামা উনাদের নিকট থেকে এসব লাখেরাজ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়।


তৎকালীন ভারত সরকারেরই একজন ইংরেজ সদস্য চার্লস মেটকাফ ব্রিটিশদের এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সম্পর্কে ১৮২০ সালে মন্তব্য করেছিল যে, “এ নীতি হচ্ছে অন্যায় অবিচারের চূড়ান্ত; কোনো দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠীর হিন্দু বাবুদের হাতে তুলে দেয়া হলো যারা নানা দুর্নীতি ও উৎকোচের আশ্রয় নিয়ে দেশের ধনসম্পত্তি চুষে খেতে চায়।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃষ্ঠা ৭৯)

উপরে বর্নিত ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে যে ব্রিটিশরা মুসলমান উনাদের লাখেরাজ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের দিয়ে দিয়েছে । যার ফলে ফকিরনি হিন্দুরা আরদালী থেকে সেজেছে কথিত জমিদার আর মুসলমান হয়েছেন গরীব।

আরদালী থেকে কথিত জমিদার সাজার প্রমান
১) মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাঙ্গালী সমাজ’ বইয়ের ‘ ১০৮ পৃ উল্লেখ আছে” মুঘল আমলের জমিদারদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক আমলের জমিদারদের পার্থক্য অবশ্যই ছিল। নতুন জমিদারদের অধিকাংশই ছিল পুরনো জমিদারদের কর্মচারী”

২) হিন্দু লেখক লোকেশ্বর বসু ‘আমাদের পদবির ইতিহাস’ বইয়ের ৬২-৬৩ পৃষ্টায় লিখেছে, “জমিদার বলতে মোঘল যুগে বোঝাতো ক্ষুদ্র অঞ্চলের শাসক, এবং তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। ..... কিন্তু ইংরেজ যুগে হিন্দুরা আবার জমিদার হলো। কার্যক্ষেত্রে এরা কিন্তু জামিনদার। এই জমিদারী প্রথার বয়স মাত্র দেড়শো বছর। পলাশীর যুদ্ধের সময়েও কোনো বিশিষ্ট বাঙ্গালি হিন্দুর দেখা মেলে না। পরে যে বাঙ্গালি হিন্দুরা কলকাতায় ছুটে এলো, তাদের মধ্যে যেমন ব্রাহ্মণ কায়স্থ ছিল, তেমনি ছিল অন্যান্য নমশূদ্র জাতি।......এই সময় ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করে ব্যবসা করে, নানাভাবে তাদের উপকার করে, দোভাষী হয়ে, জাহাজ ঘাটায় মাল নামানো-উঠানোর কুলি সংগ্রহ করে দিয়ে অনেকেই কপাল ফেরালো। এদের মধ্যে কথিত ধনীরা জমিদারী কিনলো ইংরেজদের কাছ থেকে। কিন্তু সে জমিদারী আসলে খাজনা আদায়ের ঠিকাদারী। তবু দু-তিন পুরুষেই তারা বনেদী বনে গেলো।”

উদাহারন কি ?

১) রবীন্দ্রঠগঃ
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তার 'রবীন্দ্রজীবনী' ১ম খন্ডের ৩য় পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে,"....... জ্ঞাতি কলহে বিরক্ত হইয়া মহেশ্বর ও শুকদেব নিজগ্রাম বারোপাড়া হইতে কলিকাতা গ্রামের দক্ষিণে গোবিন্দপুরে আসিয়া বাস করে। সে সময়ে কলিকাতা ও সুতানুটিতে শেঠ বসাকরা বণিক। এই সময়ে ইংরেজদের বাণিজ্যতরণী গোবিন্দপুরের গংগায় আসিয়া দাঁড়াইত। পঞ্চানন কুশারী ( রবীর পূর্বপুরুষ) ইংরেজ কাপ্তেনদের এইসব জাহাজে মালপত্র উঠানো নামানো ও খাদ্য পানীয় সংগ্রহাদি কর্মে প্রবৃত্ত হয়। এই সকল শ্রমসাধ্য কর্মে স্থানীয় হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিম্নশ্রেণির লোকেরা তাহার সহায় ছিল।............... তাহারা পঞ্চাননকে 'ঠাকুর মশায়' বলিয়া সম্বোধন করিত। কালে জাহাজের কাপ্তেনদের কাছে ইনি 'পঞ্চানন ঠাকুর' নামেই চলিত হইল; তাহাদের কাগজপত্রে তাহারা Tagore,Tagoure লিখিতে আরম্ভ করল। এইভাবে 'কুশারী ' পদবীর পরিবর্তে 'ঠাকুর ' পদবী প্রচলিত হইল। [ সূত্রঃ চিত্রা দেব রচিত 'ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল' প্রকাশনায়- আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলিকাতা]
পরবর্তিতে এই কুলিরাই ইংরেজদের দালালি করে জমিদার সাজে

২) নাটোরের রাজবাড়িঃ
মুর্শিদ কুলি খানের সময় রঘুনন্দন নামক এক নমশূদ্র মুর্শিদাবাদের রাজস্ববিভাগের একজন সামান্য আরদালি ছিলো। পরবর্তিতে মুর্শিদ কুলি তাকে তাকে রাজস্ব বিভাবের উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। এই সময় ধীরে ধীরে ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে অনেক জমিদারী তার ভাই রামজিবনের নামে স্থানান্তর করে। রামজিবনের মৃত্যুর পর তার পোষ্যপুত্র রামকান্ত আরদালির সনদ পায় ১৭৩৩ সালে। ১৭৩০ সালে ভবানী নামক এক নমশূদ্রের সাথে বিয়ে হয়। রাম জীবনের দত্তক পুত্র রামকান্তের বিয়ে হয়। রাম জীবনের মৃত্যুর পরে রামকান্ত নাটোরের রাজা হয়। ১৭৪৮ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পরে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ( চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংগালি সমাজ , পৃ ৯০ )

তাঁর মানে জমিদার বলতে মুসলমানকেই বুঝায় । কোন কাফির মুশরিককে নয়। মুসলমানদের জমিদারী কেড়ে নিয়েই বিধর্মীরা জমিদার সেজেছে ।