বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলমান আন্দোলন
Image result for sword
বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলমান আন্দোলন 

সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি
সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে এতো উচ্চস্থান অর্জন করেছিলেন যেমৌলভী মুহম্মদ ইউসূফশাহ ইসমাইল ও মাওলানা আবদুল হাই এর মতো শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি খান্দানের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উনার হস্তে বয়াত গ্রহণ করেন। এর পর থেকে দলে দলে লোক উনার মুরীদ হতে থাকেন। তিনি উনার অনুসারীদেরকে যে জেহাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন তার লক্ষ্য হলো সত্যের পথে সংগ্রাম করে মহান আল্লাহ পাক উনার প্রদর্শিত সরল ও সঠিক পথে চলা। এ পথেই তিনি উনার অনুগামীদেরকে আজীবন পরিচালনা করেন।
শাহ ইসমাইলের নিকট লিখিত এক পত্রে জেহাদের বর্ণনা করে তিনি বলেন-
 সম্মানিত জিহাদ উনার উদ্দেশ্য ধন সম্পদ অর্জন করা নয়। বিভিন্ন অংশ জয় করা বা স্বীয় স্বার্থ পরিতৃপ্ত করা অথবা নিজের জন্য একটা রাজ্য স্থাপন করাও সম্মানিত জিহাদ উনার উদ্দেশ্য নয়। সম্মানিত জিহাদ উনার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনাকে  সন্তুষ্ট করা এবং মুসলিম সমাজে যেসব কুসংস্কার প্রচলিত আছে তাকে বিনষ্ট করা -(স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসআবু জাফরপৃঃ ৮৩)
এমন মহান ও পবিত্র উদ্দেশ্য যাঁরযাঁর চরিত্র ছিল নির্মল ও নিষ্কলুষযিনি ছিলেন ব্যক্তিস্বার্থের বহু উর্ধে এবং একমাত্র সন্তুষ্টি অর্জন যাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্যউনার সম্পর্কে হান্টার বলে –“এই বিস্ময়কর প্রভাবের উৎপত্তি কেবলমাত্র অশুভ ভিত্তির উপরেই ঘটেনিসাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি খলিফা হিসাবে উনার জীবন আরম্ভ করেছিলেন দুটি মহান নীতির প্রবক্তা রূপে। নীতি দুটি হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনার একত্ব এবং মানুষের সাম্য। সত্যিকার দ্বীনপ্রচারকরা সকলেই এই দুই নীতি অনুসরণ করে থাকেন। দেশবাসীর অন্তরে যে দ্বীনিভাব দীর্ঘকাল যাবত সুপ্ত অবস্থায় ছিল এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত হিন্দু ধর্মের সাহচর্যের দরুন সৃষ্ট কুসংস্কার অতিমাত্রায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে মুসলমান উনাদের মনকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলএবং দ্বীন ইসলাম উনাকে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিলসাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি এক স্বতঃফূর্ত প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে নাড়া দিয়েছিলেন মুসলমান উনাদের সেই নিষ্ঠ দ্বীনি মনের দুয়ারে। তিনি এবং উনার ঘনিষ্ঠ শিষ্যবর্গ ভক্তের (Imposters) দলে পরিণত হয়েছিলেন একথা সত্য হওয়া সত্ত্বেও আমি একথা বিশ্বাস না করে পারি না যেসাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি জীবনে অন্তর্বর্তী এমন একটা সময় ছিলযখন সর্বান্তকরণে বেদাকুল হৃদয়ে তিনি উনার দেশবাসীর মুক্তি কামনা করেছিলেন এবং উনার অন্তর নিবদ্ধ হয়েছিলেন একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি
[W W Hunter, The Indian Mussalmans অনুবাদ আনিসুজ্জামান (কিছু পরিবর্তণসহ) পৃঃ ৩৬]
হান্টার তার গ্রন্থে কিরূপ স্ববিরোধী উক্তি করেছে তা যে কোন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারবেন। যে ব্যক্তির অন্তর নিবদ্ধ হয়েছিল মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি যিনি সর্বান্তঃকরণে বেদনাকুল হৃদয়ে উনার দেশবাসীর মুক্তি কামান করেছিলেনউনাকে হান্টার বলেছে দস্যু-দুর্বৃত্ত এবং ভন্ড।নাউযুবিল্লাহ
হান্টার আরও বলে দ্বীনি ধ্যানে তিনি এমন মগ্ন থাকতেন যেসেটাকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অনুসারে মৃগীরোগ বলে অভিহিত করা যায় [W W Hunter, The Indian Mussalmans –অনুবাদ আনিসুজ্জামান (কিছু পরিবর্তণসহ) পৃঃ ৩৬]
মহান আল্লাহ পাক উনার ধ্যানে মগ্ন থাকাকে তাছাউফের পরিভাষায় বলা হয় মুরাকাবা-মুশাহাদা। হান্টারের মতো মহান আল্লাহ পাক উনায় অবিশ্বাসী পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা তাক বলে মৃগীরোগ।নাউযুবিল্লাহ
দ্বীন ইসলাম বিদ্বেষব্যাধি মনমস্তিষ্ককে কতখানি আক্রান্ত করে রাখলে এ ধরনের অশালীন উক্তি করা যায়তা সহজেই অনুমেয়। সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি যদি শুধুমাত্র দ্বীনি ধ্যানে মগ্ন থাকতেনতাহলে সম্ভবততঃ পাশ্চাত্য লেখকগণ উনার কোন বিরূপ সমালোচনা করত না। কিন্তু যেহেতু তিনি বিধর্মী ও বিদেশী শাসন থেকে দেশবাসীর মুক্তি কামনা করেছিলেনসেজন্যে তাদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন মৃগী রোগাক্রান্ত দুর্বৃত্ত ও ভণ্ড।নাউযুবিল্লাহ।  এ ছিল তাদের বিদ্বেষদুষ্ট ও বিকৃত মানসিকতারই পরিচায়ক।
শাহ আবদুল আযীয দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি ভাইপো প্রখ্যাত আলেম শাহ ইসমাইল এবং জামাতা মাওলানা আবদুল হাইসাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি মুরীদ হওয়ার ফল এই হলো যেসাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি খ্যাতি বিদ্যুৎ গতিতে মধ্য ভারতে ছড়িয়ে পড়লো।
চারদিক থেকে জনসাধারণ উনাকে দাওয়াত করতে থাকলো এবং তিনি উনার মুর্শেদ শাহ আবদুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অনুমতিক্রমে দোয়াব অঞ্চলের গাযিয়াবাদমীরাটমজফফরপুরসাহারনপুরদেওবন্দ প্রভৃতি স্থানসমূহে ব্যাপক সফর করেন। প্রায় চল্লিশ হাজার লোক উনার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং বহু অমুসলমানও উনার কাছে দ্বীন ইসলাম  দীক্ষিত হন উনার এ সফরকালে তিনি শিখদের হাতে মুসলমানদের নির্যাতন কাহিনী প্রথম শুনতে পান এবং উনার অন্তর সমবেদনায় বিগলিত হয়। ১৮১৯ সালে তিনি শেষবারের মতো দিল্লী ফিরে যান এবং অল্পকাল পরেই রায়বেরেলী প্রত্যাবর্তন করেন
রায়বেরেলীতে তিনি কিছুকাল অতিবাহিত করেন। সেখানে এই খোদাভক্তদের জীবনযাত্রা ছিল আদর্শস্থানীয় এবং দর্শকদের শিক্ষার যোগ্য। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত অঞ্চলে প্রায় সত্তর আশীজন লোক সায় নদীর তীরবর্তী সাইয়্যিদ বংশের পুরাতন মসজিদের চারদানে নিজ হাতে কুটীর তৈরী করে বাস করতেন।
সে বৎসর (১৮১৯ খৃঃ) গ্রীষ্মকালে জোর বৃষ্টি নামলো এবং নদীগুলোতে প্রবল প্লাবন এলো। খাবার হয়ে পড়লো দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি নির্বিকার চিত্তে উনার  আশিজন খোদাপ্রিয় ও খোদাভক্ত সংগী নিয়ে এবাদত বন্দেগীতেলোকসেবা ও প্রচার কার্যে দিনরাত ব্যস্ত রইলেন।
-(ওহাবী আন্দোলনআবদুল মওদূদপৃঃ ১৫৪-৫৫)
উপরোক্ত দলে ছিলেন দ্বীন ইসলাম জগতের বহু জ্ঞান-জ্যোতিষ্ক যথা হুজ্জাতুল ইসলাম মওলানা শাহ মুহম্মদ  ইসমাঈলশায়খুল ইসলাম মাওলানা আবদুল হাইকোতব-ই-ওয়াক্ত মাওলানা মুহম্মদ ইউসূফ প্রভৃতি। শাহ ইসমাইল উনার অসীম জ্ঞানগরিমা ও পান্ডিত্যসহ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপন পীর ও মুর্শেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি সাথে ছায়ার মতো ছিলেন এবং উনার সংগেই শাহাদতের অমৃত পান করেন। প্রাতঃকালে প্রচারণাওয়াজ নসিহত,পবিত্র কোরআন শরীফ- পবিত্র হাদীস শরীফ উনাদের ব্যাখ্যাদানদিবাভাগে কঠোর দৈহিক পরিশ্রম এবং সারারাত তাহাজ্জুদ ও এবাদত বন্দেগীতে কাটানো এ ছিল এসব খোদাপ্রেমিকদের দৈনন্দিন কর্মসূচী।
সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দ্বীন থেকে ভন্ডামী ও জাঁকজমক দূর করা এবং জীবনের প্রত্যেক স্তরে নুরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র সুন্নত মুবারক অনুসরণ করা। দ্বীন বিশ্বাসে তিনি ছিলেন পুরাপুরি তাওহীদপন্থী,মহান আল্লাহ পাক উনার সার্বভৌমত্বে অকুন্ঠ বিশ্বাসীদ্বীনি অনুসরনে পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার একনিষ্ঠ পাবন্দ।
তিনি দ্বীন ইসলাম উনাকে নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করার চেয়ে প্রকৃত সুফী জীবন যাপনের দিকেই বেশী জোর দিতেন। কারণ তার ফলেই মানুষ একটা মহৎ করুণার উপরে হয় নির্ভরশীল। একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যেতিনি নিজের ইচ্ছা ও আশা-আকাংখাকে মহান আল্লাহ পাক উনার উপরে একান্তভাবে সোপর্দ করেছিলেনযার জন্যে তিনি উনার জীবনের প্রতি মুহূর্তে মহান আল্লাহ পাক এবং হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের ইচ্ছানুযায়ী চলতে প্রস্তুত থাকতেন।
সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অভীষ্ট পথে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে  পবিত্র হজ্বে বায়তুল্লাহ উনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উনার সাথে পবিত্র হজ্বে শরীক হওয়ার জন্যে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ উনার পাশে জমায়েত হতে লাগলেন
১২৩৬ হিঃ ৩০শে শাওয়ালই. ১৮২১ এর জুলাই মাসে প্রায় চারশো নারী পুরুষের এক বিরাট কাফেলা সাতশোতে দাঁড়ালো। দলে দলে মানুষ উনার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে লাগলেন তিনি মানুষকে সত্যিকার মুসলমানী জীবন যাপনের আহবান জানালেন এবং পবিত্র হজ্ব উনার প্রয়োজনীয়তাও ব্যাখ্যা করেন।
হজ্বকাফেলা নৌকা যোগে এলাহাবাদ থেকে বেনারসমীর্জাপুরচুনারগড়গাজীপুরদানাপুরফুলওয়ারী শরীফপ্রভৃতি স্থান অতিক্রম করে আযীমাবাদ পৌঁছে।
আযীমাবাদ অবস্থানকালে তিব্বতের একটি দল উনার সাথে দেখা করে। তিনি তাদেরকে তিব্বতে ইসলামী দাওয়াতের কাজ সুপর্দ করেন এবং বলেন যেঅসীম ধৈর্য সহকারে এ কাজ করে যেতে হবে। এভাবে তিব্বতেও সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দ্বীন ইসলাম উনার দাওয়াত প্রচার হতে থাকে।
আযীমাবাদ থেকে হজ্জ্ব কাফেলা হুগলী পৌঁছলে কোলকাতা নিবাসী জনৈক মুন্সী আমীনুদ্দীন গোটা কাফেলাকে উনার মেহমান হিসাবে কোলকাতায় নিয়ে আসেন। এখানে চারদিক থেকে খোদাপ্রেমে পাগল হাজার হাজার নারী পুরুষ উনার মুরীদ হন। বহুলোক পবিত্র হজ্ব উনার জন্যে বহু হাদিয়া ও উপঢৌকন পেশ করেন। সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনার সুললিত ও অমিয় ভাষণে তাঁদের আধ্যাত্মিক পিপাসা নিবারণ করেন। গোলাম রসূল মেহের তাঁর গ্রন্থে হজ্ব সফরের আগাগোড়া বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু কোলকাতা থেকে জাহাজ যোগে পবিত্র মক্কা শরীফ রওয়ানার তারিখ লিপিবদ্ধ করেননি।
সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি কাফেলায় মোট সাত শ তিপ্পান্ন জন হজ্ব যাত্রী ছিলো। দশটি জাহাজে উনাদেরকে বিভক্ত করে দেয়া হয়। সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি দরিয়া বাকা নামক একটি পুরাতন জাহাজে দেড়শ যাত্রীসহ যাত্রা করেন। ভালো ভালো জাহাজগুলি অন্যান্যদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেন।
রায় বেরেলী থেকে রওয়ানা হওয়ার দশ মাস পর ১২৩৭ হিঃ ২৮ শে শাবানইং ১৮২২ সালের ২১শে মে কাফেলাসহ সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন।
পবিত্র হজ্ব উনার পর সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি কয়েক মাস পবিত্র মক্কা শরীফ অবস্থান করেন।
গোটা রমযান শরীফ মাস হারাম শরীফে কাটান। অতঃপর যিলকদ মাসের প্রারম্ভে গৃহের উদ্দেশ্যে জিদ্দা পরিত্যাগ করে ২০শে যিলহজ্ব বোম্বাই পৌঁছেন। বোম্বাই থেকে কোলকাতা এবং অতঃপর ইং ১৮২৪ সালের ২৯ শে এপ্রিল আপন জন্মস্থান রায়বেরেলী পৌঁছেন।
পবিত্র হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তনের পর যেখানেই যানঅসংখ্য লোক উনাকে এক নজর দেখার জন্যে এবং উনার পবিত্র হস্তে বয়াত করার জন্যে ভীড় করতে থাকেন হাজার হাজার লোক উনার নিকটে দীক্ষা গ্রহণ করে উনার দলভুক্ত হয়ে যায়।
রায় বেরেলী পৌঁছার পর সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি সর্বাত্মক সংগ্রাম বা জেহাদের প্রস্তুতি করতে থাকেন। মুসলমান উনাদেরকে অনৈসলামিক কুসংস্কারমুক্ত করে খাঁটি তৌহিদপন্থী বানাবার জন্যে সংস্কার সংশোধনের কাজ শুরু করেন শাহ ইসমাইল। তাঁর প্রণীত তাকবিয়াতুল ঈমান এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য ও মূল্যবান গ্রন্থ।
সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেনএ দেশের বিরাট মোগলসাম্রাজ্য চূর্ণ বিচূর্ণ ও ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ধ্বংসস্তুপের উপর যে দুচারটি মুসলমান রাষ্ট্র মাথা তুলেছিলতাও শেষ হয়ে গেছে। ইংরেজ গোটা ভারতের উপরে তার আধিপত্য বিস্তার করে থাকলেও একটি বিরাট অঞ্চলে শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত।
মুসলমান উনারা শুধু রাজ্য হারান নাইআপন দ্বীন ও সেরাতে মুস্তাকীম থেকে বহু দূরে সরে পড়েছেন আকীদাহ-বিশ্বাসধ্যান-ধারণা ও আচার অনুষ্ঠান অনৈসলামী চিন্তাধারা ও ধর্মকর্মের দ্বারা প্রভাবিত। মুসলমান আমীর-ওমরা যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেনতাঁরা ভোগবিলাসে লিপ্ত এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য এ ছাড়া আর অন্য কোন কিছু ছিল না যে যেমন করেই হোক তাদের জীবনের সুখ সম্ভোগের উপায় উপাদানগুলি যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। তার জাতীয় পরিমাণ যা কিছুই হোক না কেনএ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ তাদের ছিল না।
জনগণের মধ্যে অধিকাংশের অবস্থা এই ছিল যেন তাদের উপরে বজ্রপাত হয়েছে এবং তারা জ্ঞান ও সম্বিতহারা হয়ে পড়েছেঅথবা প্রবল ভূকম্পন শুরু হয়েছে এবং তারা হয়ে পড়েছে দিশেহারা। যাদের কিছু জ্ঞান বুদ্ধি ছিলতারা কোন সমাধার খুঁজে পাচ্ছিল না। অন্ধকার ভবিষ্যতকে তারা ভাগ্যের লিখন মনে করে চুপচাপ হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল এটা মনে করে যেযা হবার তা হবেই। কিন্তু তরী যখন নদীরবক্ষে ঘুর্ণাবর্তে পতিত হবেতার পাল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবেনোংগর কোন কাজে আসবে না এবং কর্ণধারেরও কোন সন্ধান পাওয়া যাবে না তখন আরোহীদের জীবন রক্ষার কোন আশা আর বলবৎ থাকবেমুসলমানরা তখন এমনি এক নৈরাশ্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল।
মুসলমান উনাদের জাতীয় জীবনের এমনি এক নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি আগমন করেন তিনি দেখলেন উনার সম্মুখে মাত্র তিনটি পথই উন্মুক্ত রয়েছে।
এক হককে পরিত্যাগ করে বাতিলের সাথে সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন করা।
দুই হককে পরিত্যাগ না করা। বরঞ্চ হকের সংগে জড়িত থাকতে গিয়ে যেসব বিপদ আপদ ও দুঃখ দারিদ্র্য আসবেতা নীরবে সহ্য করা।
তিন পুরুষোচিত সাহস ও শৌর্যবীর্য সহকারে বাতিলের মুকাবিল করতঃ এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করার আপ্রাণ চেষ্টা করা যাতে করে হকের জন্যে বিজয় সাফল্য সূচিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
প্রথমটি হলো মৃত্যুর পথজীবনের পথ নয়। দ্বিতীয়টির পরিমাণ ফল এই হতে পারে যে ক্রমশঃ ধুঁকে ধুঁকে এবং যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার ভিতর দিয়ে জাতির জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। তৃতীয় পথটিই হলো জাতীয় আত্মমর্যাদার পথবীরত্ব ও সৎ সাহসের পথ। নবজীবন লাভ করে আত্মমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ। সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই তৃতীয় পথটিই অবলম্বন করেছিলেন। এ পথে চলার সকল যোগ্যতা ও গুণাবলী উনার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
বিভিন্ন স্থানে লিখিত পত্র প্রেরন
পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে রায় বেরেলী প্রত্যাবর্তনের পর থেকে কয়েক বৎসর তিনি জেহাদ উনার প্রস্তুতি ও প্রচারণা চালান। তিনি দেশের আলেমদের নিকট পত্র পাঠালেন ফরয হিসাবে জেহাদ উনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে। তিনি স্বয়ং এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যেসমাজ সংস্কার ও সংগঠন করতে হলে শক্তি ও খেলাফত প্রতিষ্ঠা একান্ত আবশ্যক। তিনি কতিপয় বিশিষ্ট মুসলমানের নিকটে সর্বতোভাবে জেহাদে অংশগ্রহণ করারও সাহায্য করার আবেদন জানান। একখানি পত্রে তিনি নবাব সুলেমানজাকে লিখেছিলেনঃ
 আমাদের বরাতের ফেরে হিন্দুস্থান কিছুকাল খৃষ্টান ও হিন্দুদের শাসনে এসেছে এবং তারা মুসলমান উনাদের উপর ব্যাপকভাবে জুলুম শুরু করে দিয়েছে। কুফরী ও বেদাতীতে দেশ ছেয়ে গেছে এবং ইসলামী চালচলন প্রায় উঠে গেছে। এসব দেখে শুনে আমার মন ব্যথায় ভরে গেছে। আমি হিজরত করতে অথবা জেহাদ করতে মনস্থির করেছি।-(ওহাবী আন্দোলনআবদুল মওদূদপৃঃ ১৫৭)
সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি মহান আল্লাহ পাক উনার পথে জিহাদকে উনার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে এবং পরকালে মুক্তির একমাত্র পথ হিসাবে গ্রহণ করেন। শুধু নিজের জন্যেই নয় জিহাদের প্রেরনায় উদ্ধুদ্ধ করে তিনি দেশে ও বিদেশে বহু মুসলিম শাসক ও আমীর ওমরাহর কাছে উনার জ্বালাময়ী ভাষায় বহু পত্র লিখেন।উনার বহু পত্রের মধ্যে কতিপয় পত্রের উল্লেখ করেছেন গোলাম রসূল মেহের তাঁর গ্রন্থে।
সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিম্নলিখিত শাসকদের কাছে পত্র প্রেরণ করেনঃ
১। আমীর দোস্ত মুহম্মদ খান বারাকজাই কাবুল।
২। ইয়ার মুহম্মদ খান পেশাওর।
৩। সুলতান মুহম্মদ কোহাট ও বান্নু।
৪। সাইয়েদ মুহম্মদ খান হাশতগর।
৫। শাহ মাহমুদ দুররানী হিরাট।

৬। জামান শাহ দুররানী।
৭। নসরুল্লাহ বোখারী।
৮। সুলায়মান শাহ চিত্রাল।
৯। আহমদ আলী রামপুর।
১০। মুহম্মদ বাহাওয়াল খান আব্বাসী নসরৎ জং বাহাওয়ালপুর।
উপরন্তু ভারতের অত্যন্ত প্রভাবশালী ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন আমীর ওমরাহর নিকটেও তিনি জিহাদে যোগদানের জন্যে এবং সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতার জন্যে পত্র দ্বারা আহবান জানান। উনাদের মধ্যে গোয়ালিয়রের জনৈক হিন্দু রাজা হিন্দু রাওয়ের নিকটেও তিনি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রের মর্ম নিম্নরূপঃ
বিদেশী ব্যবসায়ীরা এ দেশের শাসক হয়ে বসেছে। তারা আমাদেরকে সকল দিক দিয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের কর্ণধার যারা তারা এখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এমনি অবস্থায় নিতান্ত কর্তব্যের খাতিরে বাধ্য হয়ে কতিপয় নিঃস্ব ও দরিদ্র লোক মহান আল্লাহ পাক উনার উপর নির্ভর করেন উনার দ্বীনের খেদমতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। উনারা দুনিয়ার ধনসম্পদ ও পদ মর্যাদার প্রত্যাশী নয়। উনাদের উদ্দেশ্য হলো যেজয়লাভ করলে এ দেশের শাসনভার এ দেশেরই লোকদের হাতে তুলে দেয়া হবে