বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট
বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট
“মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল৷

এই সকল অপূর্ব গুণ লইয়া বাঙ্গলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল৷ পণ্ডিতেরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিল এবং “তৈলাধার পাত্র” কিম্বা “পাত্রাধার তৈল” এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিল ৷ তাহারা হর্ষচরিত্ত হইতে ‘হারং দেহি মে হরিণি’ প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিল এবং কাদম্বরী, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পদ্য-রসাত্মক গদ্যের অপূর্ব সমাসবদ্ধ পদের গৌরবে আত্মহারা হইতেছিল৷

রাজসভায় নর্তকী ও মন্দিরে দেবদাসীরা তখন হস্তের অদ্ভুত ভঙ্গী করিয়া এবং কঙ্কণ ঝঙ্কারে অলি গুঞ্জনের ভ্রম জন্মাইয়া “প্রিয়ে, মূঞ্চময়ি মানমনিদানং” কিম্বা “মুখর মধীরম, ত্যজ মঞ্জীরম্” প্রভৃতি জয়দেবের গান গাহিয়া শ্রোতৃবর্গকে মুগ্ধ করিতেছিল৷সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়?


ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূৱ’ করিয়া তাড়াইয়া দিত, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকে বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল৷

কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল।

মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল৷ গৌড়দেশ মূসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল৷ তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভৃমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভুমি হইল৷তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন৷ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল৷


বঙ্গভাষা অবশ্য বহু পূর্ব হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল, বুদ্ধদেবের সময়ও ইহা ছিল, আমরা ললিত বিস্তরে তাহার প্রমাণ পাইতেছি। কিন্তু বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না।

চারিদিকে হিন্দু প্রজা, চারিদিকে শঙ্খ ঘন্টার রোল, আরতির পঞ্চপ্রদীপ, ধূপ, ধূনা, অগুরুর ধৌয়া-চারিদিকে রামায়ণ মহাভারতের কথা, এবং ঐ সকল বিষয়ক গান। প্রজাবৎসল মুসলমান সম্রাট স্বভাবতই জানিতে চাহিলেন, “এগুলি কি?” পণ্ডিত ডাকিলেন,-তিনি তিলক পরিয়া, শিলা দোলাইয়া, নামাবলী গায়ে দিয়া হুজুরে হাজির হইয়া বলিলে,
“এগুলি কি জানিতে চাহিলে আমাদের ধর্মশাস্ত্র জানা চাই। দ্বাদশ বর্ষাকাল ব্যাকরণ পাঠ করিয়া ইহার মধ্যে প্রবেশাধিকার হইতে পারে।” এই ঝুনো নারিকেল না ভাঙ্গিয়া ভিতরের শাঁস খাইবার উপায় নাই ৷ বাদশাহ ক্রুদ্ধ হইল, “আমি ব্যাকরণ বুঝি না, রাজ-কাজ ফেলিয়া আমি ব্যাকরণ শিখিতে যাইব, তাহাও বামুন আমাকে পড়াইবে না,-ও সকল হইবে না। দেশী ভাষায় এই রামায়ণ-মহাভারত রচনা কর।”

গৌড়েশ্বর দেশী ভাষা শিখিয়াছিল, না হইলে প্রজা শাসন করিবে কিরূপে? সে পুরোদস্তর বাঙ্গালী সাজিয়াছিল-সে কথা পূর্বেই লিখিয়াছি। দেশী ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনা করিতে হইবে, এই আদেশ শুনিয়া পণ্ডিতের মুখ শুকাইয়া গেল, ইতরের ভাষায় পবিত্র দেব-ভাষা রচনা করিতে হইবে, চণ্ডালকে ব্রাহ্মণের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান দিতে হইবে। কিন্তু শত শত কলুক ভট্ট, রঘুনন্দন, শত শত স্মৃতি লিখিয়া শত শত বৎসরে যাহা না করিতে পারে, শাহানশাহ বাদশাহের একদিনের হুকুমে তাহা হয়-রাজশক্তি এমনই অনিবার্য ৷ অগত্যা প্রাণের দায়ে ব্রাহ্মণকে তাহাই করিতে হইল ৷

পরাগলী মহাভারতে উল্লিখিত আছে;
“শ্রীযুত নায়ক যে সে নসরত খান,
রচাইল পাঞ্চালী যে গুণের নিধান।”

এতদ্বারা প্রমাণিত হইতেছে, হুসেন শাহের পুত্র নসরত শাহ মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করাইয়াছিলেন। পাঞ্চালী (পাঁচালী) অর্থ মহাভারত । নসরতের আদেশে রচিত মহাভারতের উল্লেখ আমরা পাইয়াছি, কিন্তু পুস্তকখানি এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই । এই গ্রন্থ অনুমান ১8৯৮ খৃষ্টাব্দে রচিত হইয়াছিল। তখনও নসরত সম্রাট হন নাই-তাহাকে শুধু ‘নায়ক’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।

হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য পূর্বাঞ্চলে প্রেরিত হন, তাহার বংশধরগণ ফেনী নদীর তীরস্থ পরাগলপুরে (নোয়াখালী জেলার) এখনও বাস করিতেছেন, এখনও তাহারা তথাকার ভূম্যাধিকারী। এক সময়ে পরাগল খাঁ ও তৎপুত্র ছুটি খাঁর প্রতাপ এই প্রদেশে পরিব্যপ্ত ছিল, ছুটি খাঁর সম্বন্ধে কবি শ্রী করণ নন্দী লিখিয়াছে,
“ত্রিপুরা নৃপতি যার ভয়ে এড়ে দেশ
পর্বত গহবরে গিয়া করিল প্রবেশ।”

তখন ত্রিপুরার রাজা ছিল ধর্মমাণিক্য । তাহার মত এত বড় পরাক্রমশালী রাজা ত্রিপুরার ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি দেখা যায়না ৷ তাহার প্রধানমন্তী ছিল চাণক্যতুল্য রাজনীতি-বিশারদ রায়চান। এহেন সম্রাটও ছুটি খাঁর ভয়ে উদয়পুরের পার্বত্য দুর্গের নিভৃত কোণে আশ্রয় লইয়াছিলেন বলিয়া শ্রীকরণ নন্দী আমাদিগকে জানাইয়াছে।

হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক জনৈক সুপণ্ডিত কবিকে মহাভারতের অনুবাদ রচনা করিতে নিযুক্ত করে।কবীন্দ্র পরমেশ্বর বহু স্থানে পরাগল খাঁর প্রশংসা করিয়াছেন, ‘শ্রীযুক্ত পরাগল খান পদ্মিনী ভাস্কর তিনি।’ ‘রস বোদ্ধা’, ‘গুণগ্ৰাহী’ ইত্যাদি বিশেষণ তার প্রতি সর্বদা প্রযুক্ত হইয়াছে ৷ কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রী করণ নন্দী উভয়েই মহাভারত অনুবাদের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়াছেন ৷ কবীন্দ্র লিখিয়াছে,
“নৃপতি হুসেন শাহ গৌড়ের ঈশ্বর
তান হক্ সেনাপতি হওন্ত লস্কর ৷
লস্কর পরাগল খান মহামতি
পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।
সুবর্ণ বসন পাইল অশ্ব বায়ুগতি।
লস্করী বিষয় পাই আইবন্ত চাহিয়া
চাটিগ্রামে চলি গেল হরষিত হৈয়া।
পুত্র পৌত্রে রাজ্য করে খান মহামতি
পুরাণন শুনস্ত নিত্য হরষিত মতি।।”

কবীন্দ্র পরমেশ্বর সংস্কৃতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিল এবং মহাভারতের স্ত্রী-পর্ব পর্যন্ত অনুবাদ রচনা করে। পরাগলের বিজয়দৃপ্ত সুযোগ্য পুত্র ছুটি খাঁ শ্রী করণ নন্দীর দ্বারা মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ সংকলন করাইয়াছিল৷ শ্রী করণ নন্দী তাহার গ্রন্থের ভূমিকায় ঐতিহাসিক অনেক কথাই লিখিয়াছ ৷ পরাগল খাঁর আদেশে বিরচিত মহাভারতের এক জায়গায় কবীন্দ্র পরাগল-তনয় ছুটি খাঁর উল্লেখ করিয়াছেনঃ
“তনয় ছুটি খাঁ পরগ উজ্জ্বল
কবীন্দ্র পরমেশ্বর রচিল সকল ৷”

সেই স্বভাবের নিভৃত পরম সুন্দর নিকেতন চন্দ্রশেখর পর্বতের ক্রোড়া দেশে, শ্যামল বনস্পতি সচল মুক্তার পংক্তির ন্যায় নির্ঝরধারা অধ্যুষিত পরম রমণীয় রাজধানীতে বসিয়া প্রজারঞ্জক বা মহাবীর মুসলমান সেনাপতিরা হিন্দু পণ্ডিতের দ্বারা রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ করাইয়াছিল । তাহাদের কীর্তি জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হউক-এই ছিল হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা।

সে কামনা চরিতার্থ হইয়াছে । আজ ৪৫০ বৎসর পরে তাহাদের মাতৃভাষার গৌরবের সঙ্গে প্রজারঞ্জক এই রাজাদের কাহিনী দেশবিশ্রুত হইয়াছে । পরাগল খাঁর পিতা রাস্তি খানের সমাধি এখনও পরাগলপুরে বিরাজিত । ঐ পল্লীতে বিশাল পরাগলী দীঘি এখনও সেই মহামান্য লস্কর খানের স্মৃতি বহন করিয়া তরঙ্গায়িত হইতেছে ৷


হুসেন শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটেরা দেশীয় ভাষায় কতটা অনূরাগী ছিলেন, তাহার প্রমাণ প্রাচীন বঙ্গ-সাহিত্যের অনেক স্থানেই পাওয়া যায় । কবি বিদ্যাপতি লিখিয়াছে,

“সে যে নসিরা শাহজাদা যারে হানিল মদন বানে
চিরঞ্জীবী রহ প্রভু গৌড়েশ্বর; করি বিদ্যাপতি ভনে ।”

অন্যত্র, “প্রভু গায়েশ উদ্দীন সুলতান।”

পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন কবি বিজয় গুপ্ত তাহার মনসাদেবীর ভাষান গান রচনা করে, তখন গৌড়ের তখতে হুসেন শাহ সমাসীন ছিল । কবি অতি সশ্রদ্ধভাবে তাহার উল্লেখ করিয়াছে, “সনাতন হুসেন শাহ নৃপতি তিলক।” কবি যশোরজ খান হুসেন শাহ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন,
“শাহ হুসেন, জগত ভুষণ, সেই রস জানে
গৌড়েশ্বর, ভোগ পুরন্দর যশোরাজ খানে ।”

বঙ্গের ইতিহাসে সেই যুগে একমাত্র রাজা গণেশ ক্ষণকের বিদ্যুৎচমকের ন্যায় হিন্দুশক্তির স্ফূরণ দেখাইয়াছিল এবং তারপর মুসলমানগণের হস্তে পুনরায় রাজদণ্ড আসিয়া পড়িয়াছিল । গণেশের পুত্র যদু জালালউদ্দিন নাম গ্রহণ করিয়া মুসলমান ধর্ম অবলম্বনপূর্বক হিন্দু সিংহাসনে তাহার দাবী রক্ষা করিয়াছিলেন ৷

রাজা গণেশ স্বয়ং হিন্দু হইলেও তাহার উপর মুসলমান প্রভাব এত বেশী হইয়াছিল যে, সে মুসলমানদিগের বিশেষ সাহায্য পাইয়া রাজতখত অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিল ।

সন-তারিখের সূক্ষ আলোচনা করিলে মনে হয়, এই গণেশ রাজাই কৃত্তিবাসকে রামায়ণের অনুবাদ সংকলনের আদেশ প্রদান করিয়াছিল ৷

তৎপূর্ববর্তী গৌড়ের মুসলমান সম্রাটগণ হয়ত হিন্দু পণ্ডিত দ্বারা সংস্কৃত পুরাণের বঙ্গানুবাদ সংকলনের প্রথা প্রচলন করিয়াছিল মাত্র; তাহার একটি প্রমাণ এই যে, গৌড়ের শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ১৩১৫ শকাব্দে (১৩৭৩ খৃ.) মালাধর বসুকে “গুণরাজ খাঁ” উপাধি দিয়া তাহার দ্বারা ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্দের অনুবাদ করিয়াছিল । মালাধর বসু কুলীন গ্ৰামবাসী বিখ্যাত বসুবংশীয় এবং কৃত্তিবাসের প্রায় সমসাময়িক করি । পরপর অনেক মুসলমান সম্রাটের সঙ্গে বঙ্গীয় পুরাণানুবাদকের নাম গ্রথিত দেখা যায় । সুতরাং আমাদের নিঃসন্দেহভাবে এই ধারণা বদ্ধমূল হইয়াছে যে, গৌড়েশ্বরগণের সহায়তা না পাইলে বঙ্গভাষা মাথা উঁচু করিয়া সুধী সমাজে দাঁড়াইতে পারিত না, মাথা হেঁট করিয়া পল্লীর এক কোণে চির উপেক্ষিতা হইয়া পড়িয়া থাকিত।


এই সকল পুস্তক যে বাঙ্গলা ভাষায় বিরচিত হইতেছিল, ব্রাহ্মণগণ উহা কিরূপ চক্ষে দেখিত, তাহা তাহাদের রচিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক ও বাঙ্গলা প্রবাদ বাক্য হইতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় । “অষ্টাদশ পুরাণমণি রামস্য চরিতানিচ ৷ ভাষায়াং মানবং শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ” অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ণ যাহারা বাঙ্গলা ভাষায় শ্রবণ করিবে, তাহারা রৌরব নামক নরকে গমন করিবে ।

ব্যক্তিগতভাবে কৃত্তিবাস ও কালীদাস এই কুকার্য করিয়াছিল বলিয়া তাহারা ব্রাহ্মণের ক্রোধবহ্নি হইতে নিষ্কৃতি পায় নাই । আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কায়স্থকুলোদ্ভব কাশীদাস তাহার মহাভারতের প্রতি পত্রে ব্রাহ্মণদের এত স্তব-স্তৃতি করিয়াও তাহাদের অভিশাপ হইতে অব্যাহতি পায় নাই । সে তো ভনিতায় “মস্তকে রাখিয়া ব্রাহ্মণের পদরাজ্য:” প্রতি পৃষ্ঠায় লিখিয়া তাহাদের মনস্তুষ্টি করিতে চেষ্টা পাইয়াছিল । কিন্তু তথাপি ব্রাহ্মণ রচিত এই প্রবাদ বাক্য-“কৃত্তিবেশে কাশীদেশে আর বামুন ঘেঁষে এই তিন সর্বনেশে” (কৃত্তিবাস, কাশীদাস এবং যাহারা বামুনদের সঙ্গে ঘেঁষিয়া সমান হইতে চায়- এই তিন সর্বনেশে) এখনও স্মরণীয় হইয়া আছে ।

এহেন প্রতিকূল ব্রাহ্মণ সমাজ কি হিন্দু রাজত্ব থাকিলে বাঙ্গলা ভাষাকে রাজসভার সদর দরজায় ঢুকিতে দিত? সুতরাং এ কথা মুক্তকঠে বলা যাইতে পারে যে, মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলা ভাষাকে রাজ দরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতনভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন ।

আরাকান রাজের প্রধান সচিব মুসলমানধর্মী ছিলেন, কিন্তু তাহার নাম ছিল মাগন ঠাকুর । ১৬২৬-২৭ খৃ: অব্দে মাগন ঠাকুর সৈয়দ আলওয়াল নামক কবিকে মালিক মোহাম্মদ রচিত পদ্মাবৎ নামক হিন্দী কাব্যের বাঙ্গলা তরজমা করিতে নিযুক্ত করেন । বাঙ্গলা পদ্মবৎ গ্রন্থের উল্লেখ আমরা পুনরায় করিব ৷ দৌলত কাজী নামক এক করি “লোর চন্দ্রানি” নামক কাব্য রাজানুগ্রহে রচনা করেন ।

মুসলমান রাজ-রাজারা যে রীতি প্রবর্তন করেন, তাহা ব্রাহ্মণগণের নিষেধ-বিধি ও উপেক্ষা অগ্রাহ্য করিয়া প্রচলিত হইয়াছিল; শাহানশাহ বাদশাহগণ যাহা করিলেন, ছোট ছোট হিন্দু রাজন্যবর্গ তাহার অনুকরণ করিতে লাগিল ৷ এইভাবে বঙ্গভাষা ক্ষুদ্র-বৃহত রাজসভায় প্রতিষ্ঠা পাইয়া বিজয়ী হইল ৷ ব্রাহ্মণগণই স্বয়ং রৌরব নরকের ভয় অতিক্রম করিয়া শাস্ত্রগ্রন্থের বঙ্গানুবাদ প্রণয়নে তৎপর হইল।আমরা ষোড়শ শতাব্দীর কবি ষষ্ঠিবরকে জগদানন্দ নামক মুরুব্বীর আদেশে মহাভারতের অংশবিশেষের অনুবাদ করিতে দেখিতে পাই ৷ এই ব্যক্তি সম্ভবতঃ কোন জমিদার বা প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিল ।
মুসলমানগণ এইভাবে বঙ্গদেশে বাঙ্গলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া আমাদের সাহিত্যে এক নূতন যুগ আনয়ন করিলেন । শুধু তাহাই নয়, তাহাদের প্রভাব আমাদের ভাষার বক্ষে আরবী-ফারসী ভৃগু পদচিহ্ন অঙ্কিত করিয়া দিল। প্রাকৃত ভাষার উপর ঐ সকল বিদেশী ভাষার দুচ্ছেদ্য ছাপ পড়িয়া গেল। মুসলমানেরা রাজ তখতে বসিলেন। তাহারাই সর্ববিষয়ে দেশে প্রাধান্য লাভ করিলেন । বিলাসের আসবাব রাজদরবারে যাহা কিছু শাসন সংক্রান্ত সমস্ত উচ্চপদ তাহাদের অধিকৃত হইল।

বাঙ্গলা ভাষার অভিধান বদলাইয়া গেল। ‘রাজস্ব’ শব্দ ‘খাজনায়’ পরিণতি হইল, ‘প্রজা’রা ‘রায়ৎ’ হইয়া গেল। ‘মহাপাত্র’ ‘উজীর’ হইলেন, ‘নিশিপত’ ‘কোটাল’ হইল, ‘ধর্মাধিকারী’ ‘কাজী’ হইলেন, ‘ভৃত্য’ ‘নফর’ হইল, ‘দোষী ব্যক্তি’ ‘আসামী’ হইল, ‘অভিযোগ কারী’ ‘ফরিয়াদী’ হইলেন ৷ ‘বিচারালয়’ বা ‘রাজসভা’ ‘আদালত’ ও ‘দরবারে’ পরিণত হইল। ‘প্রভু ’ হইলেন ‘হুজুর’ , ‘দাস’ হইল ‘খেদমতগার’।এইরূপ অসংখ্য শব্দ আলোচনা করিলে দেখা যাইবে যে, জাতীয় জীবনের উচ্চস্তরের ভাষা অনেকটা পরিবর্তিত হইয়া গেল ৷

যেখানে বিলাস, যেখানে আমোদ-প্রমোদ, সেখানেও বিজেতাদের ভাষা প্রভাব বিস্তার করিল।যাহা সামাজিক জীবনের অধ:স্তরের কথা, সেই শব্দগুলি শুধু প্রাকৃত ভাবাপন্ন রহিয়া গেল। কুটির বা কুঁড়ে কথার পরিবর্তন হইল না, মেটে তেলের দীপটি কুঁড়েঘরে ‘প্রদীপ’ বা ‘পিদিম’ হইয়া জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু রাজপ্রাসাদে বা প্রাসাদোপম গৃহের আলো, ঝাড়, ফানুস, দেয়ালগিরি প্রভৃতি নাম বিদেশী কায়দা অবলম্বন করিল।শেষোক্ত শব্দটির শেষাংশ ফরাসীর অপভ্রংশ।


ভাত, ডাইল, তেল, ঘি, ক্ষেতের শস্য প্রভৃতি নাম বদলাইল না। কিন্তু খাদ্য যেখানে উপাদেয় ও বিলাসীর যোগ্য, তখন তাহা ‘খানা’ হইয়া গেল।ক্ষেত যখন প্রভুত্বের নিদর্শন সেখানে তাহা ‘জমি’।‘ভূস্বামী’ জমিদার হইয়া পড়িলেন।দেশের বাণিজ্য ধীরে ধীরে মুসলমানের হস্তগত হইল, তখন উহার নাম হইল ‘কারবার’ , কারবারের সঙ্গে ‘আমদানী’ ‘রপ্তানী’ও বঙ্গভাষায় ঢুকিল।

সৌখিন লোকদের সুগন্ধি-অগুরু ও চন্দনের স্থলে ‘আতর’ ‘খােশবাে’ অধিকার করিয়া লইল । আকাশের বায়ু, তারা, চাঁদ, সূর্য এইগুলি অভিধানে রহিয়া গেল কিন্তু যেখানে বড় মানুষদের গৃহ কৃত্রিম আলোমালায় সুশোভিত হইল, সেখানে তাহা ‘রৌশনাই’ নাম ধারণ করিল। পূর্বে মাগধী ‘সূত’ ও ‘বন্দীরা’ শ্রুতিমধুর বন্দনাগীতি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গীতের সঙ্গে মিল রাখিয়া প্রত্যুষে গান করিত।সেই সঙ্গীতের মােহনীয় গুণে রাজাদের নিদ্রাভঙ্গ হইত, কিন্তু এখন তাহার স্থলে ‘রৌশনিচৌকী’ ‘নহবত’ ইত্যাদি শব্দ প্রবর্তিত হইল ।‘রাজসিংহাসন’ ‘তখতনামায়’ পরিণত হইল।

তাহা ছাড়া বিচারালয়ের সমস্ত শব্দ, ‘মতরজ্জম’, ‘নাজির’, ‘দলিল’, ‘দস্তরখানা’, মােক্তার’, ‘আইন’, ‘মুসাবিদা’, ‘পেয়াদা’ ‘খাজাঞ্চিখানা’ ‘উকীল’ ‘আরজী’ প্রভৃতি শত শত শব্দ প্রাচীন ভাষার প্রাকৃত শব্দের স্থল কাড়িয়া লইয়া নিজেদের অধিকার বিস্তার করিল।

আমরা দেখিতে পাইলাম, বঙ্গভাষা মুসলমান সম্রাটদের কৃপায় দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করিয়া ‘দ্বিজের’ ন্যায় সম্মান লাভ করিল ৷ বঙ্গভাষার উপর আরবী ও ফারসী তাহাদের সুস্পষ্ট ছাপ অঙ্কন করিয়া দিল ৷

এইবার আমরা দেখাইব তাহারা শুধু বঙ্গভাষার উপর পুর্বোক্ত প্রভাব বিস্তার করিয়াই নিরস্ত হন নাই, তাহারা বঙ্গভাষাকে অপূর্ব কবিত্ব সম্পদে ভূষিত করিয়াছেন।তাহারা মুসলমানী কিতাব লিখিয়া বাঙ্গলাকে উর্দুর দিকে টানিয়া আনিয়াছেন সত্য, কিন্তু বিকৃত মুসলমানী বাঙ্গলায় আমরা বঙ্গভষায় তাহাদের রচনার উত্কর্ষের বিশিষ্ট নিদর্শন পাই নাই।

অনুমান ১৫৭৮ খৃষ্টাব্দে ফতেয়াবাদ পরগণায় সৈয়দ আলওয়ালের জন্ম হয়। ইনি বাঙ্গলা ভাষায় এতটা সংস্কৃত শব্দ আমদানী করিয়াছেন যে, স্বয়ং ভারতচন্দ্রও ততটা করিয়াছে কিনা সন্দেহ।ইনি সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ, অলঙ্কার ও সাহিত্যে বিশেষ বূৎপন্ন ছিলেন এবং স্বীয় পদ্মাবৎ গ্রন্থে অনেক সংস্কৃত শ্লোক নিজে রচনা করিয়া জুড়িয়া দিয়াছেন।আলওয়ালই তাঁহার আদি বার্তাবহ।


আলওয়াল জীবনে বহু কষ্ট সহ্য করিয়াছিলেন, যৌবনে এক জাহাজে চড়িয়া তাহার পিতা মজলিস কাজির সংগে বঙ্গোপসাগরে যাইতেছিলেন । পর্তুগীজ জলদস্যুরা তাহাদের জাহাজ আক্রমণ করে । সেই সমুদ্র বক্ষে জাহাজের উপর ছোটখাট একটি পানিযুদ্ধ হয়। আলওয়ালের পিতা যুদ্ধে নিহত হন । কোন রকমে অব্যাহতি লাভ করিয়া আলওয়াল আরাকান যাইয়া তথাকার সচিব মাগন ঠাকুরের আশ্রয় লাভ করেন । মহামান্য মাগন ঠাকুর তাঁহার পাণ্ডিত্য ও কবিত্ব দেখিয়া মুগ্ধ হন এবং তাহারই আদেশে আলওয়াল ‘পদ্মাবৎ’ কাব্যের অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হন।

এই সময় সুজা বাদশাহ আরাকানে উপস্থিত হন এবং তাহার সহিত আরাকানরাজের মনােমালিন্য ঘটে ৷ সুজা বাদশাহের গুপ্তচর বলিয়া আলওয়াল একটি মিথ্যাবাদী লোকের সাক্ষ্যে অভিযুক্ত হন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়া সাত বৎসরকাল কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন। তৎপরে উদ্ধার পাইয়া তিনি “ছয়ফুল মুল্লুক ও বদিউজ্জামান” নামক একখানি বাঙ্গলা কাব্য রচনা করেন।


আলওয়ালের আরও অনেক কাব্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনও সাদরে পঠিত ও গীত হইয়া থাকে ৷ তিনশত বৎসর পরেও যে কবির কাব্য জনসাধারণ হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিয়াছেন, তাহার কবিতার গুণাগুণ আর সমালোচনাসাপেক্ষ নহে ৷ তিনশত বৎসর যাবৎ যে কাব্য লোকের হৃদয়ে আনন্দ দান করিয়াছে, তাহার সমালোচনার আর বাকী কী আছে?

বাঙ্গলার একটি প্রদেশের একখানি ক্ষুদ্র ইতিহাস আছে ৷ ইহা এত ছোট যে, ইহাকে একখানি ইতিহাসিকা বলা চলে, ইহার প্রায় ৪০০ ছত্র কবিতা আছে । শমসের গাজী.… কালক্রমে এমন প্রবল হইয়া উঠেন যে, তিনি ত্রিপুরেশ্বরকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া তৎস্থলে নিজে অধিষ্ঠিত হন । শমসের আলীবর্দি খাঁর সমসাময়িক লোক ও প্রায় দৃইশত বৎসর পূর্বে জীবিত ছিলেন । এখনও শমসের গাজির গান ত্রিপুরার গীত হইয়া থাকে । অবশ্য ত্রিপুরার ‘রাজমালা’ গ্রন্থে তার বিবরণ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ আছে । শমসের গাজির বিবরণ সমস্তই ঐতিহাসিক।

ইনি রাজপদ প্রাপ্ত হইয়া দেশে শিক্ষা প্রচলনের যে রীতি প্রবর্তিত করিয়াছিলেন, ধান-চাউল ও অপরাপর খাদ্যদ্রব্যের এবংসোনা-রূপার যে দর বাঁধিয়া দিয়াছিলেন, রাস্তাঘাট নির্মাণ করিয়া দেশের যে উন্নতি সাধন করিয়াছিলেন, তাহার একটি নিখুঁত ও খাঁটি চিত্র আমরা এই পুস্তকখানিতে পাইয়াছি ।… নানারূপ ঐতিহাসিক তত্ত্বে এই পুস্তকখানি পূর্ণ ৷ যদিও গ্রন্থকারের নাম নাই, তথাপি তিনি যে মুসলমান ও শমসের গাজির অন্তরঙ্গ ভক্ত ছিলেন বই পড়ার পর তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না ।

বঙ্গের যে পল্লীসঙ্গীত মুসলমান কৃষকের অতুলনীয় সম্পদ, যে গৌরব নভস্পর্শী অপূর্ব, আশ্চর্য, তাহার কথা আমি পরে লিখিতেছি । এখন এই সঙ্গীতের স্রোত মুসলমান সমাজে অবরুদ্ধ করিলে তাহাদের জাতীয় জীবন শুকাইয়া মরিবে ৷

বাড়ীখানি গঙ্গার তীরে অবস্থিত, সেই সুর নদীকে বদ্ধ করিলে জাতীয় জীবনের রসধারা কে সঞ্জীবিত রাখিবে? আমির খসরু, মিঞা তানসেন সঙ্গীত বিদ্যারূপ হিমাদ্রির কাঞ্চন জঙঘায় অধিরােহণ করিয়াছিলেন । ইহারা কি ইসলামের শত্রু ছিলেন?

এ পর্যন্ত আমরা অনেক মুসলমান বাঙ্গলা কবির নাম করিয়াছি, কিন্তু তাহা অতি নগণ্য অংশ ৷ পূর্ববঙ্গের নিরক্ষর মুসলমান চাষা ও মাঝিরা মুখে মুখে যে সকল গান বাঁধিয়া থাকে, তাহা অনেক সময় অতি সুন্দর কবিত্বময় ।

এই বঙ্গদেশে কত মসজিদ, কত ইষ্টক ও শিলালিপি, কত কীর্তিস্তম্ভ মুসলমানের বিজয়ের বার্তা ঘোষণা করিতেছে । বঙ্গদেশে এমন পল্লী নাই, যেখানে মুসলমানদের গৌরব ও পরাক্রান্ত অভিযানের কথা নাই, যেখানকার ধূলি পীর-দরবেশদের পদধূলি কিম্বা সমাধিতে পবিত্র হয় নাই । কতজন তাহার খবর রাখেন?

এ পর্যন্ত আমরা দেখাইছি বাঙ্গলা সাহিত্যের উপর মুসলমানদের কতটা প্রভাব পড়িয়াছে । কিন্তু শুধু তাহাই নহে, বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমান কবি রাজসিংহাসনের দাবী করিতেছেন, বাঙ্গলা সাহিত্যে এরূপ মুসলমান কবির আবির্ভাব হইয়াছে যাঁহারা কবিকুল চক্রবর্তী, যাহাদের যাশোভাদির নিকট আলওয়াল এমন কি ভারতচন্দ্রের খ্যাতিও পরিম্লান হইয়াছে ।

সম্প্রতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তিন খণ্ড পল্লীগীতিকা প্রকাশিত করিয়াছে । তাহাতে মুসলমান কবিদের যে কবিত্বের নিদর্শন আছে, তাহা অতুলনীয় । দুঃখের বিষয় এই সকল পল্লীগীতি সম্বন্ধে এদেশের লোক ততটা অবহিত নহেন ৷ এই পল্লীগীতিকার প্রথম খণ্ডে ‘দেওয়ানা মদীনা’ নামক একটি পালাগান প্রকাশিত হইয়াছে ৷ তৎসম্বন্ধে ফরাসীদেশের বিখ্যাত লেখক মহাত্মা রোম্যা রােলাঁ লিখিয়াছেন, এরূপ অদ্ভুত কাব্য তিনি গ্রাম্য কৃষকের নিকট হইতে প্রত্যাশা করেন নাই । পল্লী কৃষককবি কিরূপে নিপুণ শিল্পীর ন্যায় এই আশ্চর্য কীর্তির মঠ রচনা করিয়াছেন, তাহা তাহার বিস্ময়ের সৃষ্টি করিয়াছে।

“দেওয়ানা মদিনা”র প্রসিদ্ধ গায়ক ছিলেন ‘জালাল গাএন’ । তিনি যখন ভাটিয়াল সুরে এই গানটি গাহিতেন, তখন বেদনায় শ্রোতাদের হৃদয় ভরিয়া উঠিত ও তাঁহারা আর্তনাদ করিয়া কাঁদিয়া উঠিতেন ৷ উহা রয়াল আট পেজি ফর্মার ৩য় পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ । এত ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে এরূপ করুণ রসাত্মক কাব্য আমরা আর কোন সাহিত্যে পড়িয়াছি বলিয়া মনে হয় না ।

জামাত উল্লা বয়াতির রচিত ‘মাণিক তারা’ বা ‘ডাকাতের পালা’ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হইয়াছে ৷ এই পালা গানটির কাব্য-ঐশ্বর্য অতুলনীয় । কৃষক-কবি চাষাবাদের জীবনের যে নিখুঁত ছবি আঁকিয়াছেন, বঙ্গ-সাহিত্যে তাহার সমকক্ষ কবিতা কতটি আছে জানি না । এই গানটির কোন স্থানে নিপুণ শিল্পীর ন্যায় লিপিকুশলতা, কোথাও হাস্যরস্যেজ্জ্বল হৈমন্তিক রৌদ্রের ন্যায় সুখদ-পদবিন্যাস, কোথাও পূর্বরাগের রমণীয়তা- এ সমস্তই এমন দক্ষতার সহিত লিখিত হইয়াছে যে জামাত উল্লাকে সারস্বত কুঞ্জের প্রথম পংক্তিতে স্থান দিতে বোধ হয় কাহারও আপত্তি হইতে পারেনা।

গ্রাম্য কবির এই কাব্যখানি প্রত্যেক বঙ্গোলীর পাঠ করা উচিত । পাড়াগেঁয়ে ভাষা কোন স্থানে প্রাদেশিকতার বাহুল্যে দৃর্বোধ্য কিন্তু ধূলিমাটি মলিন হীরকের জ্যোতি কি সেই সকল বাহিরের মলিনতা ফুটিয়া বাহির হয় না? মাণিক তারার কবিত্বভাতির গ্রাম্য ভাষার মধ্য হইতে সেইরূপ ফুটিয়া বাহির হইয়াছে ।

তৃতীয় খণ্ডেও অনেকগুলি পালাগান আছে, তন্মধ্যে “মঞ্জুর মার পালা”টি উৎকৃষ্ট । যদিও কবির নাম পাওয়া গেল না, তথাপি ইহা যে মুসলমান কবির লেখা-সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না।মনির নামক এক মুসলমান সাপুড়ের কথা লইয়া এই কাব্য রচিত।

তৃতীয় খণ্ডের পল্লীগীতিকায় আর কয়েকটি উৎকৃষ্ট পালা আছে, তাহার একটি মনসুর ডাকাত বা কাফন চোরার পালা । এই মনসুর ডাকাতের জীবনের গতি কিভাবে ফিরিয়া গিয়াছিল, অতি জঘন্য নীচ ও নৃশংস-দস্যুবৃত্তি ছাড়িয়া সে কিরূপে একজন শ্রেষ্ঠ পীর ও সাধু হইয়াছিল, সেই মনস্তত্বের আধ্যাত্মিক চিত্রপটখানি করি এই পালা গানটিতে উদঘাটিত করিয়া দেখাইয়াছেন । ইহার মাঝে মাঝে এমন সুন্দর কবিত্বপূর্ণ চরণ আছে যাহা পড়িলে কবিকে পল্লী-কালিদাস বলিয়া প্রশংসা করিতে ইচ্ছা হয় ।

একটি নববিবাহিতা নারী পল্লীপথে প্রথম শ্বশুরবাড়ী যাত্রা করিয়াছেন ৷ জ্যোৎস্না ধবধবে রাত্রি, আটজন পাল্কীবাহক তাহাকে লইয়া যাইতেছে-কবি সেই রাত্রি দুইটি ছত্রে বর্ণনা করিয়াছেন ৷ কবি লিখিয়াছেন-জ্যোৎস্না রাত্রি, দোলা চলিয়া যাইতেছে-কেহ যেন মুষ্টি মুষ্টি বেলফুলের কলি দ্যুলোক হইতে ভূলােকে ছড়াইয়া ফেলিতেছে, এমনই সুন্দর জ্যোৎস্না ৷

এই জ্যোৎস্না রাত্রে মনসুর ডাকাত কুর্ম্মাই খালের একটা বাঁকের কাছে, কেতকী ঝাড়ের আড়ালে লুকাইয়া পাল্কীখানির গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছে । দােলার গতি, জ্যোৎস্নার বর্ণনা কবিতাগুলিকে এমন একটা ছন্দ দিয়াছে যে, মনে হয় যেন আমরা বাহকদের পদশব্দ শুনিতে পাইতেছি ও মনসুর ডাকাতের ব্যাঘ্রমূর্তি চাক্ষুষ করিতেছি । কিন্তু মনসুরের পরিবর্তনের কথাটি অতি অপূর্ব। সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, দিনে পাচবার নামাজ পড়িবে । এই দুর্দান্ত দস্যু যে রমণীকে প্রকৃতই ভালবাসিয়াছে, তাহার নিকট এই প্রতিজ্ঞা-সুতরাং তাহা দুর্লঙ্ঘ।

হাতীখেদার গানটি একশত বৎসর পূর্বের রচনা ৷ এমন একটা বিষয় লইয়া যে কবিতা রচিত হইতে পারে, তাহা অনেকেরই ধারণার অগম্য । কিন্তু গ্রাম্য মুসলমান কবি ইহাতে অপর্যাপ্ত কাব্যরস ঢালিয়া দিয়াছেন । কবিতাগুলির বিদ্রুপছন্দ যেন শিকারীদের পদশব্দের সঙ্গে তাল রাখিয়া চলিয়াছে । কবিতাগুলি একবারে স্বভাবের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতি রাখিয়া কোন স্থানে বন্দুকের আওয়াজ, অগ্নিদাহের চটপট শব্দ, কোথাও শিবিরে দর্শকদের কােলাহল ও মশালের আলোকমালার দীপালির শোভা যেন পাঠককে প্রত্যক্ষ করাইয়া সেই অদ্ভুত বন্য-অভিযানের একেবারে কেন্দ্রস্থলে লইয়া গিয়াছে । হাতিগুলির ভীষণতা, বুদ্ধিহীনতা, অকারণ আশঙ্কা, দলবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা- খেদার মধ্যে ঢুকিয়া তাহাদের

আর্তনাদ ও না খাইয়া অস্থি-চর্মসার হইয়া যাওয়া–এই সমস্তই হয়ত নিতাস্ত নিরস বিষয়-কিন্তু এগুলিকে যে কবি এরূপ রসাত্মক করিতে পারিয়াছেন-তাহার কবিতত্ব ধন্যবাদার্হ-ইহা স্বীকার করিতে হইবে । ভাষা চাটগেঁয়ে, অনেক স্থলে বুঝিয়া উঠা কঠিন, কিন্তু নারিকেলের খােলাটা ভাঙ্গিয়া ফেলিলে যেরূপ ভিতরের সকলেই সুস্বাদদু ও সরস, ভাষার বাধাটা অতিক্রম করিলে এই কবিতাও তেমনিই উপভোগ্য ও পরম উপাদেয় বোধ হইবে ।

আমরা মুসলমান বিরচিত আরও অনেক পালাগানের উল্লেখ করিতে পারিলাম না-সেগুলিতে কবিত্বের অভাব নাই, কিন্তু আমাদের স্থান ও সময়াভাব ।

মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের একরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না । তাহারা বহু ব্যয় করিয়া শাস্ত্রগুলির অনুবাদ করাইয়াছিলেন এবং সেগুলি আগ্রহ সহকারে শুনিয়া আনন্দিত হইতেন । আরব-দেশবাসীরা অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ করাইয়াছিলেন ৷

আবুল ফজলের ভ্রাতা ছদ্মবেশে কাশীতে যাইয়া সংস্কৃত শিক্ষা করিয়া আসিয়া শাস্ত্রগ্রন্থ অনুবাদ করিয়া সম্রাটকে সন্তুষ্ট করিয়াছিলেন, ইহাতে নূতন কথা কিছুই নাই।বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা।বহু পুস্তক বাঙ্গলা ভাষায় রচনা করিয়া মুসলমান কবিগণ কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন,- পালাগানে তাহারা যে শক্তি ও কবিতত্ব দেখাইয়াছেন, তাহাতে সাহিত্যিক আসরে তাহাদের স্থান প্রথম পংক্তিতে ।

কয়েকজন শিক্ষিত বাঙ্গালী হিন্দু এখন বঙ্গ-সাহিত্যের কাণ্ডারী হইয়াছে সত্য, কিন্তু গোটা বঙ্গদেশের সাহিত্য এখনও মুসলমানের হাতে-এই কথার এক বর্ণও মিথ্যা নহে। ময়নামতীর গান হইতে আরম্ভ করিয়া গোরক্ষ-বিজয়, ভাসান গান ও পূর্বোক্ত শত শত পালা গান, মুরশিদা গান, বাউলের গান এ সমস্তই মুসলমানদের হাতে । তাহারাই অধিকাংশ স্থলে মূল গায়েন ৷ তাহারাই তরজার শুরু ।

এই বঙ্গদেশ যে সুধামধুর কবিত্বরসে অভিষিক্ত, তাহার প্লাবন আনিয়াছে মুসলমান কৃষকরা । একবার ধান কাটার পর বঙ্গদেশ-বিশেষ করিয়া পূর্ববঙ্গ ঘুরিয়া আসুন, দেখিবেন, মুসলমান কৃষকেরা দল বাঁধিয়া কত প্রকার গান গাহিয়া এদেশকে আনন্দ বিতরণ করিতেছে । হিন্দুরা এ বিষয়ে কোনক্রমেই মুসলমানের সমকক্ষ নহে ।

দু’চারিজন শিক্ষিত লোক লইয়া এদেশ নহে । দু’চারিজন উপন্যাস পডুয়ার হাতে বঙ্গদেশটি নহে ৷ বঙ্গদেশ বলিতে যে সপ্তকােটি লোক বুঝায় তাহার শতকরা ৯০ জনেরও বেশী আধুনিক উচ্চশিক্ষার কোন ধার ধারে না । এই সুবৃহত জনসাধারণের শিক্ষা বড় সাধারণ নহে । যাহারা পদ্মাবতের ন্যায় এরূপ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাব্য বুঝিতে পারে, দেহতত্ত্ব বিষয়ক অতি সূক্ষ আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আয়ত্ত করিতে পারে, তাহারা কি ‘মূর্খ’ অভিধা পাইবার যোগ্য? এই বিপুল জনসাধারণের ভাষা বাঙ্গলা, মুসলমানগণ এখনও এই ভাষার উপর পল্লীগ্রামে আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছেন ।

যাঁহারা বাঙ্গলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা এদেশে প্রচলনের প্রয়াসী, তাঁহারা কখনই সে চেষ্টায় কৃতকার্য হইবেনা।লক্ষ লক্ষ মুসলমানের বাঙ্গলাই মাতৃভাষা, মায়ের মুখে তাহারা বাঙ্গলা ভাষা প্রথম শুনিয়াছে-সে ভাষা তাহাদিগকে ভুলাইয়া দেওয়ার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।ঘরের সামগ্রী তৈরী থাকিতে এরূপ চেষ্টা করিবার প্রয়োজন তো কিছুই দেখিতে পাই না।যদি বড় কিছু দিতে পার, তবে ছোট জিনিষটা ছাড়িয়া দাও।সূর্যের আলো আনিবার ব্যবস্থা করিয়া ঘরের প্রদীপটি নির্বাপণ কর, নতুবা যাহা আছে তাহা ছাড়িয়া দিয়া ঘর আধাঁর করিবে মাত্র।
লেখক শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) একজন শিক্ষাবিদ, গবেষক, লোক-সাহিত্যবিশারদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার।


[সংগৃহীতঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, মোশাররফ হোসেন খান (সম্পাদিত),বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠাঃ ১৮-২২]
ফিলিস্তিনে বিপর্যয় এবং মুসলমানের শিক্ষা
ফিলিস্তিনে বিপর্যয় এবং মুসলমানের শিক্ষা

১৫ই মে ছিল ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার বার্ষিকী। এ দিনটি ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের কাছে ‘নাকাবা দিবস’ হিসেবে পরিচিত। ‘নাকাবা’ অর্থ হলো বিপর্যয়। ১৯৪৮ সালের এ দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে দখলদার ইসরাইল প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ওসমানীয় সামাজ্যের পতন ও মুসলিম বিশ্বের প্রভাব ক্ষুন্ন করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৮৯৭ সালে থিয়োডর হার্জেল ও তার সহযোগীরা সুইজারল্যান্ডে এক সমাবেশের মাধ্যমে বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। হার্জেল পরবর্তীতে ইহুদিবাদের জনক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তার বড় লক্ষ্য।

সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীদের নানা ষড়যন্ত্রের মাঝেই শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে নয়া শক্তির সমীকরণের এক পর্যায়ে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এরপর বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে। ইহুদিবাদের প্রতি ব্রিটিশ সামাজ্যবাদের সমর্থন ফিলিস্তিনে প্রথম ইহুদিবাদী সরকার গঠনের ক্ষেত্র তৈরি করে।


ফিলিস্তিনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকা। এখানে ১৯৩০'র দশকে পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদীরা কৃষি খামার গড়ে তুলেছিল।

ইহুদিদের পাশেই ছিল ফিলিস্তিনী আরবদের বসবাস। সেখানে আরবদের কৃষি খামার ছিল। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে বসবাস করছিল। সে সময় মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।মুসলমান ইহুদিদের শত্রু গণ্য না করে ভাই বলে কাছে ঢেকে নিয়েছিলো। এমনকি অধিক লাভের আশায় ইহুদিদের নিকট জমি বিক্রি করেছিলো।

কিন্তু ১৯৩০'র দশকে ফিলিস্তিনীরা বুঝতে পারলো যে তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে-দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে।

ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিল ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে।তৎকালীন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সে চিঠি 'বেলফোর ডিক্লারেশন' হিসেবে পরিচিত।


ইহুদীদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দিবে।

১৯৩৩ সালের পর থেকে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে আসতে থাকে।

তখন ফিলিস্তিনী আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।ফিলিস্তিনী আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইহুদি নাগরিকরা।কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছে ব্রিটিশ সৈন্যরা।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দু'টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য।

ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। কিন্তু আরবদের জনসংখ্যা এবং জমির মালিকানা ছিল আরবদের দ্বিগুণ।স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়।

কিন্তু ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে তখন ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। অবশেষে ইহুদিরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেল। কিন্তু আরবরা অনুধাবন করেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।

জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। তখন ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড ছেড়ে যাবার জন্য ব্রিটিশ সৈন্যরা দিন গণনা করছিল।

তখন ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। তাদের গোপন অস্ত্র কারখানাও ছিল।কিন্তু ইহুদিদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব।সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদিরা।

সবার দৃষ্টি ছিল জেরুজালেম শহরের দিকে। মুসলমান, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের জন্য পবিত্র এ জায়গা।
জাতিসংঘ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল সেখানে জেরুজালেম আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল।


১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ইহুদীরা আরবদের উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। যেহেতু আরবদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না সেজন্য ইহুদিরা একের পর এক কৌশলগত জায়গা দখল করে নেয়।তখন ফিলিস্তিনের একজন নেতা আল-হুসেইনি সিরিয়া গিয়েছিলেন অস্ত্র সহায়তার জন্য।কিন্তু সিরিয়া সরকার ফিলিস্তিনদের সে সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করে যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। একসাথে পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে।

যেসব দেশ একযোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করেছিল তারা হচ্ছে - মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো।অন্যদিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার।

কিন্তু আরব দেশগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় ছিলনা। তাছাড়া আরব নেতৃত্ব একে অপরকে বিশ্বাস করতো না।জেরুজালেম দখলের জন্য আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই।

তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়।সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়।

আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। তখন জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

যুদ্ধবিরতির সময় দু'পক্ষই শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু ইসরায়েল বেশি সুবিধা পেয়েছিল। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে।

যুদ্ধ বিরতী শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। একর পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদিরা।


আরব দেশগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা না থাকার কারণেই ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছে এবং ইসরায়েল দেশটির জন্ম হয়ে সেটি স্থায়ী হতে পেরেছে।

https://www.bbc.com/bengali/news-40351128