সন্তু লারমাদের তৎপরতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি - ১

Image result for উপজাতি সন্ত্রাসীসন্তু লারমাদের তৎপরতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি - ১


১৯৭৫ সালে ৩টি ক্যান্টনমেন্ট স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। ১৯৭৫ সালের শেষাংশে সন্তু লারমা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে যখন শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে তখন ধীরে ধীরে সেখানে সেনাবাহিনীর মোতায়েনের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন দেশের দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৫ পরবর্তী খন্দকার মোশতাক সরকার। অতঃপর বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েম।

যে পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েন হয়েছিল সে পরিস্থিতি সাধারণ রাষ্ট্রনীতির ভাষায় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অঙ্গ, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের ভাষায় বলা যায় ইন্সারজেন্সী। ইন্সারজেন্সী শব্দটি ইংরেজি। এটার হুবহু বাংলা শব্দ নেই এবং ইন্সারজেন্সি শব্দের বিপরীত যে শব্দ সেটি হলো কাউন্টার ইন্সারজেন্সি। ব্যাখ্যার জন্য শুধু এটুকু বলা যায় যে, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছিল তাদের কিছু দাবী এবং অধিকার আদায়ের জন্য। পৃথিবীর সব জায়গায় সাধারণত যেমনটি হয় পার্বত্য চট্টগ্রামেও তেমনটি হয়েছিল। অর্থাৎ একদিনে দাবীগুলো প্রকাশিত হয়নি, একদিনে সংঘর্ষও ব্যাপক হয়নি, একদিনে সমাধানও আসেনি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জনমতকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার অন্যায়, অযৌক্তিক ও অসাংবিধানিক তথাকথিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। পার্বত্য রাজনীতির প্রবীণ পুরুষ, জেএসএস এবং আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন না ঘটলেও বেশিরভাগ শর্ত বা ধারা বাস্তবায়িত করছে বাংলাদেশ সরকার। স্মরণযোগ্য যে, দেশবাসী তথা পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙ্গালীদের দাবির প্রেক্ষিতে পরে ক্ষমতাসীন বিএনপি চুক্তি স্বাক্ষরকালে এর বিরোধিতা করে তা বাতিলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল। আভিধানিক অর্থে এর নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ হলেও সস্তা বাহাবা লাভের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একে শান্তি চুক্তি বলেও প্রচারণা চালানো অব্যাহত রয়েছে। উক্ত চুক্তির শর্তানুসারে পাহাড়ে শান্তি ও উন্নতির লক্ষ্যে যে পরিবেশ পাবার আশা ছিল বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি।

তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৮ লাখ বাংলাভাষী নাগরিকদের মানবাধিকার ও সমঅধিকারের কোন নিশ্চয়তা উক্ত চুক্তিতে রাখা হয়নি। লারমাদের জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ এর হাতে বহু বে-আইনী অস্ত্র আছে, যার দ্বারা পাহাড়ে চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, সন্ত্রাস, ডাকাতি প্রভৃতি অপকর্ম চলছে। সাধারণ মানুষ ওদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। ফলে চুক্তিটি সম্পূর্ণ একপেশে, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানেক চুক্তি বলে জাতির সামনে প্রস্ফুতি হয়েছে।

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ নেতা প্রসিত বি খীসার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সাথেও চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের টাকা ও আধিপত্য নিয়ে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলছে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। এই সংঘর্ষ, ক্রসফায়ার, দলীয় আধিপত্য ইত্যাদির কারণে পার্বত্যবাসী বাঙ্গালী ও উপজাতীয়দের স্বাভাবিক জীবন ওষ্ঠাগত, ব্যাহত ও সংকটময় হয়েছে।

সন্তু লারমা আজ নিজেই স্বঘোষিত শান্তি চুক্তির শর্ত ও ধারাগুলো একে একে অমান্য করে চলছেন এবং কৌশলে বাংলাদেশ সরকারকেই চুক্তি বাস্তবায়নের আবদার করছেন। তার স্ববিরোধী ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ভূমিকা’ দেশবাসী বুঝতে পারছে। সন্তুর ভাবী এবং পুত্র তাই ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তিকে সংগঠিত করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। ভারতে এজন্য ৩৯টি ক্যাম্পও তারা স্থাপন করেছে। চুক্তির যেসব দিক অতীতে এবং বর্তমানে জনসমক্ষে ধরা পড়ছে তা হলো:

১) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিনিময়ে বাঙ্গালীদের সকল মানবাধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালীদের ভূমির অধিকার, ভোটের অধিকার, বর্তমানে ৩টি সার্কেল চীপ, উপমন্ত্রী, ৩টি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান, টাস্কফোর্স কমিটির চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়াবার অধিকার ইত্যাদি খর্ব করার সাথে সাথে সকল ক্ষমতা উপজাতীয় নেতাদের হাতে দেয়া হয়েছে, সাধারণ উপজাতীয়রা বঞ্চিত ও শোষিত হচ্ছে।

২) পার্বত্য চুক্তির বদৌলতে ৩০ হাজার বাঙ্গালীর ঘাতক সন্তু লারমা ও তার সঙ্গীদের সকল হত্যাকান্ডের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। লারমাকে সরকারের প্রতিমন্ত্রীর সমমর্যাদায় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ (আরসি) চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়েছে। তাছাড়া জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতাদেরকে ক্ষমতাশালী (আরসি) সদস্যপদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ২ হাজার উপজাতি বিদ্রোহীকে (শান্তি বাহিনী) পুলিশে চাকরি দেয়া হয়েছে।

১ লাখের মতো পাহাড়ী শরণার্থীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে স্ব স্ব ভূমিতে পুনর্বাসন করা হয়েছে। কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে লারমা ও তার সঙ্গীদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। দাতা সংস্থা ইউএনডিপি, এডিবি, বিশ্বব্যাংক, ইইসি একতরফাভাবে লারমার নির্দেশমতো বিদেশী সাহায্য ব্যয় করছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু অতীব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও সংস্থাকেও লারমার কথা মতো পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে নিয়ন্ত্রণভূক্ত করা হয়েছে।

৩) লারমা সরকারের অংশ হয়েও নিজেই বহুবার হরতাল-অবরোধ ডেকে পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির ইন্ধন দিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের প্রতি আনুগত্য বিরোধী বিভিন্ন কুটূক্তি করেছেন। লারমা বিবিনিউজকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জোট সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন তো করছেই না, উপরন্তু চুক্তি বিরোধী নানা কর্মকান্ড করেই চলেছে।’ তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

জোট সরকারের মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ সরকার আর চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না। ঢাকায় আঞ্চলিক পরিষদের রেষ্ট হাউসে আলাপচারিতায় তিনি জাতীয় ও পার্বত্য রাজনীতির নানা দিক তুলে ধরেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে জাতীয় রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছি। যতদিন দেশে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িকও গণমুখী সরকার প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে ততদিন জুম্ম (পাহাড়ী) জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। তিনি আরও বলেন, মার খেতে খেতে পাহাড়ীদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। জুম্ম জাতি রুখে দাঁড়াবেই।

সকলেই অধিকার রয়েছে মানুষের মতো বাঁচার। সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আমরা বিগত শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে (১৯৯৬-২০০১ সাল) শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলাম। সে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের একটি অংশের বিরোধিতার কারণে ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা, অস্থায়ী নিরাপত্তা ছাউনি প্রত্যাহারসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে (২০০১-২০০৬) শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করবে বলে ঘোষণা করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের সে ঘোষণা বাস্তবায়নে কোন সততা বা আন্তরিকতা কোনটাই আমরা দেখছি না।

তিনি আরও বলেন, এ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নবিরোধী কাজ করেই চলেছে। চুক্তিতে রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন পাহাড়ী পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া পাবর্ত্য উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা একজন পাহাড়ীর। অথচ মন্ত্রণালয়ে একজন উপমন্ত্রী নিয়োগ করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান পদে একজন অপাহাড়ীকে নিয়োগ করা হয়েছে। উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে পাহাড়ীদের জমিজমা দখলের জন্য, কর্মকান্ড চলছে পাহাড়ী স্বার্থের বিরুদ্ধে। (সূত্রঃ দৈনিক জনকন্ঠ ২৬ মার্চ ২০০৫)

৪) লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্মল্যান্ড বানাতে চান। উপজাতি না বলে নিজেদেরকে বলছেন জুম্মজাতি। জনসংহতির অপর নাম ছিল ‘জুম্ম লিবারেশন আর্মি’। তাদের পত্রিকার নাম ছিল ‘জুম্ম নিউজ বুলেটিন’, ‘জুম্মকণ্ঠ’ প্রভৃতি। অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে ‘বাংলাদেশী কিংবা বাঙ্গালী’ কোনটিতেই পরিচয় দিতে রাজী নন। লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের কোনরূপ ভূমি অধিকার নাই বলেও প্রকাশ্যে দম্ভোক্তি করেছেন। যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল।

৫) চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাংক, হাসপাতাল, অফিস-আদালত ইত্যাদিতে ঢালাওভাবে সমতল থেকে কর্মরত উপজাতীয়দেরকে বদলী/পোস্টিং দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে, বাংলাভাষী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে নানা অজুহাতে পার্বত্যাঞ্চল থেকে সমতলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথবা তাদের হুকুম তামিলে বাধ্য করা হচ্ছে।

৬) জনসংহতি সমিতি পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবীর পক্ষেও জনমত সংগঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও মিডিয়ার একাংশে একপক্ষীয় প্রচারণা চালিয়ে এই মহলটি যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশের জনগণের কাছে ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছে তেমনি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারেও উঠেপড়ে লেগেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৫ রাঙামাটিতে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, এ পর্যন্ত সেখান থেকে মাত্র ৩১টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরিস্থিতি সহায়ক না হওয়ার পরও চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সেখান থেকে ১৫২টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর যে ৬টি স্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে তারও প্রত্যাহার চায় জনসংহতি সমিতি ও কতিপয় বুদ্ধিজীবী।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন জেএসএ-এর কথিত সন্ত্রাস দমন কমিটি বা সদক ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ইউপিডিএফসহ অপরাপর আরো কয়েকটি গোষ্ঠীর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও চাঁদাবাজির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মাঝেই পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী রকেট লাঞ্চারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। এরকম অস্ত্র বিবদমান দলগুলোর কাছে আরো রয়েছে।

কারণ ১৯৯৭ সালে শান্তিবাহিনীর যে ১ হাজার ৯৪৯ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করেন তারা সে সময় জমা দেন মাত্র ৮৭২টি অস্ত্র। এর বেশীরভাগই ছিল আবার পুরনো ও অচল। শান্তিবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও তাদের অনেক সদস্যই অস্ত্র জমা দেননি। এখন যেসব অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে সেগুলো এই জমা না দেয়া অস্ত্রই। পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হলে সেখানে যেমন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি যে কোন মুহূর্তে একটি গ্র“প সশস্ত্র সংগ্রামের পথও বেছে নিতে পারে। (সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ২২ মার্চ ২০০৫)

এদিকে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই এর পক্ষে জনসংহতি সমিতি ও সমমনা পাহাড়ী বনাম চুক্তির বিপক্ষে অবস্থানকারী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এর নেতৃত্বে উপজাতীয়দের গ্র“পগুলো ক্রমাগতই পরস্পর মারমুখী হতে দেখা গেছে। বেপরোয়া চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লুটপাট, রাহাজানি, খুন, চোরাগোপ্তা হামলা, অপহরণ ও জিম্মি করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়সহ মারাত্মক অপরাধবৃত্তিতে মেতে আছে সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ী এসব সংগঠন এলাকাওয়ারী আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিনিয়ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ক্যাডার, গোপন তহবিল সংগ্রহের প্রতিযোগিতা করছে পরস্পরকে পাল্লা দিয়ে।

তিন পার্বত্য জেলা দুর্গম ও অচিহ্নিত সীমান্ত পেরিয়ে আসা অবৈধ ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র হাত বাড়ালেই পেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। চলছে মাদকদ্রব্যের আবাদ ও চোরাচালান। প্রতিবছর সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণ আদায়ের পরিমাণ কোটি টাকা। অব্যাহত সন্ত্রাস নৈরাজ্যের কারণে পার্বত্য জনপদে স্থবিরতা ও হতাশা বিরাজ করছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম। পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা চাপা পড়েছে। চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষের বিবদমান সংগঠন বা গ্র“পগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উম্মোচনের জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসমর্থন আকর্ষণের চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রতিপক্ষের হিংসাত্মক পন্থায় মোকাবিলা করে যাচ্ছে। এর ফলেই পার্বত্য অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, পারস্পরিক ভীতি-সন্দেহ-অবিশ্বাস বর্তমান নাজুক অবস্থায় ঠেকে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয় ও অউপজাতীয় সবাইকে একটি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার আগে কেন এ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে তা বিবেচনা করা উচিত। সরকার বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন কারণ এটি একটি গোলযোগপূর্ণ এলাকা। গোলযোগপূর্ণ এ কারণে যে, এখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহিংস তৎপরতা সাধারণ জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে এবং সে কারণেই নিরাপত্তা বাহিনীকে মোতায়েন রাখতে হয়েছে। পার্বত্য জেলাসমূহের জন্য সরকারের দেয়া অনুদান ও বরাদ্দ যদিও অনেক ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে দমিয়ে রাখছে তবুও দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সংরক্ষণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এ আত্মত্যাগ সদিচ্ছার পরিচয় বহন করবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একটি অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভারতের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। সন্ত্রাসী অপতৎপরতার উদ্ভব, বিস্তার এবং এর গতিধারা নিয়ন্ত্রণে ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে আসছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি বলেও বিস্তৃত পরিসরে প্রচারণা শুরু হয়েছে যেখানে বিদেশীদের বলা হচ্ছে যে, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আগ্রহী নয় ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয অর্থও বরাদ্দ দিচ্ছে না। অথচ বাস্তব অবস্থা হচ্ছে পার্বত্য এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয় শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর আওতায়। এর বাইরে অনেক এনজিও ও দাতা সংস্থা কোটি কোটি ডলারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, হাসপাতালসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের পরিসংখ্যানও যদি দেয়া যায় তাহলেও দেখা যাবে দেশের অনেক এলাকার চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়েছে তুলনামূলক বেশী।

আশির দশকে চাকমা উপজাতীয়দের মধ্য থেকে তৈরি শান্তি বাহিনী ভারতীয় যোগসাজশে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে হত্যা, সন্ত্রাস ও অপহরণের রাজত্ব কায়েম করেছিল সেটা ভিন্ন নামে এখনও টিকে আছে। সেই সময় তারা ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশীকে হত্যাসহ এক নারকীয় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। জনসংহতি সমিতির অ-উপজাতীয় বাংলাভাষী নাগরিকদের খুনি শান্তি বাহিনীর হত্যা, সন্ত্রাস ও অপহরণ থেকে বাঁচানোর জন্য ১৯৮৬ সালের দিকে সেখানে বাঙ্গালী নাগরিকদেরকে তাদের জমিজমা ঘরবাড়ি থেকে উঠিয়ে এনে নিরাপত্তার নামে গুচ্ছ গ্রামে জমা করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের গুচ্ছগ্রামগুলোতে লাখ লাখ বাঙ্গালী নাগরিক গুচ্ছগ্রামের কুড়ে ঘরে সেই ১৯৮৬ সাল থেকে বসবাস করছে। ২৯ বছরে তাদের সন্তান-সন্ততি বেড়েছে পরিবার বড় হয়েছে কিন্তু কুঁড়েঘর বড় হয়নি। কার্যত তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও বন্দি জীবন যাপন করছে। ফিলিস্তিন উদ্বাস্তুদের চেয়েও খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের সংবিধান পরিপন্থী ধারা এ চুক্তিতে সন্নিবেশিত থাকার পরেও সরকার ধীরে ধীরে এ চুক্তির বাস্তবায়ন করছে। চুক্তি বাস্তবায়নের ফলস্বরূপ সন্তু লারমা স্বয়ং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ তারই প্রত্যক্ষ মদদে চলছে জেএসএস’র সন্ত্রাসী কর্মকান্ড।

প্রতিনিয়ত ঘটছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যার ন্যায় জঘন্য ঘটনা এবং দলীয় শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অস্ত্র ক্রয়সহ সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ চলছে পুরোদমে। বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে এবং অপপ্রচার করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেই চলেছেন। সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি প্রায়শঃই বিভিন্ন ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবী-দাওয়া তুলে ধরেন।

২০০৬ সালের ২৬ মার্চ সিরডাপ মিলনায়তনের এক আলোচনা সভায় সন্তু লারমা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এ হুমকিতে চারদলীয় জোট সরকার নতি স্বীকার করেনি। এমনকি ২ বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সন্তু লারমাদের দাবি পূরণ করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। অবশেষে রাজি হলেন আওয়ামী লীগ সরকার। শান্তি চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবশিষ্ট বাংলাদেশ থেকে কার্যত একটা আলাদা অস্তিত্ব দিয়েছে।

এখানে অ-উপজাতীয় নাগরিকদের নাগরিক অধিকার অসাংবিধানিকভাবে খর্ব করা হয়েছে। জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে তাদেরকে বৈষম্যের শিকার করা হয়েছে। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর পর ৬০ হাজার চাকমা উপজাতিকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কিন্তু গুচ্ছগ্রামের ৫৩ হাজার অ-উপজাতীয় পরিবারের লাখ লাখ মানুষকে তাদের বাড়িঘর, জমিজমা ফেরত দেয়া হয়নি।

এই অবিচার শুধু অ-উপজাতি নাগরিকদের প্রতি নয়, এটা আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান এবং বাংলাদেশী জনগণের প্রতি জুলুম। ওই চুক্তির ধারাবাহিকতায়ই সরকার পরে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বলা ভালো জনসংহতি সমিতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর বার বার চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের দাবি করে আসছিল। যদিও সেনা প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা সন্তু লারমাকে এতটুকুও খুশি করতে পারেনি। বললেন, এটা এক ধরনের ‘ধোকাবাজি’। তিনি দাবি করেছেন, যেভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে, তা সঠিক নয়। শুধু অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। তার দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, সেনা প্রত্যাহার করা হলে সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি ঘটবে না।

অথচ তিনি যেদিন সংবাদ সম্মেলন করেন (৫ আগস্ট ২০০৯) সেদিনই খবর আসে বান্দরবানে অপহৃত ব্যবসায়ী ফারুক আহমদ মুক্তি পেয়েছেন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করেছিল। এরই মধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত পাহাড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বেশ কটি রাজনৈতিক দল এই সিদ্ধন্তের সমালোচনা করেছে। পাহাড়ি এলাকায় বাঙ্গালীরা মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেখানে পাহাড়িদের মাঝে যে দ্বন্দ্ব, তা থেকে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর শান্তিবাহিনী নামে কোনো সংগঠন নেই এবং তারা অস্ত্র সমর্পণের নাটক করেছিল, এটা ঠিক। কিন্তু শান্তিবাহিনীর মূল সংগঠন জনসংহতি সমিতির সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পুরোদমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে। বিভিন্ন কাজকর্মের প্রকাশ ও তথ্য থেকে এ বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত যে:
(১) এই সংগঠনটি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে,
(২) এ সংগঠনটি অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে চাঁদা, অপহরণসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক লাভজনক কর্মকান্ডে লিপ্ত আছে,
(৩) সংগঠনটি গোপনে উপজাতীয় যুবক সম্প্রদায়কে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে,
(৪) সংগঠনটি বহিঃবিশ্বে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে।

২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি থেকে ২৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে-এ ধরনের সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে লেখালেখি কম হয়নি। মুলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব অবস্থার দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ব্যাপক সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ অবিবেচক একটি সিদ্ধান্ত। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে- পার্বত্য অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার বড় ধরনের এ সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ৩১ জুলাই ২০০৯)