সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অপরিহার্য প্রয়োজনে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিংকে পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী গিয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে সরকারী নির্দেশে। সাপ, মশা, জোক হিংস্র বন্যপ্রাণী, দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রতিকুল পরিবেশ, বৈরী ভূপ্রকৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে মোকাবেলা করে এবং পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হুমকি ও অপতৎপরতার মুখে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অটুট রেখেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকের অনেকে এ কথা বহুবার বলেছেন যে, সেনাবাহিনী না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বহু আগেই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো। এ কাজে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ৩৫১ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩৮৪ জন এবং অন্যভাবে ২২৭ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
তারপরও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরে আসেনি। এখনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাষ্ট্রীয় নির্দেশ পালনে নিয়োজিত। শুধু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায়ই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী অপারেশন উত্তোরণের আওতায় অসংখ্য উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজের সাথে জড়িত। এরমধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফ্রি বিষেশায়িত ও সাধারণ চিকিৎসাসেবা, ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৭টি বিনামূল্যে চক্ষুশিবির পরিচালনা করে। এতে ৩৫২৫ জন লোক সেবা গ্রহণ করে- যার মধ্যে ২১১৮ জন পাহাড়ী ও ১৪০৭ জন বাঙালি। একই বছরে ৮২৮টি বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে। এতে ১২৯১৪৯ জন সেবা গ্রহণ করে। এর মধ্যে পাহাড়ী ৫৪৫৯৬ জন এবং বাঙালি ৭৪৭০৩ জন রয়েছে।
২০১৫ সালে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৫৯৮০ জনের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, ৮৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ বা সংস্কার, ২৬টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ২৭৭৩৩ জনকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, ৩৯০৮ জনকে আর্থিক অনুদান, ১২২টি ধর্মীয় উপাসনালয়কে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা, ৪৮টি ব্রিজ ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ ও সংস্কার, ১৪০টি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা, ৩৬১টি উন্মুক্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শনসহ ৯২টি অন্যান্য সহায়তা করে। প্রত্যেক বছরই এই সেবা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ব্যাপক অবদান রয়েছে। এরমধ্যে বিদ্যালয় নির্মাণ, সংস্কার, পরিচালনা, শিক্ষকদের বেতন প্রদান, বই, খাতা, কম্পিউটার, পোশাকসহ বিভিন্ন শিক্ষা সামগ্রী প্রদান, ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, সহশিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা ইত্যাদি রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের বেকার তরুণদের উন্নয়নে নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, কম্পিউটারসহ আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করে থাকে। মহিলাদের জন্য নানা ধরনের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ পরিচালনা, কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণ করে।
বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সংস্কারের পাশাপাশি ফ্যান, লাইট, চার্জার, মাইক বিতরণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সারা বছর বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ করে থাকে। একইভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক সামগ্রী বিতরণ করে থাকে।
গভীর নলকূপ স্থাপনসহ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ফিল্টার প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম, দরিদ্র জনগণের বসতঘর নির্মাণ, হাঁস-মুরগী-ছাগলের খামার ও কুটির শিল্প স্থাপনে সহায়তা, যাত্রী ছাউনি নির্মাণ, সৌর প্যানেল প্রদান, সাংবাদিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, কৃষি সরঞ্জাম, সার, বীজ, কীটনাশক বিতরণ করে থাকে। পাহাড়ী-বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ধরনের কর্মকা- পরিচালনা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোনো উদ্ধার ও সংস্কার তৎপরতায় সেনাবাহিনী সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে সেনাবাহিনীর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। দুর্গম পাহাড়ে সড়ক নির্মাণ, সংস্কার এ কাজে জড়িতদের নিরাপত্তা প্রদান, পর্যবেক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা অবিচ্ছিন্ন রাখতে নিরাপত্তা প্রদানের কাজ করে থাকে। ৩ পার্বত্য জেলার ১৫৩৫ কিমি রোড নেটওয়ার্কের অর্ধেকই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্মাণ করেছে।
আলীকদম-থানচি সড়ক, সাজেক, নীলগিরি সড়কের মতো উঁচু সড়ক নির্মাণ করে দেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাতের উন্নয়নে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাধ দমন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, মাদক উৎপাদন ও পাচার, জঙ্গি তৎপরতা দমন, অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্য, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস দমনে অসামান্য ভূমিকা পালন করছে।
যুক্তির খাতিরে ধরা যাক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এর পরিণতি ও প্রভাব কী পড়তে পারে তা ভেবে দেখা জরুরি।
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শর্তানুযায়ী এ পর্যন্ত একটি ব্রিগেডসহ ২৩৮টি বিভিন্ন ধরনের সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেসব এলাকা পুনরায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। বিজিবি বা পুলিশ থাকার পরও সন্ত্রাসীরা ঐ সকল অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়েছে। পার্বত্য বাঙালি গণমঞ্চের নেতা শওকত আকবরের মতে, তাদের অঞ্চল থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার পরই বাঙালিদের উচ্ছেদ করে তাদের বিপুল পরিমাণ বৈধ জমি পাহাড়ীরা দখল করে নিয়ে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছে। সন্ত্রাসীদের অবস্থানের ৫শ গজের মধ্যেই পুলিশ রয়েছে।
কিন্তু সন্ত্রাসীরা পুলিশকে থোড়াই কেয়ার করছে, আর পুলিশও সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ করছে না। এরকম ঘটনা তিন পার্বত্য জেলার সর্বত্রই।