যে কারণে পাহাড়ে পাল্টাপাল্টি খুন!
রাঙামাটি পাহাড়ে চলছে পাল্টাপাল্টি খুনের ঘটনা। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে খুনের শিকার হয়েছেন জেলার নানিয়াচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ৫ পাহাড়ি।
এনিয়ে থমথমে হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পরিস্থিতি। জনমনে ভর করেছে নানা শঙ্কা, ভয় ও আতঙ্ক। আঞ্চলিক রাজনীতিতে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারে একের পর এক খুনাখুনি হচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি।
শুক্রবার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন, ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা, একই দলের কেন্দ্রীয় নেতা কনক চাকমা, সুজন চাকমা ও সেতু লাল চাকমা।
নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতি সংস্কারবাদী (এমএন লারমা) দলের শীর্ষনেতা অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে হত্যার মাত্র ১ দিনের মাথায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে চারটি। এগুলো হলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জনসংহতি সমিতি সংস্কারবাদী (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করলে এর বিরোধিতা করে প্রসিত চাকমার নেতৃত্বাধীন একদল পাহাড়ি ছাত্র ও যুবক।
পরে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে বিভক্তি দেখা দেয় জনসংহতি সমিতির মধ্যে।
২০০৭ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ভেঙে রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খীসা, শক্তিমান চাকমা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমাসহ কিছু নেতাকর্মীর নেতৃত্বে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) দল।
সর্বশেষ ইউপিডিএফ ভেঙে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। এসব দলের নেতাকর্মীরা মরিয়া পাহাড়ে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে। এ নিয়ে চলছে খুনের বদলা খুন। বলি হচ্ছে অনেকে।
গত দুই দশকে প্রাণ হারিয়েছে এসব দলের প্রায় ৫ শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক। দল প্রতিষ্ঠার ৬ মাসের মাথায় খুন হল ৩ সহকর্মীসহ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা।
জানা যায়, তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা ছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) প্রভাবশালী শীর্ষনেতা। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধের জেরে দল থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে।
এরপর মূল সংগঠন ভেঙে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর তার নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’নামে আরেক সংগঠন। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের মাত্র ২০ দিনের মাথায় ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়াচরে সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউপিডিএফ নেতা অনাদি রঞ্জন চাকমাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর ১০ দিনের ব্যবধানে ১৫ ডিসেম্বর রাতে নানিয়াচরের সীমান্তে বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের ধামাইছড়া এলাকায় ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের সংগঠক অনল বিকাশ চাকমা ওরফে প্লুটোকে।
এরপর ইউপিডিএফের সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠুন চাকমাকে খাগড়াছড়িতে হত্যাসহ তাদের আরও কয়েক সদস্য ও সমর্থককে খুন করা হয়।
এছাড়া গত ১৮ মার্চ রাঙামাটি জেলা সদরের কুতুকছড়ি আবাসিক স্কুল এলাকার একটি বাড়িতে হানা দিয়ে অস্ত্রের মুখে মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
অপহরণের ৩৩ দিন পর ১৯ এপ্রিল রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের মধুপুর তেতুল তলার এপিবিএন স্কুলগেট এলাকায় মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে ছেড়ে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা। মুক্তির জন্য বেশকিছু শর্তসহ ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে বলে দাবি অপহৃতদের পরিবারের।
এসব ঘটনার জন্য তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাকে দায়ী করে আসছিল ইউপিডিএফ। এছাড়া বর্মার নেতৃত্বাধীন দলে জনসংহতি সমিতির সংস্কারবাদী (এমএন লারমা) দলও যুক্ত বলে অভিযোগ ইউপিডিএফের।
এসব ঘটনায় বিবদমান দুটি দলের সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয় খুনের বদলা খুন। সর্বশেষ শুক্রবার খুন হলেন দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমাসহ ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ দলের পাঁচ নেতা।
আগের দিন বৃহস্পতিবার জেএসএস সংস্কারবাদী নেতা ও নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিতে হত্যা করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করা হলেও বরাবরের মতো তা অস্বীকার করে আসছে দলটি।
মন্টি ও দয়াসোনা চাকমাকে অপহরণ মামলায় মূল আসামি ছিলেন শক্তিমান চাকমা ও তপন জ্যোতি চাকমা। শেষ পর্যন্ত আদালতের কাঠগড়ায় যাওয়ার আগেই খুনের শিকার হয় এ দুই আসামি।