আর্যরাই যে সর্বপ্রথম প্রাচীন ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালাইয়াছিল এ কথার মূলে কোনো সত্য নাই

Image result for মুসলিম-সাহিত্যআর্যরাই যে সর্বপ্রথম প্রাচীন ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালাইয়াছিল এ কথার মূলে কোনো সত্য নাই

এতকাল ইতিহাসে আমরা পড়িয়া আসিতেছি যে, অতি প্রাচীনকালে পাক-ভারত উপমহাদেশে অনার্য জাতিরা বাস করিত।তাহারা অত্যন্ত অসভ্য ও বর্বর ছিল। তাহারা ফলমূল ও কাঁচা মাংস ভক্ষণ করিত এবং বনে-জঙ্গলে বাস করিত।তারপর আসিল দ্রাবিড় জাতি।তাহারাও অনার্য ও অসভ্য ছিল। তবে পূর্ববর্তীদের অপেক্ষা কিছুটা উন্নত ছিল। সর্বশেষে আসিল এক সুশ্ৰী গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় ও সুসভ্য জাতি। ইহাদের নাম আর্যজাতি।ইহারা মধ্য-এশিয়ায় বাস করিত। কালে কালে সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে তাহারা দেশ-বিদেশে ছড়াইয়া পড়ে।মেটোমুটিভাবে দুইভাগে তাহারা বিভক্ত হয়।এক ভাগ যায় পশ্চিম দিকে, অপর ভাগ আসে পূর্বদিকে।পূর্বশাখা ইরান হইয়া ভারতে প্রবেশ করে এবং দ্রাবিড় ও অন্যান্য অনার্য জাতিদিগকে পরাজিত করিয়া এই দেশ অধিকার করে। তাহারাই সর্বপ্রথম এদেশে সভ্যতার আলো জ্বালে।জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে ও ললিত কলায় তাহারাই এদেশকে সমৃদ্ধ করিয়া তোলে।

ময়েনজোদারো

কিন্তু এই থিওরী এখন একরূপ অচল ৷ সিন্ধুর ময়েন-জো-দারো, পাঞ্জাবের হরপ্পা ও অন্যান্য স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের পর এখন আর একথা কেহই বলিতে সাহস করে না যে, পাক-ভারতের সভ্যতা আর্যদের দান।প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইতেছে যে, আর্যদের অপেক্ষা দ্রাবিড়রাই ছিল অধিকতর উন্নত ও সভ্য।
ময়েন-জো-দারো ধ্বংসাবশেষ হইতে জানা যায় যে, সেখানে সুপরিকল্পিত নগর ছিল, ইষ্টক নির্মিত গৃহ ছিল, রাজপথ ও পয়ঃপ্রণালী ছিল, এমন কি সে-যুগের লোকেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কৌশলও জানিত। বিভিন্ন কারুকার্যখচিত মৃৎপাত্র, নানা ধরনের তৈজসপত্র, বহু সৌখিন আসবাবপত্র ও প্রসাধন দ্রব্য এবং অন্যান্য আরও অনেক নিদর্শনই পাওয়া গিয়াছে-যাহাদের মধ্যে উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ছাপ রহিয়াছে। আর একটি বিশেষ বস্তুর সন্ধান পাওয়া গিয়াছে-তাহা হইতেছে ৫০০ সীলমোহর । সীলমোহরগুলির উপরে এক বিশেষ ভাষার অক্ষর অঙ্কিত। সেগুলি দক্ষিণ হইতে বামে লিখিত এবং প্রাচীন ব্যাবিলন ও মিসর-লিপির সহিত সাদৃশ্যযুক্ত। অন্য কথায় লিপিগুলি সেমিটিক।

বলাবাহুল্য, এই সভ্যতা ছিল দ্রাবিড়দের।ইহার সহিত আর্য সভ্যতার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না, কেননা এ সভ্যতা ছিল আর্যদের ভারত আগমনের অন্ততঃ দেড় হাজার বৎসর অগ্রগামী। Sir John Marshal বলেন: “They (i.e. material remains of Mohen-jo-daro) exhibit the Indus people of the fourth and the fifth millennium BC. in possession of a highly developed culture in which no vestige of any Indo-Aryan culture is to be found.”

কাজেই আর্যরাই যে সর্বপ্রথম প্রাচীন ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালাইয়াছিল এ কথার মূলে কোনো সত্য নাই।প্রসিদ্ধ ভারতীয় ঐতিহাসিক K.M. Panikkar অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবেই এই মতের প্রতিবাদ করিয়াছেন:

“One thing is certain, and can no longer be contested: civilisation did not come to India with the Aryans. The doctrine of the Aryan origin of Indian civilisation is the result of the theories of the Indo-Germanic scholars who held that anything valuable in this world originated from the Aryans…. not only is Indian civilisation pre-Vedic, but also the essential features of the Hindu religion as we know it today, were perhaps present in Mohen-jo-daro.” [A Survey of Indian History]
তারপর আর্যদের আদি নিবাস যে কোথায় ছিল, আজ পর্যন্ত তাহা কেহ নিশ্চয় বলিতে পারে না। কেহ বলে মধ্য এশিয়ার, কেহ বলে ইউরোপে, কেহ বলে ভারতে, কেহবা বলে অন্যরূপ।প্রত্যেক প্রাচীন জাতিরই একটা আদিম উৎপত্তিস্থল এবং তাহার জাতীয় সংস্কৃতির কিছু না কিছু নিদর্শন আছে। মিসরীয়দের পিরামিড, ব্যাবিলোনিয়ানদের শূন্মোদ্যান, চীনাদের মহাপ্রাচীর, বৌদ্ধদের নালন্দা, তক্ষশীলা, দ্রাবিড়দের ময়েন-জো-দারাে ইত্যাদি স্মৃতিচিহ্ন এখনও বিদ্যমান।কিন্তু আর্যদের সেরূপ কােনো কীর্তি-চিহ্ন কই? কোথাও আছে কি? শ্ৰীযুক্ত অবিনাশ চন্দ্র দাস (এম এ. বি.এল) তাই আর্যসভ্যতার প্রাচীনতার দাবী মিথ্যা বলিয়া মনে করেন:

“The Indo-Aryans claim that they are the most ancient people in India; but that claim is false. India has no ancient monuments or relics like Egypt, Babylonia or Assyria.”
এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া সত্যসন্ধানী ঐতিহাসিকেরা আর্য-থিওরীকে এখন একটি অলীক কাহিনী (myth) বলিয়া মনে করেন।কেহ বা বলেন, থিওরীটি শুধুমাত্র একটা অনুভূতির উপর দাঁড়াইয়া আছে (based on a solid basis of sentiment)। আবার কেহ বা ইহাকে একটা ঐতিহাসিক প্ৰলাপ (a historical nonsense) বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন।