বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইতে উদ্ভূত কাজেই উহা আর্যভাষা-এ দাবীও বিচারসহ নয়।সংস্কৃত ভাষাভাষি আর্যদের আসিবার বহু পূর্ব হইতেই এ দেশবাসীদের যে নিজস্ব ভাষা ছিল, একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।প্রাচীনকালে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করিতে গিয়া ঐতিহাসিক (Marshman 1859) যাহা বলিয়াছে, তাহা এখানে উল্লেখযোগ্য:
“অতি প্রাচীনকালে বঙ্গদেশে কি অবস্থা ছিল তাহা নিশ্চয় করা অতি দুষ্কর ৷ বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম কোন সময় হইতে চলিল, তাহা জানা যায় না ৷ যে মানুষেরা বঙ্গদেশে প্রথম বাস করিয়াছিল, তাহারা হিন্দু ছিল না।কিন্তু পশ্চিম সীমার পার্বতীর লোকদের তুল্য এক জাতি ছিল। যে ভাষা এখন চলিত আছে, তাহা কোন সময় উৎপন্ন হইল, ইহাও নিশ্চয় করা আমাদের পক্ষে অসাধ্য। সংস্কৃত, আরবী ও ফারসী ভিন্ন আরও অন্য অনেক শব্দ বঙ্গভ্যষার চলিত আছে । তাহাতে অনুমান হয় যে, বঙ্গদেশবাসী লোকেরা যে ভাষা ব্যবহার করিত তাহার সহিত সংস্কৃত ভাষার কোনো সম্পর্ক ছিল না ।” [বঙ্গদেশের পুরাবৃত্ত]
শুধু তাই নয়।সুপ্রসিদ্ধ বাঙালী ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় আরও কঠিন কথা বলিয়াছে।তাহার মতে আর্যভাষা তো দূরের কথা, বাংলাদেশে আদৌ কোন আর্য আছে কিনা, তাহাই তো সন্দেহের বিষয়। বলে:
“যে সময় ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অথবা আরণ্যকে আমরা বঙ্গ অথবা পুণ্ড্র জাতির উল্লেখ দেখিতে পইি, সেই সময় অঙ্গে-বঙ্গে অথবা মগধে আর্য জাতির বাস ছিল না।”
অন্যত্র বলিতেছে: “এই প্রাচীন দ্রাবিড় জাতিই বঙ্গ-মগধের আদিম অধিবাসী।নৃতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা আধুনিক বঙ্গবাসিগণের নাসিকা ও মস্তক পরীক্ষা করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, তাহারা দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন। মগধে ব্রাহ্মণাদি ও উচ্চ জাতীয় ব্যক্তিগণকে আর্যজাতীয় অথবা আর্য-সংমিশ্রণে উৎপন্ন বলিয়া মনে হয়।কিন্তু বঙ্গবাসিগণকে জাতিনির্বিশেষে দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণের ফল বলা যাইতে পারে । উত্তরাঞ্চললের পশ্চিমাংশ আর্যগণ-কর্তৃক বিজিত হইবার বহুকাল পরেও মগধ স্বাধীন ছিল। সেই সময় তাহাদের কেহ এখানে আসিলে তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত। প্রাচীন সাহিত্যে আর্যগণ-কর্তৃক মগধ ও বঙ্গ অধিকারের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না। সুতরাং কোন সময় আর্যজাতি বঙ্গ মগধ অধিকার করিয়াছেন, তাহা নির্ণয় করা দু:সাধ্য ।” [বাঙ্গালার ইতিহাস]
বিখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক V.C Pillai সুস্পষ্টভাবে বলিতেছে যে, আর্যদিগের ভারতাগমনের পূর্বে-(যাহা আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ শতাব্দে সংঘটিত হইয়াছিল) এদেশ সম্পূর্ণভাবে দ্রাবিড়দের শাসনাধীন ছিল:
“The theme which first set up upon this investigation is the intricate subject known as the Aryo-Dravidian problem. It is needless to mention that the question was first set in motion on the day the Aryan entered India; which event we shall soon see took place in the fifteenth century BC. India, prior to this entry, was a Dravidian land.”
ইহা হইতে স্পষ্টভাবেই বুঝা যাইতেছে যে, সংস্কৃত হইতে বাংলা ভাষা উৎসারিত হয় নাই। আর্যদের বহুপূর্ব হইতে যখন এদেশে দ্রাবিড়রাই বাস করিত, তখন স্বীকার করিতেই হইবে বাংলা ভাষা তাহাদের হাতেই জন্মলাভ করিয়াছিল-আর্যদের হাতে নয়।প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, আধুনিক বাংলা ভাষাতেও বহু দ্রাবিড় শব্দ মিশিয়া রহিয়াছে। এদেশের বহু প্রাচীন নগর ও গ্রামের নাম, নদ-নদী ও পর্বতের নাম এখনও দ্রাবিড়।যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, পাবনা, ঝিনাইদাহ, দামুকদিয়া, রএড়া, নাগিরাট, গড়াই,তিস্তা, কড়া, গণ্ডা, পণ, কুড়ি, খোকা, খুকি- ইত্যাদি অসংখ্য দ্রাবিড় শব্দ আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় চালু আছে।
তবে অনেক শব্দ ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতেছে, কারণ হিন্দু-মুসলমান ইংরাজ ও অন্যান্য জাতিরা কালে কালে ঐ সব শব্দ হয় বর্জন করিয়াছে, নয় বিকৃত বা রূপান্তরিত করিয়া ব্যবহার করিতেছে। যেমন নাগিরাট হইয়াছে নাগের হাট, যসর হইয়াছে যশোহর ইত্যাদি। ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতও ঠিক তাই । তিনি বলেন:
“প্রাগৈতিহাসিক কালের বাঙ্গালার অধিবাসীরা কি প্রকারের মানুষ ছিল, তাহা জানা অসম্ভব, তবে এইটুকুই অনুমান হয় যে, যে যুগের ইতিহাস খুঁজিয়া পাওয়া যায়না, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতেই বাঙ্গালা দেশে আধুনিক বাঙ্গালীর পুর্ব পুরুষেরাই বাস করিয়া আসিতেছে। ভাষাতত্ত্ব হইতে এইটুকু বুঝিতে পারা যায় যে, বাঙ্গালা দেশে আর্য ভাষা আসিবার পূর্বে এ দেশের লোকেরা অষ্ট্রীক জাতীয় ভাষা এবং কতকটা দ্রাবিড় ভাষা বলিত।বাঙ্গালা দেশের ভৌগোলিক নামে দ্রাবিড় ও অস্ট্রীক কথার সন্ধান পাওয়া যায়।এইগুলি হইতে ইহা প্রমাণিত হয় যে, আর্যভাষা উত্তর-ভারতে ও বাঙ্গালায় প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্বে এ দেশে অষ্ট্রীক ও দ্রাবিড় ভাষার প্রচলন ছিল; অষ্ট্রীক ও দ্রাবিড় ভাষী লোকেরা নিজ নিজ ভাষার কথা দিয়াই এ দেশের নদনদী, পাহাড়-পর্বত ও গ্রামের নামকরণ করিয়াছিল। সেই সকল নামকে ঈষৎ পরিববর্তিত করিয়া উত্তরকালে সংস্কৃত রূপ দেওয়া হইয়াছিল, কোথাও বা সেই সকল নাম বিকৃত হইয়া অর্থহীন নাম রূপে এখনও প্রচলিত আছে । [জাতি সংস্কৃতি ও সাহিত্য]