মধ্যয্যগে বাংলা ভাষার প্রভাব

Image result for মুসলিম-সাহিত্যমধ্যযুগে বাংলা ভাষার প্রভাব
মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাংলা ভাষার মধ্যযুগের প্রবেশ-দুয়ারে আসিয়া পৌঁছিলাম। এ যুগকে মুসলিম যুগও বলা যাইতে পারে। ১৩৫০-১৭৫০ খ্রী: পর্যন্ত দীর্ঘ চারিশত বৎসর ধরিয়া বাংলা সাহিত্য মুসলিমদিগের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের প্রারম্ভে কিছুকাল যাবৎ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্ম তেমন উৎকর্ষ লাভ করিতে পারে নাই, কারণ যুগ-বিপ্লবের পর শান্ত পরিবেশ ফিরাইয়া আনিতে কিছুটা সময় লাগে।

বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের আমল হইতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয় এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিমদিগের সেবার, দানে, সাহায্যে ও সহানুভূতিতে বাংলা ভাষা নানা গৌরবে সমৃদ্ধ হইতে থাকে। বাংলা ভাষার সর্ব প্রথম মুসলিম কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর আযম শাহের রাজত্বকালে ‘য়ুসুফ জুলিখা’ নামক কাব্য লিখিয়া যশস্বী হন। মুহম্মদ সগীরের ‘য়ুসুফ্ জুলিখা’ এবং তৎপূর্ববর্তী বড় চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণর্কীর্তন’ই বাংলা সাহিত্যের দুই প্রথম গ্রন্থ।

য়ুসুফ জুলিখার ভাষা ছিল এইরূপঃ

কহে শাহ্-মোহাম্মদ যুসুফ জুলিখা পদ
দেশিভাষা-পয়ার রচিত।
কিতাব কোরাণ মধ্যে দেখিনু বিশেষ
য়ুসুফ জুলিখা কথা অমিয়া অশেষ।
কহিব কিতাব চাহি সুধারস পুরি।
শুনহ ভকত জন শ্রুতিঘট ভরি।।
দোষ খেম, গুণ ধর রসিক সুজন।
মোহাম্মদ ছগীর ভনে প্রেমিক বচন।। [মুসলিম বাংলা সাহিত্য]

সুলতান হুসেন শাহ্ এবং তাঁহার বংশধরদিগের আমলই মধ্য-বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ।এই উদারমনা সাহিত্য-রসিক গুণগ্ৰাহী সুলতান সত্যই বাংলা সাহিত্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের কবি-সাহিত্যিকদিগকে ডাকিয়া তিনি দরবারে স্থান দেন।আরবী-ফারসী হইতে নানা ধর্মগ্রন্থ, ইতিহাস, গল্প ইত্যাদি অনুবাদ করাইবার কাজে তিনি মুসলিম কবিদিগকে নিয়োগ করেন। সেই সঙ্গে মৌলিক রচনাবলীরও মর্যাদা দেন।gulam-mostafa


শুধু মুসলিম কবি নন, হিন্দু কবিদিগকেও তিনি এবং তাঁহার অনুবর্তিগণ সাদরে আহবান করেন। তাহাদেরই উৎসাহে রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য হিন্দু গ্রন্থাদি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। হুসেন শাহের আমলে শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব হওয়ায় বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব-ধারাও সংযোজিত হয়।এইরূপে বাংলা ভাষা জাতিধর্ম-নির্বিশেষে গোটা বাঙালী জাতির প্রতিনিধিত্ব করিবার সুযোগ পায়।

কিন্তু একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। হুসেন শাহের দরবারে যখন বাংলা সাহিত্য চর্চার এমন সমারোহ চলিতেছে, তখনই-বা বাংলা ভাষার প্রতি আর্য-হিন্দুদিগের মনোভাব কিরূপ ছিল? পূর্বের সেই জাতক্রোধ, বিদ্বেষ ঘৃণার ভাব তাহারা তখনও অন্তরে অন্তরে পোষণ করিতেছিল, এই জন্য সুলতানের আবেদনে অগ্রে তাহারা সাড়া দেয় নাই।পরে যখন অন্যান্য কবিরা নিজেদের কাব্য-রচনার জন্য সুলতানের নিকট হইতে প্রচুর ইনাম, খেতাব ও পুরস্কার লাভ করিতে লাগিল, কেবল মাত্র তখনই তাহারা রাজ-দরবারে আসিয়া সাহিত্য সেবার আত্মনিয়োগ করিল।

“The Brahmins could not resist the influence of this high patronage. They were, therefore compelled to favour the language they had hated so much and latterly they themselves came forward to write poems and compile works of translation in Bengali.“ [History of Bengali Literature]

শুধু তাই নয়।সুলতানদেব দেখাদেখি দেশীয় অন্যান্য হিন্দু রাজারাও তখন নিজেদের রাজসভায় বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদিগকে সমাদর করিতে লাগিলেন।এই ভাবেই বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন হইল এবং উহার সমস্ত গৌরব মুসলমানদের প্রাপ্য: “Thus the appointment of Bengali poets to the courts of Hindu Rajas grew to be fashion after the example of the Muslim chiefs.” [Ibid]


এইসব তথ্যের মুকাবেলায় কি করিয়া বলা যায় যে, বাংলা ভাষা আর্যভাষা?

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদিগের দান এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে । তাহাদের রচিত সাহিত্যে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যও ছিল প্রচুর।ধর্ম, ইতিহাস, জীবনী, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব, লৌকিক কেচ্ছা ও কাহিনী এবং অনুবাদই ছিল তাহাদের সাহিত্য-কর্মের মূলধারা।

কাসাসােল আম্বিয়া, ফতুহুশ্বাম, ফতহুল মেছের, আলেফ-লায়লা, জঙ্গনামা, শহীদে-কারবালা, লায়লি-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, আমির হামজা, চাহার দরবেশ, ছয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান, সোনাভান, গাজী কালু ইত্যাদি অসংখ্য পুঁথি মুসলমান কবিরা রচনা করিয়া গিয়াছেন।ডক্টর আব্দুল গফুর সিদ্দিকীর মতে মুসলিম পুঁথির সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০ হইবে। মুসলিম পুঁথি-সাহিত্যের ভাষা ও রচনা-রীতির কিঞ্চিৎ নমুনা নিম্নে দেওয়া হইলঃ

“মেছের সহর হইতে বাহির হইয়া
মকদ্দস পানে নবি জান নেকালিয়া
সামের সহর বিচে ফলগুন গ্রাম
তথা উতরিল যদি নবি নেককাম।
জিবরিল আসিয়া কহে শোন সমাচার
দেখ হেথা জমিনেতে কেমন বাহার।।” [কাসাসুল আম্বিয়া]

“উজিরের পানে বাদশা আঁখি ঘুমাইল।
দেলেতে হইল গোশ্বা কিছু না কহিল।
উজির কহিল বাদশা আমি সব জানি।
আমিরের বেটা এই উম্মর ইউসানি।।[আমির হামজা]

“শুন যত বেরাদার, কহি কিছু সমাচার
শুন সবে আগামি কালাম।
রুমের সহর বিচে, কুস্তনতুনিয়া দেশে
এস্তাম্বুল বলে যার নাম।” [চাহার দরবেশ]

এই চলিত ভাষা এতই জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল্ যে, অনেক হিন্দু কবিও এই ভাষায় পুঁথি লিখিয়া গিয়াছেন। একটি দৃষ্টান্ত দিই:

“আল্লা আল্লা বল পাক পরোয়ারদিগার।
আখেরে দোজখে ডালি…যার।।
দোজখ তরিতে বান্দা করহ ফিকির।
জাহিরে বাতুনে লইলাম আল্লার জিকির।।
আল্লার আরশ কোর্সে কিছু মেহেরবানী চাই।
ইমামগণের কেচ্ছা কিছু মিলাইয়া গাই।
শ্ৰীযুক্ত সাহেবের কেচ্ছা রাধাচরণ গাএ।
আল্লা আল্লা বল নবি পাঞ্জাতনের পাএ’’।।

অষ্টাদশ শতাব্দীতেও হিন্দু কবিরা তাঁহাদের কাব্যে আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার করিতে কুষ্ঠাবোধ করেন নাই।দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতচন্দ্র ও বিদ্যাপতির নাম করা যায়। নিম্নে দুইটি উদ্ধৃতি দিতেছি:

“মানসিংহ জোড় হাতে অঞ্জলি বাঁধিয়া মাথে
কহে জাহাঁপনা সেলামত।
রামজির কুদরতে মহিম হইল ফতে
কেবল তোমারই কেরামত।
হুকুম শাহানশাহী আর কিছু নাহি চাহি
জের হৈল নিমকহারাম।
গোলাম গোলামী কৈল জালিম কয়েদ হৈল
বাহাদুরী সাহেবের নাম।” [ভারতচন্দ্র রায়]

হৈয়া বান্দার বান্দা নুঙাইয়া শির।
বন্দির বড় খাঁ গাজী পীর দস্তগীর।
নিয়ৎ হাছিল সত্যপীরের কালাম।
কহে বিদ্যাপতি করি হাজার ছালাম।। [বিদ্যাপতি]

প্রাচীন গদ্য

প্রাচীন বাংলা গদ্যের নিদর্শন খুবই বিরল।শুধু সরকারী দলিল-দস্তাবিজের মধ্যেই যা কিছু নমুনা পাওয়া যায়।নিম্নে সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর ভাষার নমুনা দেখানো হইতেছে:

সপ্তদশ শতাব্দী (১৬৬২)

“শ্রী যশোমাধব ঠাকুর কুমড়াল গ্রামে দেবালয়ৎ আছিলা।রাম শর্মা ও গায়রহ্ আপনার ২ ওয়াদা মাফিক সেবা করিতেছিল।রাত্রদিন চৌকি দিতেছিল। শ্রী রামজীবন মৌলিক সেবার সরবরাহ পুরুষানুত্রুমে করিতেছেন।” ইত্যাদি। (শ্রী মনোমোহন ঘোষের ‘বাংলা গদ্যের চারযুগ’)

অষ্টাদশ শতাব্দী (১৭৮৬)

“শ্ৰীযুক্ত ওলন্দেজ কোম্পানীতে আড়ঙ্গ বিরভূমের খরিদর দাদনী আমি লইয়া ঢাকা আড়ঙ্গ চালানী করিয়াছি।আপরেল মাহেতে এবং মোকাম মজবুরের গােমস্তা কাপড় খরিদ করিতেছিল এবং কাপড় কথক ২ আমদানি হইয়াছে এবং হইতেছে দাস্ত কথক ২ তৈয়ার হইতেছে এবং মবলগ কাপড় ধোবার হাতে দাস্তর কারণ রহিয়াছে।তাহাতে সংপ্রীতি মে: গেল সাহেবের তরফ পেয়াদা আসিয়া খামখা জবরদস্তী ও মারপিঠ করিয়া ঘাট হইতে ধোবা লোককে ধরিয়া লইয়া গেল।”… ইত্যাদি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এই মিলিত রূপ অব্যাহত ছিল।কিন্তু ইহার পরই বাংলা ভাষার খাত পরিবর্তিত হইল। তখন এদেশে ইংরাজ শাসন প্রবর্তিত হইয়াছে।শাসন কার্যেরর ‘সুবিধার’ জন্য ইংরাজেরা ভেদনীতির আশ্রয় লইল।সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাহারা এই নীতি অবলম্বন করিল।
শেষ পর্বঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য

[উৎসঃ গোলাম মোস্তফা, বাংলা ভাষার নূতন পরিচয়, গোলাম মোস্তফা প্রবন্ধ সংকলন, আহমদ পাবলিশং হাউস, ঢাকা, ১৯৬৮ থেকে সংগৃহীত]