এইবার আর্য-থিওরী সম্বন্ধে শেষ কথা বলিব।আর্য-অনার্যের কথা শুনিলেই আমরা আমাদের চিন্তা ও ধারণাকে সুদূর অতীতে টানিয়া লইয়া যাই এবং ভাবি যে, আলো ও অন্ধকারের মতো দুই স্বতন্ত্র পরিমণ্ডলে আর্য ও অনার্যেরা বাস করিতেছে এবং সেখান হইতেই মানব-গোষ্ঠীর এই দুই ধারা বহিয়া আসিতেছে।কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল।আর্য-থিওরীর বয়স এখন মাত্র দেড়শত বৎসর।ইহার পূর্বে কোনো ইতিহাসে ‘আর্য’ অথবা ‘অনার্য’ বলিয়া কোনো বিশেষ চিহ্নিত জনগোষ্ঠী অথবা কোনো ভাষা ছিল না। এসব তীক্ষ্ণ শ্রেণী বিভাগ আমরা এখানে বসিয়া করিতেছি মাত্র!কাজেই সমস্ত কল্পনাটাই একটা কৃত্রিম আবরণ দিয়া মোড়া৷থিওরীটির উৎপত্তি কাহিনী নিম্নরূপ:
১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের তদানীন্তন চীফ জান্টিস এবং ‘এসিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর প্রেসিডেন্ট Sir William Jones সোসাইটির এক বার্ষিক সভায় একটি মূল্যবান ভাষণ দান করেন।ঐ ভাষণে তিনি ল্যাটিন, গ্রীক, ইংরাজী, ফরাসী, জার্মানি, পহলবী, সংস্কৃত প্রভৃতি কতিপয় ভাষার অনেকগুলি শব্দ ও ধাতৃরূপ বিশ্লেষণ করিয়া দেখান যে, ঐ সব ভাষার মূলে ঐক্য রহিয়াছে।তিনি তাই অনুমান করেন, ঐসব ভাষাভাষীজনেরা আদিতে একই স্থানে বাস করিত এবং একই ভাষায় কথা বলিত।কালে কালে বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহারা নানা দেশে ছড়াইয়া পড়িতে বাধ্য হইয়াছিল। এইরূপেই বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হইয়াছিল।
এই ইংগিত পাইয়া জার্মান পণ্ডিতদের মনে এক নতুন চিন্তার উদ্রেক হইল।তুলনামূলক ভাষাতত্বের (Comparative Philology) আলোচনায় তাঁহারা প্ৰবৃত্ত হইলেন।Max Muller, Bopp, Kalaproth প্রভৃতি পণ্ডিতগণ এই বিষয়ে বহু গবেষণা করিলেন।অতঃপর ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে Sir Thomas Young নামক জনৈক মিসরভাষাবিদ পণ্ডিত আলোচ্য ভাষাগুলিকে “Family of Indo-European Language” বলিয়া অভিহিত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঐসব ভাষাভাষী জনগণকে Indo-European Races নামে পরিচয় দেন।ইহার পরই Indo-Aryan এবং Aryan নামের উৎপত্তি হয়।
তাহা হইলে একথা অনায়াসেই বুঝা যায় যে, আর্য-অনার্যের প্রভেদ নিতান্তই আধুনিক যুগের সৃষ্টি।এই জন্যই ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় বলেন যে, আর্য, অনার্য বা দ্রাবিড় কোনো নৃতাত্তিক প্রকারভেদ নয়; উহারা ভাষার নাম; অর্থাৎ আর্য ভাষাভাষী যাহারা তাহারাই ছিল আর্য, দ্রাবিড় ভাষাভাষী যাহারা তাহারা ছিল দ্রাবিড়।[বঙ্গালীর ইতিহাস]
কিন্তু এ ব্যাখ্যাও খুব সন্তোষজনক বলিয়া মনে হয় না।তবে ইহাতে আর্যদের আভিজাত্যের ভঙ্গি নষ্ট হয় বটে।
আর্য-থিওরীর কুফল
আর্য-থিওরীর স্বরূপ দেখান হইল।ইহাতে ভারতীয় আর্যদের ভূমিকা থাকিলেও তাহারা ইহার স্রষ্টা নহে; ইউরোপ হইতে-বিশেষ করিয়া জার্মান জাতির দ্বারা-এই থিওরী উদ্ভাবিত ও প্রচারিত। উৎকট সেমিঢিক বিদ্বেষ এবং দুর্বল জাতিদিগকে গ্রাস করিবার গভীর দুরভিসন্ধি এই থিওরীর প্রধান প্রেরণা। ইউরোপে জার্মান জাতিই গোঁড়া আর্য বলিয়া খ্যাত। বিগত দুইটি মহাযুদ্ধ তাহাদের গোঁড়ামির ফলেই সংঘটিত হইয়াছে।পাক-ভারত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের যে অবনতি ঘটিয়াছে তাহার মূলেও আছে এই আর্য-থিওরীর প্রভাব।
বস্তৃতঃ এই থিওরী নিতান্তই মানবতা বিরোধী, মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে ও দেশে দেশে বিরোধ ও বৈষম্য সৃষ্টি করিতে এই থিওরী এক অমোঘ অস্ত্র।এই থিওরী মানব-সভ্যতার ইতিহাসকেও বিকৃত ও কলুষিত করিয়াছে এবং মানবজাতির সত্য পরিচয়কে সকলের চোখের আড়াল করিয়া রাখিয়াছে।কাজেই প্রত্যেক কল্যাণকামী মানুষের উচিত এই থিওরীর অবসান ঘটানো।