পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম

Image result for ১৭৫৭পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম

মীর জাফর : বিশ্বাসঘাতকদের সর্দার মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরীফ মাথায় রেখে নবাবের সামনে তার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করার পরপরই বেঈমানি করেছিলেন। তার জামাতা মীর কাসেম তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরবর্তীতে তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ভবিষ্যতে বাংলা অভিধানে বিশ্বাসঘাতকের সমার্থক শব্দ হিসেবে মীর জাফর দেখলে মোটেও অবাক হবো না।
জগৎ শেঠ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ : মীর কাসেম তাদের হত্যা করে। জগৎ শেঠকে দুর্গের চূড়া থেকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হয়।
রায় দুর্লভ : যুদ্ধের পর তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
উমিচর্ঁাদ : যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভ কর্তৃক প্রতারিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে তার মৃত্যু ঘটে।
রাজা রাজবল্লভ : পদ্মায় ডুবে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
মীর কাসেম : মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। পরবর্তীতে ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাধে ও বকসারের যুদ্ধে পরাজিত হন। পরে ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান এবং অজ্ঞাতনামা অবস্থায় দিল্লিতে তার করুণ মৃত্যু ঘটে। তার মাথার কাছে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত চাপকান। এ থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান।
ইয়ার লতিফ খান : তিনি যুদ্ধের পর হঠাৎ করে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান। ধারণা করা হয়, তাকে গোপনে হত্যা করা হয়েছিল।
মহারাজা নন্দকুমার : তহবিল তছরুপ ও অন্যান্য অভিযোগের বিচারে নন্দকুমারের ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু হয়েছিল।
মীরণ : মীর জাফরের বড় ছেলে মীরণ। অসংখ্য কুকর্মের নায়ক এই মীরণ। ইংরেজদের নির্দেশে এই মীরণকে হত্যা করে মেজর ওয়ালস। তার এই মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইংরেজরা বলে বেড়ায় যে বজ্রপাতে মীরণের মৃত্যু ঘটে।
ঘষেটি বেগম : মীরণের নির্দেশে নৌকা ডুবিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
মুহাম্মদী বেগ : নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার হত্যাকারী। কথিত আছে মৃত্যুর সময় নবাব তার কাছ থেকে দুই রাকাত সালাত আদায় করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদী বেগ সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে নবাব সিরাজকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগ মাথা গড়গড় অবস্থায় বিনা কারণে কূপে ঝাঁপ দেয় এবং মৃত্যুবরণ করে।
দানিশ শাহ বা দানা শাহ : অনেকে বলে, এই ফকির নবাব সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিল। আসকার ইবনে শাইখ তার ‘মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা’ গ্রন্থে লিখেছেন, বিষাক্ত সাপের কামড়ে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটেছিল।
রবার্ট ক্লাইভ : নবাব সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কোটি টাকার মালিক হন। ইংরেজরা তাকে ‘পলাসি হিরো’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই রবার্ট ক্লাইভ দেশে ফিরে গিয়ে একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকে নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
ওয়াটস : মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় বিদেশের মাটিতেই হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন।
স্ক্রাফটন : বাংলার বিপুল সম্পদ চুরি করে বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজ ডুবে তার অকাল মৃত্যু ঘটে।
ওয়াটসন : ওয়াটসনের ক্রমাগত স্বাস্থ্যহানি হলে কোনো ওষুধেই ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হন।
বাংলায় মুসলমানদের শক্তিকে খর্ব করে পরাধীন করতে ব্রিটিশ তরবারির সাথে হিন্দু ধনপতিদের অর্থভান্ডারও সমানভাবে সহযোগিতা করেছিল’। শেঠরা শুধু ইংরেজদেরকেই টাকা দেয়নি, সিরাজ-উদ-দৌলার অনেক সৈন্যকে পর্যন্ত অর্থ দিয়ে নিষ্ক্রিয় রেখে বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আরও দুঃখের কথা হলো বন্দী সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করার প্রস্তাব এই জগৎশেঠই দিয়েছিল।
নব্য মীর জাফরদের আনাগোনা আমাদের দেশে এখন বেশি। আড়াল করা ইতিহাস জাতিকে ও নতুন চেতনাময় প্রজন্মকে জানাতে হবে ভালো করেই। শুধুমাত্র মঞ্চ নাটকে সিরাজকে আনলেই চলবে না। সিরাজ আমাদের জাতীয় বীর, সিরাজ আমাদের অনুপ্রেরণা। পলাশী ট্র্যাজেডি হতে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। ১৭৫৭ সালের বাংলার মতোই আজকের বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে চলছে এক ধরনের ষড়যন্ত্র। সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে ষড়যন্ত্রের ধরন। একদা অর্থসম্পদ হলেও আজ তাদের লক্ষ্য এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ, যা ধ্বংস করা গেলেই সম্ভব এ দেশ ও জাতির অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধক্ষমতাকে ধ্বংস করা। এ পরিস্থিতিতে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে পলাশীর বিপর্যয় থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করা যাবে। নয়তো ইতিহাসের সেই নির্মম সত্যই বাস্তবে পরিণত হবে যে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণেই বিপর্যয় নেমে আসে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ আমাদেরকে নব্য মীর জাফর, জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভদের চিহ্নিত করতে হবে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে এখনও যে মারাত্মক কোন্দল এবং হিংসা-প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে, তাতে আমার ভয় হয় আমরা কি স্বাধীনতা হারাতে বসেছি? সময় থাকতে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। আর যেন এই সোনার বাংলায় পলাশী আর সৃষ্টি না হয়।
সিরাজ-উদ-দৌলার ইতিহাস আমাদের জাতীয় ইতিহাস। এ ইতিহাস নিজেদের শিক্ষা নেয়ার ইতিহাস। এ শিক্ষা দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশী-বিদেশী শক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার শিক্ষা। কারণ এখনও মীর জাফর, উমিচর্ঁাদ, জগৎশেঠরা সক্রিয় ও শক্তিশালী। আধুনিক বিশ্বেও সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে সকল দিক থেকে কোণঠাসা করতে ইসলামবিরোধী পরাশক্তিগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মুসলমানদের সময় এসেছে পলাশীর মর্মান্তিক পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণের।