রোহিঙ্গারা আরাকানে বহিরাগত নয় বরং বর্মি রাজারাই আরাকানের দখলদার।

Image result for রোহিঙ্গারোহিঙ্গারা আরাকানে বহিরাগত নয় বরং বর্মি রাজারাই আরাকানের দখলদার।
রোহিঙ্গারা আরাকানে বহিরাগত নয় বরং বর্মি রাজারাই আরাকানের দখলদার। বর্মি রাজারাই বারবার প্রাচুর্যে ভরপুর আরাকান দখল করে লুটপাট আর ছারখার করেছে। ১৭৮৪ সালে আরাকানের স্বাধীনতা লুপ্ত হয় বর্মি রাজা ভোদায়ার আরাকান দখলের মাধ্যমে। এরপরের আরাকানের ইতিহাস বর্মি রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর রক্তের ইতিহাস। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন বার্মা স্বাধীন হলেও আরাকানিদের ভাগ্যে এ স্বাধীনতা নিয়ে আসে নিদারুণ অভিশাপ, যা এখন গোটা বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত।

আরাকান বলতে আজকের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বোঝানো হলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এক সময় রাখাইন রাজ্য ছাড়িয়েও বার্মার বিস্তৃত অঞ্চল আরাকান রাজাদের দখলে ছিল। কোনো কোনো ইতিহাস গবেষক ও পর্যটকের লেখায় এ অঞ্চলে মোগল সাম্রাজ্যের পরই আরাকান সাম্রাজ্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘ ১০০ বছর পর্যন্ত আজকের মিয়ানমারের বিস্তৃত অঞ্চল আরাকান রাজাদের অধীনে ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে কোনো কোনো ইতিহাস গবেষকের লেখায়।

হাজার বছরেরও অধিককাল ধরে আরাকানের যে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়, তাতে আরাকান ছিল বরাবরই স্বাধীন এবং অতিশয় সমৃদ্ধ একটি দেশ। বাংলার প্রাচুর্যের কারণে যেমন ১৫শ সালের শুরুতে এখানে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে, তেমনি ১৫শ ও ১৬শ সালে আরাকানে পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের আগমন ঘটে। ১৬শ সালে ওলন্দাজরা আরাকান থেকে দাস ও চাল ক্রয় করত। তারা এখানে নিয়ে আসত লোহা ও লৌহজাতসামগ্রী। মগ দস্যুরা বাংলার উপকূল থেকে লোকজন ধরে নিয়ে তাদের কাছে বিক্রি করত। মগ জলদুস্যরা প্রথম দিকে ছিল মূলত আরাকানের নৌ-সেনাসদস্য।

১৫৩১ সালে আরাকানের রাজা জেবুক শাহ পর্তুগিজ নৌসেনাদের সহায়তায় আরাকানে নৌবাহিনী গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল মোগলদের থেকে আরাকানকে রক্ষা করা। নৌসেনা গঠনের উদ্দেশ্য ছিল যেহেতু মোগল মসিলম সেনাদের মোকাবেলা তাই জেবুক শাহ তার নৌবাহিনীতে আরাকানের মুসলমানদের পরিবর্তে মগদের স্থান দেন। কিন্তু পরে এরা মানবিকতা বিবর্জিত হিংস্র জলদস্যুতে পরিণত হয়। মধ্যযুগের কোনো কোনো পরিব্রাজক এদেরকে সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত এক শ্রেণীর মানুষ নামক প্রাণী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ফুলে ফলে সুশোভিত স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত আরাকানের পতনকাল শুরু হয় ১৬৬০ সালে আরাকানের রাজা চন্দ্র সু ধর্মা কর্তৃক মোগল রাজপুত্র শাহসুজাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে আরাকানে বিরাজ করে অস্থিরতা। মাঝে শান্তি ফিরে এলেও আরাকানি সামন্ত রাজাদের মধ্যে কোন্দলের সুযোগে ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা ভোদাপায়া আরাকান দখলে নেন। ভোদাপায়ার অত্যাচারে আরাকানের রাজা ঘা থানবি পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে বর্মিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সিনপিয়ার নেতৃত্বে আরাকান বিদ্রোহ তুঙ্গে পৌঁছে। একপর্যায়ে ১৮১১ সালে সিনপিয়ার বাহিনী রাজধানী ছাড়া গোটা আরাকান দখলে নিলেও পরে পরাজিত হয় বর্মি রাজার সেনাদের কাছে।

আরাকানের বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্মি রাজা ১৮১১ সালে সমগ্র বার্মায় প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন যুবক অথবা ২৫০ টাকা, একটি বন্দুক, ১০টি চকমকি পাথর, দুই সের বারুদ, সম ওজনের সীসা, দুইটি কুঠার, ১০টি লম্বা পেরেক সরবরাহের নির্দেশ জারি করেন। এভাবে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন বর্মি রাজা সিনপিয়ার বাহিনী পরাজিত করে। ১৮১৫ সালে সিনপিয়ার মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয় আরাকানের স্বাধীনতা উদ্ধার আন্দোলন। এরপর ১৮২৪ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মা দখল করার পর দীর্ঘ ১০০ বছর পর্যন্ত আরাকানিরা অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু ১৯৪২ সালে আরাকান জাপানিদের অধীনে যাওয়ার পর আরাকানের মুসলমানদের ওপর আবার গণহত্যায় মেতে ওঠে বর্মিরা। অবশেষে ১৯৪৫ সালে আবার ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে বার্মা। কিন্তু স্বাধীনতার মাধ্যমে বার্মা ব্রিটিশমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে আবার আরাকানের ওপর হত্যা নির্যাতন আর উচ্ছেদে মেতে ওঠে বর্মিরা। তাদের বহিরাগত আখ্যায়িত করে শুরু হয় চরম হত্যাযজ্ঞ। তাই বার্মা স্বাধীনতা আরাকানের রোহিঙ্গাদের জন্য বয়ে আনে অভিশাপ।

হাজার বছরেরও অধিকাল কাল ধরে বিদ্যমান স্বাধীন আরাকানের রাজত্বে ১৪০৬ সালে হানা দেয় বর্মি রাজা। আরাকানের তরুণ রাজা নরমিখলা পালিয়ে তখন আশ্রয় নেন বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের রাজধানী গৌড়ে। ১৪৩০ সালে বৃহত্তর বাংলার রাজধানী গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দীন শাহ নরমিখলাকে আবার আরাকানের ক্ষমতায় বসান। তিনি বর্মি রাজাদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ৫০ হাজার সৈন্য আরাকানে পাঠান এবং তারা সেখানে অবস্থান করেন। নরমিখলা সোলাইমান শাহ নাম ধারণ করে আরাকানের ক্ষমতায় বসেন এবং ম্রাউক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। আবার শুরু হয় শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে আরাকানের পথচলা। এ রাজবংশ ১০০ বছর পর্যন্ত গৌড়ের ইলিয়াস শাহী বংশের অনুগত থেকে একপ্রকার স্বাধীনভাবেই আরাকান শাসন করেছে। অপর দিকে আরাকানের প্রতি গৌড়ের সুলতানদের বদান্যতা ইতিহাসে বিরল ঘটনা হিসেবে স্থান পায়। তারা বর্মি রাজা হঠিয়ে আরাকান দখল করেও তা ফিরিয়ে দেন নরমিখলার হাতে। নরমিখলার রাজবংশের অধীনে ১০০ বছরে আরাকান খুবই শক্তিশালী একটি রাজ্যে পরিণত হয় এবং এরই ভিত্তি ধরে পরবর্তী শাসকেরা শক্তিশালী আরাকান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা বার্মার বিস্তৃত ভূ-ভাগ নিয়ে গঠিত হয়।

দিল্লির মোগলদের কারণে গৌড়ের ইলিয়াস শাহী রাজবংশের পতন ঘটলে ১৫৩০ সালে ম্রাউক রাজবংশের রাজা জেবুক শাহ আরাকানের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ বংশেরই পরবর্তী রাজা সেলিম শাহ ১৫৯৩ সালে বার্মার মলমিন পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ আরাকান রাজ্যের অধীন করেন এবং নিজে বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ফরাসি পর্যটক ফাইয়ারড এ সময় এ অঞ্চল সফর করেন এবং তিনি মোগলদের পর আরাকানকে এ অঞ্চলের শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করেন।