১. বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারণ নিয়ে গবেষণা করা শ্রী নরেশ কুমার মনে করে, বৌদ্ধবাদের বিরোধিতা ও একইসাথে ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের পুনর্স্থাপনের জন্যে, ব্রাহ্মণ পুনর্জাগরণীরা তিন ধাপের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলে।
প্রথম ধাপে তারা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর অত্যাচারের অভিযান শুরু করে। এরপরে তারা বৌদ্ধ ধর্মের ভালো দিকগুলো আত্মস্থ করে নেয় যাতে করে “নীচু” জাতের বৌদ্ধদের মন জয় করা যায়। কিন্তু বাছাইকৃত আত্মীকরণের এই ধাপে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ না হয় তা নিশ্চিত রাখা হয়। বৌদ্ধবাদ ধ্বংস প্রকল্পের শেষধাপে – ‘গৌতম বুদ্ধ হিন্দু বিধাতা বিষ্ণুর আরেকটি অবতার ছাড়া আর কিছুই নয়’ – এই ধারণা চালু করে তা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
নরেশ কুমার বলে, “বুদ্ধের নাম কলুষিত করার পাশাপাশি এহেন ব্রাহ্মণ্য পুনর্জাগরণবাদীরা নিরপরাধ বৌদ্ধদের নিপীড়ন কিংবা এমনকি মেরে ফেলার তাগিদ হিন্দু রাজাদের দিতে থাকে। বাংলার শৈব ব্রাহ্মণরাজা শশাঙ্ক শেষ বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধনের বড় ভাই রাজ্যবর্ধনকে ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে হত্যা করে। এরপরে শশাঙ্ক বোধি গয়াতে গিয়ে বোধি বৃক্ষকে উপড়ে ফেলে – যার নিচে বসে ধ্যান করে গৌতম বোধি প্রাপ্ত হয়।
পাশের বৌদ্ধ বিহারে থাকা বৌদ্ধের প্রতিকৃতি সে সরিয়ে ফেলে তার জায়গাতে শিবের প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে দেয়। এরপরে বলা হয়ে থাকে যে শশাঙ্ক কুশিনগরের সব বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নির্বিচারে হত্যা করে। আরেক শৈব হিন্দু রাজা মিহিরকুল ১৫০০ বৌদ্ধ তীর্থস্থান সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে।
২. ইতিহাসবিদ এস. আর. গোয়েল এর মতে (লেখক – A History of Indian Buddhism) পুরোহিত বর্ণের ব্রাহ্মণদের শত্রুতার জন্যেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের অবলুপ্তি ঘটেছে। গৌড়ের শাসক হিন্দু শৈব রাজা শশাঙ্ক (৫৯০-৬২৬) বোধি বৃক্ষ ধ্বংস করে – যার নিচে বসে ধ্যান করে গৌতম বোধিপ্রাপ্ত হয়। পুস্যমিত্র শুঙ্গ (১৮৫-১৫১ পূর্বাব্দ) বৌদ্ধদের প্রতি বৈরী ছিল। সে ধর্মীয় সূত্র লেখনিগুলোসহ বৌদ্ধ প্রার্থনালয় জ্বালিয়ে দেয়া ছাড়াও অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুকে পাইকারী হারে হত্যা করে।
৩. ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্ৰমণকারী চীনা পরিব্রাজক হিউয়ান সাং বলে রাজা শশাঙ্ক গয়ায় বোধিবৃক্ষ ছেদন করে এবং নিকটবর্তী বৌদ্ধ মন্দির থেকে বুদ্ধমূর্তি সরিয়ে সেখানে শিবের মূর্তি প্রতিস্থাপন করে [T. Walters, on Yuan Chwang’s Travels in India (A.D 629-45), 1905, page 111, 115]। এছাড়াও পাটালিপুত্তা ও কুশীনারাতে বৌদ্ধদের অনেক বিহার এবং সৌধ ধ্বংস করা হয় (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯২)।
৪.লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে কাশ্মীররাজ হর্ষ সম্পর্কে উইলিয়াম ডালরিমপল-এর মন্তব্য, ‘শুধু এই কাশ্মীরি রাজা একাই অন্তত চার হাজার বৌদ্ধ পুণ্যস্থান ধবংস করার জন্য দম্ভ করত।’এই ধ্বংসাত্মক কাজ পরিচালনার জন্য বিশেষ কর্মচারীও ছিল তার। পদটার নাম দিয়েছিল দেবোৎপাটননায়ক।
৬ শতকের আর-এক শৈব শাসক মিহিরকুল বৌদ্ধ বিহার ও স্তুপ ধ্বংস এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলে।
৫. বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণ বিদ্ধেষের আরেকটা নমুনা হচ্ছে বৌদ্ধদেরকে ‘বুদ্ধু’ বলে ডাকা, যেই শব্দটি এখনো ‘বেকুব বা বোকা’ অর্থে প্রচলিত আছে আমাদের দেশে (M. Abdul Mu’min Chowdhury, The Rise and Fall of Buddhism in South Asia, London, 2008, পৃষ্ঠা ৩১০)
৬. বৌদ্ধবিহারের নাম শুনিলে হিন্দুরা কানে আঙ্গুল দিত, এই পাপ নাম উচ্চারণ করিতে নাই-শিশুরা এই শিক্ষা পাইয়াছিল’। কুমিল্লা জেলার কামতা নামে একটি গ্রামে বৌদ্ধদের একটা সংঘ ছিল।হিন্দুরা এই গ্রামের নাম মুখে লইতো না।’পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীগণ কখনও ভোরের বেলায় সেই গ্রামের নাম লয় না, পুবের গ্রাম কি পশ্চিমের গ্রাম ইত্যাদি বলিয়া দরকার হইলে ইহার উল্লেখ করিয়া থাকে’ (দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা ৭)।
৭. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলে, ‘যে জনপদে এক কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১১৫০০ ভিক্ষু বাস করিত, সেখানে একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থ ৩০ বৎসরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই’ (উদৃত, দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-১১)।
৮. ঐতিহাসিক তারানাথ এবং সুম্পার (Sumpa) উদ্ধৃতি দিয়ে ড. মু’মিন চৌধুরী বলেন সেন রাজাদের অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা বাংলা থেকে প্যাগান, পেগু, আরাকান, কুকি এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩৬)।
৯. সেন রাজাদের অন্যতম ছিল রাজা বল্লাল সেন। সে কুলীন প্রথা চালু করে। বৌদ্ধদের একটা অংশকে কুলীন পদমর্যাদা দিয়ে হিন্দু ধর্মে গ্রহণ করে নেয়া হয় যারা কায়স্থ নামে পরিচিত। যারা সেনদের শাসনকে মাথা পেতে নেয়নি তারা হয়ে গেল নিম্ন বর্ণ (ড. মু’মিন চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪১)। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে ‘বস্তুত কৌলিন্য সে সকল লোককে দেওয়া হইয়াছিল, যাহারা ব্রাহ্মণ শাসন শিরোধার্য্য করিয়া লইয়াছিল’ (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-৪৮৩)।
আর বৌদ্ধদের নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল মুসলমানেরাই। আজ সে বিশ্বাসঘাতক বৌদ্ধরাই মুসলমান শহীদ করছে।