মুসলিম শাসকদের উদারতায় বৌদ্ধরা হিন্দু অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছে

Image result for মুসলিম শাসকমুসলিম শাসকদের উদারতায় বৌদ্ধরা হিন্দু অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছে
দক্ষিত ভারত থেকে আগত হিন্দু ধর্মালম্বী সেন বংশের লোকেরা পাল বংশের রাজা থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়। শুরু হয় বৌদ্ধদের উপর আরেক দফা নির্যাতন। ঐতিহাসিক তারানাথ এবং সুম্পার (Sumpa) উদ্ধৃতি দিয়ে ড. মু’মিন চৌধুরী বলেন সেন রাজাদের অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা বাংলা থেকে প্যাগান, পেগু, আরাকান, কুকি এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩৬)।
সেনদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে স্থানীয় বাঙালি বৌদ্ধদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় ছিল সবাই। সেই সময়ে বখতিয়ার খলজির আগমন ঘটে বাংলায়। তিব্বতী বুদ্ধ ঐতিহাসিক কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রীর বিবরনী থেকে জানা যায় মগধ থেকে এক দল ভিক্ষু মির্জাপুরে গিয়ে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ারের সংগে দেখা করে তাকে মগধকে মুক্ত করতে আবেদন করে (Journal of the Varendra Research Society, Rajshahi, 1940)। তাঁর আগমনে ব্রাহ্মণ্য শাসনের অবসান ঘটে। বৌদ্ধরা মুসলিম শাসনকে স্বাগত জানায়। দীনেশ চন্দ্র সেন তার পর্যবেক্ষণে বলে; শূন্যপুরাণের ‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ নামক অধ্যায়ে দেখা যায়-তাহারা (বৌদ্ধরা) মুসলমানদিগকে ভগবানের ও নানা দেবদেবীর অবতার মনে করিয়া তাহাদের কর্তৃক ব্রাহ্মণ দলনে নিতান্ত আনন্দিত হইয়াছিল। …….ইতিহাসে কোথাও একথা নাই যে সেনরাজত্বের ধ্বংসের প্রাক্কালে মুসলমানদিগের সঙ্গে বাঙালি জাতির রীতিমত কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হইয়াছে। পরন্তু দেখা যায় যে বঙ্গবিজয়ের পরে বিশেষ করিয়া উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সহস্র সহস্র বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু, নব ব্রাহ্মণদিগের ঘোর অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়াছে (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-৫২৮)
মুসলিম শাসকদের উদারতা, বৌদ্ধদের প্রতি মুসলিমদের ভালো ব্যবহারের ফলে দলে দলে বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ‘বাংলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হইয়া গেলো’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বৌদ্ধধর্ম, পৃষ্ঠা ১৩১)। তবে মুসলমান হওয়ার এই প্রক্রিয়াটি রাতারাতি হয়ে যায়নি, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে বৌদ্ধ-মুসলিম সংমিশ্রনের ফলে বৌদ্ধরা আস্তে আস্তে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে।

১২০৪ খ্রিস্টাব্দ বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের আগেই বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছিলো।তবে বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর সেটা অনেক বেড়ে যায়।ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭২ সালে ভারতে প্রথম বারের মত আদমশুমারি হয়।সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা খুব দুর্বল। বিহার-উড়িষ্যার তুলনায় বাংলাতে তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে আরো দুর্বল ছিল। পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্বই ছিল না (Dr. Kamal Siddiqui, Local government in Bangladesh,The University Press Limited, page-37)।এই চিত্র ভারতে আর কোথাও ছিলনা।ফলে মুসলমানদের ইসলাম প্রচার প্রসারে এবং নির্যাতিত বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণে ভারতের অন্য অঞ্চলের মত কোন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি।

গিয়াস আদ দীন ইয়াদ (১২১৩-২৭) এবং মুগিস আদ দীন তুগরাল (১২২৭-৮১) এর শাসনামলে সেনাবাহিনীতে স্থানীয়দের (বৌদ্ধদের) নিয়োগ দেয়ার কথা জানা যায়। এছাড়া ইলিয়াস শাহের শাসনামলে (১৩৪২-৫৭) সেনাবাহিনীতে কর্মরত ‘পাইক’ বাহিনী একটি শক্তিশালী ফোর্সে পরিণত হয়। পাইক শব্দের অর্থ হচ্ছে পদাতিক বাহিনী এবং এই শব্দটি প্রাকৃত / পালি থেকে এসেছে।এই পাইকরা ছিল বৌদ্ধ। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে মুসলিম শাসকদের সাথে বৌদ্ধদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল(ড. মু’মিন চৌধুরী,প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ২৭০)। এখনো বাংলা ভাষায় পাইক-পেয়াদা শব্দটি প্রচলিত আছে।

মুসলিম শাসকদের মধ্যে স্থানীয় (বৌদ্ধ) শিক্ষিত শ্রেণীর প্রভাব ছিল, একইসাথে মুসলিম প্রশাসনের ভূমি ব্যবস্থায় এসব স্থানীয়রা রাজস্ব্য আদায়কারী এবং হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা ছিল। (ড. মু’মিন চৌধুরী,প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ২৭১ )।
স্থানীয় বৌদ্ধদের সাথে শাসক মুসলিমদের বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল। এই বিষয়টি ফুঁটে উঠে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় (দেখুনঃ Johan Elverskog, Buddhism and Islam on the Silk Road, Philadelphia: University of Pennsylvania Press, 2010)। এর ফলে মুসলিম অত্যাচারে বাংলা থেকে বৌদ্ধদের উৎখাতের ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচারণা ভিত্তিহীন হয়ে পরে।

বৌদ্ধ-মুসলিম সুসম্পর্কের আরেকটি বড়ো নমুনা হচ্ছে বখতিয়ার খলজি এবং তার পরবর্তী শাসকরা কখনো স্থানীয় বৌদ্ধ এবং অন্যদের উপর জিজিয়া কর চাপিয়ে দেয়নি (ড. মু’মিন চৌধুরী,প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ২৬৬)।
অর্থাৎ, মুসলিম ট্রেডিশান মতে কোন দেশ মুসলিম কর্তৃক যুদ্ধে জয়ী হলে অমুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য ট্যাক্স হিসেবে জিজিয়া আদায় করা হয়। কিন্তু বাংলায় সেটা ঘটেনি।