মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নয়, হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার পতন হয়েছিল।

Image result for মীর জাফরমীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নয়, হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার পতন হয়েছিল।

মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নয়, হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতায়! বাংলার পতন হয়েছিল।
এক বিরাট ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি, যা খণ্ডন করার দরকার আছে। সবাই সব সময় নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্নে মীরজাফরকেই একচেটিয়া দোষ দিয়ে দেয়, কিন্তু আড়াল করে যাই প্রকৃত সত্যকে।
ইতিহাস বলে, মীরজাফর একা কখনোই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলো না। বরং মীরজাফর ছিলো বিশ্বাসঘাতকদের বানানো একটা পুতুল(যার নিজের কোন যোগ্যতা ছিলো না), যখনই তার দ্বারা বিশ্বাসঘাতকদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে, তখনই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বিশ্বাসঘাতকরা। বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত চক্রান্তবাজদের চেহারা।
ইতিহাসে মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছিলো অনেক পরে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যে সরাতে হবে তার পরিকল্পনা অনেক আগেই করেছিলো তিন হিন্দু বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও রাজবল্লভ মিলে। জগৎশেঠের বাড়িতে এক গোপন মিটিংয়ে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, সিরাজউদ্দৌলাকে সরাতে হবে। সেই মিটিং এ মহিলার ছদ্মবেশে পালকীতে করে যোগ দিয়েছিলো ইংরেজ দূত ওয়াটস। মিটিং এ সিদ্ধান্ত হয় সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে, আবার মুসলমানদের উত্তেজিত করা যাবে না। এ জন্য সিরাজের আত্মীয় মীর জাফরকে বসানো হবে। মি. ওয়াটস তখন বললো-
সিরাজের সাথে লড়তে যে বিরাট অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের কাছে নেই।’ তখন জগৎশেঠ বললো- ‘টাকা যা দিয়েছি (মানে এতদিন বেঈমান ইংরেজদের সেই টাকা দিতো), আরো যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাবো, কোন চিন্তা নাই”।
(তথ্যসূত্র: ইতিহাসের ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা, ২৩২)

এই মিটিং এর পর সিরাজকে সরাতে ঘসেটি বেগমকে বুঝানোর দায়িত্ব ছিলো রাজা রাজবল্লভের উপর। আর মীরজাফরকে বুঝানোর দায়িত্ব ছিলো উমিচাঁদের উপর। উমিচাঁদ মীরজাফরকে লোভ দেখায়, তুমি আমাদের দলে থাকলে তোমাকে পরবর্তীতে সিংহাসনে বসানো হবে। (বি: দ্র: যারা ব্রিটিশদের দালালি করতে পারতো, তাদেরকে রাজা উপাধি দেওয়া হতো। যেমন রাজা রামমোহন রায়, রাজা নবকৃষ্ণ)।
এরপর জগৎশেঠের বাড়িতে দফায় দফায় মিটিং হয়। সেখানে উপস্থিত থাকে জগৎশেঠ, রাজা মহেন্দ্ররায় (রায় দুর্লভ), রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও মীরজাফর। ঐ মিটিংয়েই এক হিন্দু সরাসরি বলে বসে, “মুসলিম নবাব না করে হিন্দু নবাব করা হোক”। তখন কৃষ্ণচন্দ্র মীর জাফরের দিকে দৃষ্টিপাত করে থতমত খেয়ে যায় এবং বলে- ‘না, আমরা মীরজাফরকে দিয়েই সিরাজকে সরাতে চাই।’ উদ্দেশ্য ছিলো- মুসলমানগণ ক্ষেপে উঠবে না, মুসলমান নবাবের পরিবর্তে মুসলমান নবাব হবে মাত্র। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক তর্ক হয়। তখন জগৎশেঠ বলে- “কৃষ্ণচন্দ্রের কথাই ঠিক আছে। আমরা কেউ নবাব হলে বিপদ আছে।”
(তথ্যসূত্র: ইতিহাসের ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা, ২৪৩। নবাব সিরাউদ্দৌলা- ডি এল রায়)
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, মীরজাফর ছিলো যোগত্যাহীন এক খেলার পুতুলমাত্র, পেছন থেকে মূল কলকাঠি নেড়েছিলো দাদারা। দিয়েছিলো সমর্থন ও পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ।
এখন হয়ত বলতে পারি, জগৎশেঠ কিভাবে টাকা দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? তার ব্যক্তিগত টাকা সে দিতেই পারে।
কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। শেঠ পরিবারের পূর্ব পুরুষ হীরানন্দ ছিলো অত্যন্ত দরিদ্র, যারা অভাবের জ্বালায় নিজ ভিটামাটি ত্যাগ করেছিলো। মুসলমান নবাব ও সম্রাটদের ছাত্রছায়ায় তারা পেয়েছিলো অর্থসম্পদ। এই ‘শেঠ’ উপাধিও মুসলমানদের দেওয়া। মুসলিম সম্রাট ও নবাবদের দয়াদানেই এত টাকার মালিক হয়ে ওঠে শেঠ পরিবার। শেঠ পরিবার সব সময় মুসলিম শাসকদের তোষণ করতো, ফলে শেঠ পরিবারের উপর সব সময় মুগ্ধ থাকতো সম্রাটরা। সম্রাট মুহম্মদ শাহ জগৎশেঠ উপাধি দিয়েছিলো এবং তার জন্য মতির মালা ও হাতি উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলো। উল্লেখ্য, মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর তার বাড়ির টাকা শেঠদের বাড়িতে জমা রাখা হয়েছিলো, যার পরিমাণ ঐ সময় ৭ কোটি টাকা।, যা শেঠ পরিবার আর ফেরত দেয়নি। (সূত্র: রিয়াজুস সালাতিন, Stewarts History of Bengal, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, ৫৬ পৃষ্ঠা, নিখিল চন্দ্র রায়, ঐতিহাসিক চিত্র, অক্ষয় কুমার মৈত্র)।
অর্থাৎ মুসলমানদের থেকে পাওয়া অর্থই মুসলিম শাসন অবসান করতে ব্যবহার করেছিলো জগৎশেঠ। এ জন্য ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ মীর জাফরের কথিত বিশ্বাসঘাতকতা নয় বরং হিন্দু মহাজনদের টাকাকেই মূখ্য করেছে। এ সম্পর্কে এক ইংরেজ ঐতিহাসিক বলেন-
The Rupees of the Hindu banker, equally with the sword of the English colonel contributed to the overthrow of the Mahammedan power in Bengal.
(ঐতিহাসিক চিত্র, অক্ষয় কুমার মৈত্র ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় দ্রষ্টব্য। ইতিহাসের ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা, ২৩৬)

উপরের ইংরেজী বক্তব্যে স্পষ্ট লেখা - ‘মুসলমানদের শাসনের পতন ঘটাতে দুটি জিনিস কাজ করেছে - প্রথমত হিন্দুদের টাকা, দ্বিতীয়ত্ব ইংরেজদের তরবারি।’ এতে বোঝা যাচ্ছে, ঐ সময় ঐতিহাসিকদের কাছে মুসলিম শাসন অবসানের জন্য মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকার খুব একটা মূল্য ছিলো না। উল্লেখ্য, সিরাজ-উদ-দৌলা পতনের মত ঘটনার গোড়ার ঘটনা হচ্ছে ইংরেজদের কলকাতা দুর্গ নির্মাণ করা। এই দুর্গ নির্মাণকে কেন্দ্র করেই সিরাজের সাথে ইংরেজদের দ্বন্দ্ব বাধে, যার অনেক পরের ফল হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ। ইতিহাস বলছে, ঐ দুর্গ নির্মাণের মত অর্থ ইংরেজদের ছিলো না, সেই অর্থ কিন্তু দিয়েছিলো রাজবল্লভ।
আলীবর্দীর আমলে প্রজাদের সর্বনাশ করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিলো সামান্য কেরানী রাজবল্লভ। সেই টাকা নিজপুত্র কৃষ্ণরায়ের মারফত দুর্গ নির্মাণে পাচার করেছিলো রাজবল্লভ। দুর্গ নির্মাণের পরই কলকাতায় অভিযান চালিয়েছিলো নবাব। এ সময় গ্রেফতার হয় বিশ্বাসঘাতক হলওয়েল, কৃষ্ণদাস ও উমিচাঁদ। কিন্তু সিরাজের অপরাধ ছিলো, সে ঐ তিন বিশ্বাঘাতকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তিনজনকেই ক্ষমা করে দেয়। যার ফল নবাবকে পরে পেতে হয়েছিলো। (তথ্যসূত্র: ইতিহাসের ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা, ২৪৩)

এখানে একটা কথা আসতে পারে, হিন্দুরা কেন নবাব সিরাজের মূলকেন্দ্র তথা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের পতন চাইবে?
এর উত্তর হতে পারে, হয়ত মনে মনে মুর্শিদাবাদকে কখনই সহ্য করতে পারতো না হিন্দুরা। কারণ মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজধানী করেছিলো মুর্শিদকুলী খান, যেই মুর্শিদ কুলী খান আগে ছিলো এক কুলীন ব্রাহ্মণ, যে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে যায়। এই কারণে মুর্শিদাবাদের উপর ক্ষোভ বা হিংসা ছিলো গোঁড়া হিন্দুদের।
আবার অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, একজন শেঠ(জগৎশেঠ)কিভাবে একজন নবাবকে সরিয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করলো?
এর উত্তর হচ্ছে, ঐ সময় অর্থকড়ির একটা বড় হিসেব হতো এই শেঠ পরিবারের মাধ্যমে।
মুসলিম শাসকদের তোষণ করে তারা সে সুযোগটা আদায় করে নিয়েছিলো। সারা ভারতের বহু স্থানেই তাদের গদি ছিলো। ইংরেজরা শেঠ পরিবারের নাম দিয়েছিলো ‘ব্যাংকার’। বর্তমানে যারা ইহুদীদের রথচাইল্ড পরিবার সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাদের জন্য বিষয়টি বুঝতে সোজা হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বের শাসক কে হবে, আর কে না হবে, এটা পর্দার আড়াল থেকে মূল চাবিকাঠি নাড়ে রথচাইল্ড পরিবার। এরা টাকার জোরে মূল কাজটি করে থাকে। ঐ সময়ও টাকার জোরে জগৎশেঠ পেছন থেকে বাংলাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিলো। সত্যিই বলতে, ইতিহাস পড়লে একজন স্বল্প শিক্ষিত লোকও বুঝতে পারবে বাংলার শাসন অবসানে মীর জাফর ছিলো একটা পুতুল মাত্র। কারণ তাকে সিংহাসনে বসানোর পর তার কোন ক্ষমতা ছিলো না, তাকে যা বলা হতো সে তাই করতো।
তাও মাত্র ৩ বছরের মাথায় তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বসানো হয় মীরকাশেমকে। দেখাগেলো মীরকাশেম যখন জগৎশেঠের বিরুদ্ধে গেলো, তখনই ইংরেজরাই মীরকাশেমের বিরুদ্ধচারণ শুরু করলো। এর দ্বারা প্রমাণ হয় মীরজাফর ও মীরকাশেমের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক, ইংরেজ ও জগৎশেঠ তথা হিন্দুদের সাথে সম্পর্কের তুলনায় কিছুই ছিলো না।
তাই লেখার শেষে আবার বলতে হচ্ছে, মীরজাফরের কথিত বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসঘাতকতাই বাংলার পতনের মূল কারণ। তাই আমি আর কিছু বলতে চাই না, আপনার মুল্যবান জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করুন বিশ্বাসঘাতক কি সে নাকি তারা।
ঘষেটী বেগমসহ বিশ্বাসঘাতকরা ছিল মোট পাঁচ জন এবং এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন চার জন। প্রধান চার জনের এক জন ছিলো মুসলিম আর তিনজনই হিন্দু বা প্রধান পাঁচ জনের দুইজন ছিলো মুসলিম আর তিনজনই হিন্দু। বাংলাকে শতভাগ পরাধীন করার জন্য মুসলিম কতভাগ দায়ী মিরজাফর কতভাগ দায়ী!!!