ভারতবর্ষে ইংরেজি প্রচলনের আগে যে ব্রিটিশরাও মাদরাসা শিক্ষার মুখাপেক্ষী ছিলো তথা মুসলমানদের মুখাপেক্ষী ছিলো, সেই ইতিহাস বর্তমান মুসলমানরা জানে না।

Image result for ইংরেজীভারতবর্ষে ইংরেজি প্রচলনের আগে যে ব্রিটিশরাও মাদরাসা শিক্ষার মুখাপেক্ষী ছিলো তথা মুসলমানদের মুখাপেক্ষী ছিলো, সেই ইতিহাস বর্তমান মুসলমানরা জানে না।
বর্তমান সময়ের মুসলমানদের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে একটি অবজ্ঞার মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। কারণ সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকসমূহে একটি ভুল কথা স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরকে মুখস্থ করানো হয় যে, ব্রিটিশ আমলে মুসলমানরা মাদরাসা শিক্ষা ত্যাগ করতে চায়নি দেখে তারা পিছিয়ে পড়েছিলো। বলা বাহুল্য, এই কথাগুলো পড়ার পর স্কুল-কলেজের মুসলমান শিক্ষার্থীদের মনে এই চিন্তা উদিত হয় যে, মুসলমান জাতির দুরবস্থার পেছনে বোধহয় মাদরাসা শিক্ষাই দায়ী। নাউযুবিল্লাহ!
সাথে সাথে পাঠ্যপুস্তকে এধরণের আষাঢ়ে গল্পও লেখা থাকে যে,ব্রিটিশরা উন্নত ছিলো, ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা মাদরাসা শিক্ষার তুলনায় উন্নত ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, ব্রিটিশরা ১৭৫৭ ঈসায়ীতে ক্ষমতা দখলের পরপরই কেন ইংরেজি শিক্ষা জারি করলো না? কেন ব্রিটিশরা ইংরেজি চালু করতে ১৮৩৫ ঈসায়ী পর্যন্ত সময় নিলো?
এর উত্তর হলো, ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা থাকা তো দূরের কথা, তারা তো শিক্ষিতই ছিলো না! পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধে জয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সামনে দেশ শাসনের দায়িত্ব চলে আসে, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্রিটিশরা দেশ শাসনের উপযুক্ত ছিলো না। কারণ তারা ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন সাগরে সাগরে ঘুরে বেড়ানো নৌ-দস্যু। ব্যবসার খাতিরে ছোটখাটো হিসাব কষতে পারলেও রাজস্ব আদায়ের নিয়ম ও দেশশাসনের নিয়ম তাদের আয়ত্ত্বে ছিলো না।
সবচেয়ে বড় কথা, এই অঞ্চলটি ব্রিটিশদের অন্যান্য কলোনী, যেমন আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনদের মতো অসভ্য জনগোষ্ঠীর বসতি ছিলো না। ভারতবর্ষের মুসলমানগণ ছিলেন অনেক অনেক শিক্ষিত। এখন মূর্খরা মূর্খদের উপরই প্রভাব বিস্তার করতে পারে, শিক্ষিত ব্যক্তিদের উপরে নয়। যার ফলে নৌ-দস্যু ক্লাইভ বাধ্য হয়ে ‘দ্বৈত শাসন’ নামে একটি শাসনব্যবস্থা জারি করে। এই শাসনব্যবস্থায় দেশশাসন, বিচারব্যবস্থা পরিচালনা ও রাজস্ব আদায়ের নিয়মকানুন পূর্ববর্তী মুসলিম নিয়মেই পরিচালিত হয়, ইংরেজরা শুধু একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লাভ সংগ্রহ করতো মাত্র। এই ‘দ্বৈত শাসন’ ব্যবস্থায় ইরান থেকে আগত রেযা খাঁ নামক একজন সম্ভ্রান্তবংশীয় মুসলমানকে নাবালক নবাবের প্রতিনিধি করে তার হাতে দেশশাসনের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।

কিন্তু ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলার সম্পদ লুট করা। এ লক্ষ্যে তারা বাংলার শিক্ষিত মুসলমান প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে কাজ করে প্রথমে রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আয়ত্ত্ব করে, এরপর ব্রিটিশরা নিজেরাই রাজস্ব আদায়ের নামে নির্বিচারে লুটপাটে নেমে পড়ে। রেযা খাঁয়ের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ব্রিটিশদের অন্যায় লুটপাটের ফলশ্রুতিতে ১৭৭০ ঈসায়ীতে এদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। সেই দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়।
১৭৯১ সালে লুটপাটের সুবিধার্থে মিথ্যা অভিযোগ তুলে রেযা খাঁকে অপসারণ করে ব্রিটিশরা। কিন্তু একজন রেযা খাঁকে সরিয়েই বা কী হবে? প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও রাজস্ব আদায় তখনও মাদরাসা শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই চলতো এবং অবধারিতভাবেই মুসলমানদের প্রাধান্য এতে নিশ্চিত হতো। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ আমলা উইলিয়াম হান্টার ১৮৭৩ ঈসায়ীতে রচিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইতে লিখেছিলো-
“এই ব্যবস্থা (মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা) ভারতে সে সময়ের অন্য যে কোনও বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় বহুগুণে উন্নত ছিলো। এই ব্যবস্থায় তাঁরা (মুসলমানরা) এক বুদ্ধিগত ও বৈষয়িক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছিলেন এবং কেবলমাত্র এর সাহায্যেই হিন্দুরা তাদের নিজেদের দেশে কর্তৃত্বের একটি নূন্যতম অংশ পাবার উপযুক্ত হয়ে ওঠার আশা করতে পারতো। আমাদের শাসনের প্রথম ৭৫ বছর আমরা প্রশাসন ও পরিচালনার জন্য অফিসার তৈরী করার উপায় হিসাবে এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগাচ্ছিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা আমাদের নিজস্ব জনশিক্ষা ব্যবস্থার একটি প্রকল্প চালু করি, এবং একটি প্রজন্ম নয়া পরিকল্পনা অনুযায়ী এর ফলে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠতেই পুরোনো মুসলমানী ব্যবস্থাকে রদ করে দিই। মুসলমান যুবকদের সামনে সরকারি কর্মী হিসেবে জীবনযাপনের সবধরণের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। (তথ্যসূত্র: দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১২৪)
উপরের অংশটুকু পড়লেই পাঠকদের নিকট পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ব্রিটিশরা যদি মুসলমানদের তুলনায় ‘উন্নত’ হতোই, সেক্ষেত্রে তাদের শাসনামলের প্রথম ৭৫ বছর মাদরাসা শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তাদেরকে চলতে হলো কেন? তবে শুধু ব্রিটিশরা নয়, হান্টারের উপরোক্ত বক্তব্য অনুযায়ী হিন্দুরাও ‘কর্তৃত্বের একটি নূন্যতম অংশ পাবার জন্য’ মাদরাসা শিক্ষার উপর নির্ভরশীল ছিলো।
আমরা মুসলিম শাসনামলে হিন্দুদের রাজকর্মচারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার বিভিন্ন ঘটনা শুনতে পাই। এখানে পাঠকদের জানা উচিত যে, ঐসব হিন্দুরা ধুতি-নেংটি পরা হিন্দু ছিলো না। ঐসব হিন্দুরা ছিলো মাদরাসায় পড়াশোনা করা, ফারসী ভাষায় কথা বলা, মুসলমানী পোষাক পরা হিন্দু। প্রশাসনে অন্তর্ভূক্ত হতে চাইলে একজন হিন্দুকে পোষাক আশাক থেকে শুরু করে কথাবার্তা সবকিছুতে মুসলমানী আদব-কায়দা অনুসরণ করতেই হতো। হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বা ধুতি নেংটির কোনো অবস্থানই শাসনব্যবস্থায় ছিলো না।
পেটের দায়ে মুসলমান হবার অভিনয় করলেও হিন্দুরা তাদের ধুতি নেংটি ধরে রেখেছিলো তাদের গোঁড়া হিন্দুয়ানী পারিবারিক পরিম-লে। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক নীরদ সি চৌধুরী বলেছে-
“বাঙালি (হিন্দু) পুরুষ ইংরেজ রাজত্বের আগে একমাত্র মুসলমান নবাবের কর্মচারী হইলে মুসলমানী পোষাক পরিত, উহা অন্দরে লইয়া যাওয়া হইত না। বাহিরে বৈঠকখানার পাশে একটা ঘর থাকিত, সেখানে চোগা-চাপকান-ইজার ছাড়িয়া পুরুষেরা ধুতি পরিয়া ভিতরের বাড়িতে প্রবেশ করিত। তাহার প্রবেশদ্বারে গঙ্গাজল ও তুলসীপাতা থাকিত, ম্লেচ্ছ পোষাক পরিবার অশুচিতা হইতে শুদ্ধ হইবার জন্য পুরুষেরা গায়ে গঙ্গাজল ছিটাইয়া মাথায় একটা দুইটা তুলসীপাতা দিত।” (তথ্যসূত্র: আত্মঘাতী বাঙালী- নীরদ সি চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৫০)
অর্থাৎ হিন্দুরা উপার্জনের স্বার্থে মুসলমানী পোষাক পরলেও তাদের মনে তারা ঠিকই চরম বিদ্বেষ পুষে রাখতো। এজন্য ব্রিটিশ আর হিন্দু, এই দুই অক্ষশক্তি মিলে একমত হয় যে, মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হবে। কারণ মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা যতোদিন টিকে থাকবে, ততোদিন হিন্দু আর ব্রিটিশদেরকে মুসলমানদের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হবে। মূর্খ ব্রিটিশরা শাসক হয়েও শিক্ষিত মুসলমানদের ভীড়ে কাঠের পুতুল হয়ে থাকবে, আর হিন্দুদেরকে তাদের ধুতির বদলে ‘ইজার’ তথা সেলাইবিহীন সুন্নতী লুঙ্গী ও চোগা-চাপকান পরেই কেরানিগিরি করতে হবে।
তাই মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের লক্ষ্যে এই দুই অক্ষশক্তি একযোগে এগিয়ে যায়। প্রথমে ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশরা চালু করে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আইন। মুসলমানদের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হতো লাখেরাজ বা নিষ্কর জমির আয় দিয়ে, যেসব জমি এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আইনের আওতায় কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়। যার ফলে মুসলিম শাসনামলের আরদালি শ্রেণীর হিন্দুগুলো রাতারাতি ‘জমিদার’ সেজে যায় আর মাদরাসাগুলো সব আয়ের অনুপস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায়।
যার ফলে মাদরাসা শিক্ষার ধারকবাহক যেসব ছূফী-দরবেশ ও মুজাদ্দিদ ছিলেন, উনারা ব্রিটিশবিরোধী জিহাদে লিপ্ত হলেন। এই জিহাদে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে বাঙালি মুসলমানগণ, কারণ বাঙালি মুসলমানদের নিকট থেকেই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এর নামে লাখেরাজ জমি কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। অনেকের ধারণা করে যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিলো মুসলিম রাজত্ব রক্ষার জন্য। কিন্তু না, আসল ইতিহাস হচ্ছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিলো মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা রক্ষার জন্য, মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি তাহযীব তামাদ্দুন রক্ষার জন্য। ব্রিটিশবিরোধী জিহাদ শুরু হয়েছিলো হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নেতৃত্বে। তিনি সহ ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের মূলধারার সকলেই ছিলেন ছূফী-দরবেশ শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা দিল্লীর পতন ও শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মুসলমানদের এই প্রচেষ্টার ইতি ঘটে। ব্রিটিশদের শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয় আর মুসলমানরা চিরকালের জন্য ভুলে যায় তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সোনালি অতীত। যেই মাদরাসা শিক্ষা ছিলো কাফির-মুশরিকদের উপর মুসলমানদের প্রাধান্য নিশ্চিতকরণের মূল নিয়ামক, অথর্ব মুসলমানরা ইতিহাস ভুলে সেই মাদরাসা শিক্ষাকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শুরু করে। নাউযুবিল্লাহ! আর যেই ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো মুসলমানদের একঘরে করা, তাকেই মুসলমানরা আজ উন্নতির পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। নাউযুবিল্লাহ!
এই যে আজ এদেশে হিন্দুরা প্রাধান্য বিস্তার করছে, উপজাতিরা প্রাধান্য বিস্তার করছে, এর মূল কারণই হলো এদেশে আজ মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা নেই। এখন ইংরেজরা যেভাবে মুসলমানদের প্রাধান্য খর্ব করতে মাদরাসা শিক্ষা রদ করেছিলো, ঠিক সেভাবেই মুসলমানদের প্রাধান্য ফের ফিরিয়ে আনতে মাদরাসা শিক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমস্ত মুসলমানকে একত্রিত হয়ে মাদরাসা শিক্ষাকেই মূলধারার শিক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং বর্তমানে প্রচলিত কুফরী সিলেবাসকে বয়কট করতে হবে। মুসলমানদের বুঝতে হবে যে, ইসলামবর্জিত কুফরী সিলেবাসই কাফির মুশরিকদের দম্ভের মূল স্তম্ভ। এটা রদ করতে পারলেই কাফির মুশরিকদের সমস্ত লম্ফঝম্ফ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।