দেশভাগ উত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

Image result for সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাদেশভাগ উত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
আব্বা মোটামুটিভাবে ঠিক করলেন দেশে আর থাকবেন না। এরই মধ্যে আব্বা কয়েকজনের সাথে দিল্লী গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে দেখা করলেন। নেহরু সমস্ত পরিস্থিতির ওপর আলোচনা করে শেষে বলল, ‘আল্লাহ কে উপার ভরোসা কিজিয়ে’।- (বদরুদ্দিন উমর, আমার জীবন, পৃ. ২১৮-২১৯)
১৯৪৯ সালের দিকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে নেহরু সরকারের আক্রমণের তীব্ৰতা বেশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে বিধান সভায় কথা বলা ও প্রতিবাদ করার মতো তাঁদের কেউ ছিলেন না। আব্বা এ সময় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় বিরোধী দলের নেতা। দেশ ভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি থাকলেও পরে আব্বা বিধান সভায় মুসলিম লীগ সদস্যদের পক্ষ থেকে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দেন। সে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর তাঁরা নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র পার্লামেন্টারী গ্রুপ হিসেবে পুনর্গঠিত করেন।
ডিসেম্বর মাসেই আমাদের টেস্ট পরীক্ষা হলো । কলেজের নিয়মিত ক্লাস আর না থাকলেও ফাইনাল পরীক্ষার জন্য পড়াশোনায় সময় দিতে হচ্ছিলো। এ সময় পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়াশোনা এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা কমাতে হলো।…এইভাবে পড়াশোনা করতে থাকার সময় আমাদের সামনে উপস্থিত হলো এক মহা বিপদ। সারা পশ্চিম বাঙলায় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির খুব অবনতি ঘটতে থাকলো। জানুয়ারীর প্রথম দিক থেকেই সংবাদপত্র, এমনকি রেডিওতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ওপর খবরাখবর প্রকাশিত হতে শুরু হলো এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক রিপোর্ট, বিবৃতি ইত্যাদি চারিদিকে এক আতঙ্কের সৃষ্টি করলো।

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৫ই জানুয়ারী কলকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে ১৯৪৬ সালে, কলকাতা, ও নোয়াখালী দাঙ্গার কথা উল্লেখ করে, মুসলমানদেরকে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করল। দেশ বিভাগের পরপরই যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, তার জন্যও সে দায়ী করল মুসলমানদেরকে। সে তার বক্তৃতায় এ পর্যন্ত বলল যে, পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার সীমানা ‘কৃত্রিম‘ এবং পূর্ব বাঙলার হিন্দু ভাইদেরকে সাহায্য করার জন্য এই সীমানা অতিক্রম করা যেতে পারে। রেডিওতে সর্দার প্যাটেলের বক্তৃতা প্রচার করা হচ্ছিল এবং আমরা তা শুনছিলাম।


আমার স্পষ্ট মনে আছে, মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে সে বলল, যারা ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের সময় পাকিস্তান চেয়েছিল, তারা কিভাবে রাতারাতি ভারত রাষ্ট্রের অনুগত নাগরিক হতে পারে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে তারা ভারতের প্রতি অনুগত?
এর কাছাকাছি সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখাজী বর্ধমান এসেছিল। বক্তৃতা করেছিল টাউন হল ময়দানে। খুব শক্তিশালী বক্তা ছিল সে। তার সেই দক্ষতা নিয়ে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করভাবে বিষোদগার করল।

সর্দার প্যাটেলের ১৫ই জানুয়ারীর কলকাতা বক্তৃতার পরই সংবাদপত্রগুলিতে, বিশেষ করে আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তরে, চরম উত্তেজনাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক প্রচারণা শুরু হলো। এর ফলে ১৯শে জানুয়ারী পশ্চিম বাঙলায় দাঙ্গা পরিস্থিতির খুব অবনতি ঘটলো, তার ওপর হিন্দু মহাসভা ২১ থেকে ২৪ জানুয়ারী চারিদিকে সাম্প্রদায়িক সভাসমাবেশ শুরু করে দাঙ্গা বাধিয়ে দিল। বনগাঁ, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, উল্টোডাঙা এবং কলকাতার মানিকতলা ও বেলেঘাটায় দাঙ্গা শুরু হলো। এর পরপরই ব্যাপক ও ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হলো বাটানগরে। দাঙ্গা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো।

দাঙ্গাবাজ সর্দার প্যাটেল কলকাতায় তার ১৫ই জানুয়ারীর চরম উত্তেজনাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক বক্তৃতার মাধ্যমে পশ্চিম বাঙলায় যে দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়, সে দাঙ্গা জানুয়ারী মাসে শুরু হয়ে মার্চের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলতে থাকে। এই দাঙ্গার সময়েই, হিন্দু মহাসভা এবং সর্দার প্যাটেল ছাড়াও, বিদ্বেষ এবং উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা-বিবৃতি যারা দেয় তাদের মধ্যে ছিল পশ্চিম বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও প্রাদেশিক কংগ্রেসের অনেক নেতা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এসব বক্তৃতা-বিবৃতি আমরা প্রত্যেক দিনের সংবাদপত্রে পড়ছিলাম।


ট্রেনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতেও ঘটতে থাকে। তৎকালীন আসামের লুমডিং থেকে মুসলমান উদ্বাস্তু বোঝাই একটি ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদেরকে হত্যা ও তাদের মালপত্র লুট করা হয়। কলকাতা থেকে যেসব ট্রেন বাইরে যাচ্ছিলো, সেগুলো থামিয়ে কলকাতার নিকটবর্তী ষ্টেশনগুলোতে অথবা অন্যত্র হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এরকম একটি ট্রেনে এই সময় মটর ভাই (সৈয়দ শাহেদুল্লাহ) যাত্রী ছিলেন। তিনি চোখের সামনেই এই হত্যাকাণ্ড দেখেছিলেন। তাঁর পরনে ধুতি থাকায় তিনি সরে দাঁড়িয়ে কোন মতে রক্ষা পেয়েছিলেন। এই সময় কাটোয়ায় মুসা সাহেব নামে মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতা ও আমাদের পরিচিত এক ব্যক্তিকে তাঁর দোকানে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর চামড়ার ব্যবসা ছিল।
কলকাতা থেকে নিয়ে পশ্চিম বাঙলা ও আমাদের বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানরা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হাতে হাজারে হাজারে নিহত হলেন। বর্ধমানে বড়ো আকারে কোন খুনখারাবী না হলেও দু’তিনজন খুন হলেন এবং অনেক বাড়ীতে আগুন দেওয়া হলো। চারিদিকে সৃষ্টি হলো ভয়ানক আতঙ্ক। সেটা ছিল ফেব্রুয়ারী মাস। বর্ধমানে যেসব বাড়ীতে আগুন লাগানো হয়েছিল তার মধ্যে ছিল ডাক্তার আবদুল ওয়াহেদের বাসা । তিনি থাকতেন বর্ধমান রাজবাড়ীর উত্তর ফটকের উল্টোদিকে ভবানী ঠাকুর লেনে। বিকেলের দিকেই তাঁর বাড়ীতে আগুন দেওয়া হয়।

সে সময় রশু চাচা (আবদুর রশীদ সাহেব) জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলে সঙ্গে পুলিশ নিয়ে গিয়ে তাঁদেরকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে আসেন। পার্কাস রোডের কাছাকাছি ছিল তাঁদের বাড়ী ‘আফিয়াত মনজিল’। এ সময় আমরা কি করবো কিছুই ঠিক করা যাচ্ছিলো না। এমন সময় আমাদের বাড়ীতে এলেন আহাদ চাচা। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ী ছাড়তে হবে। রিক্সা ডেকে আনা হলো এবং তিনি আমাদেরকে সঙ্গে করে পৌছে দিলেন ‘আফিয়াত মনজিলে’। সেটা ছিল আব্বার বড় ফুপুর বাড়ী।

আমরা যেদিন বাড়ী ছেড়ে ‘আফিয়াত মনজিলে’ চলে আসি সেই রাতেই আমাদের বাড়ীতে আগুন দেওয়া হয়। বাড়ীতে সে সময় ছিল হানিফ মিঞা। ১৯৪৯ সালে হানিফ মিঞা আমাদের বাড়ীতে কাজের জন্য আসে। তার বাড়ী ছিল বিহারের গয়া জেলায়।…… হানিফ মিঞার কাছে শোনা গেল যে, কিছু লোক রাত এগারোটার দিকে এসে পেট্রোল ঢেলে বাড়ীতে আগুন দিয়েছিল। দেখা গেল যে, সেই আগুনে পুরো বাড়ী না পুড়লেও বসার কামরা পুরোপুরি ছাই হয়েছিল। সোফা, চেয়ার, টেবিল, কারপেট তো বটেই, এমনকি বসার কামরার মেঝে পুড়ে ইট বেরিয়ে এসেছিল। চারিদিকের প্লাস্টার ও সিলিং এর সিমেন্ট পর্যন্ত খসে পড়ে ঐ একই অবস্থা হয়েছিল। বসার কামরা থেকে আগুনের হাল্কা বের হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিকের বারান্দা অনেকখানি পুড়ে কালো হয়েছিল।

যাই হোক, বাড়ী আমাদের এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো যে, ঐ অবস্থায় সেখানে আবার ফিরে যাওয়া সম্ভব হলো না। তাছাড়া তখনকার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিও এদিক থেকে একটা বাধা ছিল। আমাদের বাড়ীতে কেউ এভাবে আগুন দিতে পারে এটা কোনদিন আমাদের কারও ধারণার মধ্যে ছিল না। বর্ধমানে এর আগে কোনদিন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির এত অবনতি হয়নি, দাঙ্গা হওয়া তো দূরের কথা।…বড় রকম কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হলেও দু’তিনজন লোক খুন হওয়া এবং কিছু বাড়ীতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ছাড়া কোন বড় ধরনের গণ্ডগোল না হলেও এক রকম অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং অপমান বোধের জন্য সমগ্র পরিস্থিতি আমাদের কাছে অসহনীয় হলো।

…সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির একটা খুব বিশ্ৰী দিক হলো কোন খুনোখুনি মারামারি ইত্যাদি না হলেও সাধারণভাবে যাদের মধ্যে সদ্ভাব থাকে, এমনকি বন্ধুত্ব থাকে তাদের অনেকেরও পারস্পরিক সম্পর্কের অঘোষিত অবনতি। এক্ষেত্রে মুখে কিছুই বলাবলি হয় না, কিন্তু সম্পর্ক অবনতির ব্যাপার ভালভাবেই বোঝা যায়। আমাদের কাছে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির এ দিকটিই ছিল খুব পীড়াদায়ক, অসহনীয় এবং অপমানজনক। আমার নিজের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এ রকম কিছু না হলেও, আব্বার বন্ধুদের কয়েকজনের মধ্যে, এমনকি বেশ ঘনিষ্ঠ দুই একজনের মনোভাবের এবং আচরণের মধ্যে যে পরিবর্তন দেখেছিলাম সেটা ভোলার নয়।

এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা সকলকে বেশ অস্থির রাখতো। এ সময়েই আব্বা মোটামুটিভাবে ঠিক করলেন দেশে আর থাকবেন না। অন্যদের সাথেও এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকলো। আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই দেশত্যাগের চিন্তা শুরু করলেন। এভাবে দু-তিন সপ্তাহ চিন্তাভাবনা এবং আলাপ-আলোচনার পর আব্বা স্থির করলেন ঢাকায় চলে যাবেন। তখন এমনই অবস্থা যে নিজের বাড়ীঘর, পরিবেশ, আত্মীয়দের একাংশ, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে কি করবেন, কিভাবে থাকবেন- সেটা নিয়ে কোন সুস্থ চিন্তাভাবনার ক্ষমতা তার থাকলো না।

আমার তখন আঠারো বছর বয়স, নিতান্ত নাবালক নয়। কিন্তু অন্য রকম কিছু ভাবার ক্ষমতা আমারও থাকলো না। অস্থির অবস্থায় আমারও মনে হলো এছাড়া অন্য কোন পথ নেই। আসলে নিরাপত্তার অভাব ও সেই সাথে অপমানবোধ স্বাভাবিক চিন্তা শক্তিকে খুব দুর্বল করলো। এমন অবস্থায় আমরা তো নিজেদেরকে কল্পনাও করতে পারতাম না।

এর আগেই শরৎ বাবুর মৃত্যু হয়েছিল। কাজেই আব্বার দিক থেকে কারও সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করার মত কেউ ছিলেন না। শরৎ বাবু থাকলে তিনি অবশ্যই তাকে বাধা দিতেন এবং তিনিও এ ধরনের সিদ্ধান্তের মধ্যে যেতেন না। এরই মধ্যে আব্বা একবার অন্য কয়েকজনের সাথে দিল্লী গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে দেখা করলেন। গান্ধীজীর সাথে তাঁর বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল, কিন্তু তিনি তো তখন বেঁচে নেই। নেহরু সমস্ত পরিস্থিতির ওপর আলোচনা করে শেষে বললেন,

‘আল্লাহ কে উপার ভরোসা কিজিয়ে’। ভরসার ব্যাপারটা এভাবে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়া মনে হয় আব্বার কাছে সুবিধাজনক মনে হলো না। আল্লাহর ওপর ভরসা জিনিসটা এমন নৈর্ব্যক্তিক ব্যাপার যে বাস্তব পরিস্থিতিতে করণীয় কি তার কোন পথ তার মধ্যে পাওয়া যায় না। তাঁর কথা হলো, আল্লাহর ওপর ভরসা করার কথা শোনার জন্য তো নেহরুর কাছে যাওয়া হয়নি। দিল্লী থেকে ফিরে এসেই তিনি চূড়ান্তভাবে স্থির করলেন দেশে আর থাকবেন না।
দেশ ছাড়ার আগেই সব কিছু বিক্ৰী করার জন্য আব্বা প্রায় পানির দামে জমিজমা, পুকুর বাগান বিক্ৰী করলেন। কিছুদিন পর গ্রামের বাড়ী পর্যন্ত তিনি বিক্ৰী করলেন এভাবেই। এ কাজ পরেও করা যেতো, কিন্তু তিনি সে চিন্তা করলেন না। বর্ধমানের বাড়ী বিক্রীর চেষ্টাও করলেন, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সেটা হলো না। এক সময় বাড়ীটা কেনার জন্য একজন ৮০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন বাড়ী বিক্রীর কোন প্রশ্নই ছিল না। পরে ঐ বাড়ী ২৫ হাজার টাকায় বিক্ৰী হয়েছিল। “অলক্ষুণে” বাড়ী হিসেবে তার তেমন খদের ছিল না। বৰ্মা প্রবাসী এক ভদ্রলোক তখন সেটা কিনেছিলেন।

শহরের অনেক পরিচিত মধ্যবিত্ত মুসলমানরাও ঐ সময় দেশত্যাগ করলেন। বর্ধমান জজ কোর্টের প্রতিষ্ঠিত উকিলের মধ্যে সৈয়দ আবদুল গনি সাহেব ও মহম্মদ আজম সাহেব তার মধ্যে ছিলেন। আজম সাহেবদের বর্ধমান ত্যাগ দেখে অনেকে অবাক হয়েছিল। কারণ তাঁর পিতা মহম্মদ ইয়াসিন সাহেব ছিলেন বর্ধমানের বিখ্যাত কংগ্রেসী নেতা এবং আজম সাহেবও কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন।
আব্বা ঐভাবে বর্ধমান ছাড়ার সিদ্ধান্ত না নিলে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বড়ো আকারে দেশত্যাগ হতো না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আমরা যাওয়ার আগেই চলে গেলেন, কেউ গেলেন কয়েক সপ্তাহ বা দুই এক মাস পরে। কেউ বা গেলেন আরও অনেক পরে।

যেহেতু আমার ঢাকায় পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, সেজন্য সিদ্ধান্ত হলো আমি সকলের আগে চলে যাবো। যাওয়ার আগে আমাদের মালপত্র, বিশেষত আসবাবপত্র কলকাতা থেকে জাহাজে পাঠাবার ব্যবস্থা হলো। গ্রামের বাড়ীর আসবাবপত্র বর্ধমানে আনা হলো। তার পর আব্বা আমাকে বললেন তাঁর বন্ধু টোগো সরকারের বাড়ী গিয়ে তার কাছে রাখা ফার্নিচারগুলি নিয়ে আসতে। তিনি পরে দেখা করবেন। মনে হয় এ সময় কোন কাজে আব্বা কলকাতা যাচ্ছিলেন। যেহেতু আমরা চলে যাচ্ছি সে জন্য মাস দুই আগে হঠাৎ প্রয়োজন পড়ায় টোগো সরকারের কাছে আব্বা যে পাঁচশো টাকা ধার নিয়েছিলেন সেটাও দিলেন তাকে দেওয়ার জন্য।

আমি টোগো সরকারের বাড়ীতে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলাম। তিনি তখন তাঁর ওকালতি ব্যবসায়ের চেম্বারে বসেছিলেন। মনে হয় মনে খুব দাগ কেটেছিল বলেই তখনকার ঘটনাটা এখনো আমার এতো স্পষ্টভাবে স্মরণ হয়। ধার নেওয়া পাঁচশো টাকা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে আমি বললাম, তাঁর কাছে রাখা ফার্নিচারগুলি নিতে এসেছি। আমরা কয়েকদিন পরেই চলে যাবো। আমাকে অবাক করে দিয়ে টোগো সরকার বললেন, ফার্নিচার তো দেওয়ার কথা নয়। তোমার বাবা পাঁচ শো টাকা ধার নেননি, পাঁচশো টাকায় ফার্নিচারগুলি আমাকে বিক্রী করেছিলেন। এ কথা বলে তিনি কি একটা পড়ার জন্য বই বা কাগজের ওপর চোখ রাখলেন।

তাঁকে আমি ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি এবং অনেক অবস্থায় দেখেছি। কিন্তু তাঁর এই চেহারা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আমার তখন হতভম্ব অবস্থা। আমি বললাম এতো ফার্নিচার পাঁচশো টাকায় কিভাবে বিক্ৰী হয়! আমাদের বাড়ীতে আগুন দেওয়ার পর বাড়ী বন্ধ করে রেখে আসার সময় এগুলো আপনার বাড়ীতে নিরাপদ থাকবে মনে করেই দিয়ে গেলাম। তাছাড়া বিক্রী করলে আব্বা আপনার কাছে আমাকে পাঠাবেনই না কেন। কিন্তু তিনই একটাই কথা বললেন। পাঁচশো টাকা নেয়ার প্রশ্ন ওঠে না রবং ফার্নিচার ফেরৎ দেয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। এই বলে তিনি আবার চোখ নামিয়ে পড়তে লাগলেন। অগত্যা পাঁচশো টাকা ফেরৎ নিয়ে এবং ফার্নিচার না নিয়েই আমি ফিরে এলাম। আগুন ও ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেলেও, টোগো সরকারের হাত থেকে সেগুলি রক্ষা করা গেল না।

[সোর্সঃ বদরুদ্দীন উমর, আমার জীবন (প্রথম খন্ড), সাহিত্যিকা, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ২০৫-২২৩ থেকে সংক্ষেপিত] বইটির পিডিএফ সংগ্রহ করুন