পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতায় মীরজাফদের চেনা যায় তবুও কিন্তু মালউন নন্দনকুমারদের চেনার সুযোগ নাই তেমন

Image result for ১৭৫৭পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতায় মীরজাফদের চেনা যায় তবুও কিন্তু মালউন নন্দনকুমারদের চেনার সুযোগ নাই তেমন
মীরজাফর ক্ষমতায় আরোহণ করে টের পেলেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলার নবাব নন, শিখণ্ডি বা পুতুল মাত্র। তিনি যেন বৃটিশদের অর্থোপার্জন এবং শোষণের যন্ত্র। সিরাজের প্রধান সেনাপতি থাকা অবস্থায় তিনি যে মর্যাদা এবং প্রতিপত্তির প্রতীক ছিলেন নবাবীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও তাকে কোম্পানীর সাধারণ কর্মচারীদের তোষামোদ করে চলতে হয়। তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য উৎকোচ উপঢৌকন হিসেবে তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে হয়। কিন্তু তবু কোম্পানীর ক্ষুধা মেটানো সম্ভব হয়নি। রাজকোষের সমস্ত ভাণ্ডার উজার করে দিয়েও তিনি তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। অথচ ষড়যন্ত্রের শুরুতে তিনি ভেবেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী জমিদার চক্র এবং ইংরেজ বণিকদের সহযোগিতা নিয়ে তিনিই হবেন উপমহাদেশের সবেচেয়ে শক্তিশালী নবাব!
নবাবীর নেশায় তিনি এত উন্মত্ত মাতাল ছিলেন যে, ষড়যন্ত্রের গভীরে আর এক ষড়যন্ত্রকে আমলে আনতে পারেননি। বাংলার নবাব হয়ে তাকে দেখতে হল সবকিছু নীরবে, নিরুপায় হয়ে। দুর্বিষহ মনে হলেও কোম্পানীর সব অপকর্মকে সমর্থন দিতে হল হাসি মুখে। মীর জাফরের চোখের সামনে সিরাজের শোণিত-সিক্ত বাংলার মসনদ পরিণত হল তেজারতের পণ্যে। ক্লাইভের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও তার অবশিষ্ট রইল না।
মীরজাফর নিজেকে শেষ অবধি অবশ্য চিনতে পেরেছিলেন। পারলেও তার ফেরার পথ খোলা ছিল না। অবজ্ঞা, অপমান আর ঘাত প্রতিঘাত নির্দেশ খবরদারীর দুর্বিপাকে পড়ে স্বপ্ন আর সম্মোহনের ঘোর কাটতে খুব বেশী দেরী হয়নি তার। বুঝতে পেরেছিলেন নবাবীর মোড়কে বন্দীা, বেনিয়া চক্রের পুতুল ছাড়া তিনি আর কিছু নন। ক্লাইভের অর্থের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যর্থ হয়ে মীর জাফর অসহিষ্ণু এবং মরিয়া হয়ে উঠলেন ইংরেজদের লালসার দোহন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইলেন। একারণে তিনি ওলন্দাজদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের দেশছাড়া করার এক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আর এ কারণেই নবাবের নাটমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হল মীর জাফরকে। তাকে পদচ্যুত করে কলকাতায় নজরবন্দী করে রাখা হল। অবশেষে তিনি কুষ্ঠরোগে ৭৪ বৎসর বয়সে পরলোকগত হন। তার মৃত্যুর পূর্বে নন্দনকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত এনে মুখে প্রদান করেছিলেন। এটিই মীরজাফরের শেষ জলপান। এই নন্দনকুমার কে? কেবলই কি একজন জলদানকারী, নাকি আরো বড় কোন হোতা?
ঐতিহাসিক তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব বড় বড় জায়গাতেই হিন্দু জমিদার ছিল প্রতিষ্ঠিত। প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়। বর্ধমানের রাজার পরই ধনে মানে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। বাংলার মহাজনদের মাথা জগৎশেঠদের বাড়ীর কর্তা মহাতাব চাঁদ। জগৎশেঠরা জৈন সম্প্রদায়ের লোক হলেও অনেকদিন ধরে বাংলায় পুরুষানুক্রমে থাকায় তাঁরা হিন্দু সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কর্মচারীদের পাণ্ডা হলেন রায় দুর্লভ রাম।… হুগলীতে রইলো নন্দকুমার।”
ইতিহাস পরিচয় করিয়ে দেয় নন্দনকুমারকে। ব্রাহ্মণ নন্দনকুমার ছিলেন নবাব সিরাজদ্দৌলা নিযুক্ত হুগলীর ফৌজদার। তকে বলা হয়, পলাশীর যুদ্ধের প্রথম কু-মন্ত্রণাদানকারী। স্রেফ নিজস্ব লাভালাভের কথা চিন্তা করে ষড়যন্ত্রের সূচনায় এগিয়ে আসে। নন্দনকুমার অনেক বিবেচনার পর সিরাজের ভবিষ্যৎ বাস্তবিকই অন্ধকার দেখে ইংরেজদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন। রবার্ট ক্লাইভ অর্থ উৎকোচ দিয়ে তাকে বশীভূত করেছিলেন। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, ইংরেজরা সেই সময়ে আমীরচাঁদকে দিয়ে নন্দনকুমারকে ১৩ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করেছিলেন।
ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণের প্রাক্কালে নবাব সিরাজ তাদের প্রতিরোধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু বিপুল পরিমাণ ঘুষের বিনিময়ে প্রতিরোধ বাহিনীর নেতা নন্দনকুমার বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলান। বস্তুত নন্দনকুমার চন্দননগরের প্রবেশপথ থেকে যদি নবাবের সৈন্য সরিয়ে না নিতেন তাহলে ইংরেজরা ফরাসিদের যুদ্ধে হারাতে পারতো না। ইতিহাস লেখা হতো অন্যভাবে। নন্দনকুমারের তত্ত্বে ও মারপ্যাঁেচ জীবন্ত হতে শুরু কলো পলাশীযুদ্ধের নীল নকশা।
পলাশীর ষড়যন্ত্র সফল হওয়ার পর মীরজাফর নন্দনকুমারকে স্বীয় দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। মীরজাফর দ্বিতীয়বার নবাব হলে নন্দনকুমার হন প্রধানমন্ত্রী। এ বিশ্বাসঘাতক পরবর্তীতে উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছিল। দলিল জালকরণ, তহবিল তছরুপ ও অন্যান্য অভিযোগে ইংরেজ আদালতের বিচারে নন্দনকুমার ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে জীবনলীলা সাঙ্গ করে।
আপাতদৃষ্টিতে নন্দনকুমারের দৈহিক প্রস্থান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার উপস্থিতি আজো প্রানবন্ত সমাজে, জাতিতে, রাষ্ট্রে। মীরজাফরের চেয়েও বেশি। মীরজাফদের চেনা যায় তবুও। নন্দনকুমারদের চেনার সুযোগ নাই তেমন। পেছন থেকে ছুরি মেরেই যাচ্ছে সবখানে। একের পর এক রেখে যাচ্ছে স্বার্থান্ধের নজির।
এর ফলে এখনো- নব্য বেনিয়ারা অপতৎপরতা চালাচ্ছে নতুন লেবাসে। কখনো বহুজাতিক কোম্পানীর নামে। কখনোবা সাহায্য সংস্থা, এনজিও ইত্যাদি ছদ্মনামে অশুভ থাবা বিস্তারের জন্য তৎপর।