জনসংখ্যা বাংলাদেশের
সমস্যা নয়, উন্নয়নের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ এখন
আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় একটি দেশ সে ব্যাপারে ওয়াল স্ট্রিট
জার্নাল-এর সাংবাদিক সদানন্দ ধুম গত দুই বছরে একাধিকবার লিখেছে।বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশকে উন্নয়নের
পরীক্ষাগার বলা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের মত পরিস্থিতিতে
যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হলে পৃথিবীর যেকোনো দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করা হয়।
উত্তরণ ও উন্নয়নের মাধ্যম হতে পারে আমাদের বিশাল জনশক্তি ও মানব সম্পদ :
বাংলাদেশ নিয়ে
সবার আশাবাদের আরেকটি বড় কারণ এর জনসংখ্যা। বর্তমানে বিশ্বে মূল্যবান সম্পদ হলো মানবসম্পদ। বিশাল সম্ভাবনাময় এই সম্পদটি জনবহুল বাংলাদেশের
একেবারে হাতের মুঠোয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকাকে
সচল রাখতে মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন সচেতন এবং সুযোগ
পেলে সংগতির মধ্যে নতুন যেকোনো উন্নয়ন ধারণা পেলেই তারা গ্রহণ করে।
২৫ কোটি মানুষের
৫০ কোটি হাতকে দক্ষ কর্মীর হাত হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সহজেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর
হয়ে উঠবে। ঢালাওভাবে দেশের জনসংখ্যাকে
সমস্যা বলা যাবে না। দেশে জনসংখ্যা বেশি বলে আমাদের
উন্নয়নের সম্ভাবনাও অনেক বেশি। দেশের এই জনসংখ্যাকে
কাজে লাগাতে হলে জনসংখ্যাকে জনশক্তিকে পরিণত করতে হবে। জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে পরিকল্পিতভাবে
অগ্রসর হলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
জনসংখ্যার ক্ষেত্রে
বাংলাদেশের বড় সুবিধা হলো, জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এখানে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তার তুলনায় আগামী দুই
থেকে তিন দশকে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা এমন ভাবে বাড়বে যেখানে তরুণদের সংখ্যা থাকবে
বয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি। এটি একটি ভাল
সুযোগ। চীন ও ভারত এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জনশক্তিকে আরও
দক্ষ করতে হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, জনসংখ্যার এ লভ্যাংশ কাজে
লাগাতে হলে বাংলাদেশকে প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষকে কাজ দিতে হবে।
সরকারি এক হিসাবে
দেশে প্রতি বছর ৩০ লাখের বেশি শিশু জন্মাচ্ছে। দেশে প্রতি ১১ সেকেন্ডে জন্মায় একটি শিশু। প্রতি মিনিটে জন্মাচ্ছে গড়ে ৮টি শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি মিনিটে বিশ্বে জন্মায়
২৫০ শিশু, যার মধ্যে বাংলাদেশে জন্মাচ্ছে ৯ জন।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার
রয়েছে চারটি স্তর- বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত। নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনদের কাজের ক্ষেত্র
রকমারি। উচ্চবিত্তদের জন্য রয়েছে অবারিত সুযোগ
থাকলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী আছে উভয়সঙ্কটে। অথচ সমাজে নতুন মূল্যবোধ জাগরিত হয় মধ্যবিত্ত-শ্রেণী থেকেই। সমাজের মূল্যবোধের ধারাকে ধারণ, লালন ও প্রজন্মান্তরে
প্রবাহিত করে মধ্যবিত্তশ্রেণী। তাই মধ্যবিত্তের
সীমাবদ্ধতার শেকল ভাঙতে হবে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ
করতে হবে।
পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান
বেকার জনগোষ্ঠিকে করতে পারে অগ্রগতির চালিকাশক্তি :
যেকোন দেশে একজন
নাগরিকের কর্মহীন বেকার জীবন মানে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বা সৃজনশীলতা বিকাশে প্রতিকূলতা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় বেকারত্ব
অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা। এটি দেশের জাতীয়
উন্নয়নের অন্যতম প্রতিবন্ধক। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতেও
বেকারত্ব বা কর্মসংস্থানের সমস্যাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কিভাবে কোন পদ্ধতিতে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান
সৃষ্টি করা যায় সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন
জাতীয় ঐক্যমত ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকায় বাংলাদেশে বেকার সমস্যা
প্রকট রূপ নিয়েছে।
প্রতিবছর কলেজ
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে সে তুলনায়
তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছরই
আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মিলিয়ে দেশে তিন কোটির অধিক বেকার রয়েছে। এ বিপুল সংখ্যক বেকারত্ব নিয়ে দেশের কাঙ্খিত
উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বিপুল সংখ্যক
এই শিক্ষিত বেকার তরুণ যুব সমাজই পারে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তরুণ যুব
বেকারদের বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে তাদের কাজে লাগাতে হবে। বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারকে অবশ্যই গ্রহণ
করতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা।
কর্মমূখী শিক্ষার
যথেষ্ট সুযোগ না থাকাও বেকার সমস্যার একটি কারণ। কারিগরি জ্ঞানের যথেষ্ট অভাবের কারণে বিদেশে
দক্ষ শ্রমিক যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই কারিগরি
ও বৃত্তিমুলক শিক্ষা ব্যবস্থাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশে ব্যাপকহারে কল-কারখানা স্থাপন ও বিনিয়োগের
সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
কর্মসংস্থান
সৃষ্টির বিষয়ে দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের সাথে আলোচনা করে সরকারকে শিল্পবান্ধব উদ্যোগ
গ্রহণ করতে হবে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যুব
উন্নয়ন অধিদফতর, কর্মসংস্থান ব্যাংক, অন্য
ব্যাংকগুলো এবং জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সমন্বয়ে উপযোগী প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে
সুদবিহীন ঋণ সহায়তা দিয়ে, সমবায়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে সামাজিক
পুঁজিভিত্তিক ছোট-বড় প্রকল্প গড়ে তুলে মধ্যম সারির শিক্ষিতদের
আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আধুনিক প্রযুক্তির
প্রয়োগে সুজলা সুফলা বাংলাদেশ পৌছতে পারে অভিষ্ট লক্ষ্যে :
প্রকৃতিগত ভাবে
আমরা এতটা সৌভাগ্যবান যে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অঞ্চলের সব মাটিই উর্বর ও আবাদযোগ্য। সুজলা সুফলা এ দেশের যেকোন অঞ্চলের মাটিতেই
কোনরকমে অযত্ন অবহেলার মাঝেও গাছ জন্মে। পৃথিবীতে এমন উর্বরফলা দেশ বেশ বিরল। তাই আমাদের কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার করতে পারলে উৎপাদনে
অভিষ্ট ল্যক্ষ অর্জন করা আমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী। অনেকটা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই
কৃষি, খাদ্য বাংলাদেশের
সাফল্য উল্লেখযোগ্য।
উন্নত প্রযুক্তি
ব্যবহার করে কৃষি ক্ষেত্রে উতপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের আয় খুবই কম
হওয়ায় ভোগ-ব্যয় মিটিয়ে সঞ্চয় করা কঠিন। ফলে ভূমিহীন কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সাথে সাথে দেশের অনেক কৃষিজীবী কৃষিকাজ
ছেড়ে ভূমিবহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেছে নিচ্ছে। যাদের কৃষিজমি আছে তারাও অতিরিক্ত আয়ের
জন্য ভূমিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বেছে নিচ্ছে।
কৃষি খাতে সরকারি
সহযোগিতা ও ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে এসকল লোকদের কৃষিক্ষেত্রে ধরে রাখতে হবে। সরকারি খরচায় উন্নত কৃষি প্রশিন দিয়ে দেশের
বেকার যুবশ্রেনী থেকে যুব-কৃষক তৈরী করতে হবে যারা দেশের কৃষিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে
যাবে।
সরকার, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারি আর দক্ষ জনশক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারে শিল্পবিপ্লব
বাংলাদেশের বিশাল
জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিনত করে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে হলে দেশের বৃহত বেকার
জনগোষ্ঠিকে কাজে লাগানোর মত পর্যাপ্ত শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। বড় মাপের বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ছোট
ছোট বিনিয়োগকারীদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে ছোট ছোট কারখানা গড়ে তুলতে
হবে এবং উতপাদিত পণ্যের গুনগত মান ঠিক রাখার ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
দেশে শিল্পোন্নয়নের
পরিবেশ ও ত্রে তৈরী করতে হবে। ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তি মালিকানায়
ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে বাজার অর্থনীতির দ্রুত
প্রসার ঘটবে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ
কিছু শিল্প এলাকা তৈরি করে দেশের বাজার বিদেশি বিনিয়োগকারিদের জন্য উম্মুক্ত করে দিতে
হবে। এতে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা দেশকে কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র
থেকে একটি শিল্পনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করবে। চীন এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রে দ্রুত শিল্পোন্নয়ন
ঘটিয়েছে।
সত্তরের দশকে
চীন এ পদ্ধতির অমিত সম্ভাবনা অনুধাবন করে| আশির দশক থেকে চীনে ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে বাজার অর্থনীতির দ্রুত প্রসার ঘটে। বর্তমানে বিকাশমান অর্থনীতির বিশালতায়
চীনকে প্রায়ই দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন
বিশ্বের ৩০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। দ্রুত শিল্পোন্নয়নের জন্য এদেশে পুঁজি
বিনিয়োগে বিদেশি বিনিয়োগকারিদের আকৃষ্ট করতে হবে।
মালয়েশিয়ার দিকে
তাকালে দেখা যায়, মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে অনগ্রসরতার পাতাল থেকে সগর্বে আরোহণ
করেছে অগ্রগতির শীর্ষ চূড়ায়। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ
শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত মালয়েশিয়া ছিল দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। মাহাথির মোহাম্মদ মন্ত্রীদের কাছে ব্যবসায়ী
সমাজের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করলেন। ১৯৭৮ সালে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে
দেশের প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারে মনোযোগী হন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল- ১. কেউ যেন আইনশৃঙ্খলার অস্বাভাবিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত না হয় ২. বিনিয়োগকারীরা যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়েন ৩. কর্মীদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও দুর্নীতির কালো থাবা যেন উতপাদন ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি
না করে।
মাহাথিরের এ
বলিষ্ঠ পদক্ষেপ মালয়েশিয়াকে বাণিজ্যবান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত করে। ফলে দেখা গেছে, শুধু টিন ও রাবার রফতানিকারক
দেশ মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে ইলেকট্রনিক, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি এমনকি মোটরগাড়ি রফতানিকারক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাই দেশের ইতিবাচক শিল্পোদ্যোক্তাদের নিয়ে
দ্রুত শিল্পোন্নয়নের একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
কোন কোম্পানি
কারও নিজের সম্পদ নয়। কোম্পানি দেশ ও জনগণের সম্পদ। একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে শুধু মালিক বা উদ্যোক্তারা
লাভবান হয় না। লাভবান হয় দেশের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখার উদ্দেশ্য
নিয়েই কোম্পানি পরিচালিত হয়। আমাদের দেশেও
শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। অনেক দেশীয় কোম্পানি ক্রমেই
গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত হচ্ছে। এ অর্থনৈতিক
অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক।
আমাদের দেশে
যে কাঙ্খিত শিল্পের বিকাশ সম্ভব তার উতকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের গার্মেন্টস শিল্প। সত্তরের দশকের দিকে এ দেশের উদ্যোক্তারা
গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ ঘটাতে শুরু করে। এ শিল্পের বিকাশের ফলে বর্তমানে ৪০ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত দুই কোটি লোকের কর্মসংস্থানের
সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং বর্তমানে এ শিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
আমরা জানি, দারিদ্র্য দূর করার উপায়
হলো ভালো জিনিস সস্তায় উতপাদন করে বিক্রি করা যেটা চীনারা করে দেখাতে পেরেছে। আমাদের কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা দুই নম্বর
বা নকল জিনিস তৈরির এলাকা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। প্রশ্ন হলো- যারা নিজেদের চেষ্টায়
নকল পণ্য তৈরি করতে পারছে, তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বেসরকারি
উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কেন উন্নতমানের দেশি পণ্য তৈরির কাজে লাগানো যাচ্ছে না?
কেন আমরা জিঞ্জিরাকে
শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে পারছিনা? ধোলাইখালের
অশিক্ষিত শ্রমিকরা যদি মেশিনারিজ পার্টস তৈরি করতে পারে, তাহলে
তাদের কেন প্রশিক্ষিত করে ধোলাইখালকে শিল্প এলাকায় পরিণত করা যাচ্ছে না? সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা কি এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন না?
দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী
প্রাচীন শিল্প পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এসব শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া
হচ্ছে না। ফলে কাজ জানা মানুষগুলোও বেকার
হচ্ছে। ছোট ছোট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখলে মানুষ কাজ
করে খেতে পারবে। সরকার নিজে না পারলে বেসরকারি
উদ্যোক্তাদের তো উতসাহিত করতে পারে। ঢাকার বাইরে
বিশেষত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিল্প স্থাপনায় বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে ব্যবসায়ীরা ঢাকার
বাইরে শিল্প গড়ে তুলবে। ঢাকার বাইরে শিল্প গড়ে উঠলে
মানুষের শহরমুখী চাপ কমবে।
সরকারের সুপরিকল্পনায়
বৃহত্তর পর্যায়ে কাজে লাগতে পারে প্রবাসিদের রেমিট্যান্স :
কৃষির বাইরে
অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো ক্ষুদ্র উদ্যোগ, শ্রমশক্তি রপ্তানি ও তৈরি পোশাক খাত। প্রবৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে যেতে হলে এসকল
ক্ষেত্রেও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে হবে। এর জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ অবস্থায় অর্থায়নের
সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে চারটি উপায়ে। বৈদেশিক রেমিট্যান্সের
অর্থ দিয়ে, ঋণ করে, কৃষি খাত ও অকৃষি খাত থেকে। বাংলাদেশের আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হলো
জনশক্তি রফতানি । জনশক্তি রফতানির তালিকায় বাংলাদেশ
বিশ্বে তৃতীয় স্থানে আছে।
রেমিট্যান্স
আয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০টির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রবাসী রেমিট্যান্স আয় দিনে
দিনে দ্রুত বাড়ছে। রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনায়
স্বচ্ছতা থাকলে এক্ষেত্রে আরও উন্নতি সম্ভব। আমরা বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স আয় করলেও তা আমাদের কাছে বিনিয়োগযোগ্য মূলধন হিসেবে
আসে না।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির
জন্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের মেধাকেও পুঁজির মতো ব্যবহারে ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে সাধারণত দেখা যায় যে, প্রবাসী লোকেরা যতদিন
বিদেশে থাকে ততদিন বিদেশে পরিশ্রম করে বিপুল পরিমান রেমিট্যান্স পাঠায়। কিন্তু মেয়াদান্তে দেশে ফিরে আসার পর তারা
অসহায় কর্মহীন হয়ে পড়ে। এদেশে তারা উতপাদনমুখী কোন
কাজ খুঁেজ পায়না, সঞ্চিত টাকা ভেঙ্গে কোনরকমে জীবনের বাকিটা সময় পার করে।
দেশে ফিরার পর
যৌথ উদ্যোগে শিল্পমুখী বা উতপাদনমুখী কিছু করার ব্যাপারে সরকারি বন্দোবস্ত থাকা উচিত। এ ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা মাফিক সহযোগিতা
থাকলে তাদের উপার্জিত অর্থ ও সময়ের যথার্থ ব্যবহার সম্ভব যা অর্থনৈতিক উন্নযনের জন্য
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন, কারিগরি শিক্ষা ও কর্মদতার
অভাবে অনেক দেশে সুযোগ থাকলেও জনশক্তি রফতানি সম্ভব হয়না। উপযুক্ত
প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দিয়ে জনশক্তি রফতানি বাড়ানো যেতে পারে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদের প্রাচুর্য বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনার আধার :
বাংলাদেশে আছে
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। সম্পদের প্রাচুর্যতা
ও সম্ভাবনায় আমাদের সমৃদ্ধি সম্ভব। বাংলাদেশের মাটির
নিচে লুকিয়ে আছে তেল, গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর,
তামা, লোহা, গন্ধক,
নুড়িপাথর, শক্তপাথর, বালির
মত খনিজ সম্পদের বিশাল প্রাচুর্য যা দিয়ে বাংলাদেশ হতে পারে সমৃদ্ধিশালী একটি দেশ। দেশজ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের সবাইকে
যা আছে তা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
একা সম্ভব না
হলে সমবেত প্রচেষ্টায় সম্ভব করতে হবে। আমাদের আছে বিশ্বের
সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, আছে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, আর দেশজুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য, স্থাপনা,
ঐতিহ্যজড়িত পর্যটন স্পট। এসব অফুরন্ত সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে
পারলে পর্যটন শিল্পে রয়েছে বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা।
জনশক্তির সদ্ব্যবহারে
বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়নের সম্ভাবনা :
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করলেও পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের তুলনায় তা অনেক কম। মূলধন পুঁঞ্জিভূত করতে না পারা, শিক্ষা ও দক্ষ শ্রমশক্তির
ঘাটতিই অন্য দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ।
১৯৭৪ সালে মালয়েশিয়ার মাথাপিছু আয় যখন ৭০০ ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ার ৪৮০ ডলার, চীনের ১৬০ ডলার তখন বাংলাদেশের
ছিল ১০০ ডলার।
২০১২ সালে দক্ষিণ
কোরিয়ার মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৬৭০ ডলারে, মালয়েশিয়ার ৯ হাজার ৮২০
ডলারে আর চীনের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭২০ ডলারে যখন বাংলাদেশের মাথাপিছু
আয় বেড়ে দাঁড়ায় মাত্র ৮৪০ ডলারে।
ব্রিটেনের মাথাপিছু
আয় দ্বিগুণ করতে ১৫৫ বছর লেগেছিল, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের লেগেছে ৩০ থেকে ৬০
বছর। অথচ অনেক বেশি জনসংখ্যা নিয়েও
ভারত ও চীনের তা লাগছে ২০ বছর। বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা
বাড়লেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও কমবে। এখন দিনে এক ডলার ২৫ সেন্টের কম আয় করে, এমন মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটি।
আগামী ২০ বছরে
এর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। আর বাড়বে মধ্যবিত্তের
সংখ্যা। এখন বিশ্বে মধ্যবিত্ত আছে ১০০ কোটি, এ সংখ্যা বেড়ে হবে ৩০০
কোটি। মধ্যবিত্তের সংখ্যা সবচেয়ে
বেশি বাড়বে এশিয়ায়।
বিপুলসংখ্যক
এ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাই বাড়াবে প্রবৃদ্ধি। সে সময় বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৮৩০ কোটি, যা এখন ৭১০ কোটি। ২০২১ সালের মধ্য মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে আড়াই হাজার ডলার যা প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত
থাকলে অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সময়োপযোগি পরিকল্পনা
প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন ঘটাতে পারে যুগান্তকারী উন্নয়ন :
রাজনৈতিক অস্থিরতাকে
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আসা, নতুন দেশপ্রেমী নেতৃত্ব সৃষ্টি করা, সেক্টরভিত্তিক
পেশাজীবী ফোরাম গঠন করে উন্নয়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয়া, দেশের
জনগণ এবং দেশের সম্পদকে কাজে লাগানো, তরুণ সমাজের উপযোগী কর্মসংস্থান
নিশ্চিত করা, অপচয়, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, কালো টাকার লাগাম টেনে ধরা, শিল্প-কলকারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ
সহায়তা প্রদান করা, কৃষকদের আধুনিক কৃষি-প্রযুক্তির সুবিধা প্রদান করা ও তাদের ন্যায্যমূল্য দিয়ে উতপাদন বাড়ানো,
দেশের কল্যাণে শিক্ষক, চিকিতসক, পুলিশ, লেখক-সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ পেশা হিসেবে সুবিধা প্রদান করা ইত্যাদি
একাধিক প্রয়োজনীয় কর্মকান্ড সুসংহতভাবে সুসম্পন্ন করার মত একটি সময়োপযোগি পরিকল্পনা
প্রনয়ণ ও যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে পারলে অর্থনৈতিক উত্তোরণে বাংলাদেশের রয়েছে উজ্জ্বল
সম্ভাবনা।
মোদ্দাকথা হচ্ছে
আমাদেরকে এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, আমাদের বিশাল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তরিত করে সঠিকভাবে ব্যবহার করে পারলে অর্থনৈতিক
সমৃদ্ধিতে সারা বিশ্বে আমরা থাকবো অগ্রগণ্য। সরকারি
ও বেসরকারি ভাবে আমরা যদি উন্নয়নের স্বার্থে সুপরিকল্পিতভাবে সুসংবদ্ধ, সুসংকল্পবদ্ধ, দৃঢ় প্রত্যয়ী ও কঠোর পরিশ্রমী হতে পারি
তবে জনশক্তি দিয়েই আমাদের সাফল্য নিশ্চিত।