কৃষিতে সাম্রাজ্যবাদী
আধিপত্যের সূচনা হয় ষাটের দশকে। এ সময় ফোর্ড ফাউন্ডেশন, রকফেলার ফাউন্ডেশন, ও ইউএস এইডের টাকায় গঠিত কনসালটেটিভ
গ্রুপ ফর ইনটিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল রিসার্চ(C.G.I.A.R)সারা পৃথিবী জুড়ে সবুজ বিপ্লবের
কর্মসূচী হাজির করে। এই কর্মসূচী অনুসারে ভারতে তথাকথিত হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটি (HYB)বা উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ শুরু হয়। এই উচ্চফলনশীলগুলি হলো
রাসায়নিক সারে সংবেদনশীল খর্বাকৃতির গাছ। এদের দেহের গড়ন সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে মূল থেকে
শোষিত ও সালোকসংশ্লেষের ফলে উৎপন্ন পুষ্টির অর্ধেকই ধানের দানার পুষ্টি বাড়ানোর কাজে
ব্যবহার হয়। এ সমস্ত খর্বাকৃতির ধানগাছ তৈরি হয়েছিলো তাইওয়ানের ডি–জিও–উ–গেন নামক একটি জাতের সাথে দেশি ধানের সংকরায়নের মাধ্যমে।
সবুজ বিপ্লবের
ফলে ঐরকম কয়েকটি উচ্চফলনশীল ধান সমগ্র দেশ জুড়ে চাষ করা শুরু হয়ে গেলো। ফলে ভারতে যে
হাজার হাজার দেশি জাতের ধান চাষ হতো, তা ক্রমশই বন্ধ হয়ে গেলো।
এক্ষেত্রে ধানের বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সাধারণত এক বছরের বেশি না থাকায় এবং কৃষক পরপর কয়েক বছর নিজেদের স্থানীয় জাতের ধান চাষ না করায়
তাদের বীজধান নষ্ট হয়ে গেলো। উল্লেখ্য, এসময় চাষীরা উচ্চফলনশীল ধান
চাষ করেছিলো মূলত তিনটি কারণে–
১.ঠিকমতো সার, পানি, কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারলে
এর ফলন বেশি।
২.চাষীকে দিয়ে
উচ্চফলনশীল চাষ করানোর জন্য প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে চাপ দেওয়া হয়েছিলো। ৩.চাষীকে ঋণ
গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো এবং সারে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিলো।
আর পুরো মহাদেশব্যাপি
যখন কথিত সবুজ বিপ্লব সম্পূর্ণ হচ্ছিলো এবং উচ্চফলনশীলের ব্যাপক চাষাবাদের ফলে যখন
দেশি জাতগুলি বিলুপ্ত হতে শুরু করে, তখন ১৯৭৪ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন
এবং রকফেলার ফাউনডেশন গঠন করে “ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড অব প্লান্ট
জেনেটিক রিসোর্স” বা IBPGR। এ সংগঠন দুটি ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (FAO)–এর সমগ্র পরিকাঠামো ব্যবহার
করে সারা পৃথিবী থেকে (প্রধানত তৃতীয় বিশ্ব থেকে) আর্থিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন
উদ্ভিদের হাজার হাজার প্রজাতি বা ভ্যারাইটির জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করতে শুরু করে। IBPGRবেশ কিছু সংস্থার মাধ্যমে এই সংগ্রহের কাজটি সম্পূর্ণ করে। এ
সমস্ত সংস্থাগুলির উপর তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশের সরকারের কোনপ্রকার নিয়ন্ত্রণ ছিলো না।
বর্তমান পৃথিবীতে
সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের এক চতুর্থাংশই উক্ত IBPGR-এর কাছে রক্ষিত আছে। এবং সংগ্রহ
করার সময় তারা যে কথা বলেছিলো, “সংগৃহীত উদ্ভিদের একটি সেট যে দেশ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে সেই
দেশেই থাকবে”,সংগ্রহ এবং প্রয়োজন শেষে চুড়ান্ত
বৈঈমানির নজির সৃষ্টি করে উক্ত চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্বব্যাপী কথিত সবুজ বিপ্লবের
প্রবক্তারা! উল্লেখ্য যে সবুজ বিপ্লবের আগে শুধুমাত্র ভারতেই ছিলো, বেয়াল্লিশ হাজার ধানের জাত। বর্তমানে যা দুই হাজারেরও কম। আর
অবলুপ্ত ওসব ধানের জাতগুলোই আছে এখন শুধুমাত্র IBPGR-এর সংগ্রহে।
এক্ষেত্রে গত
একশো বছরে যেসব প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ, শস্য বীজ, প্রজাতি বহুজাতিকরা জোচ্চুরি ও কৌশল খাটিয়ে স্থানীয় ভান্ডার
থেকে অবলুপ্ত করিয়েছে এবং নিজেদের করায়ত্ত্ব করেছে
সেসবই এখন আবার উচ্ছমূল্যে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসছে।
কৃষক এখন বহুজাতিক
কোম্পানি ও বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রায় এবং গত বিশ–ত্রিশ বছর ধরে কথিত উচ্চফলনশীল ফসল চাষাবাদের নামে কৃষি জমিতে
ব্যাপক মাত্রায় রাসায়ানিক সার ব্যাবহারের ফলে জমির উর্বরতা হারিয়েছে। বা রাসায়ানিক
সার জমিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটিশিয়ামের যোগান
দিলেও জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, বোরন, তামা, মলিবডেনাম, লোহা প্রভৃতির যোগান দিতে
পারেনা। তাই এই অনু খাদ্যগুলি জমি থেকে স্থায়ীভাবে অপসারিত হয়েছে!
এমতাবস্থায় বহুজাতিকরা
বাজারজাত করতে শুরু করে অনুখাদ্য সার! আবার জৈবসার ব্যবহার না করায় জমির যে ক্ষতি হয়েছে
তা পূরণ করতে বহুজাতিকরা বাজারে ছেড়েছে তাদের পেটেন্টকৃত জৈব সার ও জীবানু সার! অন্যদিকে
রোগ–পোকার উপদ্রব বাড়লে অতি উচ্চফলনশীল জাতও অতিনিন্ম ফলন দিতে শুরু
করে। আবার ঘুরে ফিরে কিছুদিন পরপর পোকা–মাকড়রাও শক্তিশালী এবং অপ্রতিরোধ্য
হয়ে উঠে, তখন আবার প্রয়োজন হয় ধানের জাত পাল্টানোর বা অবলুপ্ত ভ্যারাইটিগুলোর
সমন্বয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন। যা আদিকাল থেকেই কৃষক করে আসছিলো প্রতিবছর।
কিন্তু কৃষক
চাইলে এখন আর স্থানীয় বীজে ফিরতে পারবেনা, কারণ তার কাছে থাকা বীজ ধান
অথবা ফসলের বীজ ততদিনে নষ্ট হয়ে গেছে বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, যা শুধু রক্ষিত আছে কুখ্যাত জোচ্চোর সংস্থা IBPGR-এর কাছে। যেহেতু কোন ফসলের বীজেরই অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা থাকেনা
দু–চার বছর পর, তাই থাকেনি কৃষকের ভাণ্ডারের
বীজও! আর এভাবেই সুযোগ, চাহিদা আর বীজের বাজার সৃষ্টি
করে বহুজাতিক কোম্পানিরা শুরু করেছে কথিত উচ্চফলনশীল, কথিত প্রতঙ্গ প্রতিরোধী জাত, এবং প্রতঙ্গ বিনাশী কীটনাশক ও অনু খাদ্য বা জৈব সারের ব্যবসা।
সর্বনাশী কর্পোরেট
কৃষি নয়, চাই পরিবেশসম্মত কৃষি
ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে
১ কোটি ৪০ লক্ষ কৃষক আছে, আর যুক্তরাষ্ট্রে আছে মাত্র
২০ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার মাত্র ২% কৃষক আছে। অথচ ১০০ বছর আগে ছিল ৭০ থেকে
৮০%। বাংলাদেশে ৫০% জনগণ সরাসরি কৃষি কাজের
সাথে যুক্ত, তার মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র কৃষক
ও বর্গা চাষী। ২৫ কোটি মানুষের দেশের তাহলে অন্তত ১২.৫০ কোটি মানুষ কৃষির ওপর
নির্ভরশীল। কাজেই ইওরোপ-আমেরিকার কৃষি নীতি যা হবে, শুধু সংখ্যার দিক বিচার করলেও বাংলাদেশের কৃষি একই নীতিতে চলতে
পারে না। উন্নত দেশের কৃষি পদ্ধতি এখানে চালানোর অর্থ হচ্ছে এখানকার কৃষকদের শেষ করে
দেয়া।
গত শতাব্দীর
ষাটের মাঝামাঝি সময়ে এদেশে আধুনিক কৃষির প্রবর্তন কৃষকের পক্ষে যায়নি। যদিও উচ্চ ফলনশীল
বীজের কারণে কিংবা সার দেয়ার কারণে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এর ফলে পরবর্তীকালে অনেক
ক্ষতি হয়েছে, যেমন কৃষকের সংখ্যা কমে যাওয়া, পরিবেশ নষ্ট হওয়া, খাদ্যের বৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, এবং নির্বিচারে কীটনাশকের ব্যবহার, মাটির তলার সেচের পানি ব্যবহার এবং সার ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়াজাত
করার কারণে পুষ্টি ঘাটতি ও নানা রোগের সৃষ্টি হওয়া। বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে আধুনিক
কৃষির কারণে এই ক্ষতি হয়েছে।
উচ্চ ফলনশীলের
পর এসেছে আরো বেশী কীটনাশক নির্ভর এবং বীজ ব্যবসায়ী ও কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত হাইব্রীড
বীজের। যার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফসলের চাষ বেড়েছে। কৃষক বাণিজ্যের স্বার্থে বিপুল পরিমানে
কীটনাশক ব্যবহার করছে, বাজারের প্রয়োজনে রাসায়নিক
উপাদান ব্যবহার করে কাঁচা অবস্থা থেকে পাকানো, স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর
কৃত্রিম রং দেয়ার মতো কাজ বেড়ে গেছে। কৃষি পণ্য, বিশেষ করে খাদ্য শস্যের আবাদ ব্যাপকভাবে বাড়লেও হয়ে গেছে বিষাক্ত।
খাদ্য উৎপাদন
হয় কৃষকের মাঠে, প্রকৃতির সাথে মিল রেখে। এখানে পোকা লাগতে
পারে, ফসলের আকৃতি ও রং ভিন্ন হতে পারে। সব বেগুন, টমেটো, মরিচ এক রকম হবে না, সবগুলোর স্বাদও এক হবে না। কিন্তু আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষি এসে
সে ধারণা পালটে দিয়েছে।
একটি জরীপে দেখা
গেছে ঢাকা শহরের রিক্সা ওয়ালাদের মধ্যে ৬৭% আগে কৃষি কাজ করতেন। কেউ কেউ মৌসুমী কৃষি
কাজ করে আবার ঢাকায় কিংবা যে কোন শহরে রিক্সা চালান, বা দিন মজুর খাটেন। ফলে কৃষি কাজ প্রধান পেশা হিশেবে কমে যাচ্ছে। এর একটি প্রমাণ
পাওয়া যায় ২০১২ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ২০১১ সালে “Population
and Housing Census, 2011: Socio-Economic and Demographic
Report” প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে
পেশা হিশেবে কৃষি কাজ বা কৃষক বলে কিছু নেই, আছে “Skilled
Agriculture/Forestry and Fisheries Workers”। প্রায় ৩০.১%
মানুষ এই কাজে নিয়োজিত এবং অন্যান্য সব ধরণের কাজের চেয়ে এটাই সবচেয়ে বেশী। কিন্তু
২০০৪ সালেও এর পরিমান ছিল ৪৯.৫%। এটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
বর্তমানে কৃষক
হিশেবে যারা আছেন তাদের দুরাবস্থা দেখেই ভবিষ্যত প্রজন্ম এই কাজে আসছে না, এমন কি কৃষকরা নিজেদের সন্তানদের কৃষি থেকে দূরে রাখছেন।
সবুজ বিপ্লব
মানে সার-কীটনাশকের ব্যবহার এবং তার ফলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি এখন বিশ্ব
ব্যাংক, জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ অনেকেই স্বীকার করে। ইংরেজীতে
Green Revolution কে Grey Revolution হিশেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ব্যাপক পরিবেশ
ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের কারণে কেঁচো
থেকে শুরু করে প্রজাপতি, মৌমাছিসহ ছোট, বড় প্রাণী ও জীব-অনুজীব ধ্বংস হয়েছে, মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়েছে, পানি বিষাক্ত হয়েছে, তাই সবুজ বিপ্লব আর সবুজ থাকেনি।
সবুজ বিপ্লবের সময় থেকেই শুরু হয়েছে কৃষকের সংখ্যা কমে যাওয়ার ঘটনা, কিন্তু তারপর বাজারে কীটনাশক ও রাসায়নিক কোম্পানির নেতৃত্বে
এসেছে হাইব্রিড বীজ, তখন কৃষকের অবস্থা আরও নাজুক
হয়েছে।
সবুজ বিপ্লবে
সরকারের মাধ্যমে, হাইব্রিড বীজ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি
এখন কৃষি চলে যাচ্ছে বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি জেনেটিকালী মডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমও প্রবর্তনের
মধ্যেমে। এখন বিশ্বে যেসব বড় বড় কোম্পানি কৃষির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী তারা এখন
এমন বীজ প্রবর্তন করতে চায় যার মালিকানাসহ নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির থাকবে। তারা বলছে ‘We,
the corporations, own the seeds. You, the farmer, cannot save or replant them
by law; you must buy new seeds every year from us, the corporations. [Ref: GMOs
- who will feed us and what will they feed us? Nana Ama Amamoo 2013-09-26, Issue 647
http://pambazuka.org/en/category/features/89001] ’ আমরা, কর্পোরেশানরা, বীজের মালিক। তুমি, কৃষক, আইনগতভাবে বীজ রক্ষা বা পুণউৎর্পাদন
করতে পারবে না; তোমাকে প্রতিবছর নতুন বীজ কিনতে হবে আমাদের
(কর্পোরাশানের) কাছ থেকে”। এই কর্তৃত্বকারী কোম্পানীর সংখ্যা খুব
বেশী নয়।
মাত্র ১০টি বহুজাতিক
কোম্পানি বিশ্বের ৭৩% জিএম বীজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এই দশটির মধ্যে মাত্র ৩টি কোম্পানি
মনসান্তো, সিনজেন্তা ও ডু-পন্ট ৫৩% বাজার দখল করে আছে। তবে এই তিন মোড়লের
মধ্যে মনসান্তো একাই ২৩% বাজার দখলে রেখেছে। [Who
Owns Nature, Corporate Power and the Final Frontier in the commodification of
life, ETC group, 2008] এরাই আবার কীটনাশকের বাজারে ৯৫% দখল করে আছে। অর্থাৎ বীজের বাজার ও কীটনাশকের
বাজার একই কোম্পানির হাতে রয়েছে।
প্রচুর সুর্যালোক, উত্তরে হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃষ্টিপাত এবং বিশাল তিন নদির মোহানায় জেগে ওঠা বদ্বীপ বাংলাদেশের জমি অতি উর্বর। এই দেশ কৃষি ফসলের দেশ, যাকে বলে সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা বাংলাদেশ। অথচ এই কৃষিকে ক্রমাগতভাবে
কৃষকের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে।
এই দেশে কোন
প্রয়োজন ছাড়াই জিএম ফসলের প্রবর্তন করছে। এবং খুব গর্বের সাথে ঘোষনা দেওয়া হচ্ছে যে
বাংলাদেশ জিএম ফসল উৎপাদনকারি ২৮টি দেশের সাথে যোগ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে আমরা আমাদের প্রাণ
ও প্রাণের বৈচিত্র্য বিকৃতি ঘটাচ্ছি, এবং এটা খুব আনন্দের বিষয়!
এই ঘোষনা এসেছিল ২০১৩ সালে প্রথম জিএম খাদ্য ফসল বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের চাষের অনুমোদন
দেয়ার সময়। দেশে কৃষক সংগঠন ও পরিবেশ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে, কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।
বিশ্বের পরিবেশবাদী
সংগঠন এবং স্বাধীন বিজ্ঞানীরাও প্রধান মন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও পরিবেশ ও বন
মন্ত্রীর কাছে সরাসরি চিঠি লিখেছেন এই অনুমোদন না দেয়ার জন্যে। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারি
মাসে ২০ জন কৃষককে বিটি বেগুনের চারা দেয়া হয়, কিন্তু চাষ করে কৃষকের ব্যাপক
ক্ষতি হয়েছে।
ডগা ও ফল ছিদ্রকারী
পোকা লাগবে না বলে এই প্রযুক্তি দেয়া হলেও বেগুন গাছের পাতায়, ডগায় এমনকি ফলেও পোকা লেগেছে। বিটি বেগুনের ব্যর্থ অভিজ্ঞতার
পরও আরো পাঁচটি বিটি ফসলের অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল কমিটি
অন বায়োসেফটি (এনসিবি) (বণিক বার্তা ১৪ জানুয়ারি, ২০১৫)। এর মধ্যে দুটি ধানের জাত, দুটি আলুর এবং একটি তুলার জাত রয়েছে। এই তথ্য থেকে পরিস্কার
বোঝা যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশকে দুর্বল আইনী ব্যবস্থা, অগণতান্ত্রিক ও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য
হাসিল করতে চাচ্ছে। কারণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এতো সহজে আর কোন দেশে অনুমোদন নিতে পারবে
না।
কারণ এখানে যারা
পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছে তাদের কথা না শুনলেও
কোন জবাবদিহি করতে হয় না। এখানে শিক্ষিত মানুষ জিএম প্রযুক্তিকে বিজ্ঞানের অবদান বলে
খুব স্বাগত জানায়। যদিও যারা বিরোধিতা করছে তারাও
বিজ্ঞানের পক্ষে। বোঝা দরকার যে কর্পোরেশান নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জন্যে নয়, তাদের মুনাফার জন্যে প্রবর্তন করা হয়।
দুঃখজনক হচ্ছে
বাংলাদেশ সরকার এমন আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের ও পরিবেশের
ক্ষতি করছে এবং কৃষক হাত থেকে কৃষি বীজ কেড়ে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল
করিয়ে দিচ্ছে।
খাদ্য রাজনীতি
ও কৃষিতে কর্পোরেট মনোপলি
প্রাণবৈচিত্র্য, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব, শস্য বীজ থেকে শুরু করে জিন
পর্যন্ত বেদখল হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট আগ্রাসনে। প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলো কর্তৃক অনুন্নত
কিন্তু জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশগুলোর হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জেনেটিক সম্পদ ও লোকায়ত
জ্ঞানকাঠামোর এই লুণ্ঠনকেই বায়োকলোনিয়ালিজম
বলা হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদ/
জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও দক্ষিনের এই দেশগুলোর মালিকানা হারানোর পেছনে দায়ি বিশ্ব
বাণিজ্য সংস্থার মত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো। মুক্ত বাজার অর্থনীতির
আড়ালে ডব্লিউটিও মূলত বিশ্বব্যাপী এমন এক একমাত্রিক বাণিজ্য নীতি চালু করতে চায় যা
তথাকথিত ট্রেড বাধাসমুহ দূর করে গ্লোবাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের মুনাফা অর্জনের
হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। ডব্লিউটিও’র গ্যাটস ( জেনেরাল এগ্রিমেন্ট
অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস) দুর্বল রাষ্ট্রসমূহকে গ্লোবাল কর্পোরেট বাণিজ্য নীতির অধীনে
নিয়ে আসতে চায়। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্য সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয়
বাধাসমুহ দূর করে এসব দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে সেবা খাতকে বৃহৎ কর্পোরেশনের বাণিজ্যের
জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া।
ডব্লিউটিও’র এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার (AoA) কৃষিতে উদারীকরণের নামে অনুন্নত দেশগুলোর কৃষি ব্যবস্থার উপর
বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দরজা খুলে দিচ্ছে। এওএ অনেক উন্নয়নশীল
দেশগুলোকে বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড এবং নন হাইব্রিড জিএম (জেনেটিক্যালি মোডিফাইড) শস্য চাষ করতে বাধ্য করছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী লোকাল
জাতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানাধীন জিএম শস্যজাত।
কাজেই প্রযুক্তি
নির্ভর কৃষি উৎপাদনের পরিকল্পনা নয়, কৃষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পরিবেশ নির্ভর কৃষিকে মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে
হবে। কোম্পানির মুনাফার জন্যে নয়, মানুষের পুষ্টি, সুস্থ থাকা এবং জীবন-জীবিকা চালানো সব চিন্তা করতে হবে।