কর্পোরেট অর্থনীতির
পরিচয় :
কর্পোরেট অর্থনীতি
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির একটি বিশেষ রূপ। তাই কর্পোরেট অর্থনীতি বুঝতে গেলে ধনতন্ত্র
বা (Capitalisim) সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। মধ্যযুগের
শেষে ইউরোপে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু হলেও শুরুতে ধনতন্ত্র শব্দটির প্রচলন ছিলো না।
তবে ধনপতি (Capitalist) এবং ধন (Capital) শব্দদ্বয়ের প্রচলন একটু আগে থেকেই শুরু হয়। ধনপতি বা (Capitalist) শব্দটির প্রচলন ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হলেও Capital শব্দটির প্রচলন শুরু হয় অনেক আগে ১২৮৩ খ্রিষ্টাব্দে।
বুৎপত্তিগতভাবে
Capital শব্দটি ল্যাটিন Capital শব্দ, যা প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয়
Caput শব্দ হতে উদ্ভত। এর অর্থ হচ্ছে মাথা। এ শব্দটি হতেই Chattel বা Cattle শব্দের উদ্ভব হয় যা অস্থাবর
সম্পত্তিকে বোঝাতো। দ্বাদশ শতাব্দি হতেই Capital
বলতে তহবিল, গুদামজাত পণ্য, মোট অর্থ এবং সুদ বহনকারী
অর্থ বোঝাত। ১২৮৩ খ্রিষ্টাব্দে Capital বলতে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের
মোট বিনিয়োগযোগ্য অর্থকে বেঝাত এবং সেই সময় হতেই সম্পদ, অর্থ, তহবিল, পণ্য, বিনিয়োগকৃত অর্থ, সম্পত্তি ইত্যাদির সমার্থক হিসেবে Capital শব্দটি ব্যবহৃত হতো।
এর ধারাবাকিতায়
Hollandische Marcurius ১৬৩৩ এবং ১৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দে Capital এর মালিকদের Capitalist
বলতে শুরু করে। ওলন্দাজ বা ডাচ ভাষায় ধনপতিদের Capitalistesim বলা হতো। ১৭৮৮ সালে Etielle Clavier ফরাসি ভাষায় প্রথম Capitalistesim শব্দটি ব্যবহার করে। এর কিছুদিন পর ১৭৯২ সালে Arthuryoung তার Tarvels in
France নামক বইতে ইংরেজি ভাষায় Capitalist শব্দটি ব্যবহার করে।
অর্থনীতিতে Capitalist শব্দটির প্রথম প্রচলন ঘটায় David Richardo ১৮১৭ সালে তার Political Economy of
Taxation নামক বইয়ে। Pierre Joseph এই Proudhon এই Capitalist শব্দটি ব্যবহার করে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে
তার What is property নামক বইটিতে। এরপর কার্ল মার্কস এবং ফ্রেড্রিক
এঙ্গেলস Capitalist শব্দটি ব্যবহার করে কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টুতে।
Proudho Capitalist বলতে ধন বা Capital এর ব্যক্তি বা সামষ্টিক মালিকদের বোঝালেও কার্ল মার্কস শব্দটি
সীমাবদ্ধ রাখে ব্যক্তির ক্ষেত্রে। সে Capitalist
বলতে বেঝায় ধনের ব্যক্তি মালিকদের।
অর্থনেতিক ব্যবস্থা
হিসেবে ধনতন্ত্র শব্দের প্রথম প্রয়োগ পাওয়া যায় কার্ল মার্কসের দ্যস ক্যাপিটাল বইয়ের
প্রথম খন্ডে এবং থিওরিজ অব সারপ্লাস ভ্যালুস বইয়ের ২য় খন্ডে। ক্যাপিটালিজম শব্দের বহুল
ব্যবহার মার্কসের লেখায় ছিলনা তবে Capitalist
এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদিন ব্যবস্থা
সে ২ হাজার ৬ শত বার তার দ্যস ক্যাপিটাল বইয়ে ৩টি খন্ডে ব্যবহার করেছে।
ধনতান্ত্রিক
উৎপাদন ব্যবস্থা বলতে সে বোঝাতে –
(ক) বাজার অর্থনীতির
জন্য উৎপাদনের হাতিয়ারের ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন করা হবে
বাজারের জন্য আর উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা হবে ব্যক্তিগত;
(খ) বাণিজ্যের আইনগত কাঠামো এবং
(গ) রাষ্ট্র
কর্তৃক সরবরাহকৃত ভৌত অবকাঠামো।
সে মনে করতে
শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কোন আইনগত কাঠামো ছিলনা এবং শ্রমিকদের উপর কোম্পানির
শাসন চুড়ান্ত পর্যায়ে ছিল।
কর্পোরেট অর্থনীতি
হলো মুক্ত অথবা মিশ্রিত বাজার অর্থনীতি যার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কর্পোরেশনের প্রাধান্য।
আর কর্পোশনগুলো পরিচালিত হয় ক্রমাধিকারতন্ত্র এবং আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয়
একচেটিয়া পুঁজিবাদ ছিল মূলত মার্কসীয় প্রত্যয়।
সে যা বোঝাতে
চেয়েছে তা হলো রাষ্ট্র এই নীতি তৈরি করবে যাতে করে সে কর্পোরেশনকে বাঁচতে পারে অন্যের
প্রতিযোগিতা থেকে এবং রাষ্ট্র কর্পোরেশনকে ভর্তুকি দেবে ও এর স্বার্থ রক্ষা করবে।
James Herendeen তাঁর Economics of the Corporate Economy বইতে কর্পোরেট অর্থনীতি বলতে বুঝিয়েছে
এরূপ অর্থনীতি বা কর্পোরেশন দ্বারা পরিচালিত হয় আর কর্পোরেশন পরিচালিত হয় ব্যবস্থাপনা
পর্ষদ দ্বারা। এই ব্যবস্থায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ মালিকের কাছে থাকেনা, থাকে ব্যবস্থাপক শ্রেণীর কাছে।
বইটিতে লেখা
আছে
…….. corporate
enterprise in which effective control of the corporation rests with with the
managers rather than with the share holders of the corporation
কর্পোরেট ধনতনেত্রর
মূল বৈশিষ্ট্য হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রনকে পৃথক করে ফেলা।
প্রতিযোগিতামূলক
ধনতন্ত্রে যে মালিক সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করন। আর কর্পোরেট ধনতন্ত্রে মালিকানা
থেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আসেনা, আসে ব্যবস্থাপক শ্রেনী হতে। আর এই ব্যবস্থাপক শ্রেণী
পরিচালনা পর্ষদ বা নির্বাহী ইত্যাদি পদবীর মাধ্যমে ক্রমাধিকারতন্ত্র বা আমলাতন্ত্র
অনুষরণ করে। মার্কস কখনও ভাবেনি যে, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ পৃথক
হতে পারে।
কর্পোরেশনের
বিভিন্ন ধরনের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বহুজাতিক কর্পোরেশন। এরা এত বৃহৎ
এবং এদের ক্ষমতা এত প্রসারিত যে, এরা রাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতা
করে এবং জাতি রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, দরিদ্র রাষ্ট্র এবং নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলোকে এরা খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ
করে। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এরা এই নিয়ন্ত্রণ করে?
এই নিয়ন্ত্রণের
অন্যতম কৌশল হলো জাতি রাষ্ট্রসমূহে কর্পোরেশনগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ। এর ফলে এরা কর্মসংস্থান
দেয় যায় কারণে শ্রমিকরা কর্পোরেশনেরর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক
শ্রেণী কর্পোরেট স্বার্থকেই বড় করে দেখে তাদের চাকুরীর স্বার্থে। এক্ষেত্রে শ্রমিকরা
থেকে যায় অবহেলিত। এই ব্যবস্থাপক শ্রেণী রাষ্ট্রীয় স্বার্থের চেয়েও কর্পোরেট স্বার্থকে
বড় করে দেখে। এই বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো মূলধন রপ্তানি করে অর্থাৎ এক দেশ থেকে সম্পদ
নিয়ে অন্য দেশে বিনিয়োগ করে অথচ শ্রমিকদের তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে নেয়না।
তবে এ ব্যবস্থাপক
শ্রেণীকে তারা প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে যেখানে তাদের ব্যবসা রয়েছে সেখানে প্রেরণ করে।
অর্থাৎ কর্পোরেশনের শ্রমিকরা জাতীয়, আর ব্যবস্থাপকগণ বৈশ্বিক।
এই বহুজাতিক
কর্পোরেশনগুলো রাজনৈতিক ভাবে জাতি রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙ্গে ফেলছে। ভেঙ্গে ফেলছে জাতি
সত্ত্বাকে । যেহেতু তারা বহুজাতিকজ তাই
ব্যবস্থাপক শ্রেণীর মধ্যে বহুজাতিকতার অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে দেশপ্রেম।
এক অদ্ভুত মোহে এক শ্রেণীর মানুষ পাশ্চাত্যে পড়ি জমানোকে জীবনের চরম স্বার্থকতা মনে
করছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে
সম্ভবত এই বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে সবচেযে বেশি নাজুক
অবস্থায় পড়েছে আমাদের উচ্চ শিক্ষা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কর্পোরেশন দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত। এই কর্পোরেশনের কারণে জ্ঞান চর্চা হয়ে পড়েছে বাজারভিত্তিক যার মূল উদ্দেশ্য
হচ্ছে বাহুজাতিক কর্পোরেশনে চাকুরী পাওয়া।
উচ্চ শিক্ষার
যে বিষয়গুলো সত্যি সত্যি জ্ঞান উৎপাদন করে থাকে যেমন পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের চেয়ে
বিবিএ/এমবিএ বিষয়ে পড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। এ ধরনের বিষয়ে পড়াবে মূল লক্ষ্য
বহুজাতিক কর্পোরেশনে চাকুরী করা। ফলে উচ্চ শিক্ষার জ্ঞান হয়ে গেছে পণ্য।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
চলছে কর্পোরেট কাঠামোয়। এগুলোর মালিকানায় থাকে কর্পোরেট গোষ্ঠীই আর লেখাপড়ার উদ্দেশ্যও
ঐ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা। উচ্চ শিক্ষার মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাও পণ্যে
পরিণত হয়েছে। কোচিং, মডেল টেস্ট, ভিন দেশী ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ভিন দেশী কারিকুলারম অনুসরণ – এসবই সেকথার স্বাক্ষ্য দেয়।
কর্পোরেট অর্থনীতির
প্রভাবে আজ দেশপ্রেম সংকট দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রনীতি আজ রাষ্ট্রের জন্য হয়না – হয় কর্পোরেশনগুলোর স্বার্থে।
বাংলাদেশে আইন করে বিশ্ব ব্যাংককে ডিপ্লোমেটিক ইমিউনিটি দেয়া হয়েছে।
কর্পোরেট অর্থনীতির
অরেক প্রভাব হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ভৌগলিক সীমানা অতিক্রমণ। এখন নিজ ভূখন্ডে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ
কমে গেছে। দেখা যায় বাংলাদেশের আকাশে যে স্যাটেলাইট বিদ্যমান তার মালিক হচ্ছে আইবিএম
নামক এক কোম্পানি। তারা আবহাওয়ার পূর্বাভাস সংক্রান্ত বিভিন্ন খবর আবার বাংলাদেশের
কাছেই বিক্রি করে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে যা গোপন থাকা দরকার তা স্যাটেলাইটের
কারণে আর গোপন থাকছেনা। ফলে সংকটে পড়ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। এই কর্পোরেট বিশ্ব আজ
কম্পিউটার ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে শিক্ষার
জন্য জাতি রাষ্ট্রগুলো আজ কর্পোরেশনগুলোর কাছে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। রাজনীতির দিকে
তাকালে দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলোও আজ ঐ একই শক্তির অনুগত এবং জনগণের দিকে না তাকিয়েই
ঐ শক্তির স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত থাকে।
জাতীয় ও বহুজাতিকতার
এই দ্বন্দ্বে মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ও উন্নয়ন ধারা বজায় রাখার প্রয়োজনে প্রজ্ঞা ও
গবেষণার মাধ্যমে প্রত্যেকে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
সভ্যতার অগ্রযাত্রায় সংকট থাকবেই এই সংকট আমরা কিভাবে মোকাবিলা করছি তার উপরই নির্ভর
করে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি।
কর্পোরেট বানিজ্যের
একটি সহজ উদাহরন
১। কর্পোরেট
পুঁজিবাদ চালিত হয় একমাত্র লাভ বা প্রফিটের দ্বারা , এইখানে নিয়ম নীতি , উচিত -অনুচিত , এথিকাল - নন এথিকালের বালাই নাই
২। এই মাল্টিন্যাশনাল
কর্পোরেট গুলো অর্থনীতির লিগাল, ইলিগাল, সোসাল - সব কয়টা হাত কিনে নিয়ে নিয়ন্ত্রন করছে ।
অর্থাৎ , যেই কোম্পানি মানুষের পয়সা চুষে খেয়ে ফুলে ফেপে আঙ্গুল ফুলে
কলাগাছ হচ্ছে , সেই আবার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির
নামে সোসাল ওয়ার্ক করে বেড়াচ্ছে ।
মানে , ধরুন আপনার কাছে একটা গরু আছে । ঐটা দিয়ে আপনি দুধ উৎপাদন করতেন , নিজে খেতেন , পরিবারকে খাওয়াতেন আর বাড়তিটুকু
বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আপনার কাছ থেকে অনেক টাকায়
গরুটা কিনে নিল এবং দুধ আপনার কাছে বিক্রি
করা শুরু করল , আপনিও কিনতে বাধ্য। কারন আপনার নিজের আর
গরু নাই।
আপনি টাকার লোভে
গরু বিক্রি করে দিলেও কিছু দিন পরেই ভুলটা বুঝলেন, টাকা তো চিরদিন থাকে না, খরচ হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু তখন আর কিছু করার নাই । আপনার পয়সা ফুরায় গেলে আমার কাছেই হাত
পাতলেন । আমি আপনাকে আমার মালিকানাধীন
গরু যেটা আগে আপনার ছিলো সেইটা দেখা শোনার দায়িত্ব দিলাম এমন বেতনে যেটা দিয়ে বাচ্চা
কাচ্চা দূরে থাক , আপনার নিজেরই এক গ্লাস দুধ
জুটে না ।
এবার কর্পোরেট
সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে আপনারে দুধ কিনার ঋণ দিল। সেটা দিয়ে আপনি নিজের বাচ্চার
জন্য দুধ কেনা শুরু করলেন। আপনাকে বিক্রির কমিশন দেওয়ার লোভ দেখাল ও ক্রেতা বাড়াতে
বলল। অচিরেই আপনি বুঝতে পারলেন , আয় না বাড়ালে ঋণ শোধ করা যাচ্ছে
না । বাচ্চার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে । আর আশে পাশের বাড়িতে যতদিন দুধওয়ালা গাভী
থাকবে , আপনার বিক্রি বাড়বে না । বাঁচার তাগিদে আপনি আশে পাশে লোকজনকে গাভী
বিক্রির জন্য মূলামূলি শুরু করলেন। ইতঃমধ্যে লাভের টাকা দিয়ে কর্পোরেট কোম্পানী একটি
স্কুল খুলল । স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে সেখানে
বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করল। সেখানে কর্পোরেট কোম্পানী তাদের সুবিধা মত উচিত-অনুচিত, ভ্যালু শিক্ষা দিল।
কিন্তু দিনে
দিনে খরচ বেড়েই চলেছে , শেষে ভিটা মাটি বন্ধক পড়ল
করপোরেট কোম্পানীর কাছে ।
তারপর উক্ত
ব্যক্তির স্ত্রীকে ট্রেনিং দিল ও একটা মিষ্টির কারখানা বানিয়ে তাতে কাজে লাগাল। আগে ২২ টাকা লিটারের দুধ কিনত ২০ টাকায়
। বেতন ছিল ২ টাকা । মিষ্টির কারখানায় দুধ বেচে এখন পায় ৪ টাকা
(কমিশন সহ) ।স্ত্রীর এর বেতন
২ টাকা । মিষ্টির কেজি ১৪০ টাকার ১৩৬
টাকা কর্পোরেট কোম্পানীর । মিষ্টির
কারখানায় দুধ বিক্রির কমিশন ৪ টাকা আর স্ত্রীর ২ টাকা মোট ৬ টাকা থেকে কর্পোরেট
কোম্পানীকে কিস্তি দিতে হয় । ধরে নেওয়া
যাক , কিস্তি ২ টাকা । সেখান থেকে কর্পোরেট
কোম্পানী রাখে ১ টাকা । বাকি ১ টাকা দেওয়া উক্ত
ব্যক্তির ছেলেকে যে মাসে মাসে কিস্তির টাকা কোম্পানীকে এনে দেওয়ার কাজ নিয়েছে কোম্পানী
যেই নতুন ব্যাংকটা খুলেছে সেখানে।
ইতঃমধ্যে উক্ত
লোকের মেয়ে স্কুল পাশ করেছে । তাকে ট্রেনিং
দিয়ে পোল্ট্রির কাজে লাগিয়েছে যেটা উক্ত ব্যক্তির আগের ভিটায়/ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত । শিক্ষিত বলে তার বেতন আড়াই টাকা । চাইলে অবশ্য সে ঋণ নিয়ে কোম্পানীর পোল্ট্রির
মুরগীগুলাকে বেচার ব্যবসা করতেই পারে। এই রকম ভয়ানক পরিশ্রমের ফলে অসুখ বিসুখ হতেই
পারে । তাই কোম্পানী একটা হাসপাতাল দিয়েছে । সংস্থার কর্মী হিসেবে ঐখানে ৩০% ডিস্কাউন্টে
চিকিৎসা পায়। এর ভিতরে এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি
নিয়ে আসা হয়েছে ।কোম্পানীর নতুন
গার্মেন্টস আর বিড়ি সিগারেটের কারখানায় উক্ত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শীরা কাজ করে। যাদের গরু গুলোকে উক্ত ব্যক্তিই তাদের প্রলুব্ধ করেছিল
কোম্পানীর কাছে বেঁচে দিতে । এরাই আবার কোম্পানীর
মিষ্টি, কাপড় , বিড়ি, শিক্ষা , চিকিৎসা ইত্যাদির ক্রেতাও
।
এর নাম কর্পোরেট
বাণিজ্য । কোম্পানী প্রতি পদে পদে ঠকাচ্ছে
, ঠকিয়ে লাভ করছে । প্রথমে ঠকাচ্ছে বেশি দামে গরু বিক্রির
লোভ দেখিয়ে ( অনেক বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন) , তারপর বেতনে , তারপর ঋণে , তারপর সুদে , তারপর ডিস্কাউন্ট দেওয়ার নামে উৎপাদিত পণ্যের বান্ধা কাস্টমার
বানিয়ে , এবং পরিশেষে চিরদিনের জন্য ঋণে বেধে ফেলে ।
গরু , গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য শ্রম দিবে, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবে , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবে । সুতরাং, একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে কোম্পানী তিনটি ভিন্ন ভিন্ন
ধাপে শোষন ও করছে ।
শুরুতে এই কর্পোরেট
নামক শোষক যন্ত্রটি ছোটই থাকে । আস্তে আস্তে
এরা গ্রাস করে নেয় খাদ্য , বস্ত্র, বাসস্থান , শিক্ষা , চিকিৎসা, বিনোদনের মত মৌল চাহিদা মেটানোর
সব কয়টা উৎপাদনের উপকরণ ।
এখন এই
গ্রাস তারা কেমনে সম্ভব করে? কিছু দিন
আগেও প্রধান উপায় ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে দখল ও
সরাসরি শোষণ। যেমন, বৃটিশ ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসন। কিন্তু এতে দেখা গেলো দুই দিন পর পর স্বাধীনতা যুদ্ধ
শুরু করা হয়
।এলো নতুন পদ্ধতি - সবাইরে ঘুম পাড়ায় রাখো । ব্যক্তি মনে করবে সে স্বাধীন ,কিন্তু বাস্তবে স্বাধীন না । ঠিক এই কাজটাই এখনকার মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস ওয়ার্ল্ড করে
থাকে যার নাম মার্কেটিং ( আসলে ব্রেইন ওয়াশিং) । মার্কেটিং কাকে বলে ?
মার্কেটিং হলো
সেই প্রক্রিয়া যা আপনাকে কিনতে বাধ্য করবে এমন একটা বস্তু যা আপনার কোন কালেই দরকার
ছিলো না এবং অবশ্যই উৎপাদনের দশগুণ দামে ।
এই মার্কেটিং
এর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো মিডিয়া । ২৪ ঘন্টা যেই
মিডিয়া আমাদেরকে কিছু ভ্যালু বা মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় ।