প্যাটেন্ট কী
জিনিস?
ধরা যাক, একজন বিজ্ঞানী একটা কিছু আবিষ্কার করলেন। এখন তাহলে সেই আবিষ্কার
করা জিনিসটি বাজারে বিক্রি করে বেশ একটা ব্যবসা জমিয়ে তোলা সম্ভব। এখন তাঁর অনুমতি
ছাড়াই আরেকজন সেই আবিষ্কার করা জিনিসটি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করলে ব্যাপারটা
নিশ্চয়ই ভালো হবে না।
এই ব্যাপারটা
বন্ধ করার রাস্তাই হলো ‘প্যাটেন্ট’। কেউ কিছু আবিষ্কার
করলে সেটা চটজলদি নিজের নামে প্যাটেন্ট করে ফেলতে হবে। তাহলে চাইলেই যে কেউ আর সেটা
বানিয়ে বিক্রি করতে পারবে না। যদি করেও, মামলা ঠুকে এর একটা বিহিত
করা যাবে।
তাহলে যেটা দাঁড়াল, প্যাটেন্ট হলো এক ধরনের অধিকার। কেউ কোনো কিছু আবিষ্কার করলে
রাষ্ট্রকে জানাবে, এটা তাঁর আবিষ্কার। রাষ্ট্র
মেনে নেবে, এটা বানানোর অধিকার শুধু তাঁর। বিনিময়ে
রাষ্ট্রও তাঁকে কিছু শর্ত দিয়ে দেয়। যেমন—এই অধিকারটা আজীবনের জন্য
নয়, বরং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পাওয়া যাবে। সাধারণভাবে মেয়াদটা
২০ বছরের মতো হয়। আবিষ্কার করা জিনিসটার ধরন-ধারণ অনুযায়ী এই মেয়াদ কমবেশিও হয়। সাধারণত
প্যাটেন্ট করতে গেলে আরো একটা শর্ত দেওয়া হয়, আবিষ্কারের বিষয়টা প্রকাশ্যে
জানাতে হয়।
আগে এই প্যাটেন্টের
বিষয়টা রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন ছিল। মানে, চাইলে কোনো রাষ্ট্র এই অধিকার
না-ও দিতে পারত। আবার কোনো রাষ্ট্র চাইলে প্যাটেন্টের বিপরীতে যা ইচ্ছা শর্তও জুড়ে
দিতে পারত। পরে বিশ্ব শ্রম সংস্থা এই নিয়ে একটা চুক্তি করল। সেই চুক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটির সব সদস্য রাষ্ট্রকে প্যাটেন্টের অধিকার দিতে হবে।
এই প্যাটেন্ট
শব্দটা এসেছে লাতিন শব্দ patere থেকে, যার অর্থ খুলে রাখা। পৃথিবীতে প্রথম প্যাটেন্টের ধারণা চালু
হয় প্রাচীন গ্রিসের শহর সাইবেরিসে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে। এখনকার
হিসেবে সেটা ইতালির দক্ষিণ অংশে পড়বে। সেটি অবশ্য এখনকার প্যাটেন্ট ব্যবস্থার মতো ছিল
না। এখনকার মতো প্যাটেন্ট, মানে আধুনিক প্যাটেন্ট প্রথম
চালু হয় ভেনিসে, ১৪৭৪ সালে।
তবে বেশিরভাগ
দেশ ভেনিসের এই প্যাটেন্ট ব্যবস্থা অনুসরণ করে না। ব্রিটেনে ১৬২৪ সালের ২৫ মে একটি
বিধিমালা পাস হয় Statute of
Monopolies নামে। পরে এটাকেই ওরা প্যাটেন্ট আইনে রূপান্তরিত করে। বেশির ভাগ দেশই এই বিধিমালা
অনুসরণ করেই প্যাটেন্ট আইন তৈরি করেছে।
প্যাটেন্ট সম্পদ
লুন্ঠনের হাতিয়ার
নতুন প্রযুক্তি
মাত্রই নতুন সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যম তা নয় বরং এই প্রযুক্তি সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবেও
ব্যাবহার করা হতে পারে যদি এই প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত হয় আইনি আধিপত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ
কয়েকটি দেশের দেশিয় পেটেন্ট আইন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব
অধিকার আইনের ভিত্তিতে প্রযুক্তি এখন হেজিমনিক দেশগুলো কর্তৃক অনুন্নত দেশের প্রাকৃতিক
সম্পদরাজি লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
গত দুই দশক ধরেই
পশ্চিমা বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেমন মনসেন্টো, ইউনিলিভার, ডুপন্ট তৃতীয় বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী
লোকায়ত জ্ঞান, প্রাণ বৈচিত্র্য তথা জেনেটিক সম্পদকে অবৈধভাবে
পেটেন্ট করে নিয়ে এসবের উপর তাদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে
আসছে। এ ধরনের পেটেন্ট আগ্রাসনের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির
২৭.৩ (খ) ধারা।
ট্রিপস চুক্তির
মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক বিভিন্ন প্রকারের পণ্য ও প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণ এর
সম্ভাবনা অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই চুক্তি এমনকি গ্লোবাল কর্পোরেশন কর্তৃক জেনেটিক
সম্পদ যেমন বীজ জার্মপ্লাজম প্যাটেন্টের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ফলে কৃষকগণ তাদের উদ্ভাবিত
বীজের মালিকানা হারাচ্ছে। ট্রিপস চুক্তি অনুসারে জিনের প্যাটেন্ট দাবি করতে পারবে শুধু
সরকার ও কর্পোরেশন – কৃষকগণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই প্যাটেন্ট দাবি করতে পারবে না এবং এই চুক্তিতে
ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জ্ঞানের উপর কৃষক ও কমিউনিটির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অধিকারের স্বীকৃতিও
নাই (গ্রিনফিল্ড, ১৯৯৯)।
মার্কিন বহুজাতিক
এগ্রো-কেমিক্যাল কর্পোরেশন মনসেন্টো, ইউনিলিভার ইত্যাদি বিভিন্ন
দেশ থেকে শস্য বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তোলে বিশাল শস্য বীজ ব্যাঙ্ক । এরপর উক্ত শস্যের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয়
করে যে জিনটি শস্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী তা সনাক্ত করে। লোকায়ত কৃষকদের বীজের
সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ক্রসিং (Natural combination) এর ফলে যে জিনের উদ্ভব তাকেই ল্যাবরেটরিতে সনাক্ত করে বহুজাতিক
কোম্পানি তার মৌলিক উদ্ভাবনা বলে চালিয়ে দেয় এবং ঐ শস্য বীজের পেটেণ্ট করে নেয়। কোম্পানি
পরবর্তীতে জেনেটিক রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সমস্ত উদ্ভিদ, বীজ ও উদ্ভিদজাত সব পণ্যের উপর তার মালিকানা নিয়ে নেয়।
কৃষিজ উদ্ভিদের
যে বৈচিত্র্য, বিভিন্ন জাতের ও বৈশিষ্ট্যের যে সমাহার
তা কিন্তু কৃষকদের বীজের সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন ও নবায়নযোগ্য ব্যাবহারেরই
ফল। কোম্পানি কৃষকদের পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতালব্ধ এই উৎপাদন প্রণালীকেই নিজস্ব উদ্ভাবন
বলে দাবী করে শুধু মাত্র অর্থ ও প্রযুক্তির জোরে। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের কৃষক ও জনসাধারণের
উৎপাদন প্রণালী উদ্ভূত বিভিন্ন শস্য বীজের জাত চলে যায় বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানায়।
এভাবে প্রাণ ও উদ্ভিদের পেটেন্ট হচ্ছে হাজার বছরের উন্নয়নশীল দেশের জ্ঞানের নীরব চৌর্যবৃত্তি।
উদাহরণস্বরূপ
১৯৯৫ সালে মার্কিন কৃষি বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশের ওষধি গাছ নিম হতে প্রাপ্ত ছত্রাক বিরোধী
ওষুধের পেটেন্ট, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাসমতি চালের উপর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ রাইসটেক’ কোম্পানির মালিকানা দাবী এবং
‘টেকনোমতি’ নামে বাজারজাতকরণ ইত্যাদি। এছাড়াও গাছের বিশেষ উপাদান যেমন প্রোটিন বা লিপিড এবং
এসব উপাদান সমৃদ্ধ সমস্ত জেনেটিক সম্পদ, হাইব্রিড ব্রিডিং প্রণালীর
সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্ত বীজ ও উদ্ভিদ, টিস্যু কালচার প্রযুক্তির প্রয়োগে উদ্ভূত উদ্ভিদের জেনেটিক বস্তু, বাহ্যিক জিনকে (external
gene) বিদ্যমান প্রজাতিতে
প্রযুক্ত করে নতুন জিন বহনকারী সকল উদ্ভিদ এবং বীজকে নিজের বলে দাবি করে মার্কিন বহুজাতিক
কোম্পানি ডুপন্ট এবং পাইওনিয়ার এসব জৈবিক সম্পদের উপর পেটেন্টের আবেদন করে রেখেছে।
পশ্চিমা বহুজাতিক
কোম্পানি কর্তৃক প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশগুলোর
জেনেটিক সম্পদরাজির এই লুণ্ঠনকে আমাদের মত দেশের কর্মকর্তাগণ যে মেনে নিচ্ছেনতার পেছনে
কাজ করে কালচারাল ইম্পারিয়ালিজম।
জেনেটিক ইঞ্জিরিয়ারিং/
জিএম প্রযুক্তি মাত্রই মানব কল্যাণ সাধন করবে এই অন্ধ ধারনার কারনে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো
জিএম’র মাধ্যমে সহজেই বায়োপাইরেসির
মধ্য দিয়ে আমাদের মত দেশের শস্য বীজের মালিকানা
ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। বহুজাতিক এগ্রো কামিক্যাল কর্পোরেশনগুলো অন্যান্য পদ্ধতির
চেয়ে জিএম টেকনোলোজি গ্রহণ করার কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে সহজেই প্যাটেন্ট আগ্রাসনের মাধ্যমে
কৃষি বীজের ওপর কোম্পানির মনোপলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির
সাথে রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পর্ক মানে মালিকানার সম্পর্ককে বাদ দিয়ে যারা বিবেচনা করেন
তারা নিজের অজান্তেই বহুজাতিক কোম্পানির কাছে স্বদেশের সম্পদের মালিকানা তুলে দেয়ার
এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। জিএম দিয়ে পেটেন্ট আগ্রাসন চালিয়ে কোম্পানি যখন বায়োপাইরেসি
করে আর এর মাধ্যমে আমাদের হাজার হাজার বছরের শস্যবীজের মালিকানা দাবি করে, তখন তাকে আর নির্মোহ বিজ্ঞান বলা যায় না— এটা করপোরেটের হাতিয়ার হিসেবেই
কাজ করে।
প্যাটেন্ট আগ্রাসনে
কি ক্ষতি হবে ?
১। নিজেদের লোকায়ত জ্ঞান ও সম্পদের মালিকানা হাতছাড়াঃ
প্যাটেন্ট আগ্রাসনের
মাধ্যমে লোকায়ত জনগোষ্ঠী নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের ও লোকায়ত জ্ঞানের মালিকানা হারায়।
২। খাদ্য নিরাপত্তা
ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন এবং খাদ্যের জন্য
কর্পোরেটদের উপর নির্ভরশীলতাঃ
বিশ্ব বাণিজ্য
সংস্থার ট্রিপস চুক্তি এবং এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার পুরাপুরি বাস্তবায়িত হলে দরিদ্র দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ কৃষক এর জীবন জীবিকা
যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের কর্পোরেট মনোপলি এবং মনোকালচারের
কারনে এসব দেশের প্রাণ বৈচিত্র্য বিশেষ করে
শস্য বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
বহুজাতিক কোম্পানির
মনোপলি বিজনেস শস্য বীজের বৈচিত্র্যকে ধংস করে দিচ্ছে। আগে সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ
কৃষক নিজদের শস্য বীজ নিজেরাই সংগ্রহ, সঞ্চয়, পুনরুৎপাদন করত কিন্তু
বর্তমানে মেধাস্বত্ব আইনের সুযোগ নিয়ে এসব বীজের
মালিকানা বৃহৎ এগ্রো কর্পোরেশন নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসায় কৃষকদের চড়া দামে
পেটেন্টেড বীজ কিনে নিতে হচ্ছে। আবার বীজ ইঞ্জিনিয়ারিং
ও বীজ মোডিফিকেশনের মাধ্যমে বীজের প্যাটেন্ট
নিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, ফলে সারা দুনিয়ার কৃষিতে চালু
হয়েছে বীজ আগ্রাসন।
বহুজাতিক কোম্পানি
কর্তৃক এভাবে পেটেন্ট আগ্রাসনের ফলে পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন শুরু হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য
এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
প্রথমত, বায়োপাইরেসির ফলে লোকায়ত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং জেনেটিক সম্পদের
ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এসব উদ্ভিদ এবং শস্য বীজের
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উৎপাদনের উপর বিধিনিষেধের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো খাদ্য শস্যের
উপর গবেষণা করতে পারবে না এবং খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট কর্পোরেশনের হাতে।
স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্যবীজ, উদ্ভিদ এবং ওষধি গাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকদের নিজেদের জমিতে/খামারে
বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যাবহার এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত
হবে পেটেন্ট আইনের কারনে। ফলে পেটেন্টেড শস্য বীজ ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ উৎপাদনের
জন্য হয় বহুজাতিক কোম্পানিকে রয়্যালিটি দিতে হবে অথবা আমাদেরই উৎপাদন প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত
এসব দ্রব্যাদি উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য করা হবে। ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল
ও অনুন্নত দেশগুলোতে কৃষিজ পণ্য ও খাদ্য দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে, হুমকির মুখে পড়বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। আর এসব পেটেন্টেড
পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা অর্জন করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো
৩। কালচারাল
ক্ষতিঃ
এশিয়া ও আফ্রিকার
জনপদের ট্র্যাডিশনাল কৃষি পদ্ধতির সাথে যুগপৎভাবে মিশে আছে এসব দেশের কৃষ্টি-কালচার-জীবনযাপনের
বৈচিত্র্য। কৃষিতে কর্পোরেট আগ্রাসন তথা বায়োকলোনিয়ালিজম এই বৈচিত্র্যকে বিলুপ্ত করে
দিচ্ছে এগ্রিবিজনেসের মাধ্যমে।
কর্পোরেট এগ্রিবিজনেস
কৃষির সাথে যে সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের সম্পর্ক তা অস্বীকার করে এবং দুনিয়ার খাদ্য সমস্যা
দূর করার নাম করে বীজ পেটেন্টিং এর মাধ্যমে চালু করে মনোকালচার ( বিচিত্র খাদ্য শস্যের
বদলে কোম্পানি তার বাণিজ্যিক স্বার্থে হাতে গোনা কিছু শস্য উৎপাদনে বাধ্য করে) যা কৃষির
প্রাণবৈচিত্র্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদন কৃষকদের কাছে শুধু ভোগের
বিষয় নয় এর সাথে কালচারের অনুষঙ্গ রয়েছে কিন্তু
বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক প্রাণ ও প্রতিবেশের বাণিজ্যিকীকরন ও পণ্যকরণ লোকালয়
ভিত্তিক কৃষির প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
বহুজাতিক কোম্পানির
মনোপলি বিজনেস শস্য বীজের বৈচিত্র্যকে ধংস করে দিচ্ছে। আগে সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ
কৃষক নিজদের শস্য বীজ নিজেরাই সংগ্রহ, সঞ্চয়, পুনরুৎপাদন করত কিন্তু
বর্তমানে মেধাস্বত্ব আইনের সুযোগ নিয়ে এসব বীজের
মালিকানা বৃহৎ এগ্রো কর্পোরেশন নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসায় কৃষকদের চড়া দামে
পেটেন্টেড বীজ কিনে নিতে হচ্ছে। আবার বীজ ইঞ্জিনিয়ারিং
ও বীজ মোডিফিকেশনের মাধ্যমে বীজের প্যাটেন্ট
নিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, ফলে সারা দুনিয়ার কৃষিতে চালু
হয়েছে বীজ আগ্রাসন।
বহুজাতিক কোম্পানি
কর্তৃক এভাবে পেটেন্ট আগ্রাসনের ফলে পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন শুরু হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য
এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। প্রথমত, বায়োপাইরেসির ফলে লোকায়ত জ্ঞানের
প্রয়োগ এবং জেনেটিক সম্পদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে।
এসব উদ্ভিদ এবং শস্য বীজের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উৎপাদনের উপর বিধিনিষেধের ফলে তৃতীয়
বিশ্বের দেশগুলো খাদ্য শস্যের উপর গবেষণা করতে পারবে না এবং খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে
প্রাইভেট কর্পোরেশনের হাতে। স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্যবীজ, উদ্ভিদ এবং ওষধি গাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকদের নিজেদের জমিতে/খামারে
বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যাবহার এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত
হবে পেটেন্ট আইনের কারনে। ফলে পেটেন্টেড শস্য বীজ ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ উৎপাদনের
জন্য হয় বহুজাতিক কোম্পানিকে রয়্যালিটি দিতে হবে অথবা আমাদেরই উৎপাদন প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত
এসব দ্রব্যাদি উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য করা হবে। ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল
ও অনুন্নত দেশগুলোতে কৃষিজ পণ্য ও খাদ্য দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে, হুমকির মুখে পড়বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। আর এসব পেটেন্টেড
পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা অর্জন করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো
প্রাণ-উপনিবেশীকরণ
প্রতিরোধে
নিওলিবারেল বিশ্বায়ন
এখন লোকাল কমিউনিটির বায়োলজিকাল ও কালাচারাল ডাইভার্সিটি, ইকোসিস্টেম, মূল্যবোধ এবং জ্ঞান কাঠামোকে
ধংস করতে উদ্যত। ফলে স্থানীয় জনপদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও জীবন –জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। অবিলম্বে তাই অনুন্নত দেশগুলোর ট্র্যাডিশনাল
বীজ, হারবাল মেডিসিন, জ্ঞানকাঠামো এবং প্রাণবৈচিত্র্যের
এই লুণ্ঠন ও প্যাটেন্টকরণ বন্ধ করতে হবে। প্রাণের ( উদ্ভিদ, প্রাণী, জিন) পেটেন্টকরণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক
পর্যায়ে সম্পূর্ণ অবৈধ। ট্রিপস চুক্তি আবশ্যকীয় মেডিসিন ও অন্যান্য সেবার প্রাপ্যতা
থেকে গণমানুষকে বঞ্চিত করবে এবং এসব জীবন রক্ষাকারী খাদ্য ও ওষুধের দখল, প্রাণবৈচিত্র্য, জেনেটিক সম্পদ ও ঐতিহ্যবাহী
জ্ঞানের মালিকানা বহুজাতিকের কাছে চলে যাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রাণের উপর
প্যাটেন্টকরণ অথবা অন্যান্য বায়োলজিক্যাল সম্পদের উপর মেধাসত্ত আইন কার্যকর করা অবৈধ
করা উচিত। জিন বৈচিত্র্য প্রাইভেত প্রোপার্টি হতে পারে না এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের বায়োপাইরেসি
অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা
ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা এবং তার সুরক্ষা
দেয়া আবশ্যক। কৃষক সমাজের টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনাকে বজায় রাখার স্বার্থেই আন্তর্জাতিক
ট্রেড নীতির আধিপত্য থেকে কৃষি খাতকে সুরক্ষা দিতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে
কৃষকদের জীবন জীবিকা এবং গণমানুষের লোকাল অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করা যাবে না। খাদ্যের
সহজ প্রাপ্যতার মৌলিক অধিকার তখনই বাস্তবায়িত
হবে যখন লোকাল জনগণের খাদ্য সার্বভৌমত্বের
নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভবপর হয়। এর মানে কর্পোরেট নয় বরং কৃষক ও স্থানীয় জনতাই তাদের
নিজস্ব খাদ্যনীতি এবং কৃষি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে এবং লোকায়ত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব
খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনাকে বজায় রাখা হবে যার মাধ্যমে এসব জনপদের ঐতিহ্যবাহী কালচার, জ্ঞানকাণ্ড ও বৈচিত্র্যও সুরক্ষিত হবে
প্যাটেন্ট আগ্রাসনের
কবলে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের হাজার
বছরের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং কৃষিজ
পণ্যের উপর একের পর এক মেধাস্বত্ব অধিকার তথা মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।
বিশ্ববাণিজ্য
সংস্থা থেকে বাংলাদেশের ফজলি আম ও জামদানি শাড়ির
মালিকানা স্বত্ব নিয়ে নিয়েছে ভারত।
ওষধি গাছ নিমের
স্বত্ব নিয়ে গেছে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে ভারত।
বাসমতির স্বত্ব
নিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী
নকশিকাঁথাকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ভারত বিশ্ববাণিজ্য
সংস্থার কাছে এর মালিকানা স্বত্বও দাবি করে রেখেছে । জিএম প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব
বেগুনের নয়টি জাতকে জেনেটিকালি পরিবর্তিত করে এসব বীজের মালিকানাও নিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের
মনসান্তো কোম্পানি।
এভাবে একের পর
এক আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পণ্য, ওষধি গাছ এবং কৃষিজ শস্যের
মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং এসব পণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের
কর্তৃত্ব।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং হারবাল ওষুধ বিজ্ঞানকে বহুজাতিক কোম্পানির
পেটেন্ট আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে হলে দরকার আমাদের লোকায়ত জ্ঞানের সংরক্ষন এবং রক্ষণাবেক্ষণ।
এজন্য একদিকে সরকার এবং সচেতন মহলকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারা
অনুযায়ী প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে
হবে।
বর্তমানে দক্ষিন
আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ১১৮টি সংগঠন সব ধরনের প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্ট বন্ধ
করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্টের বিপক্ষে তৃতীয় বিশ্বের
বিভিন্ন দেশের (মেক্সিকো, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া) কৃষক ও আদিবাসীদের বিভিন্ন ফেডারেশন যে প্রতিবাদ
বিক্ষোভ করছে তার সাথে এদেশের কৃষক ও জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। সরকারকে বিশ্ব বাণিজ্য
সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অন্যায্য মেধাস্বত্ব অধিকার আইন বাতিলের জন্য
কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে হবে।