কথিত সেক্যুলার শিক্ষা নয়,মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের মুল
মাদরাসা শিক্ষার
উপর ভিত্তি করেই ছড়িয়েছে জ্ঞান - বিজ্ঞানের আলো।
নাস্তিক – ইসলামবিদ্বেষীরা মাদরাসা
শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কটুক্তি করে থাকে। নাউযুবিল্লাহ। তারা বলে থাকে মাদরাসায় নাকি
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়না। নাউযুবিল্লাহ। কথিত পশ্চিমা ধাচের সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা
নাকি জ্ঞান – বিজ্ঞান শেখানো হয়! নাউযুবিল্লাহ। যার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে
কথিত মুসলমান মাদরাসায় সন্তানদের পড়ানো নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে সন্তানদের ভর্তি করায়না।
অথচ মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের মুল।
ইতিহাস সাক্ষী
অতীতের সকল মুসলিম বিজ্ঞানী , জ্ঞানী-গুনী সবাই মক্তব – মাদরাসায় পড়াশোনা করেই
জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। বেনিয়া বৃটিশ শাসনের পুর্বে মুসলিম শাসনামলে মাদরাসা শিক্ষা
ব্যবস্থাই ছিলো মুল। যেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানের
সকল শাখা সম্পর্কে পড়ানো হত।
মুসলিম শাসনামলের
অবদানঃ
মুসলিম শাসনামলের
শুরু থেকেই মুসলমানরা বাদশাহ, সুলতান, নবাব এবং তাদের বড় রাজ কর্মচারীদের
পদত্ত জায়গীর, আয়মা, আল তগমা, মদ মাশ প্রভৃত্তি লাখেরাজ সম্পত্তি ( নিষ্কর সম্পত্তি যা ওয়াকফ করে দেওয়া হত
) ভোগ করতেন। এসব সম্পত্তির আয় দ্বারা শুধু উনাদের ভরনপোষনই চলতনা, অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ,
ইমামবাড়া, মুসাফির খানাসহ নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠান
পরিচালিত হত।
ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার
সময় বাংলার এক-চতুর্থাংশ সম্পত্তি ছিল নিস্কর। শুধু বাংলাদেশেই ১৮২৮ থেকে ১৮৪৫ সাল
পর্যন্ত কয়েক বছরে অন্তত কুড়ি হাজার নিষ্কর সম্পত্তি বাজেয়াফত হয়। ফলে বহু প্রাচীন
মুসলিম বংশ উৎখাত হয় এবং মসজিদমাদরাসা-খানকাহসহ অসংখ্য মুসলিম শিক্ষা ও জনহিতকর প্রতিষ্ঠান
লুপ্ত হয়।( মুহম্মদ আবদুল মান্নান রচিত ‘ আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা , পৃ ৬০
)
জ্ঞানার্জনে
মুসলমান উনাদের গভীর অনুরাগ ,দ্বীন ইসলামী শিক্ষার উন্নয়নে দ্বীন ইসলাম প্রচারক আলিম উনাদের
উদ্যোগ এবং পন্ডিত, কবি ,বিদ্যান ব্যক্তি
ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহের প্রতি শাসকদের উদার পৃষ্টপোষকতার ফলে মুসলিম শাসনামলের বাংলাদেশে
বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে অভুতপুর্ব জাগরন সৃষ্টি হয়। এ যুগে বিরাট সংখ্যক আলিম ও দ্বীন
ইসলাম প্রচারক বিভিন্ন স্থানে জ্ঞানার্জনের বহু বিখ্যাত কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
মুহম্মদ আবদুল
মান্নান রচিত “ বাংলা ও বাংগালীঃ
মুক্তি সংগ্রামের মুলধারা” নামক বইয়ের
১৫৩ পৃঃ বলা আছে -
"হযরত ওলী-আউলিয়া
রহমতুল্লাহি আলাইহিমগন ও আলেম উনাদের প্রভাবে এবং উনাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কল্যানে
বাংগালী মুসলমানগন অত্যন্ত উন্নত আধ্যাত্মিক , নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের প্রতিনিধিত্ব
করতেন। তেরো শতকের সুলতান রুকনউদ্দীন কায়কাউসের সময় ত্রিবেনীর মাদ্রাসায় উৎকীর্ন একটি
শিলালিপি শিক্ষা সম্পর্কে সে যুগের মুসলমান উনাদের চিন্তা-চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে
“তোমরা জ্ঞানার্জন করো , কেননা জ্ঞানার্জনই প্রকৃত
আত্মনিবেদন , এর অনুসন্ধানই মুহব্বত এবং এর চর্চাতেই পরম গৌরব"।
মুসলিম শাসনামলে
এই দেশে শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি সম্পর্কে আলোচনা প্রসংগে ডক্টর এম এ রহিম
লিখেছেন –
“ মুসলমানামলের শিক্ষা ও
জ্ঞান গরিমা নানাভাবে বাংলার দ্বীনি ও সাংস্কৃতিক জীবনকে উন্নত করে তোলে। ফলে দেশে
এক অভুতপুর্ব আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরন দেখা দেয়। বাংগালী সমাজের সর্বস্তরে
শিক্ষার প্রসার ঘটে। জ্ঞানালোপদীপ্ত মুসলিম শাসন ও শাসকদের উদার শিক্ষানীতির প্রভাবে
যুগযুগব্যাপী বন্ধনদশা থেকে নিন্মশ্রেনীর হিন্দুদের বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি সম্ভব হয়।
এতদ্ব্যতিরেকে , মুসলমানগন বহু নতুন নতুন শিক্ষা কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠান
গড়ে তোলেন, যার ফলে বাংলাদেশের শিক্ষার দ্রুত উন্নতির ও শিক্ষা
বিস্তারের পথ সুগম হয়। মুসলমান উনারাই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস প্রবর্তন করেন এবং
লেখ্যবস্তুরুপে কাগজের প্রচলন করেন।পুস্তক নকল করে প্রচারের রীতি প্রবর্তন করার জন্য
বাংলাদেশ মুসলমান উনাদের নিকট ঋণি”। ( ডক্টর এম এ রহিমঃ বাংলার
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, পৃ ২৩৪-২৩৫ )
শিক্ষার প্রতি
মুসলমান উনাদের ব্যাপক আগ্রহ এবং এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দুদের মাঝেও ব্যাপক প্রভাব
বিস্তার করে। এ প্রসংগে ডক্টর এম রহিম ‘বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ , পৃ ২১৬-২২৭ বলেছেন যে
-
" মুসলমান
উনাদের পুর্বে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রধানত ব্রাম্মনদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো এবং যে কোন
প্রকারের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিন্মবর্নের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার নিষীদ্ধ ছিলো। ব্রাম্মনগন
তাদের শাস্ত্র জ্ঞানের চর্চায় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখত।--- মুসলিম শাসন প্রবর্তিত
হওয়ার কারনে সুবিধাভোগী হিন্দুদের কবল থেকে ভাগ্যাহত ও বঞ্চিত হিন্দুরা মুক্তিলাভ করে
এবং চিরকালের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। মুসলমান শাসনাধীনে
অব্রাম্মনদের পক্ষে শিক্ষা গ্রহনে ব্রাম্মনদের অসন্তুষ্টি উদপাদনের আর কোন ভয় ছিলোনা।
কেননা মুসলিম শাসন ব্যবস্থা মুসলমান-অমুসলমান , উচ্চ-নিচ সকল শ্রেনীর লোকের নিকট পার্থিব,
আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির জন্য সমান সুযোগ এনে দেয়। এভাবে
মুসলমান আমলে হিন্দু সমাজের অন্ত্যজশ্রেনীর মধ্যেও শিক্ষার প্রসার হয় এবং বঞ্চিত ও
অবহেলিত লোকেরা বিদ্যার্জন করে জীবনে উন্নতি করার সমান সুযোগ পায়"।
কেমন ছিলো
মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থা?
মুসলিম শাসনামলে
শিক্ষা খুবই সহজলভ্য ছিলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছিলো জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বশি। শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সম্পর্কে ম্যাক্সমুলার
উল্লেখ করেছে যে “ ইংরেজদের ক্ষমতা দখলকালে বাংলায় ৮০ হাজার মক্তবের অস্তিত্ব ছিল।
প্রতি ৪০০ লোকের জন্য তখন একটি মাদরাসা ছিল”। ( সুত্রঃ মুহম্মদ
আবদুল মান্নান রচিত “আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা” , পৃ ৬০ )
মুহম্মদ আবদুল
মান্নান রচিত “ বাংলা ও বাংগালীঃ
মুক্তি সংগ্রামের মুলধারা” নামক বইয়ের
১৫৪-১৫৫ পৃঃ বলা আছে -
মুসলিম শাসনামলে
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন হয়। উইলিয়াম এডাম এর ১৮৩৫ খৃঃ সে সম্পর্কে
কিছু ধারনা পাওয়া যায়। বাংলার শিক্ষার তৎকালীন অবস্থার উপর জরিপ চালিয়ে সে উল্লেখ করে
যে “বাংলা ও বিহারে পাচ থেকে পনেরো বছর বয়সের
প্রতি ৩০০ জনের বেশি অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর জন্য তখন একটি গ্রাম্য বিদ্যালয় ছিল”। (উইলিয়াম এডামঃ শিক্ষা রিপোর্ট ১৮৩৫-৩৮
, কলকাতা পৃ
৬-৭ )
“এডাম এর এই রিপোর্ট প্রনয়নকালে বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক ও
অর্থনৈতিক অবস্থা বিধ্বস্থ ছিল। মুসলিম শাসনামলে উনাদের সমৃদ্ধির যুগে শিক্ষার অবস্থা
অনেক বেশি উন্নত ছিল। প্রাথমিক মক্তব ও পাঠাশালার সংখ্যাও ছিলো অনেক বেশি। মুসলমান
উনাদের সামর্থ বেশি ছিলো বলে উনাদের মধ্যে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্তা চালু ছিলো”। ( ডক্টর এম এ রহিমঃ বাংলার সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক ইতিহাস, পৃ ২১৫ )
মুসলিম শাসনামলে
শিক্ষা খুবই সুলভ ছিলো। শিক্ষার পদ্ধতিও ছিলো যথেষ্ট উন্নত। মুসলিম শাসনামলের শিক্ষার
অবস্থা সম্পর্কে এইচ জে রাওলিনসন লিখেছে –
“ মুঘল ভারতের উন্নততর শিক্ষা
সংস্কৃতি যথেষ্ট পরিমানে তাদের শিক্ষা পদ্ধতিরই ফসল। শিক্ষা দ্বীনি কর্তব্য হিসেবে
পরিগনিত হত। ধণী পিতামাতার সন্তানকে ৪ বছর বয়সে কুরআনের একটি আয়াত উৎকীর্ন করা পাথর
বসানো শ্লেট দিয়ে একজন শিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়া হত। আর গরীব পিতা মাতার সন্তানকে মৌলভী
উনাদের দ্বারা পরিচালিত মক্তব বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হত। প্রতিটি মসজিদের সাথেও
একটি মক্তব ছিলো”।( এইচ জে রাওলিসনঃ india – a short cultural history, পৃ ৩৭২ )
বিভিন্ন সুত্র
থেকে জানা যায় , মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম শাসনামলে পাঠ্য বিষয়রুপে পবিত্র কালামুল্লাহ
শরীফ,পবিত্র হাদিস শরীফ,দ্বীনতত্ত্ব,ফিক্বহ , আইনশাস্ত্র ও অন্যান্য দ্বীন ইসলামী বিষয়ের
পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যা, অংকশাস্ত্র , চিকিৎসাবিদ্যা
, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা , কৃষি, জ্যামিতি , গার্হস্থ্য বিদ্যা
, সরকারী আইনকানুন, রাষ্ট্র বিজ্ঞান,
শাসন কৌশল , ইতিহাস ইত্যাদি পাঠ করানো হত।
ইউরোপিয় পর্যটক
বার্নিয়ার ও মানুচি উল্লেখ করে যে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যায়ন ও রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে
মুসলমান উনারা ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ এর পদ্ধতি অনুসরন করতেন।
উইলিয়াম এডাম
এমনকি উনিশ শতকের প্রথমার্ধেও বাংলার মাদরাসা গুলোতে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যায়ন চালু
থাকতে দেখেছে।সে তার ১৮৩৫ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করে যে –
“ দ্বীন ইসলামী বিষয়াদি ছাড়াও
প্রকৃতি বিষয়ক দর্শন এবং সাধারন দর্শন শাস্ত্রের গ্রন্থাদির সাথে জ্যামিতি এবং জ্যোতিষশাস্ত্র
মাদরাসাগুলোতে পড়ানো হত”। (উইলিয়াম এডামঃ শিক্ষা রিপোর্ট
১৮৩৫-৩৮ , কলকাতা পৃ
৬-৭ )
হিন্দুদের শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মুসলমান উনাদের তৎকালীন মাদরাসাগুলির তুলনা করে উইলিয়াম এডাম
লিখেছে –
“ এ দেশে মুসলমান উনাদের
অনুসৃত পাঠ্য পদ্ধতি হিন্দু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রচলিত পাঠ্য বিষয়ের তুলনায় অনেক
বেশি ব্যাপক ও উদার ছিলো। এই পাঠ্যক্রম অনুসরন করে শিক্ষিত ব্যক্তিরা বুদ্ধিবৃত্তিক
শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করত”। ( উইলিয়াম এডামঃ সেকেন্ড
রিপোর্ট , পৃ ২৬-২৭
)
তৎকালে মুসলমান
উনাদের শিক্ষা সন্বন্ধে উইলিয়াম এ্যাডাম (Willim Adam) মন্তব্য করে যে, “এ দেশে মুসলিমগন বহু বেসরকারী বিদ্যালয়
স্থাপন করেছিলেন এবং উনারা শিক্ষাকে পেশা ও জীবিকা নির্বাহের উপায় বলে গ্রহন করেননি।
উনারা একে ন্যায় ও নেকীর কাজ বলে মনে করতেন। সে আমলে প্রথম পর্যায়ের শিক্ষা বাংলা ভাষার
এবং উচ্চ শিক্ষা আরবী ও ফারসী ভাষার দেয়া হত। কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর ভারতীয় মুসলিমগণ
ফারসী ও উর্দুভাষা ব্যবহার করতেন। মুসলমান সমাজের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে মেয়েরা মসজিদে
পবিত্র কুরআন শরীফ শিক্ষার সাথে এক বা একাধিক বিষয় যেমন বাংলা, গনিত, আরবী, ফারসী ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতেন। বিত্তশালী
লোকেরা নিষ্কর জমি, ওয়াকফ ও লাখেরাজ সম্পত্তি দান করে এ শিক্ষা
ব্যবস্থা উৎসাহ দিতেন”। [মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল,বাংলাদেশ জেলা গেজেটীয়ার
বৃহত্তর যশোর)
কিভাবে মুসলিম
শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে কথিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিলো?
১৮৩৭ সালে বর্বর
বৃটিশ বেনিয়ারা অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ফার্সির স্থলে ইংরেজি চালু হয়।অথচ বেনিয়া বৃটিশেরা
ক্ষমতা দখলের পরেও ৮০ বছর ফার্সী ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে চালু ছিলো। এর ফলাফল হল
এই, লক্ষ লক্ষ
মুসলিম যারা সরকারী বিভিন্ন পজিশনে চাকুরী করতেন উনারা বেকার হয়ে গেলেন,উনাদের জীবনে নেমে এল ঘোর অন্ধকার।ফার্সি ভাষা শেখার ব্যাপারেও আর আগ্রহ থাকল
না।ফলে ফার্সিতে রচিত বিপুল সংখ্যক সাহিত্য ভান্ডার থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল পরবর্তী প্রজন্মের
মুসলিমরা।
বছরের পর বছর, শতকের পর শতক ফার্সিতে
যে সাহিত্য মুসলিম জ্ঞানী-গুনীজন তৈরি করেছিলেন তার সাথে বাংলার মুসলিমদের সংযোগ এক
প্রকার হারিয়েই গেল। জাতি হিসেবে মুসলমান উনাদের এত বড় ক্ষতি মনে হয় আর কোনটাই নয়।
একই সাথে ১৭৭৩
সালে ‘ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ মাধ্যমে লাখেরাজ সম্পত্তির
(ওয়াকফ) মালিকানা বাদ দেয়ার ফলে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, মক্তব ( যাদের খরচ নির্বাহ হতে এই সম্পত্তি
থেকে ) বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আরবী শিক্ষাও হয়ে পড়ে কষ্টকর। কেননা পুর্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
পড়ার জন্য বেতনতো দিতেই হতনা বরং মুঘল আমলে ছাত্রদেরকে বৃত্তি দেয়া হত।ধীরে ধীরে শিক্ষা
সংকুচিত হয়ে পড়ে মুসলিম সমাজে।
১৮৪৪ সালে হার্ডিঞ্জ ঘোষনা করে যে, ইংরেজিতে ডিগ্রীপ্রাপ্তরাই সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবে।
ইংরেজদের এই সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তগুলো মুসলমান উনাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার ওপর একের পর
এক আঘাত হানে। ১৮১৪ সালে ইংরেজ সরকার ভারতবাসীর শিক্ষার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ
করে। শিক্ষাখাতে তারা বার্ষিক এক লাখ টাকা ব্যয় বরাদ্দ করে। অথচ অন্যদিকে ১৮১৬ সালে
তারা মুসলমান উনাদের শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত হাজী মুহাম্মদ মুহসিন ওয়াকফ
তহবিলের সাড়ে বাইশ লাখ টাকা হস্তগত করে। মুসলমান উনারা ৫৫,০০০ টাকা বার্ষিক আয়ের সাড়ে বাইশ লাখ টাকার তাদের এই নিজস্ব তহবিল থেকে নিজেরাই
যদি ব্যয় করতে পারত, তবে সরকারি সাহায্যের কপর্দকমাত্র
ছাড়াই তারা সারা দেশে নিজেদের শিক্ষার অনেকাংশের ব্যয়-সংকুলান করতে পারত। (
মুহম্মদ আবদুল মান্নান রচিত ‘আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা’ , পৃঃ ৬১ )
১৮৫৪ সালে Wood’s Despatch নামে একটি শিক্ষা কমিশন হয় বৃটিশ প্রশাসনের
পক্ষ থেকে।পানিদস্যু , সন্ত্রাসী চার্লস উড ছিল ভারত কন্ট্রোল
বোর্ডের প্রেসিডেন্ট।তার রিপোর্টের প্রস্তাবনা অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ইউনিভার্সিটি
পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে ভারতে শিক্ষা কাঠামো তৈরি হয়।
প্রাথমিক স্তরে, মাধ্যমিক স্তরে এবং উচ্চশিক্ষা
স্তরে কিভাবে কি পড়ানো হয়ে তার বিভাগ করে দেয়া হয়। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি
এবং প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় ভাষাকে গ্রহণ করা হয়। দেশীয় ভাষা শিক্ষা
দেওয়ার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইঙ্গ-দেশীয় ভাষা মাধ্যমিক
বিদ্যালয় ও অনুমোদিত কলেজগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি
অনুদান পেতে শুরু করে (Ali Riaz, 2010).
এই প্রথম পশ্চিমা
শিক্ষা (যাকে বলা হল কথিত স্যাকুলার শিক্ষা) এবং দ্বীনি শিক্ষা আলাদা হয়ে গেল। মাদরাসা
শিক্ষাকে রাখা হল ব্যক্তিগত পর্যায়ে ( নাউযুবিল্লাহ )। আর কথিত স্যাকুলার শিক্ষায় সরকারী সাহায্য
পেতে হলে ইংরেজি শিখতে হবে এমন শর্ত দিয়ে দেয়া হল। এভাবে করে মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী
শিক্ষা ব্যবস্থা (যেখানে দ্বীন ও দুনিয়া দুটোরই সমন্বয় ছিল) ও মাদরাসাগুলো পৃষ্ঠপোষকতার
অভাবে ধীরে ধীরে আরো সংকুচিত হয়ে পড়লো।
মোদ্দাকথা, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে
বাস্তব অর্থে একটি হিন্দু রেনেসাঁস ঘটে যায় বাংলায়। দুঃখজনক হল, এই হিন্দু রেনেসাঁস কে ‘বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁস’ বলা হয়ে থাকে ( এম আর আখতার মুকুল, ১৯৮৭)
এবং এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের বর্তমান ভাষা, সাহিত্য, কবিতা এমনকি পাঠ্যপুস্তক। নাউযুবিল্লাহ।
উপরোল্লিখিত
ইতিহাসে সহজেই প্রমানিত যে ব্রিটিশ আমলের পুর্বে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞান
চর্চার অন্যতম সুতিকাগার। যে ইতিহাসকে বৃটিশেরা হিন্দুদের সহযোগীতায় মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা
করেছিলো।
যার প্রেক্ষিতে
তারা বীজ বপন করে দ্বীনহীন, জ্ঞান বিজ্ঞান বিহিন শিক্ষা ব্যবস্থার। যার রেশ এখনো মুসলমান বহন
করছে। বর্তমান সিলেবাস বৃটিশদের আশা আকাংখারই প্রতিফলন।
লক্ষ্য কি ছিলো
?
এ সম্পর্কে অধ্যক্ষ
মুহম্মদ আলমগীর রচিত ‘ ইতিহাসের আলোকে আমাদের শিক্ষার ঐতিহ্য ও প্রকৃতি’ বইয়ের ৪৬ পৃঃ বলা আছে
-
“ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসেও দেখা যায় যে, ব্রিটিশ শাসকরা তদানী
ভারতবর্ষকে ‘ইউরোপীয় করার জন্যে ইংরেজী সভ্যতার আলোকে ভারত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন
করেছিল। তারা ভারতের প্রচলিত নৈতিকতা, মানবতা সমৃদ্ধ উর্দু ও ফারসি ভাষাকে তুলে দিয়ে
তদস্থলে ইংরেজি ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষায় অভিষিক্ত করে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চালু করে সর্বত্র।” (Selection fro Educational Research
Part 1, P. 23).
টমাস ব্যারিংটন
মেকলের পরামর্শে সৃষ্ট ১৮৩৫ সালে শিক্ষা সংক্রান্ত আইনবলে কেবলমাত্র ইংরেজি স্কুল ছাড়া
অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি সাহায্য লাভের অনুপযুক্ত ঘোষিত হয়। ইংরেজ প্রবর্তিত
শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্য ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক থেকে মুসলমান উনাদের চিন্তা-চেতনায়
সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিল। এ সম্পর্কে মেকলের উক্তি থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সে
বলে :
“বর্তমানে আমাদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে, সমাজে যারা শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। তারা রক্ত-গোশত
গড়নে ও দেহের রঙে ভারতীয় হবে বটে কিন্তু রুচি, মতামত ও বুদ্ধির দিক দিয়ে হবে খাটি ইংরেজ।”
(Woodrow : Macaulay's Minutes on Education in India (1862]) | এই মেকলের মেজাজ ও মানসিকতা সম্পর্কে তার আর একটি দম্ভোক্তি
থেকে জানা যায়। সে একবার বলেছিল : “ইউরোপীয় যে কোনও ভালো লাইব্রেরির একখানি মাত্র আলমারী ভারত ও আরবের সমগ্র দেশীয়
সাহিত্যের চেয়েও বেশি মূল্যবান।"( মুহম্মদ আবদুল মান্নান রচিত ‘আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা’ , পৃঃ ৬১ )
যার বাস্তব প্রতিফলন
আজ কথিত মুসলিম সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আজকে কথিত মুসলমান রক্তে ,বর্নে মুসলমান কিন্তু কাজ-কর্মে,
চাল-চলনে, কথা-বার্তায়, আচার-আচরনে,
পোষাক-আষাকে , শিক্ষা-দীক্ষায় সকল কিছুতে পশ্চিমাদের
অনুসরন-অনুকরন করছে। নাউযুবিল্লাহ। যার মুলে রয়েছে বৃটিশ কতৃক প্রনীত কথিত সেক্যুলার
নামক শিক্ষা ব্যবস্থা।
কথিত মুসলমান
যদি নিজের মুসলমানিত্ব বজায় রাখতে চায় তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন করার আন্দোলনে
এগিয়ে আসতে। নাস্তিক্যবাদী সিলেবাস বাতিল করে দ্বীন ইসলাম ভিত্তিক সিলেবাস প্রনয়ন করতে
হবে।