বসনিয়ার যুদ্ধের কথা আমরা অনেকেই জানি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটিই ছিলো বিশ্বের প্রথম বড় সামরিক সংঘাত। এই সংঘাতের প্রায় পুরোটা জুড়েই বসনিয়াক মুসলিমদের গণহত্যা ঠাঁসা থাকলেও এর মূলে ছিলো একটি নোংরা ভূরাজনৈতিক খেলা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা অক্ষ কতৃক সাবেক সোভিয়েত সাম্রাজ্যের আঙ্গিনা বলকান উপদ্বীপে প্রবেশের চেষ্টার বিভিন্নমুখী তৎপরতার বহিঃপ্রকাশ ছিলো বলকান যুদ্ধ। সেই খেলায়ও যেমন মুসলিমরা ঢালে পরিণত হয়েছিলো, তার দুই দশক পর আরাকানেও হুবহু একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে দুটিতেই বাংলাদেশ জড়িত হয়েছে।
.
এরমধ্যে বসনিয়ায় জড়িত হওয়াটা বিস্ময়ের উদ্রেককারী হলেও সত্যি হচ্ছে, বাংলাদেশ কেবল জড়িতই হয়নি, একটা সময় পর্যন্ত হানাদার সার্ব মিলিটারী, এমনকি পশ্চিমা মিডিয়া পর্যন্তও সন্দেহ করেছে যে, জাতিসংঘের পতাকা নিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে সার্বদের বিরুদ্ধে বসনিয়ার বাহিনীকে সাহায্য করে একটি শহরে তিন বছর ধরে চলা সার্ব অবরোধ ব্যহত করেছে! এর জন্য ১২০০ সৈন্যের বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টকে তীব্র গোলাগুলিতে প্রায় দশ সপ্তাহের অবরোধে আটকে থাকতে হয়, এবং মারাত্মক রসদ ও সরঞ্জাম সংকটে ভুগতে হয়!
.
বস্তুত, বসনিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ন্যাটো দেশগুলো সীমিত মাত্রায় শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করছিলো। তবে ১৯৯৩ নাগাদ যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো বসনিয়া থেকে সরে পড়তে থাকে। তখন আমেরিকা ধর্মীয় অনুভূতির সুবিধা কাজে লাগাতে মুসলিম দেশগুলো থেকে জাতিসংঘের আওতায় শান্তিরক্ষী বসনিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা শুরু করে। ১৯৯৩ সালে এমনই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি কন্টিনজেন্ট বসনিয়ায় পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। বাংলাদেশ আর্মির কয়েকজন অফিসার রেকোনাইসেন্স মিশনে তখন বসনিয়ার আশেপাশে ঘুরেও আসেন।
.
কিন্তু বসনিয়ায় তৃতীয় কোন মুসলিম দেশ থেকে সেনা পাঠানোর বিষয়টি এতো সরল ছিলোনা। খোদ ইউরোপীয় দেশগুলোই বলকানের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে অন্য কোন মুসলিম দেশের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখতে রাজী ছিলোনা। ঐতিহাসিক ভীতি ছাড়া এর পেছনে কোন বাস্তব কারণ ছিলো বলে মনে হয়না।
প্রাথমিক বাঁধায় বাংলাদেশ থেকে সেনা বসনিয়ায় পাঠানো যায়নি। যে ব্যাটালিয়নটিকে বসনিয়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিলো, তাকে পরে কুয়েতে পাঠানো হয়।
.
১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি বসনিয়ার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে পড়লে এবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কোন প্রস্তাব উত্থাপন না করেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া থেকে সৈন্য পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশকে মাত্র ৪৫ দিনের নোটিশে একটি মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন প্রস্তুত করতে বলা হয়।
মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রির প্রধান উপাদান এপিসি। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ আজকের মতো ভুরিভুরি এপিসির মালিক ছিলোনা। এছাড়াও বলকানের তীব্র ও আদ্রতায় পূর্ণ শীতে যুদ্ধ দূরে থাক, থাকার অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশী সৈন্যদের ছিলোনা।
.
এই সমস্যা নিরসনে সোভিয়েত আমলে স্লোভাকিয়ায় চালু হওয়া সাবেক পূর্ব জার্মান সেনাবাহিনীর একটি ওয়ারহাউস থেকে রসদ, শীতের কাপড় এবং অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।
১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশী কন্টিনজেন্ট প্রথম বসনিয়ায় প্রবেশ করে। এই কন্টিনজেন্টে ছিলো একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, এবং একটি করে ওয়ার্কশপ, লজিস্টিকস সাপোর্ট, মেডিকেল ও সিগনাল ডিটাচমেন্ট। কর্নেল সেলিম আখতারের নেতৃত্বাধীন ১২০০ লোকবলের এই কন্টিনজেন্টের উপর দেয়া হয়
.
১৯৯২ সাল থেকে সার্বিয়ার অবরোধের সম্মুখীন হওয়া বিহাচ শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব। বিহাচ মূলত চারিদিকে খ্রীষ্টান অধ্যুষিত একটি ছোট্ট মুসলিম ছিটমহল। এখানে বসনিয়ানরা স্বভাবতই চাপে ছিলো এবং সার্বরা অবরোধ কষছিলো। বিহাচে কিছুদিন আগেও একটি ফরাসী ব্যাটালিয়ন ছিলো, যারা আর এখানে থাকতে চাচ্ছিলো না। তারা উইথড্র করার পর যুদ্ধ আর অবরোধে পস্ত বিহাচে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
💣 বাংলাদেশী ফোর্স গমনে হঠাৎ পরিস্থিতি বদলে গেলো 💣
তিন বছর অবরুদ্ধ থাকার পর বসনিয়ান বাহিনী সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সার্বদের উপর তীব্র আক্রমণ হানে। এই হামলায় সার্বরা পরাজিত হয়। বিহাচের আশেপাশে বেশ কিছু সার্ব জমি বসনিয়ানরা কেবল দখলই করেনি, তাদের তীব্র হামলার মুখে পলায়নপর সার্বদের ফেলে যাওয়া হাতিয়ারসম্ভারও তারা দখলে নিয়ে নেয়।
.
এই ঘটনার পর সার্ব বাহিনী ধরে নেয় তাদের এহেন বিপর্যয়ের পেছনে বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত বাহিনীর ভূমিকা আছে, যাদের সকলেই মুসলিম। এমনকি এই সময়ে জাতিসংঘের নিয়োগকৃত পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরাও সন্দেহ করতে শুরু করে, বাংলাদেশ আর্মির উপস্থিতিই বসনিয়ান বাহিনীকে সার্বদের উপর হামলা করে তাদের খেদিয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পশ্চিমা মিডিয়াও সেসময় বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের বিরুদ্ধে নেতিবাচক খবর প্রচার শুরু করেছিলো বলে ফোর্স কমান্ডার বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সেলিম আখতার জানান।
.
যাহোক, বিপর্যয়ের শিকার হবার পর সার্ব বাহিনীর নতুন লক্ষ্যবস্তু হয় বাংলাদেশী কন্টিনজেন্ট। সার্বরা প্রথমে বাংলাদেশীদের উপর তীব্র অবরোধ আরোপ করে। এমনকি হেলিকপ্টারেও খাদ্য ও রসদ সরবরাহের পথও রূদ্ধ হয়ে যায়।
এরইমধ্যে ডিসেম্বরে সার্বরা এন্টি ট্যাংক মিসাইল সহ বাংলাদেশী সেনাদের উপর হামলা করলে ইসমাইল নামে একজন সৈনিক শহীদ হন এবং আরো তিন সৈনিক আহত হয়।
.
এদিকে বাংলাদেশী সৈন্যদের বিহাচে অবরুদ্ধ ও হামলার সম্মুখীন হবার ঘটনায় বাংলাদেশে ব্যাপক উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। ঢাকায় সেনা সদর থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশী ফোর্স কমান্ডারকে প্রয়োজনীয় নসিহত দেয়ার কাজ চলতে থাকে। এমনকি বাংলাদেশী বাহিনীকে দ্রুত উদ্ধারের দাবী জানিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভের আয়োজনও করা হয়।
.
তখন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের অভিযান ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান। তিনি কর্নেল সেলিম আখতারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি ঢাকাস্থ মার্কিন ও সৌদি মিলিটারী অ্যাটাশের সাথে যুক্ত থাকেন। আমেরিকা ও সৌদি আরবের মাধ্যমে ন্যাটো ও ওআইসির মাধ্যমে বাংলাদেশী সৈন্যদের অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে বাংলাদেশ। এই প্রক্রিয়ার উপর এপি একটি প্রতিবেদন করে, যার ভিডিও ফুটেজ এখানে দিলাম- https://youtu.be/c80r5IoJRa8
..
প্রায় দশ সপ্তাহ অবরোধে বাংলাদেশী সৈন্যরা উচ্চতর সাহস ও দৃঢ়তার নজির স্থাপন করে। তারা খাদ্য ও রসদ সংকটে কাবু হয়ে পড়লেও সার্বদের তাদের উপর চেপে বসতে দিচ্ছিলো না। একবার এক তরুণ ক্যাপ্টেন তার এপিসির টিম নিয়ে বসনিয়ান পজিশনের কাছে অবস্থান নিতে গেলে সার্বরা তীব্র আক্রমণ চালায়। তবে তারপরও ওই বাংলাদেশী ক্যাপ্টেন স্বীয় অবস্থান ত্যাগ করেননি। সাধারণত কোন ভাড়াটে মিশনে এমন দৃঢ়তা দেখা যায়না।
.
অবরোধ শেষ হয় ন্যাটো বিমান হামলার ঘনঘটার মাধ্যমে। ন্যাটো প্রথমে ব্যাপক বিমান হামলার প্রস্তাব করলেও বাংলাদেশের প্রস্তাবে বিহাচে নির্বিচার বোমা হামলার বদলে কেবল সার্ব অবস্থান লক্ষ্য করে এয়ার স্ট্রাইক করে ন্যাটো। এতে করে বিহাচের মুসলিম অধিবাসী এবং বসনিয়ান সৈন্যরা অপ্রয়োজনীয় রক্তক্ষরণ থেকে রক্ষা পায়। একই সাথে হানাদার সার্বদের মনোবলে চিড় ধরায় ওই বিমান হামলা। যা কয়েকমাস পর বিহাচ থেকে চার বছর ধরে চলা সার্ব অবরোধের সমাপ্তি নিশ্চিত করে।
অতঃপর এমন অনেক গর্ব করার মতো বিষয়ের মতো বিহাচ অবরোধের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশের ভূমিকাও লোকান্তরে হারিয়ে গেছে…।