ইতিহাসের সাক্ষী
উনিশ শ' পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ব্রিটেনে ফাঁসি কার্যকরের জন্য সবচেয়ে নামকরা জল্লাদ ছিলেন আলবার্ট পিয়েরপেয়ন্ট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির দু'শতাধিক নামকরা যুদ্ধাপরাধী এবং ব্রিটেনের অনেক কুখ্যাত খুনিসহ চারশরও বেশি লোককে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছিলেন এই আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট।
তবে তিনি বলতেন, তাদের অপরাধ যাই হোক - দন্ড কার্যকরের সময় তাদের সাথে সবসময়ই সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেছেন তিনি।
১৯৪০ এবং ৫০-এর দশকে আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট ছিলেন ব্রিটেনের প্রধান জল্লাদ। সেই সময়টায় ব্রিটেনে হত্যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। এলবার্টের কাছে এই ফাঁসি দেবার কাজটা ছিল একটা পারিবারিক পেশার মতোই - কারণ তার বাবা ও কাকাও ছিলেন সরকারের তালিকাভুক্ত জল্লাদ।
আলবার্ট পিয়েরপয়েন্টের জন্ম ১৯০৫ সালে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে ছিল - বাপ-চাচার পথ অনৃসরণ করে একজন জল্লাদ হবার, এবং সে কথা তিনি একবার স্কুলে 'আমি কি হতে চাই' শীর্ষক এক রচনায় লিখেওছিলেন ।
আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট তার ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ পেলেন ১৯৩২ সালে।
তার একটা ইন্টারভিউ নেয়া হলো , আর একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্স হলো । তার পর তিনি একজন সহকারী হিসেবে জল্লাদের সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেন।
বলা বাহুল্য জল্লাদদের প্রতিদিন কাজ করতে হতো না, সুতরাং আলবার্ট টাকা পেতেন কাজের ভিত্তিতে । এর বাইরে বেশির ভাগ সময়ই আলবার্ট কাজ করতেন একজন দোকানদার হিসেবে ।
পরে তিনি একটা পাব চালানোর চাকরিতে ঢুকলেন। তবে তার দ্বিতীয় পেশা যে জল্লাদের কাজ করা - সে ব্যাপারে আলবার্টকে কড়া গোপনীয়তার রক্ষা করতে হতো। তিনি এমনকি তার স্ত্রীকেও বলেন নি। তবে তার স্ত্রী নিজেই পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন।
আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট প্রধান জল্লাদ হিসেবে প্রথম কাউকে ফাঁসি দেন ১৯৪১ সালে। এবং এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আলবার্ট তার কাজে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ।
ফাঁসি দেবার সময় তিনি অত্যন্ত শান্ত থাকতেন, তার আচরণ ছিল নম্র, এবং ব্যাপারটা সেরে ফেলতে পারতেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।
"আমাদের কারাগারে যেতে হতো বিকেল চারটার দিকে। সেখানে আমাদের গভর্নরের সাথে দেখা হতো, তার সাথে কথাবার্তা সেরে নিতে হতো। এর পর ফাঁসির নানা আয়োজন সম্পন্ন করা, ফাঁসির মঞ্চটি প্রস্তুত করা, এ সব করতে হতো।"
"ফাঁসি দেবার আসল জিনিসটা হচ্ছে যেটাকে বলে 'ড্রপ' - অর্থাৎ দন্ডিতের পায়ের নিচে যে পাটাতনটা থাকে সেটা সরে গেলে কতখানি নিচে পড়ার পর তার গলায় বাঁধা দড়িতে টান পড়বে। কার 'ড্রপ' কতটা হবে - তা দন্ডিত ব্যক্তির বয়েস কতো, তার উচ্চতা এবং ওজন কতো - এর ওপর নির্ভর করে । একটা ফাঁসি ভালোভাবে এবং পরিচ্ছন্নভাবে কার্যকর করতে হলে এই 'ড্রপ' হিসেব করতে হয় - লোকটার বয়েস, উচ্চতা এবং ওজনের ওপর ভিত্তি করে।"
পিয়েরপয়েন্টকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তিনি যখন একজন দন্ডিত ব্যক্তিকে তার কারাকক্ষে দেখতে যান - তার পর তার দন্ড কার্যকর হতে কত সময় লাগে?
এটা নির্ভর করে কোন কারাগারে ফাসিটা হচ্ছে। কোনো কারাগারে কনডেমড সেল থেকে ফাঁসিমঞ্চ খুবই কাছে, কোনোটাতে হয়তো তা জেলের আরেক প্রান্তে। এমনও হয় যে ফাঁসির ব্যাপারটা মাত্র ১৬ সেকেন্ডে শেষ হয়ে যায়।
ব্রিটেনের এক নম্বর জল্লাদ হিসেবে আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট ব্রিটেনের সবচাইতে কুখ্যাত খুনিদের ফাঁসি দিয়েছেন।
পিয়েরপয়েন্ট তার এই পেশার কথা সযত্নে গোপন রাখতেন। তিনি এ জন্য গর্ববোধও করতেন।
কিন্তু তার পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সরকার যখন ঘোষণা করলো যে প্রায় ২শ দন্ডিত নাৎসী যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য তাকে জার্মানি নিয়ে যাওয়া হবে - তখন ব্রিটেনেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
পিয়েরপয়েন্ট সবসময় জোর দিয়ে বলতেন , তিনি মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সময় কোনরকম আবেগ প্রকাশ করতেন না।
তবে একবার একজন লোকের ফাঁসি তিনি কার্যকর করেছিলেন - যিনি তারই পাবে ক্রেতা হিসেবে আসতেন। মাঝে মাঝে তারা একসাথে গানও গেয়েছেন। কিন্তু লোকটির নাম তার জানা ছিল না । তাই পিয়েরপয়েন্ট তাকে দেখার আগে বুঝতেই পারেন নি যে আজ তাকে পরিচিত একজনের ফাঁসি কার্যকর করতে হবে।
"আমি যখন সকালে তার সাথে দেখা করতে গেলাম, লোকটি প্রথমেই আমাকে বললো, হ্যালো টশ। আমি তো স্তম্ভিত । বললাম, 'হ্যালো টশ তুমি কেমন আছো?" সে বললো "আমি ঠিক আছি'। সবকিছুর পরও আমরা তো সবাই মানুষ। আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম, একেবারে তাজ্জব যাকে বলে। তবে আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব নির্বিকার থাকার।
১৯৫৬ সালে আলবার্টের সাথে পারিশ্রমিকের পরিমাণ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবাদ হলো, তিনি পদত্যাগ করলেন।তার কখনো তিনি ওই চাকরিতে ফেরেন নি।
আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট তার পেশাদার জল্লাদের জীবনে চার শতাধিক লোককে ফাসি দিয়েছিলেন। তার মধ্যে নারী ,পুরুষ, তরুণ, বৃদ্ধ - সব রকমই ছিল।
"আমি কখনোই সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবি না যে আজ আমি কি করতে যাচ্ছি। আমি আজও ভাবি না। যখন জল্লাদ ছিলাম তখনো ভাবি নি। এটা আমার মনের ওপর কোন প্রতিক্রিয়া ফেলে না। কারণ আমি মনে করি আমি শুধু আমার কর্তব্য পালন করছি। বরং - আমি আজ কাজটা ভালোভাবে করেছি - এ কথা ভাবলেই আমার মনটা পরিষ্কার হয়ে যায়।"
জল্লাদের কাজ থেকে অবসর নেবার পর পিয়েরপয়েন্ট তার পাব-এর ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হত্যার অপরাধে মৃত্যুদন্ডের বিধান স্থগিত করে আইন পাস করে। আর মৃত্যুদন্ড পুরোপুরি উচ্ছেদ করা হয় ১৯৬৯ সালে। আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট প্রথমে এটা সমর্থনই করেছিলেন। কিন্তু পরে তার মনোভাবে পরিবর্তন এসেছিল।
আলবার্ট পিয়েরপয়েন্ট মারা যান ১৯৯২ সালে।