মিয়ানমারের শতাধিক ভান্তে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে
সবুজে ঘেরা পার্বত্য এলাকায় নতুন দাবানলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এখানে মিয়ানমারের উগ্রপন্থী একটি গ্রুপ তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সরকারের খাস জমি দখল করে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তুলছে ‘ভাবনা কেন্দ্র’ বা কিয়াং। ভাবনা কেন্দ্রে বসেই মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ৯৬৯ উপজাতিদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
৩৫ জনের বেশি মিয়ানমারের নাগরিক এ কাজে জড়িত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে। তারা ধর্ম যাজক বা ভান্তে সেজে পাহাড়ীদের মধ্যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে। গত কয়েক মাসে তারা পার্বত্য এলাকায় ২৫ হাজারের বেশি অনুসারী তৈরি করেছে।
মিয়ানমারের এই ভান্তেরা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির ও রাঙ্গামাটির বনবিহারে ও রাজবন বিহারে কাউকে ঢুকতে না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের পরামর্শে এই তিনটি প্যাগোডা এখন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিহারগুলোতে গত কয়েক মাস ধরে সর্বসাধরণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে এখন জুডো ক্যারাতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা বনে ঢুকে পড়ছে। বনে গিয়ে আবার তারা উচ্চতর প্রশিক্ষণও নিচ্ছে। পরে তারা জম্ম ল্যান্ড গড়ার আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে যাচ্ছে।
সরেজমিনে পার্বত্য এলাকার রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মিয়ানমারের এক নাগরিক ভান্তে সেজে এমন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিল। যৌথবাহিনী গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে মিয়ানমারের মুদ্রাসহ (এক লাখ ৫৫ হাজার কিয়াত) গ্রেফতার করে। মিয়ানমারের মুদ্রার নাম ‘কিয়াত’। গ্রেফতারের পর যৌথবাহিনী তার কাছ থেকে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। সে বলেছে, পাহাড়ে তার মতো প্রায় শতাধিক ভান্তে রয়েছে। তার তথ্যে বলা হয় পাহাড়ের উপজাতিরা যাতে বাঙালীদের ওপর বিষিয়ে উঠে সে জন্য তারা কাজ করছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, এ রকম কয়েক শ’ ভান্তে পার্বত্য এলাকায় কাজ করে যাচ্ছে। যাদের চেনার কোন উপায় নেই। কারণ পার্বত্য এলাকার উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষের মতোই তাদের চেহারা বা রেস। মিয়ানমারের ভান্তেদের বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় আগে জাতি সত্তা নিয়ে লড়াই সংগ্রাম চলেছে। এই সংগ্রামে পাহাড়ীদের খুব একটা লাভ হয়নি। তাই বাংলাদেশের সমতলে যেমন ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী রয়েছে তাদের মতো পাহাড়ের একটি ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাহাড়ীরা লাভবান হবে।
পুরুষ ভান্তেদের মতো মিয়ানমার থেকে আসা বেশ কয়েকজন নারী সদস্যরাও এখানে কাজ করে যাচ্ছে। সমতলে জামায়াতের মহিলা কর্মীরা যেভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের তালিম দেয়, ঠিক একই রকমভাবে তারাও পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে গিয়ে উগ্র মতবাদ প্রচার করছে। গোয়েন্দারা এমন ২৫ জন নারীর সন্ধান পেয়েছে। যারা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে কাজ করছে। তাদের আটকের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ৯৬৯ রোহিঙ্গা ও রাখাইন প্রদেশেও একই রকমভাবে কাজ করছে। মিয়ানমারের উগ্রপন্থী আরও কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ‘আরাকান আর্মী (এ এ)’, ‘আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি)’, ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরওএস),’ আল ইয়াকিন’সহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ পাহাড়ে সক্রিয়। তারা নানাভাবে পাহাড়ী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। অস্ত্র অর্থেও যোগনদাতারা পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘটি গেড়ে বসেছে।
ইউপিডিএফ, জেএসএস ও জেএসএস সংস্কারপন্থী অস্ত্রধারীদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে তারা। তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখানো জম্মু ল্যান্ড গঠনের। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জম্মু ল্যান্ড গঠন করার জন্য বিভিন্ন রূপরেখাও তৈরি করা হয়েছে। কি ধরনের সরকার হবে পাহাড়ে তারও একটি ছক সাজানো হয়েছে।
পাহাড়কে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে যে, বাংলাদেশ সরকার থেকে পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করে নিজেরাই সরকার গঠন করে স্বাধীন জম্মু ল্যান্ড গঠন করবে। এ ধরনের কর্মকা- সরকার প্রশ্রয় না দেয়ায় পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো কোন না কোন কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে।
সরকারী বেসরকারী চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে। পরিবহন থেকে প্রতিদিন তাদের হাজার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। এ সবের কারণে পার্বত্য এলাকার মানুষ এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মানুষজনের স্বাভাবিক কাজকর্ম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি চায়।
গত দু’দিনে রাঙ্গামাটিতে ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ী উগ্রপন্থীদের উৎপাত না থাকলে এই এলাকার মানুষ শান্তিতেই বসবাস করতে পারত। সাধারণ উপজাতিরা বাঙালীদের সঙ্গে মিলে মিশেই চলতে চায়। কিন্তু ইউপিডিএফ, জেএসএস ও জেএসএস সংস্কারপন্থী গ্রুপের কারণে তারা ভাই বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে হিমশিম খাচ্ছে।
পাহাড়ে শান্তির জন্য শান্তিচুক্তি হয় ১৯৯৭ সালে হয়েছে। চুক্তির পর গত ২০ বছরেও এখানে শান্তির বাতাস বইছে না। দিন যত যাচ্ছে অশান্তির আগুন ততই বাড়ছে। সবুজে ঘেরা পাহাড়ে বইছে সেই আগুনের লু হাওয়া। সম্প্রতি যৌথবাহিনী ইউপিডিএফ’র একজন সশস্ত্র সদস্যকে ভারি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদসহ আটক করেছে। এই সদস্য মিজুরাম সীমান্ত এলাকার কমান্ডার রিভেল চাকমা গ্রুপের সদস্য। মিজুরামে ‘চাকমা অটোনোমাস ডিস্ট্রিক কাউন্সিল (সিএডিসি)’ নামের একটি উগ্র গোষ্ঠী তাদের সহযোগিতা করে আসছে।
গভীর অরণ্য পার হয়ে পাহাড়ের উগ্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ওই সংগঠনের কাছে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়। দেশের ভেতরে আর একটি দেশ গঠনের জন্য পাহাড়ী উগ্র গোষ্ঠীগুলোর এমন তৎপরতা ঠেকাতে যৌথবাহিনী পাহাড়ে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে।
যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারের ৯৬৯ নামের গ্রুপটি নতুন একটি আলামত। আগে এই গ্রুপের কোন কর্মকাণ্ড পাহাড়ে ছিল না। সম্প্রতি এই গ্রুপটি পাহাড়ের সর্বত্র কাজ করে যাচ্ছে। ধর্ম প্রচারের নামে এমন কর্মকাণ্ড করবে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনও কল্পনা করেনি। একজন উগ্রবাদী ভান্তেকে আটকের পর বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে।
এ ধরনের আলামত একেবারেই নতুন। তাই এদের নিয়ে কাজ করাও বেশ কঠিন। কে আসল ভান্তে আর কে নকল ভান্তে এটা চিহিৃত করতে সময় লেগে যাচ্ছে। তবে গ্রেফতারকৃত ভান্তের দেয়া তথ্যমতে, বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
উইকিপিডিয়ায় ৯৬৯ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই সংগঠনটি মুসলিম বিদ্বেষী সংগঠন যা বৌদ্ধ সন্নাসীরা গঠন করেছে। যা দ্বারা গৌতম বুদ্ধ এর গুণ, বৌদ্ধদের কর্ম ও বুদ্ধদের সমাজকে বুঝিয়েছে। ৯ দ্বারা তাদের দেবতা সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধের গুণ, ৬ দ্বারা সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা, ৯ দ্বারা বুদ্ধিষ্ট সংঘ এর গুণ বুঝিয়েছে । ইহা নাকি বুদ্ধের ত্রিরত্ন। ইহা বুদ্ধ ধর্মের চাকার থিম ও বটে। মূলত এই ৯৬৯ উগ্র মুসলিম বিদ্বেষী সংগঠন যা মুসলিম ভীতি ছড়াতে কাজ করে। সন্ত্রাসী সন্ন্যাসী আসিন উইরাথু এই সংগঠন বর্তমানে পরিচালিত করে।
২০১২ সালের দাংগাসহ সকল দাংগায় সে মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছে সঙ্গে পুলিশকে বাধা দিয়েছে প্রতিরোধ করার জন্য। টাইম ম্যাগাজিনের শিরোনাম ‘বৌদ্ধ সন্ত্রাস মুখে’ আসিন উইরাথু ওপর একটি গল্প স্থাপিত হয়, তার ছবি ম্যাগাজিনের জুন ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
সে তখন বলেছিল, আপনি দয়াবান হতে পারেন, অন্তরে প্রেম থাকতে পারে কিন্তু আপনি পাগলা কুকুরের সঙ্গে ঘুমাতে পারেন না। পাগলা কুকুর বলতে সে মুসলমানদের বুঝিয়েছে। আমরা যদি দুর্বল হই, মুসলমান আমাদের ভূমি নিয়ে নেবে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় সরকার সন্ত্রাসী উইরাথুকে সার্বিক সহযোগিতা করে।
উইরাথুর এই বক্তব্যের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ভান্তেরাও ৯৬৯ গঠন করেছে। ২০১৪ সালের ২৪ জুন লিখিত এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে যে এই সংগঠনের সঙ্গে মিল রেখে পার্বত্য চটগ্রামসহ বাংলাদেশের বসবাসরত বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা মিয়ানমারের চরমপন্থী বৌদ্ধ সংগঠন, ৯৬৯ অনুরূপ চরমপন্থী বৌদ্ধ দল গঠন করেছে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমারের ৯৬৯ এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছে তারা। ৯৬৯ এর সদস্যরা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামেও এসেছিল। গত কয়েক বছরে, ৯৬৯ ব্যাপকভাবে মিয়ানমারের সন্ন্যাসীদের দ্বারা সংগঠিত একটি চরমপন্থী আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হয়েছে। ৯৬৯ সংগঠনকে মিয়ানমার সরকার পৃষ্ঠপোষোকতা দেয়।
৯৬৯ এর সদস্যরা শুধু মিয়ানমার নয়, বাংলাদেশসহ সকল বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে যার মূল টার্গেট হলো মুসলমান। প্রতি মাসে থানচি ও মিজোরামের অরক্ষিত বর্ডার দিয়ে ১৫-২০ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মিয়ানমারে প্রশিক্ষণ নিতে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বৌদ্ধ সন্ত্রাসী যুবকরা বর্ডার ক্রস করে মিয়ানমারে যায় এবং ৯৬৯ এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভান্তেরা উগ্র সন্ত্রাসী আসিন ওয়ারাথু এর সঙ্গে সাক্ষাত করেছে। চরমপন্থী বাংলাদেশী সন্ন্যাসী প্রায় এক বছর আগে মিয়ানমারে আশ্রয় নেন এবং ৯৬৯ সদস্যদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা প্রশিক্ষণ নেয়।
ভয়াবহ বিষয় হলো তাদের প্রশিক্ষণের মূল টার্গেট মুসলমানরা। মিয়ানমারের মুসলমানদের হামলায় এসকল ভান্তে উস্কে দেয় এবং অংশগ্রহণও করে। এ সকল ভান্তের হাত রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত। মিয়ানমারে আশ্রয় নেয়া উপজাতীয় যুবকরা মিয়ানমারে ৯৬৯ এর ব্যানারে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে স্থানীয় রোহিঙ্গা স্থাপনা ও পাড়া গ্রামে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।