ইংরেজ ও তার এদেশীয় দালাল কতৃক মুসলমানদের সম্পদ লুণ্ঠনের ইতিহাস

ইংরেজ ও তার এদেশীয় দালাল কতৃক মুসলমানদের সম্পদ লুণ্ঠনের ইতিহাস

ইংরেজরা দিল্লীর সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্ব আদায়ের আনুষ্ঠানিক ফরমান আদায় করে ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট তারিখে। কিন্তু ১৭৫৭ সাল থেকেই তারা শাসন কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করেছিল। মীর জাফরকে ‘পুতুল নবাব’ সাজিয়ে লর্ড ক্লাইভ শুরু থেকেই প্রকৃত নবাব’ সেজে বসেছিল। আর এই পুতুল নবাবীর সূচনাকাল থেকেই ইংরেজরা এদেশে ইতিহাসের নজীরবিহীন শোষন ও লুণ্ঠনে লিপ্ত হয়েছিল। খোদ লর্ড ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধ জয়ের বখশিশ হিসেবে মীর জাফরের কাছ থেকে ২ লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে রাতারাতি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হয়।

মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছয়জন কর্মচারীকে ১,৫০,০০০ পাউন্ড উৎকোচ প্রদান করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের সদস্যরা প্রত্যেকে ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ পাউন্ড ঘুষ আদায় করে। (পি, রবার্টস : হিস্টরী অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৩৮; ড. এম এ রহীম : বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৯)


কোম্পানির ও কলকাতার অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এবং সৈন্য ও নৌবহরের ব্যয় বাবদ কোম্পানি আদায় করে মোট ২৫,৩১,০০০ পাউন্ড। তাছাড়া মীর জাফর ইংরেজ কর্মকর্তাদের খুশি করতে ৬,৬০,৩৭৫ পাউন্ড উপঢৌকন দেয়। বিভিন্ন ইংরেজ কর্মচারী মীর জাফরের কাছ থেকে চব্বিশ পরগণা জেলার জমি ছাড়াও ৩০ লাখ পাউন্ড ‘ইনাম' গ্রহণ করেছিল। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভকে ৩৪,৫৬৭ পাউন্ড বার্ষিক আয়ের দক্ষিণ কলকাতার জায়গীর প্রদান করা হয় । (ব্রিজেন কে গুপ্ত : সিরাজউদ্দৌলা এন্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পৃষ্ঠা ৪১)।

ইংরেজদের বিভিন্ন রূপ টাকার দাবি মেটাতে মীর জাফর রাজকোষ শূন্য করে ফেলেছিল। মীর কাসিম এই ঋণ পরিশোধ এবং মসনদের বিনিময়ে কোম্পানির কর্মচারীদেরকে ২০০,০০০ পাউন্ড দিয়েছিল। (ড. এম এ রহীম : পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৬)

মীর জাফরের পুত্র নাজমুদ্দৌলা ১৭৬৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর মসনদ লাভের জন্য কোম্পানির কর্মচারীদেরকে যে ঘুষ দেয় তার পরিমাণ ছিল ৮,৭৫,০০০ টাকা। রেজা খান ২,৭৫,০০০ টাকার উৎকোচের বিনিময়ে এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক নবাবের নবাব-নাযিম নিযুক্ত হয়েছিল। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০)
উৎকোচ নামক দুর্নীতি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানী করে ইষ্ট| ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে ষাট লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল। এ কথা ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। (Fourth Parliamentry Report 1773, P-535; সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ৯)

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ বিলাতে নিয়ে যায় । ক্লাইভের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে সে নিজ আচরণ সমর্থন করে বলে :
“পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর আমার যে অবস্থা হয়েছিল, তা ভেবে দেখ। একজন বড় রাজার ভাগ্য আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। একটি সমৃদ্ধ নগর আমার দয়ার প্রতীক্ষায় আছে। আমার মুখের সামান্য হাসিতে কৃতার্থ হওয়ার জন্য ধনী মহাজনরা একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। আমার দুই পাশে স্বর্ণ মণিমুক্তায় পূর্ণ সিন্দুকের সারি এবং এগুলি কেবল আমারই জন্য খোলা হয়েছে। (পার্লামেন্ট কমিটির সভাপতি মহোদয়, এ মুহূর্তে আমি নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যাই যে, তখন আমি কিভাবে নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিলাম।" (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৬-১২৭)।

বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে ইংরেজরা একা ছিল না। তাদের পাশে ছিল তাদের দীর্ঘ দিনের সহচর এদেশী দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়াগোষ্ঠী। তাদের শোষন, লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে কট্টর সাম্রাজ্যবাণী লর্ড ব্যারিংটন মেকলে স্বয়ং মন্তব্য করেছে :
“কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের প্রভু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, নিজেদের জন্য, প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

বাংলা ও বিহারের রাজস্ব কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ১৭৭২ সালের ৩ নভেম্বর ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরসকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে :
“নাযিমরা জমিদার ও কৃষকদের কাছ থেকে যত বেশি পারে কর আদায় করে নিচ্ছে। জমিদাররাও নাযিমদের কাছ থেকে চাষীদের লুণ্ঠন করার অবাধ অধিকার লাভ করেছে। নাযিমরা আবার তাদের সকলের (জমিদার ও কৃষকদের) সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার রাজকীয় বিশেষ অধিকারের বলে দেশের ধন-সম্পদ লুট করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছে।” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২)।

১৭৬৫-৬৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর সে বছরই তারা প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সে আদায়ের পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।


সুত্রঃ মুহম্মদ আবদুল মান্নান রচিত, আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা , পৃ ৪৪-৪৭