সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি পালন করছে, উপজাতি সন্ত্রাসীরা করছে কি ?

Related imageসরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি পালন করছে, উপজাতি সন্ত্রাসীরা করছে কি ?
চুক্তির অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্যে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক এড়ানোর অভিপ্রায়ে, চুক্তির দুই দশক পূর্তি উপলক্ষ্যে উভয় পক্ষের প্রকাশিত বুকলেটকে তথ্যের মূল উৎস হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে, যথাঃ
১। পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় আইসিএলডিএস কর্তৃক প্রকাশিত
‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতিঃ শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের দুই দশক’।
২। পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে ২০১৭’।

জেএসএস এবং সরকারের পূর্বোক্ত দুটি প্রকাশনের আলোকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রসঙ্গে উভয় পক্ষের মতভিন্নতা নিচের টেবিলে দেখানো হলোঃ


পরিসরের স্বল্পতা বিবেচনায় সঙ্গত কারণেই প্রতিটি ধারার ব্যাপারে উভয় পক্ষের বক্তব্যের বিস্তারিত আলোচনা পরিহার করা হচ্ছে। তবে, উভয় পক্ষের দাবীর মতভিন্নতার উপর আলোকপাত না করলে, দাবীর যথার্থতা নির্ণয় করা নিতান্তই দুরুহ বিধায় শুধুমাত্র প্রথম খণ্ডের ৪টি ধারা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার প্রয়াস নেয়া হলো।

চুক্তির প্রথম খণ্ডে উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন, চুক্তি বাস্তবায়নে পরিবীক্ষণ কমিটি গঠন এবং চুক্তির মেয়াদ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়নের অগ্রগতির একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নরূপঃ
১ম (ক.১) ধারাঃ “উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছে।”
বাস্তবায়নের অগ্রগতিঃ
সরকারী দাবী মোতাবেক – বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যথাঃ ২০১১ সালে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতিসত্বাসমুহের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও সংরক্ষণের বিষয়াদি নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়াও পার্বত্যাঞ্চলের বৈশিস্ট্য সংরক্ষণ এবং সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনার রূপরেখা বর্তমান সরকারের রূপকল্প ভিশন ২০২১ এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তবে, জেএসএস এর দাবী মতে, এই ধারাটি এখনো অবাস্তবায়িত রয়েছে।

২য় (ক.২) ধারাঃ
“উভয় পক্ষ এই চুক্তির আওতায় যথাশীঘ্র ইহার বিভিন্ন ধারায় বিবৃত ঐক্যমত্য ও পালনীয় দায়িত্ব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলী, রীতিসমুহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন আইন মোতাবেক করা হইবে বলিয়া স্থিরিকৃত করিয়াছেন।”
বাস্তবায়নের অগ্রগতিঃ
সরকারী দাবী মোতাবেক– বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যথাঃ
পার্বত্য চুক্তির ধারা অনুযায়ী ১৯৮৯ সালের তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনকে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ১৯৯৮ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
এছাড়াও উপজাতিদের দাবী মেনে নিয়ে পার্বত্য চট্রগ্রাম ভুমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করে পার্বত্য চট্রগ্রাম ভুমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন, ২০১৬ সংসদে অনুমোদনের পরে ১৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে বাংলাদেশ গেজেট আকারে জারী করা হয়েছে।
তবে, জেএসএস এর দাবী মতে, এই ধারাটি এখনো অবাস্তবায়িত রয়েছে। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যে, আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করা হলেও “পার্বত্য চুক্তির সাথে সংগতি বিধানকল্পে পুলিশ এক্ট, বাংলাদেশ পুলিশ রেগুলেশন ও পার্বত্য চট্রগ্রাম রেগুলেশন ইত্যাদিসহ পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রযোজ্য অর্ধ-শতাধিক আইন, প্রবিধান বা বিধিমালা সংশোধন করা হয়নি।“

৩য় (ক.৩) ধারাঃ “এই চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ করিবার লক্ষ্যে নিম্নে বর্ণিত সদস্য সমন্বয়ে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হইবেঃ
(ক) আহবায়কঃ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত একজন সদস্য।
(খ) সদস্যঃ এই চুক্তির আওতায় গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান।
(গ) সদস্যঃ পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি।
বাস্তবায়নের অগ্রগতিঃ
সরকারী দাবী মোতাবেক – বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের মাননীয় উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে আহবায়ক করে ২৫ মে ২০০৯ তারিখে তিন সদস্য বিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এই কমিটির সভাপতি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। মন্ত্রীর পদমর্যাদায় গত ৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে নিযুক্ত করা হয়েছে।
তবে, জেএসএস এর দাবী মতে, এই ধারাটি আংশিক বাস্তবায়িত রয়েছে।

৪র্থ (ক.৪) ধারাঃ “এই চুক্তি উভয়পক্ষ কর্তৃক সম্পাদিত ও সহি করিবার তারিখ হইতে বলবৎ হইবে। বলবৎ হইবার তারিখ হইতে এই চুক্তি অনুযায়ী উভয় পক্ষ হইতে সম্পাদনীয় সকল পদক্ষেপ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তি বলবৎ থাকিবে।“
বাস্তবায়নের অগ্রগতিঃ
সরকারী দাবী মোতাবেক – বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চুক্তির কার্যকারিতার মেয়াদ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বাক্ষরের তারিখ হতেই এটি কার্যকর হবে। তবে ২০০০ এবং ২০০৭ সালে পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তি, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এবং আঞ্চলিক পরিষদ আইনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়েরের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১৩ এপ্রিল তারিখে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের কতিপয় ধারা সংবিধান বিরোধী মর্মে ঘোষিত রায়ের প্রেক্ষিতে সরকার মামলা দু’টি নিস্পত্তির লক্ষ্যে সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে, এই ধারার বাস্তবায়নের ব্যাপারে জেএসএস এর পক্ষ হতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে উভয় পক্ষের দাবীর মধ্যে মতভিন্নতা লক্ষ্যণীয়, যেখানে নিজেদের দাবীর সপক্ষে ধারা এবং বিষয়ের আলোকে বাস্তবায়নের অগ্রগতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে শুধুমাত্র চুক্তির প্রথম খণ্ড যেখানে ৪টি ধারা রয়েছে, তার অগ্রগতির মতভিন্নতার দাবীসমূহের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। অবশিস্ট তিন খণ্ডে আরো ৬৮টি ধারার বাস্তবায়নের অগ্রগতির ব্যাপারেও যথারীতি মতভিন্নতা রয়েছে।

সরকারী দাবী অনুযায়ী চুক্তির ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ ও ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে,অবশিস্ট ৯টি ধারা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

অপরপক্ষে পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তির ২১তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি গত ২৯ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে ঢাকায় হোটেল সুন্দরবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। উক্ত সম্মেলনে বিতরণকৃত প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “৭২ টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং মৌলিক বিষয় সমুহসহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।”
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জেএসএস মোট ৩৮ টি ধারার বাস্তবায়নের ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করলেও অবশিষ্ট ৩৪টি ধারার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোন মতামত প্রকাশ করেনি।

এমতাবস্থায়, উভয় পক্ষের দাবীর যথার্থতা নির্ণয়ের দায়িত্ব সচেতন পাঠককুলের হাতেই ন্যস্ত করা শ্রেয়। পাঠককুলের সুবিধার্থে, পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের কয়েকটি বিশেষ দিক নিচের তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ
১। ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে।
২। ১৯৯৯ সালের ৭ মে পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে।
৩। পার্বত্য চট্রগ্রামের তিনটি জেলাতেই ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ গঠন করা হয়েছে এবং জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ২৮ – ৩০টি বিষয় হস্তান্তর করা হয়েছে।
৪। ১৯৯৯ সালে ভুমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। পাহাড়িদের দাবীর প্রেক্ষিতে ভুমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এ সংশোধনী এনে ভুমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন ২০১৬ প্রণয়ন করা হয়েছে।
৫। ভারত হতে প্রত্যাগত ১২,২২৩ টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
৬। শান্তি বাহিনীর সদস্যদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।
৭। ৭১৫ জন শান্তি বাহিনী সদস্যকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
৮। ২৫২৪ জনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ৯৯৯টি মামলার তালিকার মধ্যে ৮৮৪টি মামলা যাচাই-বাছাই এবং তন্মধ্যে ৭২০টি মামলা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চলমান।
৯। একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ ২৪০টি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে।
১০। ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। যার দায়িত্বে রয়েছেন চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী স্বয়ং।
১১। পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
১২। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে সরকার উপজাতিদের নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ‘সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা সংরক্ষণের অভিপ্রায়ে মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিনামুল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।
১৩। সরকারী চাকুরিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নির্ধারিত কোটা/অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে।
১৪। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্যে কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
১৫। পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় পদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্য হতে প্রতিনিধি নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।
১৬। পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ‘সম্প্রদায়ের একজন সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
১৭। ১৯৯৮ সালের পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।
১৮। ১৯৭৬ সালে জারীকৃত ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ অধ্যাদেশ বাতিল করে ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪ ‘ জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়েছে।
১৯। ২০১৮ সালে ঢাকার বেইলী রোডে ১.৯৪ একর জমিতে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতিদের জন্যে ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্রগ্রামের ১৬ লাখ অধিবাসীর প্রায় অর্ধেক বাঙালি হলেও উপরোল্লিখিত তালিকার সুবিধাভোগী প্রায় শতভাগই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অন্তর্গত।

এছাড়াও পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর হতে বিগত ২১ বছরে পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে যে সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে – তার সুফল কারা ভোগ করছে সেটা বলাই বাহুল্য। পার্বত্য চট্রগ্রামের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের একটা খণ্ড চিত্র নিচে তুলে ধরা হলোঃ
১। পার্বত্য চুক্তির পূর্বে ১৯৯৭-৯৮ অর্থ বছরে উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৫০.৫৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে ৯১৫.৮৩ কোটি টাকা।
২। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে পার্বত্য চট্রগ্রামে ১৭৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ কোটার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্রতি বছর ৩২৫ জন উপজাতি ছাত্রছাত্রী বিশেষ কোটা সুবিধা ভোগ করছে।
৩। সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রেও উপজাতিদের জন্যে বিশেষ কোটা সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং মন্ত্রনালয়ে কর্মকর্তা – কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় চার শত উপজাতি চাকুরীতে নিয়োজিত রয়েছে।
৪। পার্বত্য চট্রগ্রামের জনসংখ্যার ৫১% উপজাতি আর ৪৯% বাঙালি। এতদসত্তেও, শিক্ষা বৃত্তির ৭৭% বরাদ্দ করা হয়েছে উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্যে। অথচ, বাঙালীদের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৩% শিক্ষা বৃত্তি।
৫। পার্বত্য চুক্তির পূর্বে পার্বত্য চট্রগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যাপ্ত ছিল না। চুক্তির পরে ইতোমধ্যেই তিন জেলায় ৫০৭ কিমি (৩৩কেভি), ৯৮৩ কিমি (১১কেভি) এবং ১,৩৫৫ কিমি (৪কেভি) বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। উপরোন্ত, তিন পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ উন্নয়নের জন্যে ৮৭৯.৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
৬। জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়, এমন প্রত্যন্ত এলাকায় ৫০৫০টি পরিবারকে সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহের এক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অথচ, পার্বত্য চুক্তির পূর্বে পার্বত্য চট্রগ্রামের কোথাও সৌর বিদ্যুৎ সুবিধাদি ছিল না।
৭। মাত্র ২০০ কিমি পাকা রাস্তা ছিল সমগ্র পার্বত্য চট্রগ্রামে, শান্তি চুক্তির পূর্বে। চুক্তির পরে ইতোমধ্যেই প্রচুর ব্রিজ, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ করা ছাড়াও ১৫৩২কিমি পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও ১০৫কিমি পাকা রাস্তা নির্মাণাধীন রয়েছে এবং ৮৬০কিমি রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ব্রিজের মধ্যে নির্মিত থানচি ব্রিজ এবং নির্মাণাধীন নানিয়ারচর ব্রিজ অন্যতম।
৮। শান্তি চুক্তির পরে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সুবিধাদির আওতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
৯। তিন পার্বত্য জেলায় কৃষি ও কৃষি অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে বিভিন্ন স্কিমের আওতায় ২৯৯ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
১০। চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় স্থানীয়দের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে চুক্তি পরবর্তী সময়ে ১৩০টির অধিক দেশি ও বিদেশি এনজিও বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তন্মধ্যে ইউএনডিপি এককভাবে বিগত ১০ বছরে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এছাড়াও ৭ বছর মেয়াদি দুই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
১১। পার্বত্য চট্রগ্রামে উপজাতিরা প্রভূত আর্থিক সুবিধাদি ভোগ করছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তুলনামূলকভাবে অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
যেমনঃ
ক। উপজাতিদের আর্থিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ব্যয় ২ লাখ টাকার মধ্যে হলে ১০০% উপজাতিদের জন্যে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ২ লাখ টাকার বেশী হলে ১০% উপজাতিদের জন্যে সংরক্ষিত আর ৯০% উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়।
খ। উপজাতি জনগোষ্ঠীর আয়কর দিতে হয় না। তাই, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক প্রকল্পে তারা বাঙালীদের তুলনায় কম দর বিড করে কাজ বাগিয়ে নেয়।
গ। পার্বত্য চট্রগ্রামে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে উপজাতিরা ৫% আর বাঙালিরা ১৬% হারে সুদ প্রদান করে।
ঘ। বিশেষ অঞ্চল এবং অনগ্রসর অঞ্চল হিসেবে যেসব সুযোগ সুবিধা স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে, তার পুরোটাই উপজাতিরা ভোগ করে।
১২। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় উপজাতিদের বিভিন্ন ধরণের সুবিধাদি নিয়মিতভাবে প্রদান করা হচ্ছে। যেমনঃ
ক। ৪১,৮৪৭ জনকে বয়স্ক ভাতা প্রদান করা হয়েছে।
খ। ২২,৪১০ জনকে বিধবা ভাতা প্রদান করা হয়েছে।
গ। ৭,৩১১ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা এবং ৯৮১ জনকে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।
ঘ। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় ৫২,১৭২ জনের দারিদ্র বিমোচন তথা জীবন মান উন্নয়ন করা হয়েছে।
ঙ। ৬২৩টি পরিবারকের পুনর্বাসনের জন্যে আশ্রয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
১৩। চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্রগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বিগত বছরগুলোতে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটছে। এতে স্থানীয় জনসাধারনের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থিক সক্ষমতা বাড়ছে এবং জীবনমানের দ্রুত সার্বিক উন্নয়ন ঘটছে।

১৯৯৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম প্রসঙ্গ’ বইয়ে সালাম আজাদ এক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, “সম্প্রতি বান্দরবানের এই জনসভায় সন্তু লারমা পাহাড়ি জনগণকে পুনরায় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানিয়ছে।“(আজাদ, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা. ১৯)।

পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের মাত্র দুই বছরের মাথায় চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তৎকালীন সরকারের আন্তরিকতার অভাবের প্রতি ইঙ্গিত করেছিল সন্তু লারমা। অথচ, তখনো চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যেই আন্দোলনের প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিল।

মনীষ দেওয়ান নামে শান্তি বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট অস্ত্রসমর্পণের প্রেক্ষাপটে আজাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে জানিয়েছিল, “চুক্তির সব শর্ত বাস্তবায়নের জন্য কমপক্ষে আট/দশ বছর লাগবে”। (আজাদ, শান্তিবাহিনী ও শান্তিচুক্তি, ২০১৩, পৃ. ১১)। শান্তিবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট যেখানে বুঝতে পারে যে, এই চুক্তি বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন। সেখানে শান্তিবাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা সন্তু লারমা যখন চুক্তি স্বাক্ষরের বছর খানেকের মাথায় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে আহবান জানায়– তখন চুক্তির প্রতি তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক।

এই সন্দেহ দৃঢ়তা পায় যখন দেখা যায় যে, শান্তিবাহিনীর অপেক্ষাকৃত তরুণ ও শিক্ষিত অংশ চুক্তির বিরোধিতা করে অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠানে খোদ খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামেই ব্যানার উচিয়ে ধরে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন এবং পাহাড়ি গণ পরিষদ এর নেতা কর্মীরা যখন প্রকাশ্যে চুক্তির বিরোধিতা করতে শুরু করে। অথচ, এরা কিছুদিন আগেও শান্তিবাহিনীর অন্য সকলের সাথেই একত্রে সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল।

পার্বত্য চট্রগ্রামে সশস্ত্র দলের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড সর্বজনবিদিত। চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা, গুম, ধর্ষণ ইত্যাদি পার্বত্য চট্রগ্রামের নিরীহ জনসাধারনের জীবনে নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই সমস্ত অনাচার, অত্যাচার এবং আইন-শৃংখলা পরিপন্থী কাজের সাথে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই উপজাতিরাই জড়িত। এরাই, যাদের একাংশ প্রকাশ্য চুক্তির বিরোধিতা করছে, শুরু থেকেই। আর, অন্য অংশ প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও শুরু থেকেই আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে আসছে – যে ঘোষণা প্রতি বছর নবায়ন করা হচ্ছে।

সেই সাথে, পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিদের আর্থ-সামাজিক ও জীবন-মান উন্নয়নে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত উপরে বর্ণিত পদক্ষেপসমূহের বিপরীতে পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলসমুহের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিবেচনার আবশ্যকীয়তা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন।

এর বিপরীতে সরকার একতরফাভাবে চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে– যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ঢাকার বুকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম কমপ্লেক্স‘ উদ্বোধন। অথচ অপরপক্ষে অনুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বরং অস্ত্রের ঝনঝনানি ক্রমশ বাড়ছে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর প্রচেষ্টা প্রতিনয়তই চোখে পড়ছে। সরকার যেখানে চেষ্টা করছে সাধারণ উপজাতির ভাগ্যোন্নয়নের, সেখানে আরেক পক্ষ সর্বদাই তাদের দুর্দশা বাড়িয়ে চলছে। এমনকি, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সমুহের সুফল ভোগ করা সত্ত্বেও প্রতি বছরই তোতাপাখির মত বুলি আওড়িয়ে যাচ্ছে যে, চুক্তি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
তথ্যসুত্রঃ
১। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তির ২১তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংবাদ সম্মেলন, ২৯ নভেম্বর ২০১৮, হোটেল সুন্দরবন, ঢাকা।
পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, (২০১৭), পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতিঃ শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের দুই দশক, ঢাকা, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ।
২। পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি, (২০১৭), পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে ২ ডিসেম্বর ২০১৭, রাঙামাটি।
৩। সালাম আজাদ, (১৯৯৯), পার্বত্য চট্রগ্রাম প্রসঙ্গ, ঢাকা, আফসার ব্রাদার্স।
৪। সালাম আজাদ, (২০১৩), শান্তি বাহিনী ও শান্তিচুক্তি, ঢাকা, আফসার ব্রাদার্স।
৫। মোহাম্মদ সা’দাত আলী (সম্পাদনায়), (১৯৯৮), পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তিচুক্তি, ঢাকা, বনলতা প্রকাশনী